বেতন কাঠামো- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে কেন এই অবমূল্যায়ন? by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেতন কমিশনের প্রতিবেদন সচিব
কমিটির পর্যালোচনার স্তর পেরিয়ে মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে মর্মে
সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়। অর্থমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন, আগামী জুলাই থেকে
নতুন বেতন স্কেলের বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে শুরু হবে। কিন্তু মূল প্রতিবেদনের
সুপারিশে, নাকি সচিবদের পর্যালোচনার কারসাজিতে অবিশ্বাস্যভাবে
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতনকে চতুর্থ সর্বোচ্চ গ্রেডে
নির্ধারণ করা হয়েছে। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে সরকার জেনেশুনে
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এহেন অপমানজনক মর্যাদাহানির ব্যবস্থা করেছে। কারণ,
এটা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায় না। সামরিক বাহিনী ও সিভিল
আমলাতন্ত্রের সর্বোচ্চ তিনটি স্কেলকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নাগালের
বাইরে রেখে দিয়ে মন্ত্রিসভা জাতিকে কী সিগন্যাল দিতে চাইছে, বুঝতে পারলাম
না। সামরিক বাহিনীর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং মেজর জেনারেল অথবা
সিভিল আমলাতন্ত্রের মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সংস্থাপনসচিব, সিনিয়র সচিব ও
সচিবেরা কোন যুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের চেয়ে বেশি বেতন
পাবেন, সেটা সরকারকে জাতির কাছে ব্যাখ্যা করতে হবে।
এটা বোঝা কঠিন নয় যে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার যেহেতু জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়নি, তাই সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও পুলিশ-র্যাব-বিডিআরের ব্যবহারের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সে জন্য এসব গোষ্ঠীকে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা সরকারের থাকতেই পারে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আওয়ামী লীগের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু এখন মোটেও প্রয়োজন নেই। যেসব আমলা অতীতে নিজেদের ক্যারিয়ার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা ছেড়ে এলিট আমলাতন্ত্রের (সিএসপি এবং বিসিএস) ক্যাডারের পদকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত এলার্জি কাজ করে থাকে, সেটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে। এবারের এই অবমাননাকর বেতন স্কেল নির্ধারণেও এসব ফ্যাক্টর কাজ করেছে বলে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। এ ধরনের একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতার জোরে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়িত করার এ ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কিন্তু এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অপমান করার খেসারত একদিন তাদের দিতে হতে পারে। অতীতে বিপদের দিনে আওয়ামী লীগ যে বারবার এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বৃহদংশকে পাশে পেয়েছে, সেটা এখন হয়তো তারা ভুলে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে এবং সিভিল আমলাতন্ত্রকে তোয়াজ করার বিশেষ প্রয়োজন সরকার উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু অন্য পেশাজীবীদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদার যে ভারসাম্য বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত, তা তছনছ করার অধিকার তাদের নেই।
এ পর্যায়ে ১৯৮৬ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল থাকার সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা আলাদা বেতন স্কেলের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কারণ, ওই সময়ে সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তিনি আমাদের দাবির সপক্ষে অবস্থান নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, আমাদের দাবিটি তিনি সংসদে উপস্থাপন করবেন। ওই আন্দোলনের সময় আমরা ৪২ দিন শিক্ষক ধর্মঘট চালাই এবং তদানীন্তন এরশাদ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাঁচটি সভায় আলাপ-আলোচনা করি। ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল খোদ রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। এরশাদ নীতিগতভাবে আলাদা বেতন স্কেল দিতে তাঁর আপত্তি নেই বলে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, সিভিল আমলাতন্ত্রের আপত্তি রয়েছে আলাদা স্কেলের ব্যাপারে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়া হলে চাকরির প্রারম্ভিক স্তরে তুলনামূলকভাবে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার অধিকারী সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নাকি নিজেদের বঞ্চিত মনে করবেন।
আমাদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের প্রতিনিধিদলে যে চারজন জাঁদরেল আমলা নেতৃত্ব দিতেন, তাঁরা হলেন তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুজ্জামান, অর্থসচিব সাইদুজ্জামান, স্বরাষ্ট্রসচিব শামসুল হক চিশতি ও শিক্ষাসচিব আজহার আলী। ওই আলোচনায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল থাকার বিষয়টি নজির হিসেবে আমরা নথিপত্রসহ উপস্থাপন করেছিলাম, যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আমাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার ভালো যুক্তি রয়েছে। এই দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে আলাদা বেতন স্কেল রয়েছে, সেগুলোর প্রারম্ভিক স্কেল সিভিল আমলাতন্ত্রের প্রারম্ভিক পদের পর দুটো প্রমোশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তুলনীয়, এবং জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ বেতন সরকারের সচিবদের বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে, শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপ্রাপ্ত। ভারতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরের সর্বোচ্চ বেতন দুই লাখ ভারতীয় রুপিরও বেশি। দেশের সর্বোচ্চ মেধাকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা এবং জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আকর্ষণ করার যুক্তি এসব দেশে স্বীকৃত হলেও আমরা উল্লিখিত ওই চারজন তদানীন্তন প্রবল শক্তিধর উচ্চতম পদাধিকারী আমলাকে আলাদা বেতন স্কেল প্রদানের প্রস্তাবে রাজি করাতে পারিনি। তবে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছরে বৃদ্ধির দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন এবং আরও কয়েকটি নতুন সুযোগ-সুবিধা চালু করতে সম্মত হয়েছিলেন। তাঁরা আরও আশ্বস্ত করেছিলেন যে জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে প্রফেসরদের সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণের বিষয়টি প্রতিবারই অনুসৃত হবে।
এরশাদ সরকার যেহেতু অনির্বাচিত সামরিক সরকার ছিল, তাই সিভিল আমলাতন্ত্রকে খেপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেশি সুবিধা দেওয়ার কোনো তাগিদ এরশাদের না থাকারই কথা! ওই সময় এরশাদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের একটা সরল স্বীকারোক্তি এখনো আমার কানে বাজে। আমরা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে এ ব্যাপারে গেলে কোনো সহায়তা পাব কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘যেতে পারেন, তবে তাঁর চাইতে আমি পাওয়ারফুল। আমার সাথে তিন শব্দের পদবি আছে, কিন্তু ওনার পদবি দুই শব্দের। বরং পারলে আপনারা ডিজিএফআই চিফের কাছে যান। এই চারজন সচিবের সিদ্ধান্ত পাল্টাবার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র তিনি।’
আমরা যা বোঝার বুঝে ফেলেছিলাম, ওখানে আর যাইনি। একটা আংশিক বিজয়/আংশিক পরাজয় নিয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতির বিবেচনায় ৪২ দিনের আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। আলাদা বেতন স্কেলের ন্যায্য দাবিটা ওই সময়ের পরে আর জোরগলায় উচ্চারিত হয়নি, যদিও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন এ সম্পর্কে আশার বাণী উচ্চারিত হয়েছিল সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে। পরে আবারও আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার কারণে সব প্রয়াস ঝিমিয়ে পড়তে দেরি হয়নি। এরপরের সব নতুন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বেতন কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে উচ্চতর বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। আবার, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন স্কেলকেও জাতীয় বেতন স্কেল থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের নামিয়ে দেওয়া হলো চতুর্থ সর্বোচ্চ বেতনের গ্রেডে।
এ পর্যায়ে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। উচ্চতর শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকদের জাতক্রোধ ছিল। কারণ, সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হাইজ্যাক করার পর জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরাই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রতিপক্ষ’ বানানোর অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাকিস্তানের শাসক মহল, সিভিল প্রশাসনের আমলা ও সামরিক অফিসারদের মধ্যে দৃঢ়মূল ছিল বরাবরই। এই অসুস্থ রাজনৈতিক কালচারের কারণেই হয়তো সামরিক জান্তা ও আমলাতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সিএসপি ক্যাডারে এবং সামরিক বাহিনীতে সর্বোচ্চ মেধাকে জড়ো করার ভ্রান্ত নীতি অবলম্বন করা হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলের আইসিএসের আদলে সে জন্য সুপেরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা প্রার্থীদের সিএসপি ক্যাডারের লোভনীয় চাকরিতে আকর্ষণ করা হয়েছে, এবং সামরিক বাহিনীতে ভালো ছাত্রদের আকর্ষণ করার জন্য পরবর্তী সময়ে ক্যাডেট কলেজগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত করে একক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সরকার ওই রিপোর্টের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে বরং আরও নতুন নতুন ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করেছে। পরবর্তী সময়ে এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারের সময় আরও কয়েকটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়েছে এ দেশে। ধনাঢ্য পিতা-মাতার সন্তানদের জন্য ক্যাডেট কলেজ ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজ এবং নিম্নবিত্ত পিতা-মাতার সন্তানদের জন্য মাদ্রাসাশিক্ষাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের এই নীতি যে অনৈতিক ও অসাংবিধানিক, সেটা আমাদের শাসক মহলকে বোঝাতে পারছি না। বরং, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ১৯৯২ সালে এ দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেসক্রিপশন মোতাবেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার হিড়িক শুরু হয়েছে শিক্ষার বাজারীকরণের দর্শন অনুসারীদের অত্যুৎসাহে। ফলে এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে ওই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চতর বেতন-ভাতার কারণে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত নতুন বেতন স্কেলে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরও বেতনবৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার করা হয়, তাহলে বর্তমান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিকল্পিতভাবে মেধাশূন্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক তাঁর প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা দিয়ে মাসের অর্ধেক সময়ও সম্মানজনকভাবে সংসারের খরচ মেটাতে পারছেন না। (তাঁর তো ঘুষ খাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না)। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে কেন এই অবমূল্যায়ন?
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এটা বোঝা কঠিন নয় যে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার যেহেতু জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়নি, তাই সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও পুলিশ-র্যাব-বিডিআরের ব্যবহারের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। সে জন্য এসব গোষ্ঠীকে বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে খুশি রাখার চেষ্টা সরকারের থাকতেই পারে। ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আওয়ামী লীগের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু এখন মোটেও প্রয়োজন নেই। যেসব আমলা অতীতে নিজেদের ক্যারিয়ার হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা ছেড়ে এলিট আমলাতন্ত্রের (সিএসপি এবং বিসিএস) ক্যাডারের পদকে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত এলার্জি কাজ করে থাকে, সেটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে। এবারের এই অবমাননাকর বেতন স্কেল নির্ধারণেও এসব ফ্যাক্টর কাজ করেছে বলে সন্দেহ করার কারণ রয়েছে। এ ধরনের একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতার জোরে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়িত করার এ ধরনের অন্যায় সিদ্ধান্ত নিতেই পারে, কিন্তু এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অপমান করার খেসারত একদিন তাদের দিতে হতে পারে। অতীতে বিপদের দিনে আওয়ামী লীগ যে বারবার এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বৃহদংশকে পাশে পেয়েছে, সেটা এখন হয়তো তারা ভুলে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীকে এবং সিভিল আমলাতন্ত্রকে তোয়াজ করার বিশেষ প্রয়োজন সরকার উপলব্ধি করতে পারে, কিন্তু অন্য পেশাজীবীদের সামাজিক ও পেশাগত মর্যাদার যে ভারসাম্য বহুদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত, তা তছনছ করার অধিকার তাদের নেই।
এ পর্যায়ে ১৯৮৬ সালে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল থাকার সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা আলাদা বেতন স্কেলের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, সে সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কারণ, ওই সময়ে সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে তিনি আমাদের দাবির সপক্ষে অবস্থান নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন, আমাদের দাবিটি তিনি সংসদে উপস্থাপন করবেন। ওই আন্দোলনের সময় আমরা ৪২ দিন শিক্ষক ধর্মঘট চালাই এবং তদানীন্তন এরশাদ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাঁচটি সভায় আলাপ-আলোচনা করি। ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল খোদ রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। এরশাদ নীতিগতভাবে আলাদা বেতন স্কেল দিতে তাঁর আপত্তি নেই বলে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, সিভিল আমলাতন্ত্রের আপত্তি রয়েছে আলাদা স্কেলের ব্যাপারে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়া হলে চাকরির প্রারম্ভিক স্তরে তুলনামূলকভাবে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার অধিকারী সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নাকি নিজেদের বঞ্চিত মনে করবেন।
আমাদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের প্রতিনিধিদলে যে চারজন জাঁদরেল আমলা নেতৃত্ব দিতেন, তাঁরা হলেন তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুজ্জামান, অর্থসচিব সাইদুজ্জামান, স্বরাষ্ট্রসচিব শামসুল হক চিশতি ও শিক্ষাসচিব আজহার আলী। ওই আলোচনায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল থাকার বিষয়টি নজির হিসেবে আমরা নথিপত্রসহ উপস্থাপন করেছিলাম, যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আমাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার ভালো যুক্তি রয়েছে। এই দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যে আলাদা বেতন স্কেল রয়েছে, সেগুলোর প্রারম্ভিক স্কেল সিভিল আমলাতন্ত্রের প্রারম্ভিক পদের পর দুটো প্রমোশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে তুলনীয়, এবং জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ বেতন সরকারের সচিবদের বেতনের প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষ করে, শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা সবচেয়ে বেশি মর্যাদাপ্রাপ্ত। ভারতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরের সর্বোচ্চ বেতন দুই লাখ ভারতীয় রুপিরও বেশি। দেশের সর্বোচ্চ মেধাকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা এবং জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় আকর্ষণ করার যুক্তি এসব দেশে স্বীকৃত হলেও আমরা উল্লিখিত ওই চারজন তদানীন্তন প্রবল শক্তিধর উচ্চতম পদাধিকারী আমলাকে আলাদা বেতন স্কেল প্রদানের প্রস্তাবে রাজি করাতে পারিনি। তবে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছরে বৃদ্ধির দাবিটি মেনে নিয়েছিলেন এবং আরও কয়েকটি নতুন সুযোগ-সুবিধা চালু করতে সম্মত হয়েছিলেন। তাঁরা আরও আশ্বস্ত করেছিলেন যে জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে প্রফেসরদের সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণের বিষয়টি প্রতিবারই অনুসৃত হবে।
এরশাদ সরকার যেহেতু অনির্বাচিত সামরিক সরকার ছিল, তাই সিভিল আমলাতন্ত্রকে খেপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেশি সুবিধা দেওয়ার কোনো তাগিদ এরশাদের না থাকারই কথা! ওই সময় এরশাদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমদের একটা সরল স্বীকারোক্তি এখনো আমার কানে বাজে। আমরা তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে এ ব্যাপারে গেলে কোনো সহায়তা পাব কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘যেতে পারেন, তবে তাঁর চাইতে আমি পাওয়ারফুল। আমার সাথে তিন শব্দের পদবি আছে, কিন্তু ওনার পদবি দুই শব্দের। বরং পারলে আপনারা ডিজিএফআই চিফের কাছে যান। এই চারজন সচিবের সিদ্ধান্ত পাল্টাবার ক্ষমতা রাখেন একমাত্র তিনি।’
আমরা যা বোঝার বুঝে ফেলেছিলাম, ওখানে আর যাইনি। একটা আংশিক বিজয়/আংশিক পরাজয় নিয়ে আমরা ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার ক্ষতির বিবেচনায় ৪২ দিনের আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করে ক্লাসে ফিরে গিয়েছিলাম। আলাদা বেতন স্কেলের ন্যায্য দাবিটা ওই সময়ের পরে আর জোরগলায় উচ্চারিত হয়নি, যদিও ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর কিছুদিন এ সম্পর্কে আশার বাণী উচ্চারিত হয়েছিল সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে। পরে আবারও আমলাতন্ত্রের বিরোধিতার কারণে সব প্রয়াস ঝিমিয়ে পড়তে দেরি হয়নি। এরপরের সব নতুন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ গ্রেডে রাখা হয়েছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বেতন কমিশনের সুপারিশের অপেক্ষা না করেই হঠাৎ সিনিয়র সচিব ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে উচ্চতর বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। আবার, সশস্ত্র বাহিনীর বেতন স্কেলকেও জাতীয় বেতন স্কেল থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের নামিয়ে দেওয়া হলো চতুর্থ সর্বোচ্চ বেতনের গ্রেডে।
এ পর্যায়ে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। উচ্চতর শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ব্যাপারে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকদের জাতক্রোধ ছিল। কারণ, সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট ও সিভিল আমলাতন্ত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা হাইজ্যাক করার পর জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরাই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ‘প্রতিপক্ষ’ বানানোর অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাকিস্তানের শাসক মহল, সিভিল প্রশাসনের আমলা ও সামরিক অফিসারদের মধ্যে দৃঢ়মূল ছিল বরাবরই। এই অসুস্থ রাজনৈতিক কালচারের কারণেই হয়তো সামরিক জান্তা ও আমলাতন্ত্র-নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে সিএসপি ক্যাডারে এবং সামরিক বাহিনীতে সর্বোচ্চ মেধাকে জড়ো করার ভ্রান্ত নীতি অবলম্বন করা হয়েছে ১৯৪৮ সাল থেকে। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলের আইসিএসের আদলে সে জন্য সুপেরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল করা প্রার্থীদের সিএসপি ক্যাডারের লোভনীয় চাকরিতে আকর্ষণ করা হয়েছে, এবং সামরিক বাহিনীতে ভালো ছাত্রদের আকর্ষণ করার জন্য পরবর্তী সময়ে ক্যাডেট কলেজগুলো স্থাপন করা হয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকার কর্তৃক গঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে ক্যাডেট কলেজগুলোকে মূলধারার মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত করে একক ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সরকার ওই রিপোর্টের সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করে বরং আরও নতুন নতুন ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করেছে। পরবর্তী সময়ে এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকারের সময় আরও কয়েকটি ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়েছে এ দেশে। ধনাঢ্য পিতা-মাতার সন্তানদের জন্য ক্যাডেট কলেজ ও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল-কলেজ এবং নিম্নবিত্ত পিতা-মাতার সন্তানদের জন্য মাদ্রাসাশিক্ষাকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের এই নীতি যে অনৈতিক ও অসাংবিধানিক, সেটা আমাদের শাসক মহলকে বোঝাতে পারছি না। বরং, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে ১৯৯২ সালে এ দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রেসক্রিপশন মোতাবেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার হিড়িক শুরু হয়েছে শিক্ষার বাজারীকরণের দর্শন অনুসারীদের অত্যুৎসাহে। ফলে এখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দিন দিন মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে ওই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চতর বেতন-ভাতার কারণে। এ অবস্থায় প্রস্তাবিত নতুন বেতন স্কেলে যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আরও বেতনবৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার করা হয়, তাহলে বর্তমান সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিকল্পিতভাবে মেধাশূন্য করার অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক তাঁর প্রারম্ভিক বেতন-ভাতা দিয়ে মাসের অর্ধেক সময়ও সম্মানজনকভাবে সংসারের খরচ মেটাতে পারছেন না। (তাঁর তো ঘুষ খাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না)। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতাকে কেন এই অবমূল্যায়ন?
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments