বোঝা গেল বিএনপি ভারতবিরোধী নয়? by আব্দুল কাইয়ুম
রাজনীতির ব্যাকরণ কি বদলাতে শুরু করেছে? |
এটা
বাংলাদেশের জন্য ভালো যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফর তাঁর
নিজের দেশে এবং আমাদের দেশে রাজনৈতিক মেরুকরণে কিছুটা হলেও পরিবর্তনের
সূচনা করল। ধরুন বাংলাদেশে বিএনপির এত দিনের অবস্থানের কথা। তারা
সাধারণভাবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বললেও কার্যত তাদের
ভারতবিরোধী ভাবমূর্তিটিই ছিল প্রধান। কিছু একটা হলেই ‘গেল গেল, সব ভারত
নিয়ে গেল’ ধরনের কথা তাদের নেতাদের মুখে শোনা যেত। কিন্তু এবার মোদির সফরের
কিছুদিন আগে থেকে বিএনপির নেতারা আনুষ্ঠানিকভাবে একটা কথা প্রতিষ্ঠার
চেষ্টা করেছেন যে তাঁরা মোটেও ভারতবিরোধী নন, ভারতের সঙ্গে তাঁরা সব সময়
সম্পর্কের উন্নয়ন চেয়েছেন।
বিএনপি যে সত্যিই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব চায়, সেটা এবার নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে না এলে বোঝাই যেত না। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, কী এমন ঘটে গেল যে বিএনপিকে উঠেপড়ে লাগতে হলো ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রমাণের জন্য? এটাই আসল কথা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যত দিন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, তত দিন বিএনপির ভারতবিদ্বেষ বেশি সোচ্চার ছিল। ইদানীং জামায়াত বিএনপি থেকে একটু দূরে। সেটা যে কারণেই হোক। এর ফলে বিএনপির পক্ষে গতানুগতিক ভারতবিদ্বেষ থেকে কিছুটা সরে আসা সম্ভব হয়েছে।
ভুলে যাওয়া যায় না যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ও ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জন্য নির্ধারিত সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতের সঙ্গে মৈত্রীকে বিএনপির খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। কিন্তু পঁচাত্তর-উত্তর পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বাইরের সব শক্তিকে টেনে আনার প্রক্রিয়ায় জামায়াত-মুসলিম লীগ চক্র সুযোগ পায়। আজ অবধি সেই রাজনৈতিক সমীকরণ ভাঙাচোরা অবস্থায় হলেও চলছে।
এবারই প্রথম দেখা গেল জামায়াতে ইসলামী মোদির সফরে জনগণ হতাশ হয়েছে দাবি করে একটি বিবৃতি দিয়েছে মাত্র, বিক্ষোভ মিছিল করল না বা কিছু করার সুযোগ পেল না। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এটা এক বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন। এবং এই পরিবর্তন এসেছে নরেন্দ্র মোদির সফরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে।
ভারতের চলতি রাজনৈতিক সমীকরণেও কিছু ওলট-পালট দেখা গেছে। আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত এলেনই না। অথচ সবাই ভাবছিলাম তিনি আসবেন, তিস্তা চুক্তি হবে। হয়নি। এবারও হলো না। কিন্তু মোদির সফরের সময় মমতা আলাদাভাবে হলেও এলেন। ঢাকায় তিনি বৈঠক করলেন তাঁদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে। কী বোঝা গেল?
ভারতের লোকসভায় মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, কিন্তু রাজ্যসভায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসের জন্য সেখানে মোদির মিত্র দরকার। আজ মোদির সফরের সময় মমতার বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে তিনি রাজ্যসভায় বিরোধীদলীয় জোটের অন্যান্য দলের চেয়ে একটু তফাতে গেছেন। এতে মোদির লাভ। কিন্তু বাংলাদেশের লাভ আরও বেশি। কারণ, তিস্তা চুক্তির জন্য তাঁর আসার খুব দরকার ছিল। তিনি এসেছেন। হয়তো এ জন্য ভারতে কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল কিছুটা অখুশি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মমতার আসার তাৎপর্য অনেক বেশি।
মোদির বাংলাদেশ সফরের ফলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একধরনের নতুন মাত্রার সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ যোগাযোগ, বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি। এটা ভবিষ্যতে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তার মানে, কানেক্টিভিটির এক নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মোদির এই সফর স্বয়ং মোদিকেও বদলে দিয়েছে। গত বছর তিনি যখন ভারতের লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হন, তখন অনেকে ভেবেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বোধ হয় চুলায় উঠবে। না, তা হলো না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত জনভাষণে তিনি যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই দেশের তরুণ সমাজকে, তা সত্যিই উদ্দীপনামূলক। দুই দিনের সফরে মোদি শুধু দুই দেশের মৈত্রীর বন্ধনে নতুন মাত্রা যোগ করেননি, তিনি নিজ অতীতের ভাবমূর্তিকেও নতুন ছাঁচে গড়েছেন। আজকের মোদি যে গতকালের মোদিকে এত দূরে ফেলে এসেছেন, তা হয়তো বাংলাদেশ এত সহজে বুঝতে পারত না, যদি–না তাঁর বাংলাদেশ সফর এত সুন্দর হতো।
এখন কী? মোদি তো পথ দেখিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের এখন কী করার আছে? ভারত ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে তাঁর দেশে ৫০ হাজার তরুণের নতুন চাকরির সংস্থান করবে। বাংলাদেশ কী করবে? এখনই হিসাব-নিকাশ করে সব ঠিক করা দরকার। যদি রাস্তাঘাট, গ্যাস-বিদ্যুতের সুব্যবস্থা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। চাকরি পাবেন দেশের বেকার তরুণেরা। উন্নয়ন হবে।
এখানে কয়েকটা বড় সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্ন তো রয়েছেই। সবার অংশগ্রহণ কবে হবে, কীভাবে হবে, সেসব অবশ্যই ঠিক করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি ভাবে বিএনপি আসলে আসবে, না হলে নাই, তাহলে বিরাট রাজনৈতিক ভুল করবে। কোনো দেশেই কার্যকর বিরোধী দল ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। কবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে কীভাবে কী হয়েছিল, সেখানে কত বড় ভিশনারি নেতা ছিলেন, সেসব অনুকরণ করে আমাদের দেশে কিছু করতে যাওয়া হবে মারাত্মক ভুল।
বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ ৬০ বছরের একটি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ধারণ করছে। কার্যকর বিরোধী দল ছাড়া দেশ শাসনের কথা তাদের চিন্তায় আনাই ভুল। তা ছাড়া এ রকম এক বিরোধী দলশূন্য পরিস্থিতিতে দেশ শাসনের কোনো অতীত অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। এমনকি পঁচাত্তরের বাকশালের মধ্যেও ছিল ন্যাপ-সিপিবি এবং অন্যান্য দল ও ব্যক্তি। তাই সেটা ছিল ভিন্ন একটি অধ্যায়। তারপরও সেটা যে ভুল ছিল, সে কথা আওয়ামী লীগ নিজেও মূল্যায়ন করেছে।
বর্তমান অবস্থা বাকশাল নয়, বিএনপি যতই বলার চেষ্টা করুক। কিন্তু কার্যকর বিরোধী দল যে নেই এবং এ অবস্থা জোর করে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে আওয়ামী লীগ করছে, তাতে সন্দেহ নেই। এই পথটি আওয়ামী লীগের অপরিচিত। এই অচেনা পথে যাওয়ার আগে আওয়ামী লীগকে দুবার ভাবতে হবে।
তার চেয়ে বরং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন দিয়ে দেশে প্রাণবন্ত সংসদ চালু করার একটি উদ্যোগ এখন জরুরি। বিশেষভাবে মোদির সফরের পর এই এজেন্ডা আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে।
আর তা ছাড়া মোদির সফরের সুফল ধরে রাখতে হলে এখন আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মত ও পথ ভাবতে হবে। অনেক বৈদেশিক বিনিয়োগ আসতে পারে। বিদেশি সহায়তা আসবে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারলে সব পানিতে যাবে। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ৭ শতাংশে এনেছেন। কিন্তু তিনি তো জানেন, শুধু ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এটা অনুমানের বিষয় নয়। গত রোববার ‘২০১৫ মার্কিন বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রতিবেদন’-এর বাংলাদেশ অধ্যায়ে এ কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের প্রত্যয় থাকলেও বাস্তবায়নে অসংগতি রয়েছে বলে সেখানে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে দেড় শ কোটি মার্কিন ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে। এর আগের বছর ছিল ৯৯০ মিলিয়ন ডলার। এ বছর হয়তো আরও বাড়বে। কারণ, ভারত পাশে দাঁড়িয়েছে। চীন তো আছেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদির সাম্প্রতিক সফরকে স্বাগত জানিয়েছে।
এখন সরকারের উচিত দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। তাহলে ৭ কেন, ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়তো অনায়াসে আসবে।
মোদির সফরের পর সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। পালন করতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
বিএনপি যে সত্যিই প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব চায়, সেটা এবার নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে না এলে বোঝাই যেত না। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন, কী এমন ঘটে গেল যে বিএনপিকে উঠেপড়ে লাগতে হলো ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব প্রমাণের জন্য? এটাই আসল কথা। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যত দিন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল, তত দিন বিএনপির ভারতবিদ্বেষ বেশি সোচ্চার ছিল। ইদানীং জামায়াত বিএনপি থেকে একটু দূরে। সেটা যে কারণেই হোক। এর ফলে বিএনপির পক্ষে গতানুগতিক ভারতবিদ্বেষ থেকে কিছুটা সরে আসা সম্ভব হয়েছে।
ভুলে যাওয়া যায় না যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে ও ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর জন্য নির্ধারিত সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারতের সঙ্গে মৈত্রীকে বিএনপির খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। কিন্তু পঁচাত্তর-উত্তর পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বাইরের সব শক্তিকে টেনে আনার প্রক্রিয়ায় জামায়াত-মুসলিম লীগ চক্র সুযোগ পায়। আজ অবধি সেই রাজনৈতিক সমীকরণ ভাঙাচোরা অবস্থায় হলেও চলছে।
এবারই প্রথম দেখা গেল জামায়াতে ইসলামী মোদির সফরে জনগণ হতাশ হয়েছে দাবি করে একটি বিবৃতি দিয়েছে মাত্র, বিক্ষোভ মিছিল করল না বা কিছু করার সুযোগ পেল না। আমাদের দেশের রাজনীতিতে এটা এক বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন। এবং এই পরিবর্তন এসেছে নরেন্দ্র মোদির সফরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে।
ভারতের চলতি রাজনৈতিক সমীকরণেও কিছু ওলট-পালট দেখা গেছে। আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ পর্যন্ত এলেনই না। অথচ সবাই ভাবছিলাম তিনি আসবেন, তিস্তা চুক্তি হবে। হয়নি। এবারও হলো না। কিন্তু মোদির সফরের সময় মমতা আলাদাভাবে হলেও এলেন। ঢাকায় তিনি বৈঠক করলেন তাঁদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে। কী বোঝা গেল?
ভারতের লোকসভায় মোদির সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, কিন্তু রাজ্যসভায় নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিল পাসের জন্য সেখানে মোদির মিত্র দরকার। আজ মোদির সফরের সময় মমতার বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে তিনি রাজ্যসভায় বিরোধীদলীয় জোটের অন্যান্য দলের চেয়ে একটু তফাতে গেছেন। এতে মোদির লাভ। কিন্তু বাংলাদেশের লাভ আরও বেশি। কারণ, তিস্তা চুক্তির জন্য তাঁর আসার খুব দরকার ছিল। তিনি এসেছেন। হয়তো এ জন্য ভারতে কংগ্রেস, সিপিএমসহ অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল কিছুটা অখুশি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে মমতার আসার তাৎপর্য অনেক বেশি।
মোদির বাংলাদেশ সফরের ফলে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় একধরনের নতুন মাত্রার সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ যোগাযোগ, বাণিজ্যের সুযোগ বৃদ্ধি। এটা ভবিষ্যতে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তার মানে, কানেক্টিভিটির এক নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মোদির এই সফর স্বয়ং মোদিকেও বদলে দিয়েছে। গত বছর তিনি যখন ভারতের লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হন, তখন অনেকে ভেবেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বোধ হয় চুলায় উঠবে। না, তা হলো না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত জনভাষণে তিনি যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই দেশের তরুণ সমাজকে, তা সত্যিই উদ্দীপনামূলক। দুই দিনের সফরে মোদি শুধু দুই দেশের মৈত্রীর বন্ধনে নতুন মাত্রা যোগ করেননি, তিনি নিজ অতীতের ভাবমূর্তিকেও নতুন ছাঁচে গড়েছেন। আজকের মোদি যে গতকালের মোদিকে এত দূরে ফেলে এসেছেন, তা হয়তো বাংলাদেশ এত সহজে বুঝতে পারত না, যদি–না তাঁর বাংলাদেশ সফর এত সুন্দর হতো।
এখন কী? মোদি তো পথ দেখিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের এখন কী করার আছে? ভারত ২০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়ে তাঁর দেশে ৫০ হাজার তরুণের নতুন চাকরির সংস্থান করবে। বাংলাদেশ কী করবে? এখনই হিসাব-নিকাশ করে সব ঠিক করা দরকার। যদি রাস্তাঘাট, গ্যাস-বিদ্যুতের সুব্যবস্থা হয়, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। চাকরি পাবেন দেশের বেকার তরুণেরা। উন্নয়ন হবে।
এখানে কয়েকটা বড় সমস্যা রয়েছে। রাজনৈতিক সমঝোতার প্রশ্ন তো রয়েছেই। সবার অংশগ্রহণ কবে হবে, কীভাবে হবে, সেসব অবশ্যই ঠিক করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি ভাবে বিএনপি আসলে আসবে, না হলে নাই, তাহলে বিরাট রাজনৈতিক ভুল করবে। কোনো দেশেই কার্যকর বিরোধী দল ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। কবে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে কীভাবে কী হয়েছিল, সেখানে কত বড় ভিশনারি নেতা ছিলেন, সেসব অনুকরণ করে আমাদের দেশে কিছু করতে যাওয়া হবে মারাত্মক ভুল।
বিশেষভাবে আওয়ামী লীগ ৬০ বছরের একটি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ধারণ করছে। কার্যকর বিরোধী দল ছাড়া দেশ শাসনের কথা তাদের চিন্তায় আনাই ভুল। তা ছাড়া এ রকম এক বিরোধী দলশূন্য পরিস্থিতিতে দেশ শাসনের কোনো অতীত অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। এমনকি পঁচাত্তরের বাকশালের মধ্যেও ছিল ন্যাপ-সিপিবি এবং অন্যান্য দল ও ব্যক্তি। তাই সেটা ছিল ভিন্ন একটি অধ্যায়। তারপরও সেটা যে ভুল ছিল, সে কথা আওয়ামী লীগ নিজেও মূল্যায়ন করেছে।
বর্তমান অবস্থা বাকশাল নয়, বিএনপি যতই বলার চেষ্টা করুক। কিন্তু কার্যকর বিরোধী দল যে নেই এবং এ অবস্থা জোর করে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যে আওয়ামী লীগ করছে, তাতে সন্দেহ নেই। এই পথটি আওয়ামী লীগের অপরিচিত। এই অচেনা পথে যাওয়ার আগে আওয়ামী লীগকে দুবার ভাবতে হবে।
তার চেয়ে বরং সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন দিয়ে দেশে প্রাণবন্ত সংসদ চালু করার একটি উদ্যোগ এখন জরুরি। বিশেষভাবে মোদির সফরের পর এই এজেন্ডা আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে।
আর তা ছাড়া মোদির সফরের সুফল ধরে রাখতে হলে এখন আরেকটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়নের মত ও পথ ভাবতে হবে। অনেক বৈদেশিক বিনিয়োগ আসতে পারে। বিদেশি সহায়তা আসবে। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারলে সব পানিতে যাবে। অর্থমন্ত্রী প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ৭ শতাংশে এনেছেন। কিন্তু তিনি তো জানেন, শুধু ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে। এটা অনুমানের বিষয় নয়। গত রোববার ‘২০১৫ মার্কিন বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রতিবেদন’-এর বাংলাদেশ অধ্যায়ে এ কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের প্রত্যয় থাকলেও বাস্তবায়নে অসংগতি রয়েছে বলে সেখানে দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে দেড় শ কোটি মার্কিন ডলারের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে। এর আগের বছর ছিল ৯৯০ মিলিয়ন ডলার। এ বছর হয়তো আরও বাড়বে। কারণ, ভারত পাশে দাঁড়িয়েছে। চীন তো আছেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোদির সাম্প্রতিক সফরকে স্বাগত জানিয়েছে।
এখন সরকারের উচিত দুর্নীতি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া। তাহলে ৭ কেন, ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়তো অনায়াসে আসবে।
মোদির সফরের পর সরকারের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেল। পালন করতে পারবে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments