সাবধান, হরতাল কিন্তু চলছে! by এ কে এম জাকারিয়া
জনগণ
আর কত ভয় পাবে! ভয়কে ‘জয়’ করার পথ ধরা ছাড়া তো তাদের সামনে আর কোনো পথ
নেই! কিন্তু ভয় দেখিয়ে যে পক্ষ জয় চায় বা যারা জয়কে ধরে রাখতে চায়, তারা কি
চাইবে জনগণ ভয়কে জয় করুক?
পেট্রলবোমার বীভৎসতা ও এর ভয় দিয়ে শুরু হয়েছিল টানা অবরোধ কর্মসূচি। আগুনে পুড়ে মৃত্যু, বার্ন ইউনিটে কাতরানি—এসবের চেয়ে বড় ভয় দেখানো আর কী হতে পারে! সেই অবরোধ এখনো চলছে, মাস দুয়েক হতে যাচ্ছে। সঙ্গে শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল। এ সময় আগুনে পুড়ে মরেছে ৬০ জনেরও বেশি। সরকারকে ভয় দেখাতে গিয়ে জনগণকে শিকারে পরিণত করেছে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট। তবে একই সঙ্গে জনগণকেও ভয় দেখাতে চেয়েছে তারা। উদ্দেশ্য, অবরোধ সফল ও দেশ অচল করে সরকারের পতন ঘটানো। আর এসব দমনে সরকার দিনে দিনে কঠোর হয়েছে। নিয়েছে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এমনকি ‘গণপিটুনির’ পথও। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত এসবে মারা গেছে ৩৬ জনেরও বেশি। সেই একই ভয় দেখানোর কৌশল। ভয় দেখিয়ে আন্দোলন সফল করার যে কৌশল, তার বিপরীতে ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমনের কৌশল খুব কাজে দিচ্ছে কি?
বড় ঘটনা না ঘটলেও দেশজুড়ে বাসে, ট্রাকে বা গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলা বা আগুন দেওয়া কিন্তু থেমে নেই। গত মঙ্গলবার ভোরেও শিবগঞ্জের কানসাটে পেট্রলবোমার আগুনে কাভার্ড ভ্যানের চালক নিহত ও সহকারী আহত হয়েছেন। বুধবার দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২১ জন। যত ভয়ানকই হোক, সব ভয়ই একসময় ভোঁতা হয়ে আসে। বিরোধী দলের লোকজন মনে হয় এখন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ভয় কাটানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। আর সাধারণ মানুষ পেট্রলবোমা, ককটেল বা গাড়িতে আগুন—এসব ভয়কে জয় করার চেষ্টায় হরতাল-অবরোধ মানা বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে, কাজে যাচ্ছে। দোকাপাট খুলছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে, স্কুল-কলেজগুলোতেও নানা কৌশলে ক্লাস, পড়ালেখা, পরীক্ষা—এসব চালানো হচ্ছে।
নিরুপায় জনগণ যখন এসব ‘সাহস’ দেখানো শুরু করেছে, তখনই আবার শুরু হয়েছে ভয় দেখানোর কাজ। অবরোধ-হরতালে ঢাকা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এ ধরনের কোনো কর্মসূচি যে চলছে, সেটা প্রায় টেরই পাওয়া যাচ্ছিল না। গত সোমবার সকালে নিকেতনের সামনে হাতিরঝিলে প্রবেশপথে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন লাগানো এবং বোমা ফাটিয়ে আন্দোলনকারীরা সম্ভবত জনগণকে এই বার্তাই দিতে চাইল; সাবধান, হরতাল কিন্তু চলছে! হামলার ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া এবং তাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান আলী রীয়াজ তাঁর সাম্প্রতিক এক বইয়ে (ভয়ের সংস্কৃতি, বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রথমা প্রকাশন ২০১৪ ) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনীতির সাবেক অধ্যাপক আচিন ভানায়েককে উদ্ধৃত করেছেন। আলী রীয়াজ লিখেছেন, আচিন ভায়ানক মনে করেন, সহিংসতা হলো একটি নাটক। নাটক এই অর্থে যে তা অন্যদের সামনে বা জ্ঞাতসারে ঘটানো হচ্ছে, যাতে এর প্রভাব তাদের ওপর পড়ে। যার ওপর প্রত্যক্ষ সহিংসতা চালানো হলো না, তাকেও জানানো হলো যে তারও এই পরিণতি হতে পারে।
অবরোধ ও হরতালের সমর্থকেরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে সোমবার নিকেতনের সামনে ও এর আগে–পরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে হামলা চালিয়ে নগরবাসীর সামনে সন্ত্রাসের যে ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করল, তার বার্তাটি হচ্ছে, যে কেউই এ ধরনের হামলার শিকার হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সন্ত্রাসের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলে জনগণ আতঙ্কিত না হয়ে যাবে কোথায়! ঘটনার পর ঢাকা শহরের রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা সত্যিই কমে গিয়েছিল। এখন আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এসব হামলা নিয়ে কথা হয়েছে। সরকার যে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তা পরিষ্কার। বিরোধী পক্ষের এই সন্ত্রাস ও ভয় দেখানোর জবাব হয়তো সরকার একইভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার পথই ধরবে।
সোমবার নিকেতনের সামনে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর খবর ফেসবুকে শেয়ার করে এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ‘ঢাকার রাস্তায় যারা প্রাইভেট কার, বাস বের করে, তাদের সঙ্গে পিস্তল রাখার অনুমতি দেওয়া আর কেউ বা কারা গাড়ি ভাঙতে অথবা আগুন দিতে এলে, তাদের গুলি করার অনুমতি দেওয়া হোক। স্ট্যাটাসটা অনেকের কাছে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আগুনে নিজেকে বা নিজের গাড়ি পুড়তে দেখলে সবার এমনটাই মনে হয়।’ বোঝা যায় ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রশ্নও তো খুব স্বাভাবিক যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে তাঁর মতো নাগরিকেরা কী করবেন? তাঁর বা তাঁদের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করবে কে? বারিধারা-বসুন্ধরায় থাকেন এক বন্ধু। গত মঙ্গলবার বিকেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ড্রাইভওয়েতে ককটেল বিস্ফোরণের পর ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এমন কোনো জায়গা কি আছে, যেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করতে পারি?’
ভয় আর আতঙ্ক সবাইকে পেয়ে বসেছে। আলী রীয়াজ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি নির্মীয়মাণ, ইতিমধ্যে নির্মিত ও প্রবলভাবে বিরাজমান, আমরা তাকে বলতে পারি ভয়ের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হলো সন্ত্রাস ও আতঙ্ক। ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যেই এই সংস্কৃতির সূচনা, বিকাশ ও স্থায়িত্ব।’ এটা বলতেই হচ্ছে যে দেশে এখন ‘ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের’ প্রক্রিয়াই চলছে। জনগণের মধ্যে খুব সহজেই ভীতি ও ভীতির বোধ তৈরি করা যাচ্ছে।
আলী রীয়াজ আরও লিখেছেন, আতঙ্ক সৃষ্টি, সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিচালনা বা বল প্রযুক্ত হওয়ার ঘটনা প্রতি ক্ষেত্রেই হতে হবে এমনটি জরুরি নয়। আতঙ্ক, সন্ত্রাস বা বল প্রয়োগ—এর যেকোনো একটি ঘটতে পারে, এই বোধই যথেষ্ট। বারিধারা-বসুন্ধরা এলাকাকে যিনি নিরাপদ এলাকা হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন, সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের পর আতঙ্কিত নাগরিকের মনে তাই প্রশ্ন জাগে, ‘এমন কোনো জায়গা কি আছে, যেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করতে পারি?’ কেউ নিজে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তার মধ্যে ভয়ের বোধটি ঠিকই ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে।
মূলধারার রাজনীতি যখন ভয়ের সংস্কৃতিনির্ভর হয়ে পড়ে, তখন সমাজের সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। অভিজিৎকে যারা বীভৎস কায়দায় খুন করেছে, তাদের কৌশলও সেই ‘ভয়’, সমাজে অভিজিতের মতো আরও যাঁরা আছেন, যাঁরা ভিন্ন চিন্তা করেন, তাঁদের ভয় দেখানো। এর আগে হুমায়ুন আজাদ একই জায়গায় একই কায়দার আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। লেখক-কবিদের অনেকেই বইমেলা থেকে একই পথে বের হয়ে আসেন। তাঁদের অনেকে নিশ্চয়ই নিজেকে অভিজিতের জায়গায় চিন্তা করে শিউরে উঠেছেন। স্বাধীন চিন্তা, মত প্রকাশ বা লেখালেখিতে অনেকেই কি এখন বাড়তি চাপ অনুভব করছেন না? ভয়ের সংস্কৃতি সমাজে এই পরিস্থিতিই তৈরি করে।
কোনো পক্ষের ভয় দেখানোর কৌশল নতুন ভয়, পাল্টা ভয় বা ভয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ভয়ের পুনরুৎপাদন ঘটায়। গাড়ি ভাঙচুর করতে দেখে তাই অনেকের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকারের বিষয়টি মাথায় আসে! অবরোধ-হরতালে পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো বীভৎসতা বা তা দমনের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ কৌশল যখন ভয়ের সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে, আইনের শাসন যখন শিকেয় উঠছে, তখন নাগরিক চিন্তার মধ্যেও তার প্রতিফলন ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক।
ভয়ের সংস্কৃতির বিপদ হচ্ছে এটা কাউকেই জয়ী হতে দেয় না। ভয় ও পাল্টা ভয়ের লড়াইয়ে কোনো পক্ষ হয়তো আপতত বা সাময়িক জয়ের সুখ পেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দুঃস্বপ্নই হয়ে দাঁড়ায়, যা সহজে শেষ হওয়ার নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পাল্টা হিসেবে বুশের ‘ওয়ার অন টেরর’ শুরু করার পর। ২০০৪ সালে এ নিয়ে ফিয়ার: দ্য হিস্ট্রি অব এ পলিটিক্যাল আইডিয়া শিরোনামে একটি বই লিখেছেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক কোরে রবিন। লিখেছেন ‘একদিন ওয়ার অন টেরর শেষ হয়ে যাবে, সব যুদ্ধই শেষ হয়। এবং এটা যখন শেষ হয়ে যাবে, তখনো দেখব যে আমরা সেই ভয়ের মধ্যেই বসবাস করছি, এটা সন্ত্রাস বা র্যাডিকেল ইসলাম নয়, বরং অভ্যন্তরীণ শাসকেরা যে ভয় তৈরি করেছেন, তার মধ্যে।’ আজ ১০ বছর পর কোরে রবিনের এই ভবিষ্যদ্বাণী তো সত্য বলেই মনে হচ্ছে।
ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশে যেভাবে শিকড় গাড়তে শুরু করেছে, তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে খুব সময় লাগবে বলে মনে হয় না। এখন সব ধরনের ভয়কে জয় করার অব্যাহত সাহস দেখানো ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
পেট্রলবোমার বীভৎসতা ও এর ভয় দিয়ে শুরু হয়েছিল টানা অবরোধ কর্মসূচি। আগুনে পুড়ে মৃত্যু, বার্ন ইউনিটে কাতরানি—এসবের চেয়ে বড় ভয় দেখানো আর কী হতে পারে! সেই অবরোধ এখনো চলছে, মাস দুয়েক হতে যাচ্ছে। সঙ্গে শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন হরতাল। এ সময় আগুনে পুড়ে মরেছে ৬০ জনেরও বেশি। সরকারকে ভয় দেখাতে গিয়ে জনগণকে শিকারে পরিণত করেছে বিএনপি ও ২০-দলীয় জোট। তবে একই সঙ্গে জনগণকেও ভয় দেখাতে চেয়েছে তারা। উদ্দেশ্য, অবরোধ সফল ও দেশ অচল করে সরকারের পতন ঘটানো। আর এসব দমনে সরকার দিনে দিনে কঠোর হয়েছে। নিয়েছে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এমনকি ‘গণপিটুনির’ পথও। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত এসবে মারা গেছে ৩৬ জনেরও বেশি। সেই একই ভয় দেখানোর কৌশল। ভয় দেখিয়ে আন্দোলন সফল করার যে কৌশল, তার বিপরীতে ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমনের কৌশল খুব কাজে দিচ্ছে কি?
বড় ঘটনা না ঘটলেও দেশজুড়ে বাসে, ট্রাকে বা গাড়িতে পেট্রলবোমা হামলা বা আগুন দেওয়া কিন্তু থেমে নেই। গত মঙ্গলবার ভোরেও শিবগঞ্জের কানসাটে পেট্রলবোমার আগুনে কাভার্ড ভ্যানের চালক নিহত ও সহকারী আহত হয়েছেন। বুধবার দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়েছেন অন্তত ২১ জন। যত ভয়ানকই হোক, সব ভয়ই একসময় ভোঁতা হয়ে আসে। বিরোধী দলের লোকজন মনে হয় এখন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ভয় কাটানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। আর সাধারণ মানুষ পেট্রলবোমা, ককটেল বা গাড়িতে আগুন—এসব ভয়কে জয় করার চেষ্টায় হরতাল-অবরোধ মানা বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছে, কাজে যাচ্ছে। দোকাপাট খুলছে, ব্যবসা-বাণিজ্য চালাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে, স্কুল-কলেজগুলোতেও নানা কৌশলে ক্লাস, পড়ালেখা, পরীক্ষা—এসব চালানো হচ্ছে।
নিরুপায় জনগণ যখন এসব ‘সাহস’ দেখানো শুরু করেছে, তখনই আবার শুরু হয়েছে ভয় দেখানোর কাজ। অবরোধ-হরতালে ঢাকা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছিল। এ ধরনের কোনো কর্মসূচি যে চলছে, সেটা প্রায় টেরই পাওয়া যাচ্ছিল না। গত সোমবার সকালে নিকেতনের সামনে হাতিরঝিলে প্রবেশপথে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন লাগানো এবং বোমা ফাটিয়ে আন্দোলনকারীরা সম্ভবত জনগণকে এই বার্তাই দিতে চাইল; সাবধান, হরতাল কিন্তু চলছে! হামলার ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো জনগণকে সতর্ক করে দেওয়া এবং তাদের মধ্যে ভয় ছড়িয়ে দেওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান আলী রীয়াজ তাঁর সাম্প্রতিক এক বইয়ে (ভয়ের সংস্কৃতি, বাংলাদেশে আতঙ্ক ও সন্ত্রাসের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রথমা প্রকাশন ২০১৪ ) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিশ্ব রাজনীতির সাবেক অধ্যাপক আচিন ভানায়েককে উদ্ধৃত করেছেন। আলী রীয়াজ লিখেছেন, আচিন ভায়ানক মনে করেন, সহিংসতা হলো একটি নাটক। নাটক এই অর্থে যে তা অন্যদের সামনে বা জ্ঞাতসারে ঘটানো হচ্ছে, যাতে এর প্রভাব তাদের ওপর পড়ে। যার ওপর প্রত্যক্ষ সহিংসতা চালানো হলো না, তাকেও জানানো হলো যে তারও এই পরিণতি হতে পারে।
অবরোধ ও হরতালের সমর্থকেরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে সোমবার নিকেতনের সামনে ও এর আগে–পরে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যানবাহনে হামলা চালিয়ে নগরবাসীর সামনে সন্ত্রাসের যে ‘নাটক’ মঞ্চস্থ করল, তার বার্তাটি হচ্ছে, যে কেউই এ ধরনের হামলার শিকার হতে পারে। এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে সন্ত্রাসের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলে জনগণ আতঙ্কিত না হয়ে যাবে কোথায়! ঘটনার পর ঢাকা শহরের রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা সত্যিই কমে গিয়েছিল। এখন আবার স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে অনির্ধারিত আলোচনায় হঠাৎ বেড়ে যাওয়া এসব হামলা নিয়ে কথা হয়েছে। সরকার যে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে তা পরিষ্কার। বিরোধী পক্ষের এই সন্ত্রাস ও ভয় দেখানোর জবাব হয়তো সরকার একইভাবে ফিরিয়ে দেওয়ার পথই ধরবে।
সোমবার নিকেতনের সামনে গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন লাগানোর খবর ফেসবুকে শেয়ার করে এক বন্ধু স্ট্যাটাস দিয়েছেন। ‘ঢাকার রাস্তায় যারা প্রাইভেট কার, বাস বের করে, তাদের সঙ্গে পিস্তল রাখার অনুমতি দেওয়া আর কেউ বা কারা গাড়ি ভাঙতে অথবা আগুন দিতে এলে, তাদের গুলি করার অনুমতি দেওয়া হোক। স্ট্যাটাসটা অনেকের কাছে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আগুনে নিজেকে বা নিজের গাড়ি পুড়তে দেখলে সবার এমনটাই মনে হয়।’ বোঝা যায় ক্ষুব্ধ হয়েই তিনি এমন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রশ্নও তো খুব স্বাভাবিক যে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়লে তাঁর মতো নাগরিকেরা কী করবেন? তাঁর বা তাঁদের আত্মরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করবে কে? বারিধারা-বসুন্ধরায় থাকেন এক বন্ধু। গত মঙ্গলবার বিকেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ড্রাইভওয়েতে ককটেল বিস্ফোরণের পর ফেসবুকে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘এমন কোনো জায়গা কি আছে, যেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করতে পারি?’
ভয় আর আতঙ্ক সবাইকে পেয়ে বসেছে। আলী রীয়াজ তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে যে সংস্কৃতি নির্মীয়মাণ, ইতিমধ্যে নির্মিত ও প্রবলভাবে বিরাজমান, আমরা তাকে বলতে পারি ভয়ের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির প্রধান উপাদান হলো সন্ত্রাস ও আতঙ্ক। ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের মধ্যেই এই সংস্কৃতির সূচনা, বিকাশ ও স্থায়িত্ব।’ এটা বলতেই হচ্ছে যে দেশে এখন ‘ভীতি উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনের’ প্রক্রিয়াই চলছে। জনগণের মধ্যে খুব সহজেই ভীতি ও ভীতির বোধ তৈরি করা যাচ্ছে।
আলী রীয়াজ আরও লিখেছেন, আতঙ্ক সৃষ্টি, সন্ত্রাসী তৎপরতা পরিচালনা বা বল প্রযুক্ত হওয়ার ঘটনা প্রতি ক্ষেত্রেই হতে হবে এমনটি জরুরি নয়। আতঙ্ক, সন্ত্রাস বা বল প্রয়োগ—এর যেকোনো একটি ঘটতে পারে, এই বোধই যথেষ্ট। বারিধারা-বসুন্ধরা এলাকাকে যিনি নিরাপদ এলাকা হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন, সেখানে ককটেল বিস্ফোরণের পর আতঙ্কিত নাগরিকের মনে তাই প্রশ্ন জাগে, ‘এমন কোনো জায়গা কি আছে, যেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করতে পারি?’ কেউ নিজে আক্রান্ত হোক বা না হোক, তার মধ্যে ভয়ের বোধটি ঠিকই ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে।
মূলধারার রাজনীতি যখন ভয়ের সংস্কৃতিনির্ভর হয়ে পড়ে, তখন সমাজের সব ক্ষেত্রেই তার প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। অভিজিৎকে যারা বীভৎস কায়দায় খুন করেছে, তাদের কৌশলও সেই ‘ভয়’, সমাজে অভিজিতের মতো আরও যাঁরা আছেন, যাঁরা ভিন্ন চিন্তা করেন, তাঁদের ভয় দেখানো। এর আগে হুমায়ুন আজাদ একই জায়গায় একই কায়দার আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। লেখক-কবিদের অনেকেই বইমেলা থেকে একই পথে বের হয়ে আসেন। তাঁদের অনেকে নিশ্চয়ই নিজেকে অভিজিতের জায়গায় চিন্তা করে শিউরে উঠেছেন। স্বাধীন চিন্তা, মত প্রকাশ বা লেখালেখিতে অনেকেই কি এখন বাড়তি চাপ অনুভব করছেন না? ভয়ের সংস্কৃতি সমাজে এই পরিস্থিতিই তৈরি করে।
কোনো পক্ষের ভয় দেখানোর কৌশল নতুন ভয়, পাল্টা ভয় বা ভয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ভয়ের পুনরুৎপাদন ঘটায়। গাড়ি ভাঙচুর করতে দেখে তাই অনেকের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র রাখার অধিকারের বিষয়টি মাথায় আসে! অবরোধ-হরতালে পেট্রলবোমায় মানুষ পুড়িয়ে মারার মতো বীভৎসতা বা তা দমনের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ কৌশল যখন ভয়ের সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে, আইনের শাসন যখন শিকেয় উঠছে, তখন নাগরিক চিন্তার মধ্যেও তার প্রতিফলন ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক।
ভয়ের সংস্কৃতির বিপদ হচ্ছে এটা কাউকেই জয়ী হতে দেয় না। ভয় ও পাল্টা ভয়ের লড়াইয়ে কোনো পক্ষ হয়তো আপতত বা সাময়িক জয়ের সুখ পেতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দুঃস্বপ্নই হয়ে দাঁড়ায়, যা সহজে শেষ হওয়ার নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ভয়ের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পাল্টা হিসেবে বুশের ‘ওয়ার অন টেরর’ শুরু করার পর। ২০০৪ সালে এ নিয়ে ফিয়ার: দ্য হিস্ট্রি অব এ পলিটিক্যাল আইডিয়া শিরোনামে একটি বই লিখেছেন মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাংবাদিক কোরে রবিন। লিখেছেন ‘একদিন ওয়ার অন টেরর শেষ হয়ে যাবে, সব যুদ্ধই শেষ হয়। এবং এটা যখন শেষ হয়ে যাবে, তখনো দেখব যে আমরা সেই ভয়ের মধ্যেই বসবাস করছি, এটা সন্ত্রাস বা র্যাডিকেল ইসলাম নয়, বরং অভ্যন্তরীণ শাসকেরা যে ভয় তৈরি করেছেন, তার মধ্যে।’ আজ ১০ বছর পর কোরে রবিনের এই ভবিষ্যদ্বাণী তো সত্য বলেই মনে হচ্ছে।
ভয়ের সংস্কৃতি বাংলাদেশে যেভাবে শিকড় গাড়তে শুরু করেছে, তা দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে খুব সময় লাগবে বলে মনে হয় না। এখন সব ধরনের ভয়কে জয় করার অব্যাহত সাহস দেখানো ছাড়া জনগণের সামনে আর কোনো পথ আছে বলে মনে হয় না।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com
No comments