রাজনীতি নাকি নরম হচ্ছে! by আনিসুল হক
রাজনীতিতে
উভয় পক্ষ কিছুটা নমনীয়—প্রথম আলোর প্রথম পাতায় এই খবর পড়ে একধরনের
আরাম অনুভব করছি। ছোটবেলায় আতাফল এনে চালের বস্তার ভেতরে রেখে দিতাম। আর
রোজ দুবেলা পরখ করে দেখতাম, নরম হলো কি না। কাঁঠালের ব্যাপারেও একই ঘটনা
ঘটত। কাঁচা পুরুষ্ট কাঁঠাল রাখা আছে ভাঁড়ার ঘরে, রোজ গিয়ে টোকা দিয়ে
দেখতে হতো, ঢ্যাপ ঢ্যাপ শব্দ হয় কি না। ওই শব্দ থেকেই বোঝা যেত, কাঁঠাল
নরম হয়েছে কি না, পেকেছে কি না। আমাদের চাওয়া ছিল, ফল নরম হোক। নরম হওয়া
মানে পেকে যাওয়া। এখন আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রেও একই চাওয়া, রাজনীতি
পরিপক্ব হোক, পেকে উঠুক, রাজনীতির পক্ষগুলো নরম হোক। প্রথম আলো বলছে,
কূটনীতিকদের উদ্যোগে রাজনীতিতে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে। বেগম জিয়াকে
গ্রেপ্তার না করা হলো সেই নমনীয়তার লক্ষণ।
আর তাতে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে বিরোধী দলকে একটুখানি পরিসর দেওয়ার কথাও।
আমরা, দেশের নাগরিকগণ, অবশ্য সব সময় কাকের মতো কা-কা-কা করে এসেছি, তাল পাকুক, আর পাকা তাল টুপ করে ঝরে পড়ুক। এভাবে তাল পাকা আর তাল পড়ার ঘটনা ঘটলে তা হবে সত্যিকারের কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, কাক যতই কা-কা করুক না কেন, তাল পাকবে না, তাল পড়বেও না। আর গাছে যদি বেল পাকেও, তাতে জনগণের কী?
জনগণের কী! জনগণ তো ন্যাড়া। তবে যে ন্যাড়ার মাথায় বেল পড়েছিল, সে হয়তো আর কোনো দিন বেলতলায় যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ বারবার বেলতলায় যায়। তাদের মাথায় বারবার বেল পড়ে। তখন তারা কানে ধরে, নাকে খত দেয়, এই শেষ, আর কোনো দিন বেলতলায় যাব না, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে যায় এবং আবার বেলতলায় যায়। তাদের মাথায় আবার বেল পড়ে।
অথবা তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে দিব্যি খাওয়া যায়।
যা-ই হোক, আমরা, বাংলাদেশের ন্যাড়া জনগণ, যাদের মাথায় বেল পড়ে, কিংবা যাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া যায়, তারা বারবার করে বলি, ও রাজনীতি, তুমি পাকো, তুমি নরম হও।
ফল পাকা আর নরম হওয়া নিয়ে এ দেশে বেশি প্রচলিত অবশ্য ডালিমবিষয়ক গান।
‘চারা গাছে ফুল ফুইটাছে ডাল ভাইঙ্গো না রে মালি ডাল ভাইঙ্গো না।
কাঁচা ডালিম পাকবে বলে কয় দিন রব বসে
সেই না ডালিম পাকলে পরে ভরবে মধুর রসে’...ইত্যাদি।
এখন আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, আমাদের রাজনীতির ফল পাকুক, আমাদের রাজনীতি নরম হোক। আমরা আর হরতাল-অবরোধ চাই না। আমরা আর পেট্রলবোমা চাই না। আমরা শক্ত অবস্থান চাই না। আমরা নমনীয়তাই চাই।
ছোটবেলায় একটা কৌতুক পড়েছিলাম। ডাক্তার রোগীকে বলছে, খোসাসমেত ফল খাবেন।
রোগী বলছে, সব ফল খেতে পছন্দ করি না। কোনো কোনো ফল খেতে পছন্দ করি।
যে ফল খেতে পছন্দ করেন, সেই ফলই খোসাসমেত খাবেন। আপনার প্রিয় ফল কী?
আমার প্রিয় ফল নারকেল।
নারকেল পাকলেও নরম হয় না। এর বাইরের দিকটা বড়ই শক্ত।
আমাদের রাজনীতি পাকলেও নরম হবে কি? আমাদের রাজনীতির চারপাশটাও যে বড়ই শক্ত।
তাই খবরের কাগজে এই খবর পড়ে মনটা একটু আরামই বোধ করল।
তারপর মনে হতে লাগল, হায়, আমাদের অবস্থা এই রকম হয়ে পড়েছে যে, স্বাভাবিক শান্তির একটা দিন যেন আমাদের পাওনা নয়। অস্বাভাবিক সংঘাতের দিনরাত্রিই যেন এখানে নিয়ম। তাই হঠাৎ করে কোনো শুক্রবারের দিনটিতে যদি হরতাল না থাকে, মনে হয়, ইশ্, কত ভালোই না আমাদের রাজনীতিবিদেরা। আমাদের একটা দিন উপহার দিয়েছেন, যেদিন হরতাল নাই। অবরোধ আছে। তা থাকুক। তবু তো হরতাল নাই। রাজনীতিবিদেরা কত ভালো, সপ্তাহে একটা দিনে হরতাল দেন না। তাঁরা আমাদের কী ছাড়টাই না দেন।
আর এসবই কিন্তু করা হচ্ছে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য। মানুষের কল্যাণের জন্য। নাগরিকদের ভালোর জন্য। তাতে প্রতিদিন দু-দশজন মানুষ পেট্রলবোমায় পুড়ছে, পুড়ুক, মানুষকে বাঁচাতে হবে না?
মানুষের কল্যাণের জন্য দু-চারজন মানুষকে গুলি করে কিংবা বোমা মেরে খুন করা যাবে না? এসবই তো করা হচ্ছে মানুষের ভালোর জন্য।
কী বললেন, যে মারা যাচ্ছে, সেও মানুষ? না-না না-না তারা তো ব্যক্তিমানুষ। আমরা তো কল্যাণ করছি জনগণের। আমরা তো মুক্তি আদায় করছি দেশবাসীর। সমগ্রের মুক্তির জন্য রোজ দু-চারজনকে মারা তো কেবল বৈধ নয়, কর্তব্য।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বসলে পাগল হয়ে যেতে হবে। মানুষকে মেরে ওরা মানুষের মুক্তি চায়। মানুষের মুক্তির জন্য ওরা মানুষকে মেরে ফেলে। তবে এই দেশে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার কোনো পরিবেশ নেই। সবার মাথা গরম। সবার চিন্তাই প্রায় অসুস্থ। মেরে ফেলো, বিনাশ করো, নির্মূল করো, খতম করো, উৎখাত করো, নিশ্চিহ্ন করো’র ব্রত নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। লড়াই লড়াই লড়াই চাই...
কী সুন্দর একটা দেশ পেয়েছিলাম। কী সুন্দর একটা জাতি আমাদের! কোত্থেকে কী হয়ে গেল। কেউ কাউকে একটুখানি ছাড় দেবে না। কেউ কাউকে একটুখানি পরিসর দেবে না। শুধু ধ্বংস হোক, নিপাত যাক আওয়াজ। একটা দিনও আর আমাদের মসৃণ নয়। একটা প্রহরও আর আমাদের নিরাপদ নয়।
আমাদের রাজনীতি হলো ইস্পাতকঠিন। অথচ লোকে বলে, রাজনীতি হলো সমঝোতার আর্ট। পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কমপ্রোমাইজ। শত্রুর সঙ্গেই লোকে আলাপ করতে বসে। ইসরায়েলের সঙ্গে বসে ফিলিস্তিনিরা। সামরিক জান্তার সঙ্গে বসেন অং সান সু চি। নেলসন ম্যান্ডেলা বসেন বর্ণবাদী প্রতিপক্ষের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল করতে যান পিন্ডিতে। কিন্তু আমরা একচুলও ছাড় দেব না। একচুলও নড়ব না।
আমাদের রাজনীতি নরম হবে না। এই অবস্থায় বিদেশিদের তাপে কাঁঠাল নাকি খানিকটা নরম হয়েছে। কিলায়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। ফল পুরুষ্ট হলে আর ফলের মরসুম এলে আপনা থেকেই ফল পাকে।
কিন্তু আমাদের রাজনীতি তো পরিপক্ব হবে না। রাজনীতি নাকি আর রাজনীতিবিদদের হাতেই নেই, পরিপক্ব হবে কোত্থেকে!
তবু খবরের কাগজে রাজনীতির নমনীয়তার খবর আমাদের স্বস্তি দেয়। আমরা এমনই হাভাতে হয়ে গেছি। আমরা এমনি রকম কাঙাল হয়ে আছি শান্তির জন্য, স্বাভাবিকতার জন্য। আমাদের জন্য এখন আমাদের করুণা হওয়া উচিত।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আর তাতে জ্বালাও-পোড়াও বন্ধের কথা যেমন আছে, তেমনি আছে বিরোধী দলকে একটুখানি পরিসর দেওয়ার কথাও।
আমরা, দেশের নাগরিকগণ, অবশ্য সব সময় কাকের মতো কা-কা-কা করে এসেছি, তাল পাকুক, আর পাকা তাল টুপ করে ঝরে পড়ুক। এভাবে তাল পাকা আর তাল পড়ার ঘটনা ঘটলে তা হবে সত্যিকারের কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহল বলছেন, কাক যতই কা-কা করুক না কেন, তাল পাকবে না, তাল পড়বেও না। আর গাছে যদি বেল পাকেও, তাতে জনগণের কী?
জনগণের কী! জনগণ তো ন্যাড়া। তবে যে ন্যাড়ার মাথায় বেল পড়েছিল, সে হয়তো আর কোনো দিন বেলতলায় যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ বারবার বেলতলায় যায়। তাদের মাথায় বারবার বেল পড়ে। তখন তারা কানে ধরে, নাকে খত দেয়, এই শেষ, আর কোনো দিন বেলতলায় যাব না, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে যায় এবং আবার বেলতলায় যায়। তাদের মাথায় আবার বেল পড়ে।
অথবা তাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে দিব্যি খাওয়া যায়।
যা-ই হোক, আমরা, বাংলাদেশের ন্যাড়া জনগণ, যাদের মাথায় বেল পড়ে, কিংবা যাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়া যায়, তারা বারবার করে বলি, ও রাজনীতি, তুমি পাকো, তুমি নরম হও।
ফল পাকা আর নরম হওয়া নিয়ে এ দেশে বেশি প্রচলিত অবশ্য ডালিমবিষয়ক গান।
‘চারা গাছে ফুল ফুইটাছে ডাল ভাইঙ্গো না রে মালি ডাল ভাইঙ্গো না।
কাঁচা ডালিম পাকবে বলে কয় দিন রব বসে
সেই না ডালিম পাকলে পরে ভরবে মধুর রসে’...ইত্যাদি।
এখন আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছি, আমাদের রাজনীতির ফল পাকুক, আমাদের রাজনীতি নরম হোক। আমরা আর হরতাল-অবরোধ চাই না। আমরা আর পেট্রলবোমা চাই না। আমরা শক্ত অবস্থান চাই না। আমরা নমনীয়তাই চাই।
ছোটবেলায় একটা কৌতুক পড়েছিলাম। ডাক্তার রোগীকে বলছে, খোসাসমেত ফল খাবেন।
রোগী বলছে, সব ফল খেতে পছন্দ করি না। কোনো কোনো ফল খেতে পছন্দ করি।
যে ফল খেতে পছন্দ করেন, সেই ফলই খোসাসমেত খাবেন। আপনার প্রিয় ফল কী?
আমার প্রিয় ফল নারকেল।
নারকেল পাকলেও নরম হয় না। এর বাইরের দিকটা বড়ই শক্ত।
আমাদের রাজনীতি পাকলেও নরম হবে কি? আমাদের রাজনীতির চারপাশটাও যে বড়ই শক্ত।
তাই খবরের কাগজে এই খবর পড়ে মনটা একটু আরামই বোধ করল।
তারপর মনে হতে লাগল, হায়, আমাদের অবস্থা এই রকম হয়ে পড়েছে যে, স্বাভাবিক শান্তির একটা দিন যেন আমাদের পাওনা নয়। অস্বাভাবিক সংঘাতের দিনরাত্রিই যেন এখানে নিয়ম। তাই হঠাৎ করে কোনো শুক্রবারের দিনটিতে যদি হরতাল না থাকে, মনে হয়, ইশ্, কত ভালোই না আমাদের রাজনীতিবিদেরা। আমাদের একটা দিন উপহার দিয়েছেন, যেদিন হরতাল নাই। অবরোধ আছে। তা থাকুক। তবু তো হরতাল নাই। রাজনীতিবিদেরা কত ভালো, সপ্তাহে একটা দিনে হরতাল দেন না। তাঁরা আমাদের কী ছাড়টাই না দেন।
আর এসবই কিন্তু করা হচ্ছে জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য। মানুষের কল্যাণের জন্য। নাগরিকদের ভালোর জন্য। তাতে প্রতিদিন দু-দশজন মানুষ পেট্রলবোমায় পুড়ছে, পুড়ুক, মানুষকে বাঁচাতে হবে না?
মানুষের কল্যাণের জন্য দু-চারজন মানুষকে গুলি করে কিংবা বোমা মেরে খুন করা যাবে না? এসবই তো করা হচ্ছে মানুষের ভালোর জন্য।
কী বললেন, যে মারা যাচ্ছে, সেও মানুষ? না-না না-না তারা তো ব্যক্তিমানুষ। আমরা তো কল্যাণ করছি জনগণের। আমরা তো মুক্তি আদায় করছি দেশবাসীর। সমগ্রের মুক্তির জন্য রোজ দু-চারজনকে মারা তো কেবল বৈধ নয়, কর্তব্য।
ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে বসলে পাগল হয়ে যেতে হবে। মানুষকে মেরে ওরা মানুষের মুক্তি চায়। মানুষের মুক্তির জন্য ওরা মানুষকে মেরে ফেলে। তবে এই দেশে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার কোনো পরিবেশ নেই। সবার মাথা গরম। সবার চিন্তাই প্রায় অসুস্থ। মেরে ফেলো, বিনাশ করো, নির্মূল করো, খতম করো, উৎখাত করো, নিশ্চিহ্ন করো’র ব্রত নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম। জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। লড়াই লড়াই লড়াই চাই...
কী সুন্দর একটা দেশ পেয়েছিলাম। কী সুন্দর একটা জাতি আমাদের! কোত্থেকে কী হয়ে গেল। কেউ কাউকে একটুখানি ছাড় দেবে না। কেউ কাউকে একটুখানি পরিসর দেবে না। শুধু ধ্বংস হোক, নিপাত যাক আওয়াজ। একটা দিনও আর আমাদের মসৃণ নয়। একটা প্রহরও আর আমাদের নিরাপদ নয়।
আমাদের রাজনীতি হলো ইস্পাতকঠিন। অথচ লোকে বলে, রাজনীতি হলো সমঝোতার আর্ট। পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কমপ্রোমাইজ। শত্রুর সঙ্গেই লোকে আলাপ করতে বসে। ইসরায়েলের সঙ্গে বসে ফিলিস্তিনিরা। সামরিক জান্তার সঙ্গে বসেন অং সান সু চি। নেলসন ম্যান্ডেলা বসেন বর্ণবাদী প্রতিপক্ষের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল করতে যান পিন্ডিতে। কিন্তু আমরা একচুলও ছাড় দেব না। একচুলও নড়ব না।
আমাদের রাজনীতি নরম হবে না। এই অবস্থায় বিদেশিদের তাপে কাঁঠাল নাকি খানিকটা নরম হয়েছে। কিলায়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না। ফল পুরুষ্ট হলে আর ফলের মরসুম এলে আপনা থেকেই ফল পাকে।
কিন্তু আমাদের রাজনীতি তো পরিপক্ব হবে না। রাজনীতি নাকি আর রাজনীতিবিদদের হাতেই নেই, পরিপক্ব হবে কোত্থেকে!
তবু খবরের কাগজে রাজনীতির নমনীয়তার খবর আমাদের স্বস্তি দেয়। আমরা এমনই হাভাতে হয়ে গেছি। আমরা এমনি রকম কাঙাল হয়ে আছি শান্তির জন্য, স্বাভাবিকতার জন্য। আমাদের জন্য এখন আমাদের করুণা হওয়া উচিত।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments