ত্বকীর মুখ আমাদের সাহস by আনু মুহাম্মদ
বাংলাদেশের
জন্য গৌরবের এক কিশোর ত্বকী হত্যার দুই বছর হয়ে গেল। যে হত্যাকারীরা
গ্রন্থপ্রেমী এক কিশোরকে গ্রন্থাগারের রাস্তা থেকে তুলে নির্যাতন করে
হত্যার পর শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিল, তারা এখন আর অজানা নয়। তদন্ত হয়েছে,
অপরাধী শনাক্তও হয়েছে, কিন্তু তার পরও আটকে আছে বিচারকাজ। ত্বকী হত্যার
বিচার চেয়ে সারা দেশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক
নেতা-কর্মীও দাবি জানাচ্ছেন। কিন্তু অভিযুক্ত পরিবারের ক্ষমতা দলের চেয়ে
বেশি। প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-নেতাদের মুখে নাশকতা আর মানুষ
খুনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে পাচ্ছি, খুনিদের কঠোর শাস্তি
দেওয়ার প্রত্যয় শুনতে পাচ্ছি, খুনিদেরকে ক্ষমা না করার উদাত্ত ঘোষণা শুনতে
পাচ্ছি। কিন্তু খুন, পেট্রলবোমা, ‘ক্রসফায়ার’ অব্যাহত আছে।
অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ও বিচার কানাগলিতে প্রবেশ করছে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পার হয়ে গেছে, তাঁদের হত্যাকারীদের বিচার তো দূরের কথা, তদন্তের ঘোরপ্যাঁচই কাটছে না। ঢাকার মিরপুরের কালশীতে বাইরে থেকে ঘরের তালা আটকে গানপাউডার ঢেলে শিশু-নারীসহ ছয়জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্থানীয় এমপি। কোনো তদন্তের খবরই পাওয়া যায় না, বিচার তো দূরের কথা। ওদিকে গত কয় বছরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে মুক্ত হয়ে গেছে খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বহু আসামি।
যে সমাজে আমরা বাস করি, নৃশংসতার নানা ঘটনা বারবার এই সমাজের প্রকৃত রূপ আমাদের সামনে হাজির করে। দেখায় এগুলো শুধু এক-দুই ব্যক্তির বিষয় নয়, এই দল বা সেই দলের বিষয়ও নয়, এদের ক্ষমতার জাল বহুদূর বিস্তৃত। শুধু এক-দুই খুন নয়, আরও বহুবিধ অপরাধে তারা লিপ্ত। তারা ভূমিদস্যু, একের পর এক জলাভূমি, সাধারণ মালিকানাধীন জমি তাদের দখলে। তারা চাঁদাবাজ, পরিবহন থেকে শুরু করে সব ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের শিকার। ফুটপাতের ছোট্ট ব্যবসা, রিকশা থেকে বাস, নদী-বন থেকে খেলার মাঠ সর্বত্র তাদের লোভের আগ্রাসন।
এই সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ তৈরি করতে প্রতিটি ক্ষেত্রে নাগরিকদেরই বাড়তি অর্থ খরচ করতে হয়। দখল, লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজি কার্যকর করতে এই মাফিয়াদের পুষতে হয় সন্ত্রাসী বাহিনী। এই ভাড়াটে বাহিনী শুধু ভাড়া খাটে না, নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে নিজেরাও নতুন নতুন পথ সন্ধান করে। এদের হাতে নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানি এগুলো তাই নিয়মিত ঘটনা। এই মাফিয়া গোষ্ঠীর হাতে বাঁধা থাকে প্রশাসন, পুলিশ, আইন-আদালত, সরকারি ক্ষমতা।
এই দুর্বৃত্ত জালের মধ্যেই ত্বকী হত্যা ও হত্যাকারীদের সংহতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ত্বকী স্কুলের মেধাবী ছাত্র, সৃজনশীল কিশোর। লেখাপড়া, কবিতা লেখাসহ সৃজনশীল কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকত ও। লাইব্রেরি ছিল তার প্রিয় গন্তব্য, বই ছিল প্রিয় সঙ্গী, মানুষের সৃজনশীল মুক্ত সমতার ভবিষ্যৎ ছিল তার স্বপ্ন। আমরা জানি, মাফিয়া সন্ত্রাসীরা এ রকম মুক্তচিন্তার কিশোর-তরুণদের পছন্দ করে না। নারায়ণগঞ্জে এরা ক্ষমতার মদমত্তে গড়ে তুলেছে খুনি উৎপীড়কদের একটি অন্ধকার জগৎ। তারা যেকোনো অপরাধ করতে পারে, কোনো অপরাধেই তাদের কোনো বিচার হবে না এই বিশ্বাসই তাদের ঔদ্ধত্যের কারণ। খেলার ছলে মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেললেও না। কিন্তু ত্বকীর বাবা ও তার পরিবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই মাফিয়াদের সব দখল-লুণ্ঠন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রতিরোধ চুরমার করতেই দুর্বৃত্তরা বেছে নিয়েছিল ত্বকী হত্যার নিষ্ঠুরতম পথ। কিন্তু সফল হয়নি, ত্বকীর মুখ হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের চিহ্ন। ত্বকী হত্যার বিচার তাই একদিন হবেই।
বাংলাদেশ এখন সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, অসহিষ্ণুতা আর বিচারহীনতার দেশ। অনেকে এর জন্য পুলিশি অদক্ষতাকে দায়ী করেন। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ওপরের নির্দেশ, ক্ষমতাবানদের প্রভাব বা সিদ্ধান্তের কোনো বাধা না থাকলে অপরাধী শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা যে তাদের পক্ষে খুবই সম্ভব, তার বহু প্রমাণ আছে। সমস্যা দক্ষতার নয়, সমস্যা সিদ্ধান্তের।
ত্বকী অল্প বয়সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি শক্তিশালী কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার ওই বয়সেরই লেখা গদ্য, কবিতা, ওর আগ্রহ, ছবি সবকিছুতে বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন, যা ধারণ করেই এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। অথচ এই ‘চেতনা’র নামাবলি গায়ে দিয়েই সরকার রক্ষা করছে ত্বকী হত্যাকারীদের। খুনি বীভৎস মুখ আড়াল করছে চেতনার ঝান্ডা দিয়ে। সেই মুখোশ খুলে দিতে ত্বকীর মুখই আমাদের সাহস।
নারায়ণগঞ্জ গডফাদার সন্ত্রাসীর এলাকা বলে পরিচিত। শীতলক্ষ্যা নদী খুনিদের উল্লাস বহন করতে করতে ক্লান্ত। এই নারায়ণগঞ্জই একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের প্রতীক। আর তার কেন্দ্রে এখন ত্বকীর মুখ। মৃত্যুর পরও ত্বকী তাই প্রতিরোধের শক্তি।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu
অভিজিৎ হত্যার তদন্ত ও বিচার কানাগলিতে প্রবেশ করছে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের তিন বছর পার হয়ে গেছে, তাঁদের হত্যাকারীদের বিচার তো দূরের কথা, তদন্তের ঘোরপ্যাঁচই কাটছে না। ঢাকার মিরপুরের কালশীতে বাইরে থেকে ঘরের তালা আটকে গানপাউডার ঢেলে শিশু-নারীসহ ছয়জন মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি স্থানীয় এমপি। কোনো তদন্তের খবরই পাওয়া যায় না, বিচার তো দূরের কথা। ওদিকে গত কয় বছরে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে মুক্ত হয়ে গেছে খুনের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত বহু আসামি।
যে সমাজে আমরা বাস করি, নৃশংসতার নানা ঘটনা বারবার এই সমাজের প্রকৃত রূপ আমাদের সামনে হাজির করে। দেখায় এগুলো শুধু এক-দুই ব্যক্তির বিষয় নয়, এই দল বা সেই দলের বিষয়ও নয়, এদের ক্ষমতার জাল বহুদূর বিস্তৃত। শুধু এক-দুই খুন নয়, আরও বহুবিধ অপরাধে তারা লিপ্ত। তারা ভূমিদস্যু, একের পর এক জলাভূমি, সাধারণ মালিকানাধীন জমি তাদের দখলে। তারা চাঁদাবাজ, পরিবহন থেকে শুরু করে সব ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের শিকার। ফুটপাতের ছোট্ট ব্যবসা, রিকশা থেকে বাস, নদী-বন থেকে খেলার মাঠ সর্বত্র তাদের লোভের আগ্রাসন।
এই সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজদের কোটি কোটি টাকার সম্পদ তৈরি করতে প্রতিটি ক্ষেত্রে নাগরিকদেরই বাড়তি অর্থ খরচ করতে হয়। দখল, লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজি কার্যকর করতে এই মাফিয়াদের পুষতে হয় সন্ত্রাসী বাহিনী। এই ভাড়াটে বাহিনী শুধু ভাড়া খাটে না, নিজেদের ক্ষুধা মেটাতে নিজেরাও নতুন নতুন পথ সন্ধান করে। এদের হাতে নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানি এগুলো তাই নিয়মিত ঘটনা। এই মাফিয়া গোষ্ঠীর হাতে বাঁধা থাকে প্রশাসন, পুলিশ, আইন-আদালত, সরকারি ক্ষমতা।
এই দুর্বৃত্ত জালের মধ্যেই ত্বকী হত্যা ও হত্যাকারীদের সংহতির ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ত্বকী স্কুলের মেধাবী ছাত্র, সৃজনশীল কিশোর। লেখাপড়া, কবিতা লেখাসহ সৃজনশীল কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকত ও। লাইব্রেরি ছিল তার প্রিয় গন্তব্য, বই ছিল প্রিয় সঙ্গী, মানুষের সৃজনশীল মুক্ত সমতার ভবিষ্যৎ ছিল তার স্বপ্ন। আমরা জানি, মাফিয়া সন্ত্রাসীরা এ রকম মুক্তচিন্তার কিশোর-তরুণদের পছন্দ করে না। নারায়ণগঞ্জে এরা ক্ষমতার মদমত্তে গড়ে তুলেছে খুনি উৎপীড়কদের একটি অন্ধকার জগৎ। তারা যেকোনো অপরাধ করতে পারে, কোনো অপরাধেই তাদের কোনো বিচার হবে না এই বিশ্বাসই তাদের ঔদ্ধত্যের কারণ। খেলার ছলে মানুষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেললেও না। কিন্তু ত্বকীর বাবা ও তার পরিবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই মাফিয়াদের সব দখল-লুণ্ঠন-অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রতিরোধ চুরমার করতেই দুর্বৃত্তরা বেছে নিয়েছিল ত্বকী হত্যার নিষ্ঠুরতম পথ। কিন্তু সফল হয়নি, ত্বকীর মুখ হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের চিহ্ন। ত্বকী হত্যার বিচার তাই একদিন হবেই।
বাংলাদেশ এখন সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা, অসহিষ্ণুতা আর বিচারহীনতার দেশ। অনেকে এর জন্য পুলিশি অদক্ষতাকে দায়ী করেন। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ওপরের নির্দেশ, ক্ষমতাবানদের প্রভাব বা সিদ্ধান্তের কোনো বাধা না থাকলে অপরাধী শনাক্ত করা, খুঁজে বের করা যে তাদের পক্ষে খুবই সম্ভব, তার বহু প্রমাণ আছে। সমস্যা দক্ষতার নয়, সমস্যা সিদ্ধান্তের।
ত্বকী অল্প বয়সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি শক্তিশালী কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তার ওই বয়সেরই লেখা গদ্য, কবিতা, ওর আগ্রহ, ছবি সবকিছুতে বাংলাদেশের সেই স্বপ্ন, যা ধারণ করেই এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। অথচ এই ‘চেতনা’র নামাবলি গায়ে দিয়েই সরকার রক্ষা করছে ত্বকী হত্যাকারীদের। খুনি বীভৎস মুখ আড়াল করছে চেতনার ঝান্ডা দিয়ে। সেই মুখোশ খুলে দিতে ত্বকীর মুখই আমাদের সাহস।
নারায়ণগঞ্জ গডফাদার সন্ত্রাসীর এলাকা বলে পরিচিত। শীতলক্ষ্যা নদী খুনিদের উল্লাস বহন করতে করতে ক্লান্ত। এই নারায়ণগঞ্জই একই সঙ্গে হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের প্রতীক। আর তার কেন্দ্রে এখন ত্বকীর মুখ। মৃত্যুর পরও ত্বকী তাই প্রতিরোধের শক্তি।
আনু মুহাম্মদ: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu
No comments