৭ই মার্চ স্বাধীনতাযুদ্ধের অনিবার্য মুখবন্ধ by কেয়া চৌধুরী
ইতিহাস
কথা বলে। আমরা হয়তো সবসময় সেই শব্দমালা কানে শুনতে পাই না। কিন্তু ঘটনা
প্রবাহে ইতিহাস আমাদের ফিরে নিয়ে যায় সত্য ও ন্যায়ের পথে। বাংলায় বসন্ত ঋতু
আর ইংরেজিতে অগ্নিঝরা মার্চ মাস। বাঙালি জাতির অবিস্মরণীয় এই মাসটি,
একাধারে আনন্দ-বেদনার এবং রক্তস্নাত নবজন্মে অধ্যায়ে রচিত। এ মাসেই ১৯২০
সালের ১৭ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান। যিনি
বাঙালি জাতিকে দিশা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র
প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। ইতিহাসের মহানায়ক হয়ে ওঠা শেখ মুুজিবুর রহমান ৭ কোটি
বাঙালির প্রাণের নেতা। অথচ কোন কারণ ছাড়াই ’৭১ সালে ইয়াহিয়া পূর্বঘোষিত
জাতীয় অধিবেশন স্থগিত করে শেখ মুজিবকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। তারা জানতো
না এরই মধ্যে বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখার কাজ
শুরু করে দিয়েছিলেন। সে কারণেই, ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া যখন জাতীয়
পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিল। অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিকামী
বাঙালি ইয়াহিয়ার ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করল। বিক্ষুব্ধ জনগণ যখন রাজপথে নেমে
পড়ল, তখন বঙ্গবন্ধু ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের
সংসদীয় কমিটির বৈঠক করছিলেন। পহেলা মার্চের সেই বৈঠক থেকে, বঙ্গবন্ধু হাজার
হাজার বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশে হাত নেড়ে বলেছিলেন, ‘আপনারা ধৈর্য ধরুন।
পরিস্থিতি বোঝে নির্দেশ দেয়া হবে। মনে রাখবেন, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’
১৯৭১
সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মূলত একটি স্বাধীন
বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেছিলেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল
একটি দিন ৭ই মার্চ। ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ১০ লক্ষাধিক উদ্বেলিত
বাঙালির মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন ইতিহাসের
অমোঘ বানী, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার
সংগ্রাম’। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন সাড়ে ৭ কোটি
বাঙালি সেদিন বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণায় অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছিল। অভিন্ন
ভাষায় উচ্চারিত হয়েছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’,
‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধ’ু ইত্যাদি
রণধ্বনি। ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে
প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, আরও দেব, এই দেশের মানুষকে মুক্ত
করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর আজন্মের।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি লড়েছেন, ১৯৪৭ থেকে ’৭১ পর্যন্ত। তিনি সংগ্রাম
করেছেন দেশবিরোধী চেতনার বিরুদ্ধে। আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর লড়েছেন,
নীতিহীনতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি অসাদাচরণের বিরুদ্ধে।
জনগণের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই, বঙ্গবন্ধু নীতিবিহীন নেতাকে
অপছন্দ করতেন। প্রজন্মের অমূল্য দলিল বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’
তিনি বলেছেন, ‘নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে কোন ফল পাওয়া যায় না। অযোগ্য
নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোন দিন একসঙ্গে হয়ে
দেশের কোন কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়’।
বাংলার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামগ্রিক
জীবনযাত্রায়, ব্যবহৃত প্রতিটি বক্তব্য বাস্তবসম্মত এবং প্রাসঙ্গিক। বেগম
খালেদা জিয়া (আইএস) জঙ্গিবাদী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে, টানা ২ মাসে নজিরবিহীন
সহিংস রাজনীতির মাধ্যমে যে রেকর্ড সৃষ্টি করছেন, তা বাঙালির প্রতি
পাকিস্তানি জুলুম-অত্যাচারের মতো প্রতিহত করার সময় এসেছে। গত দুই মাসে
পেট্রলবোমার আগুনে পোড়া ১১৫টি তাজা জীবন কেড়ে নেয়ার রাজনীতি, কখনোই জনগণের
রাজনীতি হতে পারে না। খালেদা জিয়ার মতো নীতিহীন নেত্রীর দ্বারা দেশসেবা নয়,
বরং দেশ ও জনগণের ধ্বংস-সর্বনাশ অনিবার্য।
কেয়া চৌধুরী |
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই
মার্চের ভাষণ শুধু স্বাধীনতার লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে বাঙালিকে,
মন্ত্রমুগ্ধের মতো উজ্জীবিত করেনি। ১৯৭১ সাল থেকে আজ অবধি, বাঙালির প্রতিটি
আন্দোলন-সংগ্রামে মূলস্তম্ভ হয়ে অবদান রেখে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় সত্য হলো,
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ব বাংলার মানুষকে বঞ্চনা এবং নিপীড়নের
নামে যে ইতিহাসের সৃষ্টি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার দেয়া ১৮ মিনিটের
বক্তব্যে সে ইতিহাসকে চিরতরে কফিনবন্দি করেছিলেন। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার শিক্ষা দেয়। শক্তি যোগায় মিথ্যা-প্রবঞ্চনা ও
অপরাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেয়ার। ৭ই মার্চের মহাকাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর
আঙুলের হেলুনি, আমাদের পথ দেখায় সত্য সুন্দর ও সমৃদ্ধির। ৭ই মার্চের গর্জে
ওঠা জাতির পিতার কণ্ঠস্বর আমাদেরকে নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী
করে তোলে। তাই ঐতিহাসিকভাবেই অগ্নিঝরা ৭ই মার্চ গৌরবময় স্বাধীনতা যুদ্ধের
অনিবার্য মুখবন্ধ।
No comments