দেশান্তরি পাখিরা সব by রেজাউর রহমান
যথেষ্ট আর্থিক শক্তি-সামর্থ্য না থাকলেও স্ত্রী মরিয়মকে নিয়ে রাজধানীর এক অভিজাত প্রাইভেট হাসপাতালে উঠতে হয় তমালকে। রোগের রকমসকম ভালো নয়। ছোটখাটো ক্লিনিক বা মেডিকেল সেন্টারে এর চিকিৎসা হবে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তিনি চান, স্ত্রীর ভালো চিকিৎসা হোক। আশায় বুক বেঁধেছেন তমাল। স্থানীয় এক প্রাইমারি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস মরিয়ম ততটা নয়। ঠেলা ট্রলি থেকে দুজন নার্স তাঁকে বিছানায় উঠিয়ে শুইয়ে দিলে তিনি তমালকে কাছে ডাকেন। তাঁর হাত ধরে চোখের জল ছেড়ে দেন, ‘বিছানাটা এত সাদা, আমার মনে হয়, এটাই আমার শেষ শয়ন।’
তমালের চোখও ছলছল করে ওঠে এ কথায়।
হাসপাতালের পাশেই গুলশান লেক। শীতের সকালে হালকা কুয়াশার আস্তরণ বিছিয়ে রাখে এলাকার যত্নে-অযত্নে বেড়ে ওঠা তাবৎ গাছগাছালি, বনজঙ্গল। এ অবস্থা বেশিক্ষণ টেকে না। সকালি সূর্যের আলোকচ্ছটা তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অস্বচ্ছ জলে উড়ে উড়ে বসে দু-চারটা বাদামি পাখার বকপাখি। ফকফকে সাদা বকও নামে কালেভদ্রে।
আজ এখানে তাঁদের তৃতীয় দিন। প্রত্যুষের এই সময়টায় মরিয়ম ঘুমান। হয়তো এ সময়টায় তাঁর ব্যথাটা একটু দম ধরে। দিন-রাতের বাকি সময় তিনি অসহনীয় ব্যথাকাতর হয়ে শুধু ছটফট করেন।
এই সামান্য ফুরসতে গায়ে গরম জামাকাপড় চড়িয়ে ডিউটি নার্সকে জানিয়ে হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে বের হন তমাল। গুলশান লেকের আঁকাবাঁকা খোলা ইট-সিমেন্টের পাড় ধরে ধরে হাঁটেন, প্রশান্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে। এইটুকুন তাঁর সামান্য ফুরসত। ঘড়ি ধরে আবার তাঁকে কেবিনে ফিরতে হয়। রোগীর কখন ঘুম ভাঙে, কখন কী দরকার হয়।
তমাল বরাবরের মতো মরিয়মের কেবিনে ফিরে যাওয়ার আগে নিচতলায় ক্যাফেটেরিয়া থেকে দ্রুত সংক্ষিপ্ত নাশতার পাট চুকিয়ে নেন। ক্যাফেটা বেশ বড়সড়। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। মেনু-আইটেমের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। তবে এর অনেকই তাঁর অপরিচিত। তিনি চেনা তালিকার বাইরে যান না। দুটো পুরি ও এক কাপ চা-ই তাঁর জন্য সহজসাধ্য মেনু। নাশতার ট্রেটা হাতে উঁচিয়ে এগিয়ে যান তমাল। একটা সুবিধামতো জায়গা খুঁজতে গিয়ে ক্যাফের ফ্লোরটা যে উঁচুনিচু দুই স্তরে সাজানো, তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। দু-কদম এগিয়ে তমাল ট্রে হাতে নিচু স্তরে পড়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণে এক ভদ্রমহিলা তাঁকে জাপটে ধরে ফেলেন, ‘আরে ভাই, একটু চোখ মেলে হাঁটবেন তো! এক্ষুনি চোখেমুখে গরম চা পড়ে বার্ন ইউনিটে যেতে হতো। ভাগ্যিস, আমি ফলো করছিলাম...।’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেন তমাল। যথেষ্ট লজ্জিত হয়ে। এক ভদ্রমহিলা তাঁকে জাপটে ধরে রেখেছেন, ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে।
‘লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই। ভুল তো মানুষেরই হয়। আসুন, ধীরস্থির হয়ে বসুন।’
চেয়ার টেনে বসতে বসতে ভদ্রমহিলা মিটিমিটি হাসেন।
‘অনেক দিন পর হলেও আপনাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি...আপনি তমাল ইসলাম না?’
‘হ্যাঁ।’ তাঁর চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।
‘কিন্তু আপনি!’
‘আমি সেই কবের...। ইসাবেলা। কিন্তু সবাই আমাকে কলেজে বেলা বলে ডাকত।’ কথা শেষ না করেই উঠে যান তিনি। ফিরে আসেন এক মুঠি টিস্যু পেপার নিয়ে। ‘আপনার বাঁ হাতটা দেখি...সেখানে পেপার কাপ ছলকে যে চা পড়ে গেছে, আপনার বোধ করি খেয়াল নেই?’
বেলা টিস্যু পেপার দিয়ে তমালের বাঁ হাতটা সুন্দর করে মুছে দেন।
‘খেয়াল না থাকারই তো কথা। এমন দৈবচক্র...আকস্মিকতা...।’
‘আকস্মিকতাই তো! কত বছর আগের কথা। আমরা এক কলেজে পড়তাম। আর কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশনে আমরা শ্যামা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল। আপনার মনে নেই?’
‘খুব একটা মনে পড়ছে না।’
‘কেন, আপনিও তো নেচেছিলেন। পার্শ্বচরিত্রে কোটালের ভূমিকায়, আর আমি তো শ্যামার চরিত্রে...সেইটাই আমার কাল হয়েছিল। তরুণ ডিসি আফজাল সাহেবের নজরে পড়ে গেলাম। আর সেই নজর পড়ার মাশুল দিতে দিতে এত দূর...এত কাল।’
তখন হালকা হালকা কলেজজীবনের কিছু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তমাল।
‘হ্যাঁ...তাই মনে পড়ছে, একসময় নাচের তালিম নিয়েছিলাম কিছুদিন। সেই সময় ময়মনসিংহ শহরে গান-বাজনার খুব চর্চা ছিল।’
বেলা বিনয়ী হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন, ‘আমাদের আসল কথাটাই যে চাপা পড়ে গেছে। আমরা এখানে এসেছি বিপদে পড়ে। শখে কেউ কি হাসপাতালে আসে! তোমার কী অবস্থা?’
‘অবস্থা ভালো না। মরিয়মকে নিয়ে এসেছি। তাঁর রোগের নাকি চিকিৎসা নাই। লিভার সিরোসিস...বেচারা বড় কষ্ট পাচ্ছে।’
আঁতকে ওঠেন বেলা, ‘কী বলো! আমার অবস্থাটা অবশ্য তেমন জটিল নয়। মাকে নিয়ে এসেছি...ওল্ড অ্যাইজ কমপ্লিকেশন। এই বয়সে...।’
চা শেষ করে তমাল ঘড়ি দেখেন, ‘আমার উঠতে হয়। সকাল নয়টায় মরিয়মের সিটি স্ক্যান করার কথা।’
‘আই অ্যাম সরি। তুমি যাও। তোমার কেবিন নম্বর কত?’
‘তিনের দুই...।’
‘আমার কেবিন পাঁচতলায়। ভিআইপি-৩। আমি খবর নেব তোমার।’
তমাল তড়িঘড়ি করে উঠে যান।
মরিয়মের মুখে একেবারে রুচি নেই। তিনি কিছুই মুখে নিতে চান না। তারপর নার্সরা যথেষ্ট চেষ্টাসাধ্য করে দু-চামচ স্যুপ খাইয়ে ঘুমের বড়ি দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন মাত্র। এ ছাড়া দুই হাতে রয়েছে স্যালাইন, কত না ইনজেকশন। তমাল তাঁর পায়ের কাছের ডিভানে কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে এ বিষয়ের প্রধান চিকিৎসকের কথাগুলো ঘুরেফিরে বাজতে থাকে তাঁর কানে: আমি আশাবাদী মানুষ। আমার কাজ মৃতপ্রায় মানুষে প্রাণ সঞ্চার করা। এটা আমি নিষ্ঠার সঙ্গে করি। আবার অযথা মানুষকে আমি আশার কথা শোনাই না।...তমাল সাহেব, আগামীকাল পেসেন্ট ওটিতে যাবে। ফিরবে কী অবস্থায় সেই ব্যাপারে আমার ধারণা অস্পষ্ট। আল্লাহ জানেন। মরিয়মের অচেতন ফ্যাকাশে চেহারার দিকে চেয়ে থেকে তাঁর চোখের কোণে জল জমে। তখনই ফোন বেজে ওঠে, ‘আমি বেলা। তুমি খেয়েছ? আমি ক্যাফেতে বসে আছি...আসো।’ তমাল একবার ভাবেন, না বলে দেবেন কি না? পরে বলেন, ‘আসছি।’ বেলার মুখোমুখি বসেন তমাল। বেলার সামনে খাবারের প্লেট। পাশে একটা বিদেশি জুসের ছোট বোতল।
‘তুমি কি খাবে?’
‘আমি তো সাধারণত দুপুরে খাই না।’
‘কেন?’
‘হাসপাতালে এসে অবধি আমি খেতে পারছি না। ওই যে সকালের নাশতা...। রাতে সামান্য রুটি-বিস্কিট।’
কী বলে! এ খেয়ে কি মানুষ বাঁচতে পারে?’
দেরিতে মুখ খোলে তমাল, ‘মরিয়ম গত দু-তিন মাসে দুমুঠো ভাত মুখে দেয়নি। অথচ সে ছিল ভোজনরসিক। স্কুল থেকে এসে কত-কী না করত একে একে। জ্বলন্ত চুলার গরমে দাঁড়িয়ে। আমি তাঁকে বারণ করতাম। সে অভিমানী হয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলত, ‘তোমাকে আমি যে পিতৃত্ব উপহার দিতে পারিনি...তাই বলে একটু ভালো খাবার...।’ ‘পিতৃত্ব কোনো একটা ব্যাপার হলো? আমি তো আমার ধনকুবের স্বামীকে পিতৃত্ব উপহার দিয়েছি। কিন্তু সেই উপহার যে বড় যান্ত্রিক...ভালোবাসার আশ্রয়ে হয়নি। তাই আমি ছেলে-স্বামী দুজনকেই হারিয়েছি। বাউণ্ডুলে ছেলে শফিক আমেরিকাবাসী। কিছুই করে না। বাবা আফজালের ব্যাংক-ব্যালান্স হাতিয়ে সময় কাটে তার। আর আফজাল এক সাদা চামড়ার কম বয়সী ল্যাটিনো মেয়েকে নিয়ে থাকে...। আমি থাকি সুইডেনে। একা। আফজাল একসময় এখানে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা জমিয়েছিল। মা মাঝেসাঝে যান।’ তমালকে অশান্ত-বিপন্ন দেখায়, ‘মরিয়মের এই নিমজ্জমান অবস্থা দেখে আমার মুখে খাবার রোচে না আজকাল।’ বেলা উঠে যান। খালি একটা প্লেট হাতে ফিরে আসেন। তাঁর ভরা প্লেট থেকে দু-চামচ বিরিয়ানি-মুরগি তুলে তমালকে দেন। ‘সামান্য একটু খাও...অল্পই...। আমি এত খেতে পারব না।’ তমাল তা না করতে পারেন না। হাত পেতে নেন। খাবার মুখে নিলেও তাঁকে বড় বিপন্ন-সকরুণ দেখায়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বেলা অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করার চেষ্টা করেন, ‘তোমার কত দূর কী মনে আছে জানি না...তবে আমাদের সেই নৃত্যনাট্যের ব্যাপক সফলতার পর অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। এর ওপর স্বয়ং ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার সাহেব যখন মাঝেসাঝে স্কুলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খোঁজখবর নিতেন, তখন আমাদের ক্লাসের অনেকেই হিংসাপরায়ণ হয়ে আমাদের পিছে লেগেছিল। আমার তো তাদের টিকি ধরার উপায় ছিল না। তখন সহজ শিকার হয়েছিলে তুমি।’
‘কেমন?’
‘আমারও ব্যাপারটা ধরতে সময় লেগেছিল। আমাকে তোমার লেখা প্রেমপত্র পেয়ে বান্ধবীদের নিয়ে সেদিন হেসে গড়াগড়ি গিয়েছিলাম। পোস্টে পাঠানো চিঠির ভেতর লাল গোলাপের পাপড়িও ছিল।’ ‘আমি তোমাকে লিখেছিলাম? কী বলো!’ তমাল বিস্মিত হয়ে খাওয়া থামান। ‘আমি আমার বান্ধবীদের নিয়ে তোমাকে চরম শায়েস্তা করার কথা ভাবছিলাম। ব্যাপারটা কেমন করে জানি জানাজানি হয়ে যায়। বান্ধবী আসমাকে তার বন্ধু রবিউল বলে দিয়েছিল যে চিঠিটা আসলে তমাল লেখেনি। তার নাম দিয়ে ছেলেবন্ধুরা মিলে তামাশা করার জন্য লিখেছিল।’ তমাল চিন্তামুক্ত হন, ‘তাই বলো।’ লাঞ্চের পর বেলা তমালকে তাঁদের কেবিনে নিয়ে যান। নার্স তখন তাঁর মায়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন। ‘এই যে মা, হঠাৎ করেই আমার এক কলেজের বন্ধুকে পেয়ে গেলাম।’
মা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, ‘তাই...ভালো...ভালো। তুমি গল্প করার একজন পেলে।’
‘হ্যাঁ, উনার স্ত্রী অসুস্থ। তিনিও এখানে।’ তমাল দেখেন, তাঁদের আলিশান দুই রুমের এক কেবিন। একটা গেস্টদের বসার ঘর। সোফা-কুশন, ফুল-ফলের সাজিতে সাজানো। এ ঘরে চা-কফি, কাপ-পিরিচ, ইলেকট্রিক কেটলি—সব সাজানো রয়েছে। বেলা তমালের ভাবগতি দেখে বিনম্র হওয়ার চেষ্টা করেন, ‘হসপিটালটা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কেবিনগুলোর ভাড়া বড় বেশি।’ তমাল মৃদু সমর্থন দেন, ‘তাই।’ তমাল বেলাকে নিয়ে তিনতলায় মরিয়মের কেবিনে যান। বেলা মরিয়মকে দেখে প্রায় আঁতকে ওঠেন। মরিয়ম তাঁর ফ্যাকাশে, ব্যথাকাতর, কায়ক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জমান। বেলার মনে হয়, এ রোগীর অপারেশন করে কোনো লাভ হবে না। রোগী এমনিতে মৃতপ্রায়। বেলা তমালের দিকে চান। তাঁর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া...কোনো আশার আলো নেই সেখানে। তমালের জন্য বেলার মনে নিদারুণ এক কষ্টের বোঝা দানা বাঁধতে থাকে। পরের দিন সকালে তাঁদের কেবিন থেকে ঘড়ির হিসাব ধরে বের হন বেলা। তাঁর ধারণামতে তিনি তমালকে ওটির সামনে পেয়ে যান। ততক্ষণে মরিয়ম চলে গেছেন ভেতরে। বেলাকে পেয়ে তমাল চোখের পানি ছেড়ে দেন। ‘মরিয়ম যে কিছু বলে গেল না, অজ্ঞান অবস্থায় চলে গেল।’ বেলা তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
‘যাক...চিন্তা কোরো না। সব ভালো যার শেষ ভালো। অপারেশনটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক...দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’ তমাল বেলার হাত চেপে ধরেন, ‘দোয়া করো যেন তা-ই হয়।’ বিকেল চারটার দিকে সার্জন ওটি থেকে বের হয়ে তমালকে বলে গেলেন, ‘রোগী নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে আছেন। তাঁর জ্ঞান ফেরেনি।’ তমাল চিকিৎসকের পেছন পেছন দ্রুত হেঁটে গিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বেলা যা বোঝার বুঝে নিলেন। একসময় মাকে দেখার অছিলায় সেখান থেকে কেটে পড়েন তিনি। ভোররাতের দিকে হবে হয়তো। তমাল তাঁদের কেবিনের কুশনে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। টেলিফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমি ডিউটি ডক্টর শুভ বলছি। আপনাদের রোগী মরিয়মের জ্ঞান ফেরেনি। তিনি মারা গেছেন।’ তমাল দৌড়ে ওটিতে যান। সাদা চাদর উঠিয়ে মৃত মরিয়মকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সকাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার গোছ ও সহায়তার জন্য দু-একজন নিকটাত্মীয়, বিশেষ করে তমালের ছোট ভাই হাসপাতালের ফর্মালিটিজ একে একে সারতে থাকেন। মৃতের সার্টিফিকেট, রিপোর্ট, পেমেন্ট ইত্যাদি সমাধার কাজে এগিয়ে যান। হসপিটালের ফর্মালিটিজ গুছিয়ে আনতে আনতে বেলা গড়িয়ে যায়। শেষমেশ লেনদেনের জন্য তাঁরা নার্সদের ডেস্কে যান। নার্স ইনচার্জ তাঁদের জানান, ‘নিচের তলায় অ্যাকাউন্টস সেকশনে হিসাবপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি।’ তাঁরা নিচের তলায় যান। অ্যাকাউন্টস সেকশন জানায়, ‘এই নিন আপনাদের মৃত রোগী রিলিজের ছাড়পত্র।’
‘পেমেন্ট?’
‘পেমেন্ট তো হয়ে গেছে...পাঁচ লাখ সাত হাজার টাকা।’
‘কখন...কে দিল?’
‘এক ভদ্রমহিলা তো আপনাদের হয়ে পে করে গেছেন। অনেকক্ষণ হয়।’ তমালের তাৎক্ষণিক ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তিনি দৌড়ে পাঁচতলার তিন নম্বর কেবিনে যান। তখন জানতে পারেন, বেলা ও তাঁর মা সকাল সকাল রিলিজ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। বেলার সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। দিন সাতেক পরে মরিয়মকে তাঁদের গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সযত্নে রেখে তমাল ফিরে আসেন ঢাকায়। তাঁদের বাড্ডার বাসায় তালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন সদ্য মৃত স্ত্রীর সাজানো সংসারের মাঝখানে। কত কথা, কত স্মৃতি মনে পড়ে যেতে থাকে তাঁর। একসময় হাসপাতালের শেষের দিনগুলোর দৃশ্যও একে একে এগিয়ে আসে তমালের সামনে। মনে পড়ে বেলার কথা। মনে পড়ে, তাঁর নানামুখী অন্তরঙ্গ সাহচর্য ও সাহায্যের কথাও। তখন হঠাৎ করে তাঁকে দেওয়া বেলার কার্ডটার কথাও মনে পড়ে যায়। তাঁর মানিব্যাগে পেয়েও যান সেটি। তৎক্ষণাৎ ফোন করেন বেলাকে। টেলিফোন বন্ধ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিক্ত অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন তমাল। বেলাকে নিদেনপক্ষে দুটো কৃতজ্ঞতার কথাও যে শোনাতে পারেননি তিনি। কার্ডে তিনি তাঁর ঠিকানাটা দেখেন এবং বারিধারার উদ্দেশে রওনা দেন। বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। ব্রাসের নেমপ্লেটে তাঁর নাম লেখা—ইসাবেলা। বেলার খোঁজ চাইলে কেতাদুরস্ত দারোয়ান জানান, তিনি তো বিদেশ চলে গেছেন। মাকে নিয়ে।
তমালের চোখও ছলছল করে ওঠে এ কথায়।
হাসপাতালের পাশেই গুলশান লেক। শীতের সকালে হালকা কুয়াশার আস্তরণ বিছিয়ে রাখে এলাকার যত্নে-অযত্নে বেড়ে ওঠা তাবৎ গাছগাছালি, বনজঙ্গল। এ অবস্থা বেশিক্ষণ টেকে না। সকালি সূর্যের আলোকচ্ছটা তীক্ষ্ণ তিরের ফলার মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে অস্বচ্ছ জলে উড়ে উড়ে বসে দু-চারটা বাদামি পাখার বকপাখি। ফকফকে সাদা বকও নামে কালেভদ্রে।
আজ এখানে তাঁদের তৃতীয় দিন। প্রত্যুষের এই সময়টায় মরিয়ম ঘুমান। হয়তো এ সময়টায় তাঁর ব্যথাটা একটু দম ধরে। দিন-রাতের বাকি সময় তিনি অসহনীয় ব্যথাকাতর হয়ে শুধু ছটফট করেন।
এই সামান্য ফুরসতে গায়ে গরম জামাকাপড় চড়িয়ে ডিউটি নার্সকে জানিয়ে হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে বের হন তমাল। গুলশান লেকের আঁকাবাঁকা খোলা ইট-সিমেন্টের পাড় ধরে ধরে হাঁটেন, প্রশান্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে। এইটুকুন তাঁর সামান্য ফুরসত। ঘড়ি ধরে আবার তাঁকে কেবিনে ফিরতে হয়। রোগীর কখন ঘুম ভাঙে, কখন কী দরকার হয়।
তমাল বরাবরের মতো মরিয়মের কেবিনে ফিরে যাওয়ার আগে নিচতলায় ক্যাফেটেরিয়া থেকে দ্রুত সংক্ষিপ্ত নাশতার পাট চুকিয়ে নেন। ক্যাফেটা বেশ বড়সড়। রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। মেনু-আইটেমের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। তবে এর অনেকই তাঁর অপরিচিত। তিনি চেনা তালিকার বাইরে যান না। দুটো পুরি ও এক কাপ চা-ই তাঁর জন্য সহজসাধ্য মেনু। নাশতার ট্রেটা হাতে উঁচিয়ে এগিয়ে যান তমাল। একটা সুবিধামতো জায়গা খুঁজতে গিয়ে ক্যাফের ফ্লোরটা যে উঁচুনিচু দুই স্তরে সাজানো, তা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। দু-কদম এগিয়ে তমাল ট্রে হাতে নিচু স্তরে পড়ে যাওয়ার পূর্বক্ষণে এক ভদ্রমহিলা তাঁকে জাপটে ধরে ফেলেন, ‘আরে ভাই, একটু চোখ মেলে হাঁটবেন তো! এক্ষুনি চোখেমুখে গরম চা পড়ে বার্ন ইউনিটে যেতে হতো। ভাগ্যিস, আমি ফলো করছিলাম...।’
ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেন তমাল। যথেষ্ট লজ্জিত হয়ে। এক ভদ্রমহিলা তাঁকে জাপটে ধরে রেখেছেন, ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে।
‘লজ্জিত হওয়ার কিছুই নেই। ভুল তো মানুষেরই হয়। আসুন, ধীরস্থির হয়ে বসুন।’
চেয়ার টেনে বসতে বসতে ভদ্রমহিলা মিটিমিটি হাসেন।
‘অনেক দিন পর হলেও আপনাকে চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি...আপনি তমাল ইসলাম না?’
‘হ্যাঁ।’ তাঁর চোখে-মুখে অপার বিস্ময়।
‘কিন্তু আপনি!’
‘আমি সেই কবের...। ইসাবেলা। কিন্তু সবাই আমাকে কলেজে বেলা বলে ডাকত।’ কথা শেষ না করেই উঠে যান তিনি। ফিরে আসেন এক মুঠি টিস্যু পেপার নিয়ে। ‘আপনার বাঁ হাতটা দেখি...সেখানে পেপার কাপ ছলকে যে চা পড়ে গেছে, আপনার বোধ করি খেয়াল নেই?’
বেলা টিস্যু পেপার দিয়ে তমালের বাঁ হাতটা সুন্দর করে মুছে দেন।
‘খেয়াল না থাকারই তো কথা। এমন দৈবচক্র...আকস্মিকতা...।’
‘আকস্মিকতাই তো! কত বছর আগের কথা। আমরা এক কলেজে পড়তাম। আর কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশনে আমরা শ্যামা নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ করেছিলাম। সেই অনুষ্ঠান যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিল। আপনার মনে নেই?’
‘খুব একটা মনে পড়ছে না।’
‘কেন, আপনিও তো নেচেছিলেন। পার্শ্বচরিত্রে কোটালের ভূমিকায়, আর আমি তো শ্যামার চরিত্রে...সেইটাই আমার কাল হয়েছিল। তরুণ ডিসি আফজাল সাহেবের নজরে পড়ে গেলাম। আর সেই নজর পড়ার মাশুল দিতে দিতে এত দূর...এত কাল।’
তখন হালকা হালকা কলেজজীবনের কিছু স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তমাল।
‘হ্যাঁ...তাই মনে পড়ছে, একসময় নাচের তালিম নিয়েছিলাম কিছুদিন। সেই সময় ময়মনসিংহ শহরে গান-বাজনার খুব চর্চা ছিল।’
বেলা বিনয়ী হয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন, ‘আমাদের আসল কথাটাই যে চাপা পড়ে গেছে। আমরা এখানে এসেছি বিপদে পড়ে। শখে কেউ কি হাসপাতালে আসে! তোমার কী অবস্থা?’
‘অবস্থা ভালো না। মরিয়মকে নিয়ে এসেছি। তাঁর রোগের নাকি চিকিৎসা নাই। লিভার সিরোসিস...বেচারা বড় কষ্ট পাচ্ছে।’
আঁতকে ওঠেন বেলা, ‘কী বলো! আমার অবস্থাটা অবশ্য তেমন জটিল নয়। মাকে নিয়ে এসেছি...ওল্ড অ্যাইজ কমপ্লিকেশন। এই বয়সে...।’
চা শেষ করে তমাল ঘড়ি দেখেন, ‘আমার উঠতে হয়। সকাল নয়টায় মরিয়মের সিটি স্ক্যান করার কথা।’
‘আই অ্যাম সরি। তুমি যাও। তোমার কেবিন নম্বর কত?’
‘তিনের দুই...।’
‘আমার কেবিন পাঁচতলায়। ভিআইপি-৩। আমি খবর নেব তোমার।’
তমাল তড়িঘড়ি করে উঠে যান।
মরিয়মের মুখে একেবারে রুচি নেই। তিনি কিছুই মুখে নিতে চান না। তারপর নার্সরা যথেষ্ট চেষ্টাসাধ্য করে দু-চামচ স্যুপ খাইয়ে ঘুমের বড়ি দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছেন মাত্র। এ ছাড়া দুই হাতে রয়েছে স্যালাইন, কত না ইনজেকশন। তমাল তাঁর পায়ের কাছের ডিভানে কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ আগে এ বিষয়ের প্রধান চিকিৎসকের কথাগুলো ঘুরেফিরে বাজতে থাকে তাঁর কানে: আমি আশাবাদী মানুষ। আমার কাজ মৃতপ্রায় মানুষে প্রাণ সঞ্চার করা। এটা আমি নিষ্ঠার সঙ্গে করি। আবার অযথা মানুষকে আমি আশার কথা শোনাই না।...তমাল সাহেব, আগামীকাল পেসেন্ট ওটিতে যাবে। ফিরবে কী অবস্থায় সেই ব্যাপারে আমার ধারণা অস্পষ্ট। আল্লাহ জানেন। মরিয়মের অচেতন ফ্যাকাশে চেহারার দিকে চেয়ে থেকে তাঁর চোখের কোণে জল জমে। তখনই ফোন বেজে ওঠে, ‘আমি বেলা। তুমি খেয়েছ? আমি ক্যাফেতে বসে আছি...আসো।’ তমাল একবার ভাবেন, না বলে দেবেন কি না? পরে বলেন, ‘আসছি।’ বেলার মুখোমুখি বসেন তমাল। বেলার সামনে খাবারের প্লেট। পাশে একটা বিদেশি জুসের ছোট বোতল।
‘তুমি কি খাবে?’
‘আমি তো সাধারণত দুপুরে খাই না।’
‘কেন?’
‘হাসপাতালে এসে অবধি আমি খেতে পারছি না। ওই যে সকালের নাশতা...। রাতে সামান্য রুটি-বিস্কিট।’
কী বলে! এ খেয়ে কি মানুষ বাঁচতে পারে?’
দেরিতে মুখ খোলে তমাল, ‘মরিয়ম গত দু-তিন মাসে দুমুঠো ভাত মুখে দেয়নি। অথচ সে ছিল ভোজনরসিক। স্কুল থেকে এসে কত-কী না করত একে একে। জ্বলন্ত চুলার গরমে দাঁড়িয়ে। আমি তাঁকে বারণ করতাম। সে অভিমানী হয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলত, ‘তোমাকে আমি যে পিতৃত্ব উপহার দিতে পারিনি...তাই বলে একটু ভালো খাবার...।’ ‘পিতৃত্ব কোনো একটা ব্যাপার হলো? আমি তো আমার ধনকুবের স্বামীকে পিতৃত্ব উপহার দিয়েছি। কিন্তু সেই উপহার যে বড় যান্ত্রিক...ভালোবাসার আশ্রয়ে হয়নি। তাই আমি ছেলে-স্বামী দুজনকেই হারিয়েছি। বাউণ্ডুলে ছেলে শফিক আমেরিকাবাসী। কিছুই করে না। বাবা আফজালের ব্যাংক-ব্যালান্স হাতিয়ে সময় কাটে তার। আর আফজাল এক সাদা চামড়ার কম বয়সী ল্যাটিনো মেয়েকে নিয়ে থাকে...। আমি থাকি সুইডেনে। একা। আফজাল একসময় এখানে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা জমিয়েছিল। মা মাঝেসাঝে যান।’ তমালকে অশান্ত-বিপন্ন দেখায়, ‘মরিয়মের এই নিমজ্জমান অবস্থা দেখে আমার মুখে খাবার রোচে না আজকাল।’ বেলা উঠে যান। খালি একটা প্লেট হাতে ফিরে আসেন। তাঁর ভরা প্লেট থেকে দু-চামচ বিরিয়ানি-মুরগি তুলে তমালকে দেন। ‘সামান্য একটু খাও...অল্পই...। আমি এত খেতে পারব না।’ তমাল তা না করতে পারেন না। হাত পেতে নেন। খাবার মুখে নিলেও তাঁকে বড় বিপন্ন-সকরুণ দেখায়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বেলা অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করার চেষ্টা করেন, ‘তোমার কত দূর কী মনে আছে জানি না...তবে আমাদের সেই নৃত্যনাট্যের ব্যাপক সফলতার পর অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিল। এর ওপর স্বয়ং ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার সাহেব যখন মাঝেসাঝে স্কুলের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের খোঁজখবর নিতেন, তখন আমাদের ক্লাসের অনেকেই হিংসাপরায়ণ হয়ে আমাদের পিছে লেগেছিল। আমার তো তাদের টিকি ধরার উপায় ছিল না। তখন সহজ শিকার হয়েছিলে তুমি।’
‘কেমন?’
‘আমারও ব্যাপারটা ধরতে সময় লেগেছিল। আমাকে তোমার লেখা প্রেমপত্র পেয়ে বান্ধবীদের নিয়ে সেদিন হেসে গড়াগড়ি গিয়েছিলাম। পোস্টে পাঠানো চিঠির ভেতর লাল গোলাপের পাপড়িও ছিল।’ ‘আমি তোমাকে লিখেছিলাম? কী বলো!’ তমাল বিস্মিত হয়ে খাওয়া থামান। ‘আমি আমার বান্ধবীদের নিয়ে তোমাকে চরম শায়েস্তা করার কথা ভাবছিলাম। ব্যাপারটা কেমন করে জানি জানাজানি হয়ে যায়। বান্ধবী আসমাকে তার বন্ধু রবিউল বলে দিয়েছিল যে চিঠিটা আসলে তমাল লেখেনি। তার নাম দিয়ে ছেলেবন্ধুরা মিলে তামাশা করার জন্য লিখেছিল।’ তমাল চিন্তামুক্ত হন, ‘তাই বলো।’ লাঞ্চের পর বেলা তমালকে তাঁদের কেবিনে নিয়ে যান। নার্স তখন তাঁর মায়ের চুল বেঁধে দিচ্ছিলেন। ‘এই যে মা, হঠাৎ করেই আমার এক কলেজের বন্ধুকে পেয়ে গেলাম।’
মা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন, ‘তাই...ভালো...ভালো। তুমি গল্প করার একজন পেলে।’
‘হ্যাঁ, উনার স্ত্রী অসুস্থ। তিনিও এখানে।’ তমাল দেখেন, তাঁদের আলিশান দুই রুমের এক কেবিন। একটা গেস্টদের বসার ঘর। সোফা-কুশন, ফুল-ফলের সাজিতে সাজানো। এ ঘরে চা-কফি, কাপ-পিরিচ, ইলেকট্রিক কেটলি—সব সাজানো রয়েছে। বেলা তমালের ভাবগতি দেখে বিনম্র হওয়ার চেষ্টা করেন, ‘হসপিটালটা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কেবিনগুলোর ভাড়া বড় বেশি।’ তমাল মৃদু সমর্থন দেন, ‘তাই।’ তমাল বেলাকে নিয়ে তিনতলায় মরিয়মের কেবিনে যান। বেলা মরিয়মকে দেখে প্রায় আঁতকে ওঠেন। মরিয়ম তাঁর ফ্যাকাশে, ব্যথাকাতর, কায়ক্লিষ্ট চেহারা নিয়ে গভীর ঘুমে নিমজ্জমান। বেলার মনে হয়, এ রোগীর অপারেশন করে কোনো লাভ হবে না। রোগী এমনিতে মৃতপ্রায়। বেলা তমালের দিকে চান। তাঁর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া...কোনো আশার আলো নেই সেখানে। তমালের জন্য বেলার মনে নিদারুণ এক কষ্টের বোঝা দানা বাঁধতে থাকে। পরের দিন সকালে তাঁদের কেবিন থেকে ঘড়ির হিসাব ধরে বের হন বেলা। তাঁর ধারণামতে তিনি তমালকে ওটির সামনে পেয়ে যান। ততক্ষণে মরিয়ম চলে গেছেন ভেতরে। বেলাকে পেয়ে তমাল চোখের পানি ছেড়ে দেন। ‘মরিয়ম যে কিছু বলে গেল না, অজ্ঞান অবস্থায় চলে গেল।’ বেলা তাঁকে সান্ত্বনা দেন।
‘যাক...চিন্তা কোরো না। সব ভালো যার শেষ ভালো। অপারেশনটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক...দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।’ তমাল বেলার হাত চেপে ধরেন, ‘দোয়া করো যেন তা-ই হয়।’ বিকেল চারটার দিকে সার্জন ওটি থেকে বের হয়ে তমালকে বলে গেলেন, ‘রোগী নিবিড় পরিচর্যা কক্ষে আছেন। তাঁর জ্ঞান ফেরেনি।’ তমাল চিকিৎসকের পেছন পেছন দ্রুত হেঁটে গিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বেলা যা বোঝার বুঝে নিলেন। একসময় মাকে দেখার অছিলায় সেখান থেকে কেটে পড়েন তিনি। ভোররাতের দিকে হবে হয়তো। তমাল তাঁদের কেবিনের কুশনে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলেন। টেলিফোন বেজে ওঠে। রিসিভার তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে ভারী কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘আমি ডিউটি ডক্টর শুভ বলছি। আপনাদের রোগী মরিয়মের জ্ঞান ফেরেনি। তিনি মারা গেছেন।’ তমাল দৌড়ে ওটিতে যান। সাদা চাদর উঠিয়ে মৃত মরিয়মকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। সকাল থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার গোছ ও সহায়তার জন্য দু-একজন নিকটাত্মীয়, বিশেষ করে তমালের ছোট ভাই হাসপাতালের ফর্মালিটিজ একে একে সারতে থাকেন। মৃতের সার্টিফিকেট, রিপোর্ট, পেমেন্ট ইত্যাদি সমাধার কাজে এগিয়ে যান। হসপিটালের ফর্মালিটিজ গুছিয়ে আনতে আনতে বেলা গড়িয়ে যায়। শেষমেশ লেনদেনের জন্য তাঁরা নার্সদের ডেস্কে যান। নার্স ইনচার্জ তাঁদের জানান, ‘নিচের তলায় অ্যাকাউন্টস সেকশনে হিসাবপত্র পাঠিয়ে দিয়েছি।’ তাঁরা নিচের তলায় যান। অ্যাকাউন্টস সেকশন জানায়, ‘এই নিন আপনাদের মৃত রোগী রিলিজের ছাড়পত্র।’
‘পেমেন্ট?’
‘পেমেন্ট তো হয়ে গেছে...পাঁচ লাখ সাত হাজার টাকা।’
‘কখন...কে দিল?’
‘এক ভদ্রমহিলা তো আপনাদের হয়ে পে করে গেছেন। অনেকক্ষণ হয়।’ তমালের তাৎক্ষণিক ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তিনি দৌড়ে পাঁচতলার তিন নম্বর কেবিনে যান। তখন জানতে পারেন, বেলা ও তাঁর মা সকাল সকাল রিলিজ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। বেলার সঙ্গে তাঁর আর দেখা হয়নি। দিন সাতেক পরে মরিয়মকে তাঁদের গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে সযত্নে রেখে তমাল ফিরে আসেন ঢাকায়। তাঁদের বাড্ডার বাসায় তালা খুলে দাঁড়িয়ে থাকেন সদ্য মৃত স্ত্রীর সাজানো সংসারের মাঝখানে। কত কথা, কত স্মৃতি মনে পড়ে যেতে থাকে তাঁর। একসময় হাসপাতালের শেষের দিনগুলোর দৃশ্যও একে একে এগিয়ে আসে তমালের সামনে। মনে পড়ে বেলার কথা। মনে পড়ে, তাঁর নানামুখী অন্তরঙ্গ সাহচর্য ও সাহায্যের কথাও। তখন হঠাৎ করে তাঁকে দেওয়া বেলার কার্ডটার কথাও মনে পড়ে যায়। তাঁর মানিব্যাগে পেয়েও যান সেটি। তৎক্ষণাৎ ফোন করেন বেলাকে। টেলিফোন বন্ধ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। তিক্ত অস্থিরতায় ভুগতে থাকেন তমাল। বেলাকে নিদেনপক্ষে দুটো কৃতজ্ঞতার কথাও যে শোনাতে পারেননি তিনি। কার্ডে তিনি তাঁর ঠিকানাটা দেখেন এবং বারিধারার উদ্দেশে রওনা দেন। বাড়ি খুঁজে পেতে অসুবিধা হয়নি। ব্রাসের নেমপ্লেটে তাঁর নাম লেখা—ইসাবেলা। বেলার খোঁজ চাইলে কেতাদুরস্ত দারোয়ান জানান, তিনি তো বিদেশ চলে গেছেন। মাকে নিয়ে।
No comments