বিভিন্ন আইনে বাধাগ্রস্ত দুর্নীতির তদন্ত by সাঈদ আহমেদ
প্রচলিত
কয়েকটি আইনের ধারা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি আদেশে বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে দুর্নীতির অনুসন্ধান ও তদন্ত। এগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে
নির্বাচন কমিশন, সিএজি (কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল) অফিস ও বিভিন্ন
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। সংশ্লিষ্ট আইনের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো
প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা থেকে বিরত থাকছে অথবা যথাসময় সরবরাহ করছে
না। এসব প্রতিষ্ঠানের অসহযোগিতার কারণে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই
দায়সারাগোছের অনুসন্ধান বা তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বাধ্য হচ্ছেন দুদক
কর্মকর্তারা। এতে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আদালতে প্রমাণ করা
যাচ্ছে না দুর্নীতির অভিযোগ। কৌশলে পার পেয়ে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। দুদকের
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ১৯(১)(ঘ) ধারায় পাবলিক রেকর্ড তলব করার ক্ষমতা দুদক কর্মকর্তার রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১০৯ ধারা এবং দুদক আইনের ১৯(৩) ধারায় দুদককে সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য। ২০১৩ সালে সংশোধিত ‘দুদক আইনের প্রাধান্য’ অংশে বলা হয়, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা থাকুক না কেন এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে’। সংযোজিত এ ধারার কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইনের ঊর্ধ্বে দুদককে সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য বলে মন্তব্য করেন দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ব্যাংক, সিএজি অফিসের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ ও সাক্ষ্য প্রদানে গড়িমসি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে কখনো ১৮৯১ সালের ‘ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ও ৬ (১) ধারা, ১৮৯৮ সালের ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৯৪ (১) ধারা এবং ১৮৭২ সালের ‘পাবলিক ডকুমেন্টস’ অ্যাক্টকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘কেস ইন হুইচ অফিসার অব ব্যাংক নট কম্পেলেবল টু প্রডিউস বুকস’। এ ধারা অনুযায়ী গ্রাহকের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত কোনো তথ্য ব্যাংক কর্মকর্তা সরবরাহ করতে বাধ্য নয়। একই আইনের ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইন্সপেকশন বুকস বাই অর্ডার অব কোর্ট অর জাজ’ (বিচারক বা কোর্টের আদেশে বই পরিদর্শন)। তথ্য-প্রমাণের জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আদালত কিংবা বিচারকের লিখিত আদেশ দ্বারা নির্দেশিত আইনি প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ পেতে পারেন। অর্থাৎ আদালতের পূর্বানুমোদনের বাধ্যকতা রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান পর্যায়ে ব্যাংকের কাছে তথ্য-প্রমাণ চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে মতামত চেয়ে পাঠিয়ে দেয় তাদের আইনি শাখায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা দুদককে তথ্য প্রদানের পরিবর্তে ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্সের রেফারেন্সসহ আদালত কিংবা বিচারকের লিখিত আদেশ আনার পরামর্শ দেন। ফলে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ছাড়াই ফিরে আসেন দুদক কর্মকর্তা।
আরও জানা গেছে, ২০১৩ সালে নবম জাতীয় সংসদের ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন প্রকল্পে টাইগার আইটি (বিডি) নামক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়। এ ব্যাপারে ধারাবাহিক যোগাযোগের এক পর্যায়ে গত বছর একাধিকবার ইসি সচিবালয়কে চিঠি দেন দুদকের উপপরিচালক মো. নাসিরউদ্দিন। ৩ মার্চ ইসির উপসচিব মো. সাজাহান খান পাল্টা চিঠিতে দুদককে কোনো সহযোগিতা না করে জানান, নির্বাচন কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সংবিধানের ভাবমূর্তি জড়িত। পরে ওই অনুসন্ধানটি আর এগোয়নি।
দুদকের চাহিদাকৃত তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা দুদকের চিঠি পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অভিযোগটি পর্যালোচনা করার। দুদকের চিঠির জবাবে বিষয়টি দুদককে অবহিত করেছি মাত্র। দুদকের তাগাদাপত্র হস্তগত হয়েছে। আমরা বলেছি, নিজেরাই তথ্য দেব। হয়তো সময় লাগবে।
এছাড়া পেট্রোবাংলার অধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২২১ কোটি টাকার দুর্নীতি অনুসন্ধানে ২৫ অডিটরকে গত বছরের ১২ মে তলব করে দুদক। উপপরিচালক শেখ ফাইয়াজ আলম স্বাক্ষরিত তলবি নোটিশে ওই বছর ১৮ ও ১৯ মে অডিটরদের দুদকে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু নোটিশকে উপেক্ষা করেন অডিটররা। তাদের পক্ষে ২৪ আগস্ট সিএজির পক্ষে ডেপুুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল পাল্টা চিঠি দিয়ে বলেন, অডিটররা দুদকে হাজির হলে তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বিঘœ ঘটার আশংকা রয়েছে।
ডেপুুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল ড. শ্যামল কান্তি চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট দুদক চেয়ারম্যান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সিএজিসহ অডিট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে একাটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দুদকের মামলায় বক্তব্য প্রদান ও সাক্ষ্য প্রদানে নিরীক্ষা কাজে নিয়োজিতদের জড়িত না করার বিষয়ে একমত পোষণ করে উভয়পক্ষ। সিএজি কর্মকর্তারা দুদকে হাজির হতে বাধ্য নন- এমন মন্তব্য করে ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, দুদকের তদন্তে সহায়তা প্রদানে সরকারের অধীনস্থ কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সশরীরে সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টি দুদক আইন-২০০৪ ও দুদক আইন (সংশোধনী)-২০১৩ কিংবা কোনো বিধিতেও উল্লেখ নেই। ওই চিঠির পর অডিটররা শেষ পর্যন্ত দুদকে হাজির হননি। তাদের সাক্ষ্যের অভাবে এখনও সম্পন্ন হয়নি পেট্রোবাংলার ২২১ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান।
তথ্য না দেয়া প্রসঙ্গে ড. শ্যামল কান্তি চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুদকের কার্যক্রমে আমরা সব সময়ই সহযোগিতা করে আসছি। আমরা যে চিঠি দিয়েছি সেটির জবাব এখনও পাইনি। আমরা তো রেকর্ডপত্র দিচ্ছি। কিন্তু তলব করলে আমরা যেতে পারব না। এটি হয় না। যদি সাক্ষ্য দিতে হয় তাহলে অডিটররা অডিট করবেন কিভাবে? ভীতি কাজ করবে। অডিটকে কেন সাংবিধানিক রাখা হয়েছে? যাতে ইনফ্লুয়েঞ্জ করতে না পারে। সারা বিশ্বে অডিটকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যদি অডিট বিভাগের কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকে তাহলে অফিসে এসে তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া যেতে পারে। দুদকে ডেকে নিয়ে নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, কক্সবাজারের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলার তদন্ত শুরু করে দুদক। তদন্তের এক পর্র্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি সরকারি ব্যাংকের কাছে বদির আর্থিক লেনদেনসহ কিছু রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তা দুদকের তদন্ত টিমের হাতে ধরিয়ে দেন ২০০৯ সালের ২৩ জুন জারিকৃত দুদকেরই একটি অফিস সার্কুলার। ওই সার্কুলারে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করার অনুরোধ জানানো হয়। দুদকের তৎকালীন সচিব খোন্দকার আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশটিতে বলা হয়, ১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ও ৬ (১) ধারা এবং ১৮৯৮ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সিআরপিসি বা ফৌজদারি কার্যবিধি )’র ৯৪ (১) ধারা এবং পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৪০৩, ৪০৬, ৪০৮ এবং ৪০৯, ৪২০, ৪২৪ ধারায় সংঘটিত অপরাধের অনুসন্ধানে দলিলাদি সরবরাহে আদালতের পূর্বানুমোদন নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
দুদক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, সিআরপিসির ৯৪ (২) ধারায় ‘অন্যান্য ক্ষেত্রে’ দলিলাদি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ‘অন্যান্য ক্ষেত্র’ বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক), আয়কর বিভাগের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং কোর্ট আদেশের কথা বলা হয়েছে। দুদকের কথা বলা হয়নি। ফলে আমানতকারী/হিসাবধারীর হিসাব সংক্রান্ত কোনো তথ্য দুদক পাচ্ছে না। তবে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে সিআরপিসি ৯৪ (১), (২) কোনো বাধা নয় বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নিজেদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে হয়তো দুদকের কার্যক্রমকে বিলম্বিত করতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সহযোগিতা করছেন। আর দুদক আইনকে অন্য আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে দুদকের এ কমিশনার বলেন, অফিস আদেশ কখনো আইনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। যে অফিস সার্কুলারের দোহাই দিয়ে তথ্য-প্রমাণ দেয়া হচ্ছে না সেটি বাতিল করা হয়েছে দেড়বছর আগে। তবে বাতিলকৃত আদেশটি সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দুদক সচিবের। সেটি তিনি করেছেন কিনা আমার জানা নেই।
অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের আইনি প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উদ্ভুত সংকটগুলোর এডহক ভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে পরিণামদর্শিতা, গবেষণার অভাব, আমলা নির্ভরতার ফলেই তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিবাজরাই পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এটি দূর করতে দুদক আইন আরও সংশোধন করা প্রয়োজন।
দুদক সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এর ১৯(১)(ঘ) ধারায় পাবলিক রেকর্ড তলব করার ক্ষমতা দুদক কর্মকর্তার রয়েছে। যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দণ্ডবিধির ৪০৯ এবং ১০৯ ধারা এবং দুদক আইনের ১৯(৩) ধারায় দুদককে সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য। ২০১৩ সালে সংশোধিত ‘দুদক আইনের প্রাধান্য’ অংশে বলা হয়, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা থাকুক না কেন এই আইনের বিধানাবলী প্রাধান্য পাইবে’। সংযোজিত এ ধারার কারণে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজস্ব আইনের ঊর্ধ্বে দুদককে সহযোগিতা প্রদানে বাধ্য বলে মন্তব্য করেন দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
কিন্তু নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, ব্যাংক, সিএজি অফিসের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ ও সাক্ষ্য প্রদানে গড়িমসি করছে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে কখনো ১৮৯১ সালের ‘ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ও ৬ (১) ধারা, ১৮৯৮ সালের ‘কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ৯৪ (১) ধারা এবং ১৮৭২ সালের ‘পাবলিক ডকুমেন্টস’ অ্যাক্টকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ধারায় বলা হয়েছে ‘কেস ইন হুইচ অফিসার অব ব্যাংক নট কম্পেলেবল টু প্রডিউস বুকস’। এ ধারা অনুযায়ী গ্রাহকের আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত কোনো তথ্য ব্যাংক কর্মকর্তা সরবরাহ করতে বাধ্য নয়। একই আইনের ৬(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ইন্সপেকশন বুকস বাই অর্ডার অব কোর্ট অর জাজ’ (বিচারক বা কোর্টের আদেশে বই পরিদর্শন)। তথ্য-প্রমাণের জন্য আবেদনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আদালত কিংবা বিচারকের লিখিত আদেশ দ্বারা নির্দেশিত আইনি প্রক্রিয়ায় তথ্য-প্রমাণ পেতে পারেন। অর্থাৎ আদালতের পূর্বানুমোদনের বাধ্যকতা রয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, অনুসন্ধান পর্যায়ে ব্যাংকের কাছে তথ্য-প্রমাণ চাইলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় এ বিষয়ে মতামত চেয়ে পাঠিয়ে দেয় তাদের আইনি শাখায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা দুদককে তথ্য প্রদানের পরিবর্তে ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্সের রেফারেন্সসহ আদালত কিংবা বিচারকের লিখিত আদেশ আনার পরামর্শ দেন। ফলে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা ছাড়াই ফিরে আসেন দুদক কর্মকর্তা।
আরও জানা গেছে, ২০১৩ সালে নবম জাতীয় সংসদের ভোটার আইডি কার্ড প্রণয়ন প্রকল্পে টাইগার আইটি (বিডি) নামক প্রতিষ্ঠানের অর্থ লুটের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত চাওয়া হয়। এ ব্যাপারে ধারাবাহিক যোগাযোগের এক পর্যায়ে গত বছর একাধিকবার ইসি সচিবালয়কে চিঠি দেন দুদকের উপপরিচালক মো. নাসিরউদ্দিন। ৩ মার্চ ইসির উপসচিব মো. সাজাহান খান পাল্টা চিঠিতে দুদককে কোনো সহযোগিতা না করে জানান, নির্বাচন কমিশন একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এর সঙ্গে সংবিধানের ভাবমূর্তি জড়িত। পরে ওই অনুসন্ধানটি আর এগোয়নি।
দুদকের চাহিদাকৃত তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিব সিরাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা দুদকের চিঠি পাওয়ার পরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অভিযোগটি পর্যালোচনা করার। দুদকের চিঠির জবাবে বিষয়টি দুদককে অবহিত করেছি মাত্র। দুদকের তাগাদাপত্র হস্তগত হয়েছে। আমরা বলেছি, নিজেরাই তথ্য দেব। হয়তো সময় লাগবে।
এছাড়া পেট্রোবাংলার অধীন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২২১ কোটি টাকার দুর্নীতি অনুসন্ধানে ২৫ অডিটরকে গত বছরের ১২ মে তলব করে দুদক। উপপরিচালক শেখ ফাইয়াজ আলম স্বাক্ষরিত তলবি নোটিশে ওই বছর ১৮ ও ১৯ মে অডিটরদের দুদকে হাজির হতে বলা হয়। কিন্তু নোটিশকে উপেক্ষা করেন অডিটররা। তাদের পক্ষে ২৪ আগস্ট সিএজির পক্ষে ডেপুুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল পাল্টা চিঠি দিয়ে বলেন, অডিটররা দুদকে হাজির হলে তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে বিঘœ ঘটার আশংকা রয়েছে।
ডেপুুটি কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল ড. শ্যামল কান্তি চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯ সালের ১৮ আগস্ট দুদক চেয়ারম্যান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সিএজিসহ অডিট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে একাটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় দুদকের মামলায় বক্তব্য প্রদান ও সাক্ষ্য প্রদানে নিরীক্ষা কাজে নিয়োজিতদের জড়িত না করার বিষয়ে একমত পোষণ করে উভয়পক্ষ। সিএজি কর্মকর্তারা দুদকে হাজির হতে বাধ্য নন- এমন মন্তব্য করে ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, দুদকের তদন্তে সহায়তা প্রদানে সরকারের অধীনস্থ কোনো কর্তৃপক্ষ বা সংস্থার কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সশরীরে সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়টি দুদক আইন-২০০৪ ও দুদক আইন (সংশোধনী)-২০১৩ কিংবা কোনো বিধিতেও উল্লেখ নেই। ওই চিঠির পর অডিটররা শেষ পর্যন্ত দুদকে হাজির হননি। তাদের সাক্ষ্যের অভাবে এখনও সম্পন্ন হয়নি পেট্রোবাংলার ২২১ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান।
তথ্য না দেয়া প্রসঙ্গে ড. শ্যামল কান্তি চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুদকের কার্যক্রমে আমরা সব সময়ই সহযোগিতা করে আসছি। আমরা যে চিঠি দিয়েছি সেটির জবাব এখনও পাইনি। আমরা তো রেকর্ডপত্র দিচ্ছি। কিন্তু তলব করলে আমরা যেতে পারব না। এটি হয় না। যদি সাক্ষ্য দিতে হয় তাহলে অডিটররা অডিট করবেন কিভাবে? ভীতি কাজ করবে। অডিটকে কেন সাংবিধানিক রাখা হয়েছে? যাতে ইনফ্লুয়েঞ্জ করতে না পারে। সারা বিশ্বে অডিটকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, যদি অডিট বিভাগের কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ থাকে তাহলে অফিসে এসে তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া যেতে পারে। দুদকে ডেকে নিয়ে নয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, কক্সবাজারের সরকারদলীয় এমপি আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন মামলার তদন্ত শুরু করে দুদক। তদন্তের এক পর্র্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে একটি সরকারি ব্যাংকের কাছে বদির আর্থিক লেনদেনসহ কিছু রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তা দুদকের তদন্ত টিমের হাতে ধরিয়ে দেন ২০০৯ সালের ২৩ জুন জারিকৃত দুদকেরই একটি অফিস সার্কুলার। ওই সার্কুলারে দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করার অনুরোধ জানানো হয়। দুদকের তৎকালীন সচিব খোন্দকার আসাদুজ্জামান স্বাক্ষরিত অফিস আদেশটিতে বলা হয়, ১৮৯১ সালের ব্যাংকার্স বুক এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫ ও ৬ (১) ধারা এবং ১৮৯৮ সালের কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সিআরপিসি বা ফৌজদারি কার্যবিধি )’র ৯৪ (১) ধারা এবং পেনাল কোড বা দণ্ডবিধির ৪০৩, ৪০৬, ৪০৮ এবং ৪০৯, ৪২০, ৪২৪ ধারায় সংঘটিত অপরাধের অনুসন্ধানে দলিলাদি সরবরাহে আদালতের পূর্বানুমোদন নেয়ার কথা বলা হয়েছে।
দুদক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, সিআরপিসির ৯৪ (২) ধারায় ‘অন্যান্য ক্ষেত্রে’ দলিলাদি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ‘অন্যান্য ক্ষেত্র’ বলতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক), আয়কর বিভাগের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং কোর্ট আদেশের কথা বলা হয়েছে। দুদকের কথা বলা হয়নি। ফলে আমানতকারী/হিসাবধারীর হিসাব সংক্রান্ত কোনো তথ্য দুদক পাচ্ছে না। তবে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের ক্ষেত্রে সিআরপিসি ৯৪ (১), (২) কোনো বাধা নয় বলে মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে দুদক কমিশনার সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা নিজেদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দাবি করে হয়তো দুদকের কার্যক্রমকে বিলম্বিত করতে পারেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা সহযোগিতা করছেন। আর দুদক আইনকে অন্য আইনের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে দুদকের এ কমিশনার বলেন, অফিস আদেশ কখনো আইনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। যে অফিস সার্কুলারের দোহাই দিয়ে তথ্য-প্রমাণ দেয়া হচ্ছে না সেটি বাতিল করা হয়েছে দেড়বছর আগে। তবে বাতিলকৃত আদেশটি সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দুদক সচিবের। সেটি তিনি করেছেন কিনা আমার জানা নেই।
অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদকের আইনি প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, উদ্ভুত সংকটগুলোর এডহক ভিত্তিক সমাধানের চেষ্টা, আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে পরিণামদর্শিতা, গবেষণার অভাব, আমলা নির্ভরতার ফলেই তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিবাজরাই পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এটি দূর করতে দুদক আইন আরও সংশোধন করা প্রয়োজন।
No comments