অভিজিৎ হত্যার দায়, অগণতান্ত্রিক চর্চা ও রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা by ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান
আমরা
যে কতটা অগণতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করছি, তা প্রমাণ করে আজকের এই
মুক্তচিন্তার মানুষ অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত
সন্ত্রাসী কর্তৃক অভিজিত রায় হত্যা এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে
হত্যার চেষ্টার ঘটনায় আমরা সবাই হতবাক।গোটা বিশ্ববাসী আজ বিস্মিত। দেশীয়
আন্তর্জাতিক মহলে এ ঘটনার নিন্দার ঝড় উঠেছে। পুরো দেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া
এ হত্যাকাণ্ডে আলোড়িত হয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যমও। এই হত্যাকাণ্ডকে যে যেভাবে
সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করুক না কেন, জনজীবনের নিরাপত্তা দেয়ার ব্যর্থতার
দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
কাগজে কলমে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাস্তবে কী আমরা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছি? না অন্য কোনো অসভ্য সমাজে বসবাস করছি। তা এখন বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না।
গণতন্ত্র তো হলো সেই পরিবেশ- যেখানে সব মত-বিশ্বাসের মানুষ তাদের সব চিন্তা-চেতনার কথা মুক্তভাবে প্রকাশ ও চর্চা করতে পারে। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো বই-পত্রিকা যেমন নিষিদ্ধ করা যায় না, তেমনি কোনো লেখককে হত্যা তো দূরের কথা, অপদস্থ করাও যায় না। লেখার প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করতে হয়। কিন্তু সেটা কী আমাদের দেশে হচ্ছে?
আজ মুক্তবুদ্ধির লেখক হত্যা আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। এ হত্যাকাণ্ডই প্রমাণ করে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো যে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে এবং আমরা যে ক্রমেই কতটা অসভ্য হয়ে উঠছি।
এর আগে অভিজিৎ রায়ের অনেক নাম শুনেছি, কিন্তু তাকে বা তার স্ত্রীকে কখনো দেখিনি। তার লেখাও কোনো দিন পড়িনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় বইমেলা থেকে বের হওয়ার পরই অজ্ঞাত সন্ত্রাসী কর্তৃক অভিজিত রায় হত্যা এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে। আরো বেশী উদ্বিগ্ন হয়েছি এ জন্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটলো, যেখানে সর্বদা মুক্তচিন্তার লোকদের সমাগম থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে, তখন আমাদের এতো দক্ষ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা কোথায় ছিলেন? এতো ক্ষমতাধর সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র কী করছিল!
ঘটনার পরপরই আনসার বাংলা সেভেন নামের একাউন্ট থেকে এর দায় স্বীকার করে টুইটে বলা হয়, ইসলাম বিরোধী ব্লগার মার্কিন-বাঙালি নাগরিক অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে তার ইসলাম বিরোধী অপরাধের জন্য।
অপর একটি টুইটে বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ড খোরাসান এবং শামে সম্প্রতি শহীদ আমাদের দুই ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ ( দ্য টার্গেট ওয়াজ এন আমেরিকান সিটিজেন। টু-ইন-ওয়ান। আমেরিকা রিসেন্টলি মার্টার্ড টু অফ আওয়ার ব্রাদার্স ইন খোরাসান অ্যান্ড শাম। রিভেঞ্জ। পানিশমেন্ট)।
এই সূত্র ধরেই আমাদের দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এ হত্যাকাণ্ডকে সাম্প্রদায়িক তথা ইসলামপন্থিদের ঘাড়ে চাপিয়ে বক্তব্য প্রদান করে আসছেন। এমন কী বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দাবি করেছেন- এই হত্যাকাণ্ড মান্না-খোকার টেলিসংলাপের ষড়যন্ত্রের ফসল।
তাদের এই বক্তব্য যদি সত্য বলেই ধরে নেয়া যায়, তবে আমাদের কথা হলো- মান্না-খোকার ষড়যন্ত্রের তথ্য তো দুইদিন আগেই ফাঁস হয়েছিল তবে কেন সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া গেলো না। কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা জোরদার করতে পারেনি।
আসলেই কী ব্যাপারটি সেরকম! না, আমাদের দেশে যে অগণতান্ত্রিক চর্চা চলে আসছে সেটারই ধারবাহিতা এই হত্যাকাণ্ড। মুক্ত চিন্তার মানুষের প্রাণহানির ঘটনা এটাই নতুন নয়, আগেও বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আজাদ ও ব্লগার রাজীবসহ আরো অনেককে এভাবেই জীবন দিতে হয়েছে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাতে। প্রতিটি ঘটনার পরপরই ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ইসলামপন্থিদের দায়ি করা হয়েছে।
এর ফলে আমরা কী দেখলাম- কোনো হত্যাকাণ্ডেরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অপরাধীরা থেকে গেছে ধরা ছুঁয়ার বাইরে। এবারও পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দশা একই হবে।
কেননা, হত্যাকাণ্ডের পর কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে একটি পক্ষকে দায়ি করা হয়েছে। এ ধরনের দাবি ভিকটিম পরিবারসহ বিভিন্ন মহল থেকে করতেই পারেন। কিন্তু তদন্ত ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায় কারো উপর চাপানো মানে মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করা তথা প্রকৃত জড়িতদের আড়াল করা। এতে প্রকৃত অপরাধীরা ঘটনা ঘটিয়ে অনেকটা নিরাপদেই থেকে যাচ্ছে।
ফলে এ হত্যা আমাদের সব নাগরিকের জন্যই হুমকি স্বরূপ। এর বিচার না হলে আরও যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এক দশক পেরিয়ে গেলেও হুমায়ুন আজাদের উপর বর্বর সন্ত্রাসী হামলার বিচার না হওয়ায় আজ নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন তরুণ গবেষক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়।
শুক্রবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গিয়েছিলাম বইমেলায়, অন্যান্য দিনের তুলনায় এদিন মেলার পরিবেশটা কেমন জানি শুনসান ছিল। লেখক-পাঠক-দর্শকদের মধ্যে ছিল এক ধরনের শোকাতুর ভাব। বইমেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড। মুক্তচিন্তার এ ব্লগার ও লেখককে হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার প্রতিবাদমুখর ছিল বইমেলা। সবাই এ কাপুরুষোচিত হত্যার ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছে।
দেখা গেছে, বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন লেখক-প্রকাশকরা ও পাঠকরা। শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে গিয়ে দেখলাম, কালো ডিজিটাল ব্যানারে লেখা হয়েছে- ‘কলমযোদ্ধা শহীদ অভিজিৎ রায়। আমরা তোমাকে ভুলবো না।’ এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবার এসেছে, অভিজিৎ রায় ও মীজান রহমানের যৌথ লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’। এছাড়া শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকেই বের হয়েছিল অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা’, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’-নামক বইগুলো।
আমাদের দেশে মূলত: গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার কারণে এই হত্যার সংস্কৃতি চলে আসছে। ভিন্ন মত দমন-নিপীড়নের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে যেমনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক, তেমনি ঘটনার পরপরই তদন্ত ব্যতিরেকে কোনো পক্ষের উপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। নিরপেক্ষভাবে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত জড়িতদের বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চারের আগে সব ধরনের অগণতান্ত্রিক চর্চাকে সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আশা করা যায়- রাষ্ট্রে শান্তি ফিরে আসবে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
সবশেষে বলবো- অভিজিৎ রায় যে একজন বড় মাপের মুক্তচিন্তার লেখক ছিলেন এতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। তার চিন্তা-চেতনা ও মতের সাথে আমাদের অনেকের চিন্তার অমিল থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে, এটা আবার কোন ধরনের মত। এটাকে আমি সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। এরা দেশ, জাতি ও মানবতার শত্রু। ফলে যে কোনো মূল্যে এই সন্ত্রাসবাদ রুখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। কিন্তু অভিজিৎ রায় হত্যার দুইদিন পরেও জড়িত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তাই আমাদের সবার দাবি অবিলম্বে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সমাজে সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত অভিজিৎ রায়ের শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার আশু সুস্থতা কামনা করে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের প্রত্যাশা রেখে আজ এখানেই শেষ করলাম।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
কাগজে কলমে আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। বাস্তবে কী আমরা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বসবাস করছি? না অন্য কোনো অসভ্য সমাজে বসবাস করছি। তা এখন বেশ প্রশ্নবিদ্ধ। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই কল্পনা করা যায় না।
গণতন্ত্র তো হলো সেই পরিবেশ- যেখানে সব মত-বিশ্বাসের মানুষ তাদের সব চিন্তা-চেতনার কথা মুক্তভাবে প্রকাশ ও চর্চা করতে পারে। ফলে গণতান্ত্রিক সমাজে কোনো বই-পত্রিকা যেমন নিষিদ্ধ করা যায় না, তেমনি কোনো লেখককে হত্যা তো দূরের কথা, অপদস্থ করাও যায় না। লেখার প্রতিবাদ লেখা দিয়েই করতে হয়। কিন্তু সেটা কী আমাদের দেশে হচ্ছে?
আজ মুক্তবুদ্ধির লেখক হত্যা আমাদের রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। এটা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অশনিসংকেত। এ হত্যাকাণ্ডই প্রমাণ করে আমাদের রাষ্ট্র কাঠামো যে ক্রমেই ভেঙে পড়ছে এবং আমরা যে ক্রমেই কতটা অসভ্য হয়ে উঠছি।
এর আগে অভিজিৎ রায়ের অনেক নাম শুনেছি, কিন্তু তাকে বা তার স্ত্রীকে কখনো দেখিনি। তার লেখাও কোনো দিন পড়িনি। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় বইমেলা থেকে বের হওয়ার পরই অজ্ঞাত সন্ত্রাসী কর্তৃক অভিজিত রায় হত্যা এবং তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে। আরো বেশী উদ্বিগ্ন হয়েছি এ জন্য যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটলো, যেখানে সর্বদা মুক্তচিন্তার লোকদের সমাগম থাকে। মনে প্রশ্ন জাগে, তখন আমাদের এতো দক্ষ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা কোথায় ছিলেন? এতো ক্ষমতাধর সরকারের রাষ্ট্রযন্ত্র কী করছিল!
ঘটনার পরপরই আনসার বাংলা সেভেন নামের একাউন্ট থেকে এর দায় স্বীকার করে টুইটে বলা হয়, ইসলাম বিরোধী ব্লগার মার্কিন-বাঙালি নাগরিক অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে তার ইসলাম বিরোধী অপরাধের জন্য।
অপর একটি টুইটে বলা হয়, এই হত্যাকাণ্ড খোরাসান এবং শামে সম্প্রতি শহীদ আমাদের দুই ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ ( দ্য টার্গেট ওয়াজ এন আমেরিকান সিটিজেন। টু-ইন-ওয়ান। আমেরিকা রিসেন্টলি মার্টার্ড টু অফ আওয়ার ব্রাদার্স ইন খোরাসান অ্যান্ড শাম। রিভেঞ্জ। পানিশমেন্ট)।
এই সূত্র ধরেই আমাদের দেশের বিভিন্ন সংগঠন ও বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ এ হত্যাকাণ্ডকে সাম্প্রদায়িক তথা ইসলামপন্থিদের ঘাড়ে চাপিয়ে বক্তব্য প্রদান করে আসছেন। এমন কী বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম দাবি করেছেন- এই হত্যাকাণ্ড মান্না-খোকার টেলিসংলাপের ষড়যন্ত্রের ফসল।
তাদের এই বক্তব্য যদি সত্য বলেই ধরে নেয়া যায়, তবে আমাদের কথা হলো- মান্না-খোকার ষড়যন্ত্রের তথ্য তো দুইদিন আগেই ফাঁস হয়েছিল তবে কেন সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া গেলো না। কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা জোরদার করতে পারেনি।
আসলেই কী ব্যাপারটি সেরকম! না, আমাদের দেশে যে অগণতান্ত্রিক চর্চা চলে আসছে সেটারই ধারবাহিতা এই হত্যাকাণ্ড। মুক্ত চিন্তার মানুষের প্রাণহানির ঘটনা এটাই নতুন নয়, আগেও বিশিষ্ট লেখক হুমায়ুন আজাদ ও ব্লগার রাজীবসহ আরো অনেককে এভাবেই জীবন দিতে হয়েছে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীদের হাতে। প্রতিটি ঘটনার পরপরই ঢালাওভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও ইসলামপন্থিদের দায়ি করা হয়েছে।
এর ফলে আমরা কী দেখলাম- কোনো হত্যাকাণ্ডেরই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অপরাধীরা থেকে গেছে ধরা ছুঁয়ার বাইরে। এবারও পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দশা একই হবে।
কেননা, হত্যাকাণ্ডের পর কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই ঢালাওভাবে একটি পক্ষকে দায়ি করা হয়েছে। এ ধরনের দাবি ভিকটিম পরিবারসহ বিভিন্ন মহল থেকে করতেই পারেন। কিন্তু তদন্ত ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায় কারো উপর চাপানো মানে মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করা তথা প্রকৃত জড়িতদের আড়াল করা। এতে প্রকৃত অপরাধীরা ঘটনা ঘটিয়ে অনেকটা নিরাপদেই থেকে যাচ্ছে।
ফলে এ হত্যা আমাদের সব নাগরিকের জন্যই হুমকি স্বরূপ। এর বিচার না হলে আরও যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এক দশক পেরিয়ে গেলেও হুমায়ুন আজাদের উপর বর্বর সন্ত্রাসী হামলার বিচার না হওয়ায় আজ নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন তরুণ গবেষক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়।
শুক্রবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গিয়েছিলাম বইমেলায়, অন্যান্য দিনের তুলনায় এদিন মেলার পরিবেশটা কেমন জানি শুনসান ছিল। লেখক-পাঠক-দর্শকদের মধ্যে ছিল এক ধরনের শোকাতুর ভাব। বইমেলায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড। মুক্তচিন্তার এ ব্লগার ও লেখককে হত্যার প্রতিবাদে শুক্রবার প্রতিবাদমুখর ছিল বইমেলা। সবাই এ কাপুরুষোচিত হত্যার ঘটনার নিন্দা ও ধিক্কার জানিয়েছে।
দেখা গেছে, বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করেছেন লেখক-প্রকাশকরা ও পাঠকরা। শুদ্ধস্বরের স্টলের সামনে গিয়ে দেখলাম, কালো ডিজিটাল ব্যানারে লেখা হয়েছে- ‘কলমযোদ্ধা শহীদ অভিজিৎ রায়। আমরা তোমাকে ভুলবো না।’ এ প্রকাশনা সংস্থা থেকে এবার এসেছে, অভিজিৎ রায় ও মীজান রহমানের যৌথ লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’। এছাড়া শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকেই বের হয়েছিল অভিজিৎ রায়ের ‘সমকামিতা’, ‘অবিশ্বাসের দর্শন’, ‘ভালোবাসা কারে কয়’-নামক বইগুলো।
আমাদের দেশে মূলত: গণতান্ত্রিক পরিবেশ না থাকার কারণে এই হত্যার সংস্কৃতি চলে আসছে। ভিন্ন মত দমন-নিপীড়নের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে উৎসাহিত করছে। ফলে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে যেমনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতান্ত্রিক চর্চা আবশ্যক, তেমনি ঘটনার পরপরই তদন্ত ব্যতিরেকে কোনো পক্ষের উপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। নিরপেক্ষভাবে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রকৃত জড়িতদের বের করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক তৎপরতার বিরুদ্ধে সোচ্চারের আগে সব ধরনের অগণতান্ত্রিক চর্চাকে সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তবেই আশা করা যায়- রাষ্ট্রে শান্তি ফিরে আসবে এবং মুক্তবুদ্ধি চর্চার পরিবেশ নিশ্চিত হবে।
সবশেষে বলবো- অভিজিৎ রায় যে একজন বড় মাপের মুক্তচিন্তার লেখক ছিলেন এতে কারো কোনো সন্দেহ নেই। তার চিন্তা-চেতনা ও মতের সাথে আমাদের অনেকের চিন্তার অমিল থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে, এটা আবার কোন ধরনের মত। এটাকে আমি সন্ত্রাসবাদ ছাড়া আর কিছুই মনে করি না। এরা দেশ, জাতি ও মানবতার শত্রু। ফলে যে কোনো মূল্যে এই সন্ত্রাসবাদ রুখতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। কিন্তু অভিজিৎ রায় হত্যার দুইদিন পরেও জড়িত কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। তাই আমাদের সবার দাবি অবিলম্বে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।
একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য সমাজে সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে নিহত অভিজিৎ রায়ের শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার আশু সুস্থতা কামনা করে এবং এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের প্রত্যাশা রেখে আজ এখানেই শেষ করলাম।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com
No comments