নিরপেক্ষ তদন্ত হলে ক্ষতি কী? by আবদুল লতিফ মন্ডল
জাতিসংঘের
তত্ত্বাবধানে সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা এবং
পেট্রলবোমাবাজিসহ সব নাশকতার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি জানিয়েছে
সরকারবিরোধী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। গত ২০ ফেব্র“য়ারি জোটের পক্ষে
এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এ দাবি জানান। তিনি
বলেছেন, ২০ দলীয় জোট গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছে, সরকারপ্রধান এবং
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা অবিরাম মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে গণতান্ত্রিক
আন্দোলনকে নাশকতা ও জঙ্গিরূপে উপস্থাপনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০ দলীয়
জোট ইতিপূর্বে অনেকবার এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। সরকারদলীয়
লোকজন এবং এজেন্টরা সুপরিকল্পিতভাবে এসব পেট্রলবোমাবাজিসহ অন্যান্য নাশকতায়
ধরা পড়লেও তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে (যুগান্তর, ২০ ফেব্র“য়ারি)।
একতরফাভাবে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট অবসানে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে দ্রুত আলোচনার দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ৫ জানুয়ারি শুরু করা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এবং অবরোধকে বেগবান করতে ডাকা ঘন ঘন হরতাল কর্মসূচিতে এ যাবৎ কতজন মানুষ নিহত হয়েছেন, কী পরিমাণ সম্পদ, বিশেষ করে যানবাহন নষ্ট হয়েছে তার সঠিক তথ্য এ মুহূর্তে পাওয়া কষ্টকর। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অবরোধের ৪০ দিনে অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮৯ এবং এর মধ্যে পেট্রলবোমায় ৫২, ক্রসফায়ারে ২০, সংঘর্ষে ১৩ ও পুলিশের গুলিতে ৪। তাছাড়া পেট্রলবোমায় আহত প্রায় দুশ ব্যক্তি হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। পেট্রলবোমায় নিহত ও আহতদের সিংহভাগ বাসযাত্রী ও পরিবহন শ্রমিক। প্রায় ১২০০ যানবাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও ৫ হাজার বাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। রেলে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ১২টি।
এতগুলো মানুষের জীবনহানি ও পঙ্গুত্ব এবং বিপুলসংখ্যক যানবাহন বিনষ্টের জন্য আসলে কারা দায়ী তা নিয়ে একটি ঘোলাটে অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ ও নাশকতার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে দায়ী করে তাদের জঙ্গিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৯ ফেব্র“য়ারি মন্ত্রিসভার অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পেট্রলবোমা ও নাশকতায় এতগুলো মানুষের প্রাণহানির দায়-দায়িত্ব বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে নিতে হবে। তিনি এই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ১২ ফেব্র“য়ারি সফিপুরে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। তারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে। মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে অভিহিত করেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের রেশ ধরে সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা বিএনপি জোটের, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার সমালোচনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি চলমান অবরোধ বা হরতালে সংঘটিত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে এসবের দায়ভার সরকারের ওপর চাপাচ্ছে। গত ৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক; কিন্তু তাদের আন্দোলন চলাকালে যাত্রীবাহী ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন নাগরিকের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তারা মানুষের জীবন নিয়ে অপরাজনীতি করেন না। হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন হীন ও নৃশংস অপরাজনীতি তারা কখনও করবেন না। তিনি এ ধরনের নৃশংস অপরাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ক্ষমতাসীন দল অতীতে বিরোধী দলে থাকাকালে আন্দোলনের নামে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারার, রেলস্টেশন পুড়িয়ে দেয়ার, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়ার যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় নিরপরাধ মানুষকে নৃশংস পন্থায় হত্যা করে তার দায়ভার বিরোধী পক্ষের ওপর চাপিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে অপপ্রচার ও বিরোধী দলকে সেই সুযোগে দমন করার চেষ্টা করছে। এর আগে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে বিএনপির জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চলাকালে যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিয়ে যখন সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পরস্পরবিরোধী দাবি উঠেছে, তখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে আইনের আওতায় আনার পক্ষে মত দেন প্রধানমন্ত্রী। ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে এই মত প্রকাশ করেন। এর দুদিন পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করা শুরু করে। খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে পুলিশ তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানা ও চৌদ্দগ্রাম থানায় ২টি করে মামলা করেছে। খালেদা জিয়া ছাড়াও এসব মামলায় বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যান্য দলের প্রায় ১০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পঞ্চগড় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং গুলশান থানায় মামলা করেছেন যথাক্রমে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক।
অবরোধ-হরতাল চলাকালে যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপসহ নাশকতামূলক কার্যকলাপের দায়ভার নিয়ে সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পরস্পরবিরোধী দাবি জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তারা জানতে চান, আসলে কারা এসব কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। একটি সাপ্তাহিকীতে লেখা হয়েছে, বিএনপি বলছে, অবরোধ-হরতালে সংঘটিত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দায় তাদের নয়, সব দায় সরকারের। এদিকে সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা শুধু বলেই যাচ্ছেন, বিএনপি সন্ত্রাস করছে। কিন্তু সন্ত্রাস বা পেট্রলবোমাবাজদের ধরা বা শাস্তি বা প্রকৃত বোমাবাজদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও অনেকের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে তাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে, তারা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী-ভাড়াটে, তবে এই স্বীকারোক্তি কতটা স্থায়ী সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে (সাপ্তাহিক, ১৯ ফেব্রুয়ারি)।
চলমান অবরোধ-হরতালে নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির দায়ভার নিয়ে বিরাজমান ঘোলাটে অবস্থার ইতি টানা দরকার। জনগণের অধিকার আছে প্রকৃত সত্য জানার। একটি নিরপেক্ষ তদন্ত এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে। বিষয়টি তদন্তের জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত দুজন বিচারপতিকে এ কমিটির সদস্য করা যেতে পারে। এ কমিটির রিপোর্টে যাদের এসব কার্যকলাপের পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে দলের/জোটের স্বার্থ হাসিলের জন্য ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট এ ধরনের জঘন্য কার্যকলাপের আশ্রয় না নেয়।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
একতরফাভাবে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট অবসানে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে দ্রুত আলোচনার দাবিতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ৫ জানুয়ারি শুরু করা অনির্দিষ্টকালের অবরোধ এবং অবরোধকে বেগবান করতে ডাকা ঘন ঘন হরতাল কর্মসূচিতে এ যাবৎ কতজন মানুষ নিহত হয়েছেন, কী পরিমাণ সম্পদ, বিশেষ করে যানবাহন নষ্ট হয়েছে তার সঠিক তথ্য এ মুহূর্তে পাওয়া কষ্টকর। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, অবরোধের ৪০ দিনে অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৮৯ এবং এর মধ্যে পেট্রলবোমায় ৫২, ক্রসফায়ারে ২০, সংঘর্ষে ১৩ ও পুলিশের গুলিতে ৪। তাছাড়া পেট্রলবোমায় আহত প্রায় দুশ ব্যক্তি হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। পেট্রলবোমায় নিহত ও আহতদের সিংহভাগ বাসযাত্রী ও পরিবহন শ্রমিক। প্রায় ১২০০ যানবাহন পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ও ৫ হাজার বাহন ভাঙচুর করা হয়েছে। রেলে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে ১২টি।
এতগুলো মানুষের জীবনহানি ও পঙ্গুত্ব এবং বিপুলসংখ্যক যানবাহন বিনষ্টের জন্য আসলে কারা দায়ী তা নিয়ে একটি ঘোলাটে অবস্থা বিরাজ করছে। সরকার যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ ও নাশকতার জন্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে দায়ী করে তাদের জঙ্গিবাদী হিসেবে চিহ্নিত করছে। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ৯ ফেব্র“য়ারি মন্ত্রিসভার অনির্ধারিত আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, পেট্রলবোমা ও নাশকতায় এতগুলো মানুষের প্রাণহানির দায়-দায়িত্ব বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে নিতে হবে। তিনি এই দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তাকেই হত্যাকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ১২ ফেব্র“য়ারি সফিপুরে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। তারা পেট্রলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করছে। মুখের গ্রাস কেড়ে নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বিএনপি-জামায়াতের কর্মকাণ্ডকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে অভিহিত করেন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের রেশ ধরে সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা বিএনপি জোটের, বিশেষ করে খালেদা জিয়ার সমালোচনা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিএনপি চলমান অবরোধ বা হরতালে সংঘটিত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে এসবের দায়ভার সরকারের ওপর চাপাচ্ছে। গত ৫ ফেব্র“য়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ২০ দলীয় জোটের আন্দোলন সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক; কিন্তু তাদের আন্দোলন চলাকালে যাত্রীবাহী ও অন্যান্য যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন নাগরিকের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তারা মানুষের জীবন নিয়ে অপরাজনীতি করেন না। হত্যা ও লাশের রাজনীতির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এমন হীন ও নৃশংস অপরাজনীতি তারা কখনও করবেন না। তিনি এ ধরনের নৃশংস অপরাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ক্ষমতাসীন দল অতীতে বিরোধী দলে থাকাকালে আন্দোলনের নামে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারার, রেলস্টেশন পুড়িয়ে দেয়ার, কর্তব্যরত পুলিশ অফিসারের মাথা ইট দিয়ে থেঁতলে দেয়ার যে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে, তারই ধারাবাহিকতায় নিরপরাধ মানুষকে নৃশংস পন্থায় হত্যা করে তার দায়ভার বিরোধী পক্ষের ওপর চাপিয়ে আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রচারমাধ্যমে অপপ্রচার ও বিরোধী দলকে সেই সুযোগে দমন করার চেষ্টা করছে। এর আগে বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে বিএনপির জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চলাকালে যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায়ভার নিয়ে যখন সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পরস্পরবিরোধী দাবি উঠেছে, তখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে আইনের আওতায় আনার পক্ষে মত দেন প্রধানমন্ত্রী। ২১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে এই মত প্রকাশ করেন। এর দুদিন পর খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করা শুরু করে। খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে পুলিশ তার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ী থানা ও চৌদ্দগ্রাম থানায় ২টি করে মামলা করেছে। খালেদা জিয়া ছাড়াও এসব মামলায় বিএনপি ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যান্য দলের প্রায় ১০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পঞ্চগড় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এবং গুলশান থানায় মামলা করেছেন যথাক্রমে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক।
অবরোধ-হরতাল চলাকালে যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপসহ নাশকতামূলক কার্যকলাপের দায়ভার নিয়ে সরকার ও সরকারবিরোধী জোটের পরস্পরবিরোধী দাবি জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। তারা জানতে চান, আসলে কারা এসব কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত। একটি সাপ্তাহিকীতে লেখা হয়েছে, বিএনপি বলছে, অবরোধ-হরতালে সংঘটিত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দায় তাদের নয়, সব দায় সরকারের। এদিকে সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা শুধু বলেই যাচ্ছেন, বিএনপি সন্ত্রাস করছে। কিন্তু সন্ত্রাস বা পেট্রলবোমাবাজদের ধরা বা শাস্তি বা প্রকৃত বোমাবাজদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তৎপরতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। যদিও অনেকের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করে তাদের দিয়ে বলানো হচ্ছে, তারা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী-ভাড়াটে, তবে এই স্বীকারোক্তি কতটা স্থায়ী সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে (সাপ্তাহিক, ১৯ ফেব্রুয়ারি)।
চলমান অবরোধ-হরতালে নাশকতামূলক কার্যকলাপ এবং অনেক নিরীহ মানুষের প্রাণহানির দায়ভার নিয়ে বিরাজমান ঘোলাটে অবস্থার ইতি টানা দরকার। জনগণের অধিকার আছে প্রকৃত সত্য জানার। একটি নিরপেক্ষ তদন্ত এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে। বিষয়টি তদন্তের জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হতে পারে। হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত দুজন বিচারপতিকে এ কমিটির সদস্য করা যেতে পারে। এ কমিটির রিপোর্টে যাদের এসব কার্যকলাপের পরিকল্পনাকারী, নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে, তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে দলের/জোটের স্বার্থ হাসিলের জন্য ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট এ ধরনের জঘন্য কার্যকলাপের আশ্রয় না নেয়।
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com
No comments