কী অপরাধ আমাদের? by মনজু আরা বেগম
দেড়
মাসেরও বেশি সময় ধরে চলছে বিরোধী জোটের হরতাল-অবরোধের রাজনীতি। এ সময়ের
মধ্যে এমন একটি দিন নেই যেদিন আগুনে পুড়ে কিংবা দগ্ধ হয়ে গরিব-নিরীহ সাধারণ
মানুষসহ সবস্তরের মানুষ পুড়ছে না বা মরছে না সেই সঙ্গে যানবাহন ও বিভিন্ন
ধরনের পণ্যসহ দেশের সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে না। এ পর্যন্ত সারা দেশে পেট্রলবোমা
এবং আগুনে পুড়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৬। সংঘর্ষ, রেলে নাশকতা ও অন্যান্য
ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। যানবাহনে আগুন ও ভাংচুরের সংখ্যা ১
হাজার ১৬৬। এক মাসে অর্থনীতির ক্ষতি দাঁড়িয়েছে জিডিপির ৫ শতাংশ। ঢাকা
মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে ভর্তির সংখ্যা ১৩০। জনগণই ক্ষমতার উৎস অথচ সেই
জনগণ, সেই সাধারণ মানুষের স্বার্থ, জীবনের নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনীতির
কথা তারা ভাবছেন না। আমরা এমন একটি স্বাধীন দেশে বাস করছি যেখানে জীবনের
কোনো নিরাপত্তা নেই। নেই কোনো নিশ্চয়তা। প্রতিটি মুহূর্ত আতংকে আমাদের সময়
কাটছে। রাস্তায় বের হতে ভয় পাচ্ছি। পেট্রলবোমার আঘাতে পুড়ে যাওয়া মানুষের
বীভৎস ও সহিংস রূপ দেখে আতংকে ঘুম ভেঙে যায়।
মানুষকে মানুষ এভাবে পুড়িয়ে মারতে পারে কল্পনাও করা যায় না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দগ্ধ মানুষের ভয়াবহ রূপ দেখে কষ্টে, যন্ত্রণায়, রাগে, দুঃখে ক্ষোভে ইচ্ছে করে মানবতাবর্জিত পাষণ্ড মানুষ নামের পশুগুলো থেকে দূরে অন্য কোথাও চলে যাই। অসহায় দগ্ধ মানুষগুলোকে দেখতে একদিন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলাম। সহ্য করতে পারিনি। এদের হাত থেকে নারী-শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না। দূর থেকে দেখে চলে এসেছি। চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছি তাদের সুস্থতার জন্য। আর প্রার্থনা করছি সেসব পাষণ্ড, পিশাচ নরখেকোদের আল্লাহ যেন সুমতি দেন। তাদের দিলে রহমত দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহিংসতাকেও যেন তারা হার মানাচ্ছে। মানুষের আর্তচিৎকার তাদের কানে পৌঁছে না।
নিরীহ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারার এ জঘন্য রাজনীতি আর কতদিন আমাদের দেখতে হবে কিংবা সহ্য করতে হবে? যাত্রীবাহী-পণ্যবাহী যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে দেশের মানুষ এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এ অপরাজনীতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সহিংস রাজনীতির এ অস্ত্রটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে রাজনীতির নামে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পোড়ানোর কথা শোনা যায়নি। আমরা জানি রাজনীতিকরা জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন। জনগণের জন্যই যদি রাজনীতি করেন তাহলে সেই সাধারণ নিরীহ জনগণকে পুড়িয়ে মারছেন কেন? দেশের সম্পদ ধ্বংস করছেন কেন? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে তো দাবি-দাওয়া আদায় করা যায় না। জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে তো আপনারা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছেন। দেশটা তো কারও একক সম্পত্তি নয়। আমরা সাধারণ মানুষ যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য মিথ্যার বেসাতি করি না, তাদের মারার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? রাজনীতির নামে ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য আমাদের আপনাদের রাজনীতির বলিরপাঁঠা বানাবেন, তা তো হতে পারে না।
এদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ রাজনীতি বোঝে না বা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা দেখতে চায় চাল, ডাল, তেল নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য তাদের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে আছে কিনা। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো পেট পুরে খেয়ে শান্তিতে নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে চায়। তারা দেশে-বিদেশে গাড়ি-বাড়ি করার, মার্সিডিস কিংবা বিএমডব্লিউডি গাড়িতে চড়ার কিংবা বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে না। তারা অন্যের সম্পদ কেড়ে নেয়ারও চিন্তা করে না। তাদের চাওয়া-পাওয়া সামান্য। অল্পতেই তারা তুষ্ট। আমাদের দেশটা অপার সম্ভাবনার দেশ। অমিত সম্ভাবনার এ দেশটাকে নিয়ে আপনারা দয়া করে ছিনিমিনি খেলবেন না।
গত এক বছর ধরে বিশ্বের সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা এসেছে তা ধরে রাখতে পারলে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো মাত্র সময়ের ব্যাপার ছিল। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। রেমিটেন্স প্রবাহের প্রশংসনীয় ও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও ৬.১২ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৪ ডলার থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হয়েছে ১১৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এভাবে একটানা হরতাল-অবরোধ চলতে থাকা সত্ত্বেও রফতানি আয় বৃদ্ধির খবর নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশের পণ্য রফতানি আয় গত বছরের এ সময়ের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি হয়েছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে খুব বেশি দেরি হবে না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাব অনুযায়ী একদিনের হরতাল-অবরোধে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। দেশের এ ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও তাতে কেউই কর্ণপাত করছেন না।
অবস্থাদৃষ্টে সেই প্রবাদ বাক্যের কথা মনে হচ্ছে- কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো। দয়া করে নিুআয়ের সাধারণ মানুষদের কষ্টের কথা একবার ভাবুন। একদিকে তাদের আয়-রোজগারের পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কাজেই আর দেরি না করে এ অপরাজনীতির হাত থেকে দেশের মানুষ এবং সম্পদকে রক্ষা করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অবিলম্বে এগিয়ে আসবেন এটাই আমাদের এখন একমাত্র চাওয়া।
মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক
monjuara2006@yahoo.com
মানুষকে মানুষ এভাবে পুড়িয়ে মারতে পারে কল্পনাও করা যায় না। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দগ্ধ মানুষের ভয়াবহ রূপ দেখে কষ্টে, যন্ত্রণায়, রাগে, দুঃখে ক্ষোভে ইচ্ছে করে মানবতাবর্জিত পাষণ্ড মানুষ নামের পশুগুলো থেকে দূরে অন্য কোথাও চলে যাই। অসহায় দগ্ধ মানুষগুলোকে দেখতে একদিন ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে গিয়েছিলাম। সহ্য করতে পারিনি। এদের হাত থেকে নারী-শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না। দূর থেকে দেখে চলে এসেছি। চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। মহান আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করেছি তাদের সুস্থতার জন্য। আর প্রার্থনা করছি সেসব পাষণ্ড, পিশাচ নরখেকোদের আল্লাহ যেন সুমতি দেন। তাদের দিলে রহমত দেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহিংসতাকেও যেন তারা হার মানাচ্ছে। মানুষের আর্তচিৎকার তাদের কানে পৌঁছে না।
নিরীহ-নিরপরাধ সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে মারার এ জঘন্য রাজনীতি আর কতদিন আমাদের দেখতে হবে কিংবা সহ্য করতে হবে? যাত্রীবাহী-পণ্যবাহী যানবাহনে পেট্রলবোমা মেরে দেশের মানুষ এবং অর্থনীতিকে ধ্বংস করার এ অপরাজনীতি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সহিংস রাজনীতির এ অস্ত্রটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে রাজনীতির নামে পেট্রলবোমা মেরে মানুষ পোড়ানোর কথা শোনা যায়নি। আমরা জানি রাজনীতিকরা জনগণের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করেন। জনগণের জন্যই যদি রাজনীতি করেন তাহলে সেই সাধারণ নিরীহ জনগণকে পুড়িয়ে মারছেন কেন? দেশের সম্পদ ধ্বংস করছেন কেন? সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে তো দাবি-দাওয়া আদায় করা যায় না। জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলে তো আপনারা নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই করছেন। দেশটা তো কারও একক সম্পত্তি নয়। আমরা সাধারণ মানুষ যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই, যারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতায় থাকার জন্য মিথ্যার বেসাতি করি না, তাদের মারার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? রাজনীতির নামে ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য আমাদের আপনাদের রাজনীতির বলিরপাঁঠা বানাবেন, তা তো হতে পারে না।
এদেশের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ রাজনীতি বোঝে না বা রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা দেখতে চায় চাল, ডাল, তেল নুনসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য তাদের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে আছে কিনা। তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুবেলা দুমুঠো পেট পুরে খেয়ে শান্তিতে নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে চায়। তারা দেশে-বিদেশে গাড়ি-বাড়ি করার, মার্সিডিস কিংবা বিএমডব্লিউডি গাড়িতে চড়ার কিংবা বিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে না। তারা অন্যের সম্পদ কেড়ে নেয়ারও চিন্তা করে না। তাদের চাওয়া-পাওয়া সামান্য। অল্পতেই তারা তুষ্ট। আমাদের দেশটা অপার সম্ভাবনার দেশ। অমিত সম্ভাবনার এ দেশটাকে নিয়ে আপনারা দয়া করে ছিনিমিনি খেলবেন না।
গত এক বছর ধরে বিশ্বের সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য। গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা এসেছে তা ধরে রাখতে পারলে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো মাত্র সময়ের ব্যাপার ছিল। খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। রফতানিমুখী পোশাক শিল্পের দ্রুত বিকাশ ঘটেছে। রেমিটেন্স প্রবাহের প্রশংসনীয় ও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকা সত্ত্বেও ৬.১২ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৪ ডলার থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে হয়েছে ১১৯০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। এভাবে একটানা হরতাল-অবরোধ চলতে থাকা সত্ত্বেও রফতানি আয় বৃদ্ধির খবর নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশের পণ্য রফতানি আয় গত বছরের এ সময়ের চেয়ে দুই শতাংশ বেশি হয়েছে। বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছতে খুব বেশি দেরি হবে না। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির হিসাব অনুযায়ী একদিনের হরতাল-অবরোধে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। দেশের এ ক্ষতি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হলেও তাতে কেউই কর্ণপাত করছেন না।
অবস্থাদৃষ্টে সেই প্রবাদ বাক্যের কথা মনে হচ্ছে- কানে দিয়েছি তুলো, পিঠে বেঁধেছি কুলো। দয়া করে নিুআয়ের সাধারণ মানুষদের কষ্টের কথা একবার ভাবুন। একদিকে তাদের আয়-রোজগারের পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে আসছে, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কাজেই আর দেরি না করে এ অপরাজনীতির হাত থেকে দেশের মানুষ এবং সম্পদকে রক্ষা করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষ অবিলম্বে এগিয়ে আসবেন এটাই আমাদের এখন একমাত্র চাওয়া।
মনজু আরা বেগম : লেখক ও গবেষক
monjuara2006@yahoo.com
No comments