ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বনাম তারুণ্যের মানবতা by এ কে এম শাহনাওয়াজ
রাজতন্ত্রের
যুগে জনগণ পরিচিত ছিল প্রজা বলে। সে সময় অধিকার নিয়ে প্রজার নিরর্থক কোনো
মাথাব্যথা ছিল না। রাজ্য বা সাম্রাজ্যের মালিক ছিলেন রাজা বা সম্রাট। রাজার
ইচ্ছায় রাজ্য চলত। ভালো রাজা সুশাসন পরিচালনা করতেন। প্রজাদরদি হতেন।
প্রজাদেরও অমন রাজার রাজত্বে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অভাব ছিল না। আবার
অত্যাচারী রাজাও ছিলেন। অমন রাজার অধীনে জীবন দুঃসহ হয়ে উঠত প্রজা
সাধারণের। তবে অকারণে সিংহাসনের দিকে কারও নজর ছিল না। বংশপরম্পরায়
রাজপরিবার শাসন করত। মাঝে মধ্যে অন্য রাজ্যের আক্রমণে পরাস্ত হলে সিংহাসন
চলে যেত বিদেশী শাসকদের হাতে। তবে বংশ আর মর্যাদাক্রমে রাজরাজড়াদের মধ্যেই
সিংহাসন আবর্তিত হতো। সিংহাসন নিয়ে সেখানেও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ঘটনা ঘটত।
রক্ত ঝরত। এসব ঝড়-ঝাপটা পোহাতেন সিংহাসনের সুবিধাভোগীরাই। প্রজার গায়ে
এসবের আঁচ তেমন লাগত না। একইভাবে ভালো-মন্দে প্রজারা জীবন নির্বাহ করত।
আধুনিক যুগে রাজতন্ত্র কার্যকরভাবে বহাল নেই। প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী নানা নামে রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন প্রতিষ্ঠিত। বলা হয়, এখন আর কেউ প্রজা নয়। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। জনগণই সব শক্তির উৎস। তারাই রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ঘটানোর মূল চালিকাশক্তি। আসলে এসব কেতাবি কথা। বাস্তবে স্বার্থপর হিংস্র রাজনীতির বলয়ে জনগণ এখন প্রজারও অধম। এখনও রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য রাজনীতিকরা ষড়যন্ত্র করেন। তবে রক্তারক্তি তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। নিজেদের ক্ষমতা লাভের সিঁড়ি বানায় জনসাধারণকে। জনগণকেই জিম্মি করে। নির্বাচন নামের বস্তু দিয়ে সাধারণ মানুষকে করে প্রতারণা।
২০১৩ সালে বিএনপি জোট মনে করেছিল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন করলে ফলাফল অনুকূলে আনতে পারবে না। তাই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে। আওয়ামী লীগ অনড় ছিল। সাংবিধানিক ও আইনগত শক্তি তার রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অটল থাকে। দাবি মানানোর জন্য এখন আর প্রাসাদের ভেতর বিবদমান দলগুলো নিজেদের রক্ত ঝরায় না। জিম্মি করে ফেলে সাধারণ মানুষকে। দস্যুর মতো ছুরি ধরে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের বুকে। এভাবেই দুর্বল করতে চায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে। ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি জোট। শুধু বর্জন নয়, ঘোষণা দিয়েছিল ‘নির্বাচন হতে দেয়া হবে না’। এ লক্ষ্যে ২০১৩-এর ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল নাশকতা। বিএনপি-জামায়াতের পরিচালনায় পেট্রলবোমায় মানুষ আর যানবাহন পোড়ানোর সংস্কৃতি প্রবলভাবে চলে আসছে সে সময় থেকে। নির্বাচনে মনোনয়ন না নিয়ে একটি শূন্যতা তৈরির চেষ্টা করে বিরোধী জোট। যে কারণে সরকারদলীয় জোটের ১৫৪ প্রার্র্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়ে যান। বর্জন ও প্রতিহতকারীরা নির্বাচন কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত অনেক স্কুলে আগুন দেয়। বোমা ছুড়ে আতংক সৃষ্টি করে। যার ফল হিসেবে আতংকগ্রস্ত অনেক ভোটারই ভোট দিতে আসেননি। এভাবে এ যুগে সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একই ধারাবাহিকতায় সিংহাসন প্রত্যাশীরা বিগত প্রায় দুই মাস ধরে সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি, শিক্ষা সব
কিছুকে জিম্মি করে হরতাল-অবরোধের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচি কার্যকর না থাকলেও চোরাগোপ্তা বোমা হামলায় জীবন বিপন্ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের। মানুষ পথে বেরুচ্ছে ঠিকই। তবে আতংকমুক্ত জীবনযাপন করতে পারছে না।
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির ভয়ংকর মানুষগুলো যখন নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে দ্বিধা করছে না, ঠিক তখনই একদল তরুণ তাদের বন্ধুর জীবন রক্ষায় ছুটছে দ্বারে দ্বারে। এজন্যই বুঝি হাজার হতাশায় আমরা আলোর শিখা এখনও দেখতে পাই। আবার নতুন করে বেঁচে থাকার আশ্বাস খুঁজে পাই। পাঠকের কাছে নিবেদন করতে চাই সে কথাটিই।
দিন কয়েক আগে আমার এক ছাত্রী টেলিফোন করে জানাল, ওদের এক বন্ধু ভয়ংকর অসুস্থ। ওরা বন্ধুর জন্য কিছু করতে চায়। এজন্য পরামর্শ করতে আমার কাছে আসবে। আমার কক্ষে বিভিন্ন বিভাগের চারজন ছাত্রী এলো। ওদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। জানাল, ওদের বন্ধু ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ছাত্রী নুসরাত জেরিন জিনিয়ার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আছে। ডাক্তার বলেছেন, রোগীর অবস্থা অনেকটা জটিল। বাঁচাতে হলে দ্রুত বিদেশে নিয়ে জিনিয়ার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। জিনিয়া স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এখন স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। পিতৃহারা মেয়েটির পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি নেই চিকিৎসার ব্যয় বহন করার। ডাক্তাররা ধারণা দিয়েছেন, বিদেশে এ চিকিৎসা করাতে কমপক্ষে ৭৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো আর্থিক খাত নেই যেখান থেকে সহায়তা করতে পারেন। তবে জিনিয়ার বিভাগে ছাত্রকল্যাণের একটি ফান্ড আছে। সেখান থেকে ৪-৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার একটি অনুমোদন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারে। আমি ছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম ওরা কী করতে চায়। এ তরুণীদের কাছে তো অত রাস্তা খোলা নেই। তবে হতাশার ভেতরেও একটা দৃঢ়তা আছে ওদের কণ্ঠে। ওরা যে করেই হোক বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে। ওরা জানাল, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাবে। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের কাছে সাহায্যের আবেদন করবে। পথে পথে মানুষের কাছে সাহায্য চাইবে। আমি ওদের দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠ শুনে বিস্মিত হলাম। কী বৈপরীত্য! রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার জন্য লোভী রাজনীতিকরা যখন সাধারণ সুস্থ নিরপরাধ মানুষকে বোমা মেরে পুড়িয়ে মারছে, তখন একদল তরুণ জীবনবাজি রেখে ছুটছে অসুস্থ বন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য।
আমি বললাম, তোমরা যে উদ্যোগের কথা ভাবছ তা তো প্রয়োজনের বালিতে বারি বিন্দু হবে। যে মেয়েটিকে বিদেশে পাঠিয়ে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে তার দরকার বড় মাপের প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিক ও সরকারি সহায়তা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পথঘাট আমার চেনা নেই। আমি আমার দুই বন্ধুকে ফোন করলাম। ওরা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা। ওদের পরামর্শ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তার অফিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদন জানালে একটি উপায় হতে পারে। আইআইটি বিভাগের স্নেহভাজন সভাপতিকে এ পরামর্শ দিলাম। আমি ওদের বললাম, তোমরা তোমাদের মতো চেষ্টা করতে থাক।
পরদিন আমি একুশের বইমেলায় গেছি। হঠাৎ একটি মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে কতগুলো হ্যান্ডবিল। আমার সামনে একটি এগিয়ে দিল। বলল, ওদের অসুস্থ বন্ধুর জন্য সাহায্য চায়। দেখলাম জিনিয়ার জন্য ও পথে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চিনত না। পরিচয় দিলাম। জানাল, ওরা কয়েকটি মেয়ে হরতাল উপেক্ষা করে বাসে চড়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে বইমেলায় এসেছে। এক-একজন এক একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়ার অভিজ্ঞতা ওদের নেই। তাই খুব দ্বিধা হচ্ছে। আজ বন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য সব দ্বিধা অতিক্রম করে পথে নেমেছে। নগদ অর্থ নয়। লিফলেটে ঠিকানা রয়েছে। হৃদয়বানরা যাতে যোগাযোগ করেন।
আমি একটু আড়ালে সরে গিয়ে ওকে লক্ষ করছিলাম। খুব দ্বিধায় ও কম্পিত হাতে মেলায় আসা মানুষদের কাছে লিফলেট তুলে দিতে চাইছে। দেখলাম, ব্যস্ত ও সন্দিগ্ধ মানুষের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছে এবং লিফলেট না নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্ধুর জন্য পথে নামা মেয়েটির মুখ কালশিটে হয়ে যাচ্ছে। ওকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল আমার। আবার ভেসে উঠল আমাদের লোভী ও ভয়ংকর অমানবিক রাজনীতিকদের মুখ। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ফোনালাপ আমি শুনেছি। প্রিন্ট মিডিয়ায় পড়েছি। যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য গণরায়ের বদলে শর্টকাট পথ খুঁজছেন আমাদের রাজনীতিকরা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দাবিদার মাহমুদুর রহমান মান্না আর প্রবাসে থাকা বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা সরকারকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে দু’-তিনটি ছাত্রের লাশ ফেলে দেয়ার কথা বলেন, তখন অসুস্থ বন্ধুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর অসাধ্য সাধনের জন্য পথে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি পেতে এ মহৎপ্রাণ প্রজন্মের জীবন কেড়ে নিতে চায় কুৎসিত রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষরা। আমরা বুঝতে পারি এ অমানবিক, স্বার্থপর ভয়ংকর রক্তবীজ একটি-দুটি নয়, অনেক ছড়িয়ে আছে। গণমানুষের প্রতিরোধ ছাড়া এদের হাত থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি নেই।
দুদিন আগে ইন্টারনেটে একটি মেইল পেয়ে চমৎকৃত হয়েছি। আমার বরাবরই সুন্দরের প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের কাছে। প্রত্যাশাটা আরও বেড়ে গেল। একই চিঠি প্রকাশিত হয়েছে গতকালের (২৫ ফেব্র“য়ারি) যুগান্তরে। এ দুর্বিনীত পরিবেশে মানবিক চেতনার তরুণীটির নাম তাসনুভা তাবাসসুম। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যখন রাজনীতিকরা তাদের লোভের আগুনে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে বার্ন ইউনিটে পাঠাচ্ছে, তখন মন কেঁদে উঠছে তাসনুভার। সে অগ্নিদগ্ধদের সহায়তার একটি পথ খুঁজে পেয়েছে। বলছে, আমাদের দেশের ৫ কোটি মুঠোফোন ব্যবহারকারীর প্রত্যেকে যদি মাত্র ১০ টাকা করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাঠায় তবে ৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ সম্ভব। তাসনুভা এ দুঃসময়ে আমাদের জিনিয়ার জন্যও নতুন একটি পথ খুঁজে দিল। মাত্র ৭ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী যদি জিনিয়ার জন্য ১০ টাকা করে পাঠায় তবে দুদিনের মধ্যেই জিনিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। হিংসার রাজনীতি আমাদের জীবন কাড়তে জানে; কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ মানবিক আবেদনে কিভাবে সাড়া দিতে পারে তার প্রমাণ কি আমরা রাখতে পারি না? এই সুযোগে আমি জিনিয়ার চিকিৎসায় অর্থ সাহায্যের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের দানশীল মানুষ ও সাধারণ সব মানুষের কাছে আবেদন জানাই। ওদের বিতরণ করা হ্যান্ডবিলে আর্থিক সাহায্য পাঠানোর ঠিকানাটি হল : বিকাশ নং-০১৭৩৮২৭৫১২৭, অথবা মো. জসিম উদ্দিন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নং- ১৮১১৭১০৫৯০১।
আমরা বিশ্বাস করি অসুন্দরের শেষ পরিণতি অন্ধকার। সুন্দরের জয় হবেই। আমি আমার প্রত্যয়ী ছাত্রীদের মুখে সেই আলো দেখতে পেয়েছি।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
আধুনিক যুগে রাজতন্ত্র কার্যকরভাবে বহাল নেই। প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক, সাম্যবাদী নানা নামে রাষ্ট্রব্যবস্থা এখন প্রতিষ্ঠিত। বলা হয়, এখন আর কেউ প্রজা নয়। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। জনগণই সব শক্তির উৎস। তারাই রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল ঘটানোর মূল চালিকাশক্তি। আসলে এসব কেতাবি কথা। বাস্তবে স্বার্থপর হিংস্র রাজনীতির বলয়ে জনগণ এখন প্রজারও অধম। এখনও রাষ্ট্রক্ষমতার জন্য রাজনীতিকরা ষড়যন্ত্র করেন। তবে রক্তারক্তি তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। নিজেদের ক্ষমতা লাভের সিঁড়ি বানায় জনসাধারণকে। জনগণকেই জিম্মি করে। নির্বাচন নামের বস্তু দিয়ে সাধারণ মানুষকে করে প্রতারণা।
২০১৩ সালে বিএনপি জোট মনে করেছিল, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে তারা নির্বাচন করলে ফলাফল অনুকূলে আনতে পারবে না। তাই নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলে। আওয়ামী লীগ অনড় ছিল। সাংবিধানিক ও আইনগত শক্তি তার রয়েছে। তাই ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন করার ব্যাপারে অটল থাকে। দাবি মানানোর জন্য এখন আর প্রাসাদের ভেতর বিবদমান দলগুলো নিজেদের রক্ত ঝরায় না। জিম্মি করে ফেলে সাধারণ মানুষকে। দস্যুর মতো ছুরি ধরে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের বুকে। এভাবেই দুর্বল করতে চায় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে। ২০১৪-এর নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি জোট। শুধু বর্জন নয়, ঘোষণা দিয়েছিল ‘নির্বাচন হতে দেয়া হবে না’। এ লক্ষ্যে ২০১৩-এর ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল নাশকতা। বিএনপি-জামায়াতের পরিচালনায় পেট্রলবোমায় মানুষ আর যানবাহন পোড়ানোর সংস্কৃতি প্রবলভাবে চলে আসছে সে সময় থেকে। নির্বাচনে মনোনয়ন না নিয়ে একটি শূন্যতা তৈরির চেষ্টা করে বিরোধী জোট। যে কারণে সরকারদলীয় জোটের ১৫৪ প্রার্র্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়ে যান। বর্জন ও প্রতিহতকারীরা নির্বাচন কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারিত অনেক স্কুলে আগুন দেয়। বোমা ছুড়ে আতংক সৃষ্টি করে। যার ফল হিসেবে আতংকগ্রস্ত অনেক ভোটারই ভোট দিতে আসেননি। এভাবে এ যুগে সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। একই ধারাবাহিকতায় সিংহাসন প্রত্যাশীরা বিগত প্রায় দুই মাস ধরে সাধারণ মানুষের জীবন, জীবিকা, অর্থনীতি, শিক্ষা সব
কিছুকে জিম্মি করে হরতাল-অবরোধের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। এসব কর্মসূচি কার্যকর না থাকলেও চোরাগোপ্তা বোমা হামলায় জীবন বিপন্ন হচ্ছে সাধারণ মানুষের। মানুষ পথে বেরুচ্ছে ঠিকই। তবে আতংকমুক্ত জীবনযাপন করতে পারছে না।
আমাদের ক্ষমতার রাজনীতির ভয়ংকর মানুষগুলো যখন নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নিতে দ্বিধা করছে না, ঠিক তখনই একদল তরুণ তাদের বন্ধুর জীবন রক্ষায় ছুটছে দ্বারে দ্বারে। এজন্যই বুঝি হাজার হতাশায় আমরা আলোর শিখা এখনও দেখতে পাই। আবার নতুন করে বেঁচে থাকার আশ্বাস খুঁজে পাই। পাঠকের কাছে নিবেদন করতে চাই সে কথাটিই।
দিন কয়েক আগে আমার এক ছাত্রী টেলিফোন করে জানাল, ওদের এক বন্ধু ভয়ংকর অসুস্থ। ওরা বন্ধুর জন্য কিছু করতে চায়। এজন্য পরামর্শ করতে আমার কাছে আসবে। আমার কক্ষে বিভিন্ন বিভাগের চারজন ছাত্রী এলো। ওদের চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা। জানাল, ওদের বন্ধু ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ছাত্রী নুসরাত জেরিন জিনিয়ার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি আছে। ডাক্তার বলেছেন, রোগীর অবস্থা অনেকটা জটিল। বাঁচাতে হলে দ্রুত বিদেশে নিয়ে জিনিয়ার বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে। জিনিয়া স্নাতক চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। এখন স্নাতকোত্তরের ছাত্রী। পিতৃহারা মেয়েটির পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি নেই চিকিৎসার ব্যয় বহন করার। ডাক্তাররা ধারণা দিয়েছেন, বিদেশে এ চিকিৎসা করাতে কমপক্ষে ৭৫ লাখ টাকা প্রয়োজন।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি অধ্যাপক আবুল হোসেন স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন কোনো আর্থিক খাত নেই যেখান থেকে সহায়তা করতে পারেন। তবে জিনিয়ার বিভাগে ছাত্রকল্যাণের একটি ফান্ড আছে। সেখান থেকে ৪-৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার একটি অনুমোদন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দিতে পারে। আমি ছাত্রীদের কাছে জানতে চাইলাম ওরা কী করতে চায়। এ তরুণীদের কাছে তো অত রাস্তা খোলা নেই। তবে হতাশার ভেতরেও একটা দৃঢ়তা আছে ওদের কণ্ঠে। ওরা যে করেই হোক বন্ধুকে বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে। ওরা জানাল, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটে যাবে। ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকদের কাছে সাহায্যের আবেদন করবে। পথে পথে মানুষের কাছে সাহায্য চাইবে। আমি ওদের দৃঢ় প্রত্যয়ী কণ্ঠ শুনে বিস্মিত হলাম। কী বৈপরীত্য! রাষ্ট্রক্ষমতা পাওয়ার জন্য লোভী রাজনীতিকরা যখন সাধারণ সুস্থ নিরপরাধ মানুষকে বোমা মেরে পুড়িয়ে মারছে, তখন একদল তরুণ জীবনবাজি রেখে ছুটছে অসুস্থ বন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য।
আমি বললাম, তোমরা যে উদ্যোগের কথা ভাবছ তা তো প্রয়োজনের বালিতে বারি বিন্দু হবে। যে মেয়েটিকে বিদেশে পাঠিয়ে দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে তার দরকার বড় মাপের প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিক ও সরকারি সহায়তা। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পথঘাট আমার চেনা নেই। আমি আমার দুই বন্ধুকে ফোন করলাম। ওরা অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার সরকারি কর্মকর্তা। ওদের পরামর্শ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা তার অফিসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদন জানালে একটি উপায় হতে পারে। আইআইটি বিভাগের স্নেহভাজন সভাপতিকে এ পরামর্শ দিলাম। আমি ওদের বললাম, তোমরা তোমাদের মতো চেষ্টা করতে থাক।
পরদিন আমি একুশের বইমেলায় গেছি। হঠাৎ একটি মেয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে কতগুলো হ্যান্ডবিল। আমার সামনে একটি এগিয়ে দিল। বলল, ওদের অসুস্থ বন্ধুর জন্য সাহায্য চায়। দেখলাম জিনিয়ার জন্য ও পথে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চিনত না। পরিচয় দিলাম। জানাল, ওরা কয়েকটি মেয়ে হরতাল উপেক্ষা করে বাসে চড়ে জাহাঙ্গীরনগর থেকে বইমেলায় এসেছে। এক-একজন এক একদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে মানুষের কাছে সাহায্য চাওয়ার অভিজ্ঞতা ওদের নেই। তাই খুব দ্বিধা হচ্ছে। আজ বন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য সব দ্বিধা অতিক্রম করে পথে নেমেছে। নগদ অর্থ নয়। লিফলেটে ঠিকানা রয়েছে। হৃদয়বানরা যাতে যোগাযোগ করেন।
আমি একটু আড়ালে সরে গিয়ে ওকে লক্ষ করছিলাম। খুব দ্বিধায় ও কম্পিত হাতে মেলায় আসা মানুষদের কাছে লিফলেট তুলে দিতে চাইছে। দেখলাম, ব্যস্ত ও সন্দিগ্ধ মানুষের অনেকেই বাঁকা চোখে দেখছে এবং লিফলেট না নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্ধুর জন্য পথে নামা মেয়েটির মুখ কালশিটে হয়ে যাচ্ছে। ওকে খুব অসহায় মনে হতে লাগল আমার। আবার ভেসে উঠল আমাদের লোভী ও ভয়ংকর অমানবিক রাজনীতিকদের মুখ। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া ফোনালাপ আমি শুনেছি। প্রিন্ট মিডিয়ায় পড়েছি। যখন রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য গণরায়ের বদলে শর্টকাট পথ খুঁজছেন আমাদের রাজনীতিকরা, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি দাবিদার মাহমুদুর রহমান মান্না আর প্রবাসে থাকা বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা সরকারকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল দখল করে দু’-তিনটি ছাত্রের লাশ ফেলে দেয়ার কথা বলেন, তখন অসুস্থ বন্ধুকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর অসাধ্য সাধনের জন্য পথে নেমেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা। ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি পেতে এ মহৎপ্রাণ প্রজন্মের জীবন কেড়ে নিতে চায় কুৎসিত রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষরা। আমরা বুঝতে পারি এ অমানবিক, স্বার্থপর ভয়ংকর রক্তবীজ একটি-দুটি নয়, অনেক ছড়িয়ে আছে। গণমানুষের প্রতিরোধ ছাড়া এদের হাত থেকে দেশ ও জাতির মুক্তি নেই।
দুদিন আগে ইন্টারনেটে একটি মেইল পেয়ে চমৎকৃত হয়েছি। আমার বরাবরই সুন্দরের প্রত্যাশা তরুণ প্রজন্মের কাছে। প্রত্যাশাটা আরও বেড়ে গেল। একই চিঠি প্রকাশিত হয়েছে গতকালের (২৫ ফেব্র“য়ারি) যুগান্তরে। এ দুর্বিনীত পরিবেশে মানবিক চেতনার তরুণীটির নাম তাসনুভা তাবাসসুম। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। যখন রাজনীতিকরা তাদের লোভের আগুনে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে বার্ন ইউনিটে পাঠাচ্ছে, তখন মন কেঁদে উঠছে তাসনুভার। সে অগ্নিদগ্ধদের সহায়তার একটি পথ খুঁজে পেয়েছে। বলছে, আমাদের দেশের ৫ কোটি মুঠোফোন ব্যবহারকারীর প্রত্যেকে যদি মাত্র ১০ টাকা করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পাঠায় তবে ৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ সম্ভব। তাসনুভা এ দুঃসময়ে আমাদের জিনিয়ার জন্যও নতুন একটি পথ খুঁজে দিল। মাত্র ৭ লাখ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী যদি জিনিয়ার জন্য ১০ টাকা করে পাঠায় তবে দুদিনের মধ্যেই জিনিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। হিংসার রাজনীতি আমাদের জীবন কাড়তে জানে; কিন্তু তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ মানবিক আবেদনে কিভাবে সাড়া দিতে পারে তার প্রমাণ কি আমরা রাখতে পারি না? এই সুযোগে আমি জিনিয়ার চিকিৎসায় অর্থ সাহায্যের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, দেশের দানশীল মানুষ ও সাধারণ সব মানুষের কাছে আবেদন জানাই। ওদের বিতরণ করা হ্যান্ডবিলে আর্থিক সাহায্য পাঠানোর ঠিকানাটি হল : বিকাশ নং-০১৭৩৮২৭৫১২৭, অথবা মো. জসিম উদ্দিন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নং- ১৮১১৭১০৫৯০১।
আমরা বিশ্বাস করি অসুন্দরের শেষ পরিণতি অন্ধকার। সুন্দরের জয় হবেই। আমি আমার প্রত্যয়ী ছাত্রীদের মুখে সেই আলো দেখতে পেয়েছি।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnawaz7b@gmail.com
No comments