মৃত্যুর মিছিলে ‘এ জীবন বড়ই সুন্দর’! by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
৩
ফেব্রুয়ারি সোহেল ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, শেষ লাইনটাতে
লিখেছিলেন, ‘এ জীবন বড়ই সুন্দর!’ এ কথাটার মধ্যে কী তীব্র ব্যঙ্গ ও
হাহাকার ছিল, তা বুঝতে হলে তাঁর পুরো স্ট্যাটাসটি পড়তে হবে। সেই
স্ট্যাটাসটি হুবহু এখানে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক মনে করি, ‘আমি যা বুঝেছি এত
দিনে মৌলিক অধিকার, গণতন্ত্র সব ভুয়া। ওসব আমাদের জন্য নয়। আমি বেঁচে আছি
শুধু সমাজের উঁচুতলার মানুষের দয়ায়। ওদের দয়ায় আমি গণতন্ত্রকামী মানুষ।
ওদের প্রয়োজনে কখনো আমরা মানবতাকামী, কখনো সাম্যবাদী, কখনো পুড়ে যাওয়া
বারবিকিউ, কখনো দেশপ্রেমী। সব সময়ই আমি একটা সংখ্যামাত্র। কখনো পুড়ে
যাওয়া নিহত সাতজনের কেউ, কখনো পুড়ে যাওয়া আহত ২০ জনের একজন, কখনো বোমার
হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কেউ। কখনো আমি পথচারী, কখনো আমি মিছিলের কেউ...।
আমি জন্মালেও কারও কিছু যায়-আসে না, আমার মৃত্যুতেও কারও কোনো ক্ষতি নেই!
‘আমি বেঁচে আছি অন্যের দয়ায়! আমি একটা দাবার গুটি মাত্র। শুধু নতুন নতুন চালের ক্ষেত্রে আমাকে প্রয়োজন হয়, আমার প্রতিটি মুভমেন্ট অন্যের প্রয়োজনে এক-একটা চাল মাত্র।
‘এ জীবন বড়ই সুন্দর!’
এই স্ট্যাটাসটা দেওয়ার মাত্র ১৯ দিন পর সোহেল প্রাণ হারিয়েছেন। না, সোহেল যে রকম আশঙ্কা করেছিলেন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে বা বোমার আঘাতে মারা যাননি তিনি। বোঝা যায়, দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও সহিংসতার বিষয়টি উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলেছিল তাঁকে। সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় প্রতিদিন ছাপা হওয়া নিহত, আহত, অগ্নিদগ্ধ মানুষের সংখ্যার হিসাব তাঁকে যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি নিজেও একটি সংখ্যামাত্র। এই এক-একটি সংখ্যার সঙ্গে আরও কত মানুষ, কত পরিবার সম্পর্কসূত্রে গাঁথা, কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের আশা, আশ্বাস ও আনন্দ—এ কথা ভেবেই হয়তো বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন সোহেল। কিন্তু তিনি কি তখন ভেবেছিলেন অপঘাতে মৃত্যু যে দেশে স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে, সেখানে মৃত্যু আরও কতভাবে কত পথে এসে কড়া নাড়তে পারে জীবনের দুয়ারে?
বাবার কোলে চার বছর বয়সী মেয়ের ছবিটি দেখুন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একটি মুহূর্তের কথা লেখা আছে এই ছবিতে। বাবার চেহারায় গভীর তৃপ্তি, স্নেহ ও মমতা। মেয়ের মুখে হাসি, সে জানে বাবার কোল তার সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়, নিরাপদ ঠিকানা। কিন্তু এই ছবি এখন শুধু স্মৃতিই হয়ে গেল। হয়তো স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে বারবার ফিরে আসবেন বাবা, বাস্তব জীবনে প্রতীতি আর কখনোই ফিরে পাবে না সেই মমতাময় স্পর্শ।
পুরো নাম কাজী আনোয়ারুল হক (৪১)। পেশায় ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতিও করেছেন এক-আধটু। কিন্তু শৈশবে বাবাকে হারানো মা-বাবার একমাত্র ছেলের পক্ষে সমাজবদলের সংগ্রামের চেয়ে জীবন-জীবিকার লড়াইটা যে অনেক জরুরি, সেই বাস্তব বোধবুদ্ধি তাঁর ছিল। ঢাকায় গিয়ে চাকরি করেছেন, চাকরি বদলও করেছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। স্ত্রী তৌফিক আরা (নীতু) বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে অভাবের সংসারটা সামাল দিয়েছেন। অবশেষে ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল। বছর খানেক আগে পোশাক রপ্তানির ব্যবসায় ঢুকে মোটামুটি সাফল্য পেয়েছিলেন সোহেল। মনে হচ্ছিল কষ্টের দিনগুলো বোধ হয় শেষ হয়েছে। মেয়ে প্রতীতিকে সময় দিতে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৌফিক আরা। কিন্তু স্বপ্ন-কল্পনার সঙ্গে জীবন মেলে না এ দেশে।
২২ ফেব্রুয়ারি সোহেল তাঁর পার্টনারের সঙ্গে ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন গাজীপুর। মাস খানেক আগে পোশাক রপ্তানির বিক্রয় আদেশ পেয়েছিলেন কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। বিদেশি বায়ারের সঙ্গে কারখানা পরিদর্শন শেষে সহযোগীসহ ফিরছিলেন ঢাকায়। রাস্তা অতিক্রম করার সময় হঠাৎ একটি বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় মারাত্মক আহত হন তিনি। উত্তরায় একটি ক্লিনিকে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন তাঁকে। এখানেই সব আলোচনা থেমে যেতে পারে। থেমেছেও। কেউকেটা কেউ তো নন, কেন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাবে এই সংবাদ, কেন দু-চারজন বন্ধু ও আত্মীয় ছাড়া আর কেউ এসে দাঁড়াবে তাঁর স্ত্রী-কন্যার পাশে? যেমন তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, সেভাবেই ‘সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু’—এ রকম সংখ্যাবাচক সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু প্রতীতি আর তার মা তৌফিক আরাই শুধু জানেন কী হারালেন তাঁরা, কী রকম নিরাশার অন্ধকার অপেক্ষা করে আছে তাঁদের জন্য। তবে নিছক একটি সংখ্যা যখন কোটি মানুষেরই প্রতিনিধি, তখন তার দিকে ভালো করে তাকালে দেশটাকেও যে দেখা হয়ে যায়।
আমরা সবাই যেন এক মৃত্যুর মিছিলের যাত্রী। হরতাল-অবরোধে আহত, নিহত, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে মানুষ। পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্পে মরছে মানুষ, গণপিটুনিতেও মরছে। বেশি জনসংখ্যার এই দেশে মানুষের অপমৃত্যু আজ এতটাই স্বাভাবিকতা পেয়েছে যে এর জন্য একটি দীর্ঘশ্বাসের বেশি কিছু বরাদ্দ রাখতে পারছি না আমরা।
সড়ক, রেল ও নৌপথে চলাচল রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা ওত পেতে আছে প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু সাধারণ মানুষের উপায় কী? এই তো মাত্র কদিন আগে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারাল ৭০ জন। শান্ত পদ্মার মাঝনদীতে দিনে-দুপুরে একটি কার্গো জাহাজ কেন একটি যাত্রীবাহী লঞ্চকে ধাক্কা দিল, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে এর কোনো মীমাংসা পাওয়া যায় না। হয় অদক্ষ চালক, নয় চরম অবহেলাই এর জন্য দায়ী। ঘটনার পর নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ছুটে গেছেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছেন, তদন্তের আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু এ রকম তো অনেক দেখেছি, আবার ভুলেও গেছি। একটি বিপর্যয়ের ঘটনা আড়াল করে দেয় নতুন কোনো দুর্ঘটনা। অসংখ্য লঞ্চডুবির ঘটনার মূল কারণ যে মালিক বা চালকের অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে বেশি অর্থোপার্জনের লোভ, সেটি কি বন্ধ করা গেছে? ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল কি বন্ধ হয়েছে?
এসব ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করবেন এমন অসম্ভব কল্পনা করি না। কিন্তু জবাবদিহির দায়ও কি নেই তাঁদের?
২০১১ সালে আমাদের দেশের দুই কৃতী সন্তান মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর দেশজুড়ে অনেক হইচই হলো। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার কি তেমন তারতম্য হয়েছে তার পরও? চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক দিন ধরে। ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি থেকেই হয়তো এই আন্দোলনে নামার
গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় ঝাড়ুমিছিল করেছে পরিবহনশ্রমিকদের একটি সংগঠন। নৌমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি বলতে পারেন, গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যায়, তাহলে এই শ্রমিকদেরই বা
আর দোষ কী! এভাবে অন্যায়কে জায়েজ করা হলে তার প্রতিকারের সম্ভাবনা কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়।
কাজী আনোয়ারুল হক আর নেই। কিন্তু তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি এখনো আছে। সেখানে কভার ফটোতে দেখা যাচ্ছে ধান কাটার পর শুকনো খড় বিছানো একটি মাঠে শিশুকন্যার হাত ধরে হাঁটছেন তিনি। মাঠের শেষে সবুজ গাছগাছালির ছায়ায় কয়েকটি ঘর, দূর দিগন্তে বিস্তৃত নীল আকাশ। এমন সুন্দর প্রকৃতিশোভিত একটি দেশের মানুষ সোহেল। তবু খেদ করে, ব্যঙ্গ করে তাঁকে লিখতে হয়েছিল, ‘এ জীবন বড়ই সুন্দর!’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
‘আমি বেঁচে আছি অন্যের দয়ায়! আমি একটা দাবার গুটি মাত্র। শুধু নতুন নতুন চালের ক্ষেত্রে আমাকে প্রয়োজন হয়, আমার প্রতিটি মুভমেন্ট অন্যের প্রয়োজনে এক-একটা চাল মাত্র।
‘এ জীবন বড়ই সুন্দর!’
এই স্ট্যাটাসটা দেওয়ার মাত্র ১৯ দিন পর সোহেল প্রাণ হারিয়েছেন। না, সোহেল যে রকম আশঙ্কা করেছিলেন, অগ্নিদগ্ধ হয়ে বা বোমার আঘাতে মারা যাননি তিনি। বোঝা যায়, দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও সহিংসতার বিষয়টি উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলেছিল তাঁকে। সংবাদপত্রের পাতায় প্রায় প্রতিদিন ছাপা হওয়া নিহত, আহত, অগ্নিদগ্ধ মানুষের সংখ্যার হিসাব তাঁকে যেন বুঝিয়ে দিয়েছিল, তিনি নিজেও একটি সংখ্যামাত্র। এই এক-একটি সংখ্যার সঙ্গে আরও কত মানুষ, কত পরিবার সম্পর্কসূত্রে গাঁথা, কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের আশা, আশ্বাস ও আনন্দ—এ কথা ভেবেই হয়তো বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন সোহেল। কিন্তু তিনি কি তখন ভেবেছিলেন অপঘাতে মৃত্যু যে দেশে স্বাভাবিকতায় রূপ নিয়েছে, সেখানে মৃত্যু আরও কতভাবে কত পথে এসে কড়া নাড়তে পারে জীবনের দুয়ারে?
বাবার কোলে চার বছর বয়সী মেয়ের ছবিটি দেখুন। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী একটি মুহূর্তের কথা লেখা আছে এই ছবিতে। বাবার চেহারায় গভীর তৃপ্তি, স্নেহ ও মমতা। মেয়ের মুখে হাসি, সে জানে বাবার কোল তার সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আশ্রয়, নিরাপদ ঠিকানা। কিন্তু এই ছবি এখন শুধু স্মৃতিই হয়ে গেল। হয়তো স্বপ্নে-দুঃস্বপ্নে বারবার ফিরে আসবেন বাবা, বাস্তব জীবনে প্রতীতি আর কখনোই ফিরে পাবে না সেই মমতাময় স্পর্শ।
পুরো নাম কাজী আনোয়ারুল হক (৪১)। পেশায় ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রজীবনে রাজনীতিও করেছেন এক-আধটু। কিন্তু শৈশবে বাবাকে হারানো মা-বাবার একমাত্র ছেলের পক্ষে সমাজবদলের সংগ্রামের চেয়ে জীবন-জীবিকার লড়াইটা যে অনেক জরুরি, সেই বাস্তব বোধবুদ্ধি তাঁর ছিল। ঢাকায় গিয়ে চাকরি করেছেন, চাকরি বদলও করেছেন, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। স্ত্রী তৌফিক আরা (নীতু) বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে অভাবের সংসারটা সামাল দিয়েছেন। অবশেষে ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল। বছর খানেক আগে পোশাক রপ্তানির ব্যবসায় ঢুকে মোটামুটি সাফল্য পেয়েছিলেন সোহেল। মনে হচ্ছিল কষ্টের দিনগুলো বোধ হয় শেষ হয়েছে। মেয়ে প্রতীতিকে সময় দিতে চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তৌফিক আরা। কিন্তু স্বপ্ন-কল্পনার সঙ্গে জীবন মেলে না এ দেশে।
২২ ফেব্রুয়ারি সোহেল তাঁর পার্টনারের সঙ্গে ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন গাজীপুর। মাস খানেক আগে পোশাক রপ্তানির বিক্রয় আদেশ পেয়েছিলেন কানাডার একটি প্রতিষ্ঠান থেকে। বিদেশি বায়ারের সঙ্গে কারখানা পরিদর্শন শেষে সহযোগীসহ ফিরছিলেন ঢাকায়। রাস্তা অতিক্রম করার সময় হঠাৎ একটি বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় মারাত্মক আহত হন তিনি। উত্তরায় একটি ক্লিনিকে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন তাঁকে। এখানেই সব আলোচনা থেমে যেতে পারে। থেমেছেও। কেউকেটা কেউ তো নন, কেন সংবাদমাধ্যমে গুরুত্ব পাবে এই সংবাদ, কেন দু-চারজন বন্ধু ও আত্মীয় ছাড়া আর কেউ এসে দাঁড়াবে তাঁর স্ত্রী-কন্যার পাশে? যেমন তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, সেভাবেই ‘সড়ক দুর্ঘটনায় একজনের মৃত্যু’—এ রকম সংখ্যাবাচক সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু প্রতীতি আর তার মা তৌফিক আরাই শুধু জানেন কী হারালেন তাঁরা, কী রকম নিরাশার অন্ধকার অপেক্ষা করে আছে তাঁদের জন্য। তবে নিছক একটি সংখ্যা যখন কোটি মানুষেরই প্রতিনিধি, তখন তার দিকে ভালো করে তাকালে দেশটাকেও যে দেখা হয়ে যায়।
আমরা সবাই যেন এক মৃত্যুর মিছিলের যাত্রী। হরতাল-অবরোধে আহত, নিহত, অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে মানুষ। পুলিশের ‘বন্দুকযুদ্ধের’ গল্পে মরছে মানুষ, গণপিটুনিতেও মরছে। বেশি জনসংখ্যার এই দেশে মানুষের অপমৃত্যু আজ এতটাই স্বাভাবিকতা পেয়েছে যে এর জন্য একটি দীর্ঘশ্বাসের বেশি কিছু বরাদ্দ রাখতে পারছি না আমরা।
সড়ক, রেল ও নৌপথে চলাচল রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা ওত পেতে আছে প্রতিমুহূর্তে। কিন্তু সাধারণ মানুষের উপায় কী? এই তো মাত্র কদিন আগে পদ্মায় লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারাল ৭০ জন। শান্ত পদ্মার মাঝনদীতে দিনে-দুপুরে একটি কার্গো জাহাজ কেন একটি যাত্রীবাহী লঞ্চকে ধাক্কা দিল, স্বাভাবিক বুদ্ধিতে এর কোনো মীমাংসা পাওয়া যায় না। হয় অদক্ষ চালক, নয় চরম অবহেলাই এর জন্য দায়ী। ঘটনার পর নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ছুটে গেছেন, আর্থিক ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিয়েছেন, তদন্তের আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু এ রকম তো অনেক দেখেছি, আবার ভুলেও গেছি। একটি বিপর্যয়ের ঘটনা আড়াল করে দেয় নতুন কোনো দুর্ঘটনা। অসংখ্য লঞ্চডুবির ঘটনার মূল কারণ যে মালিক বা চালকের অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই করে বেশি অর্থোপার্জনের লোভ, সেটি কি বন্ধ করা গেছে? ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল কি বন্ধ হয়েছে?
এসব ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করবেন এমন অসম্ভব কল্পনা করি না। কিন্তু জবাবদিহির দায়ও কি নেই তাঁদের?
২০১১ সালে আমাদের দেশের দুই কৃতী সন্তান মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর দেশজুড়ে অনেক হইচই হলো। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যার কি তেমন তারতম্য হয়েছে তার পরও? চলচ্চিত্র নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক দিন ধরে। ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি থেকেই হয়তো এই আন্দোলনে নামার
গুরুত্ব উপলব্ধি করেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় ঝাড়ুমিছিল করেছে পরিবহনশ্রমিকদের একটি সংগঠন। নৌমন্ত্রীর মতো একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি বলতে পারেন, গরু-ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যায়, তাহলে এই শ্রমিকদেরই বা
আর দোষ কী! এভাবে অন্যায়কে জায়েজ করা হলে তার প্রতিকারের সম্ভাবনা কতটুকু তা সহজেই অনুমেয়।
কাজী আনোয়ারুল হক আর নেই। কিন্তু তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি এখনো আছে। সেখানে কভার ফটোতে দেখা যাচ্ছে ধান কাটার পর শুকনো খড় বিছানো একটি মাঠে শিশুকন্যার হাত ধরে হাঁটছেন তিনি। মাঠের শেষে সবুজ গাছগাছালির ছায়ায় কয়েকটি ঘর, দূর দিগন্তে বিস্তৃত নীল আকাশ। এমন সুন্দর প্রকৃতিশোভিত একটি দেশের মানুষ সোহেল। তবু খেদ করে, ব্যঙ্গ করে তাঁকে লিখতে হয়েছিল, ‘এ জীবন বড়ই সুন্দর!’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com
No comments