একুশের সঙ্গে একান্তে by পবিত্র সরকার
প্রত্যেক
বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে, আমি তাকে সাড়ম্বরে শরীর বেঁকিয়ে লোক দেখানো
কুর্নিশ করি। সেও একটা কুর্নিশ করে; কিন্তু আমাকে নয়, যে মানুষগুলো তার
পরিসরে প্রাণ দিয়েছিল তাদের স্মৃতিতে। সে বলে, শুধু আমার শহীদদের নয়, আমি
কুর্নিশ করি শিলচরের উনিশে মের শহীদদের, পৃথিবীতে যে যেখানে মাতৃভাষার জন্য
প্রাণ দিয়েছেন, সবাইকে। একুশে ফেব্র“য়ারি একা নয়, বিচ্ছিন্ন নয়, সে শুধু
বাংলার নয়, বাংলাদেশ বা ভারতের নয়, এখন সে পৃথিবীর। সে সব মাতৃভাষার প্রতি
ভালোবাসার টানে জুড়ে থাকে।
এবার আমি একটু সুযোগ ছিনিয়ে নিয়ে তার হাত ধরে বসালাম। বললাম, বসো, দুটো কথা কই। তুমি ওই সব শহীদের হৃৎপিণ্ড-ছেঁড়া রক্তের চিহ্ন বুকে ধরে আছ সে আজ প্রায় তেষট্টি বছর হল। তুমি তো লক্ষ্য করেছিলে ১৯৪৮ থেকে জিন্নার উর্দু ভাষার পক্ষে বক্তৃতার প্রতিবাদে, সে প্রতিবাদ কীভাবে উত্তাল হতে হতে কী ক্ষমাহীন ক্রোধের জন্ম দিয়েছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে, ক্রোধ থেকে বিদ্রোহে গিয়ে পৌঁছেছিল তা। তার পর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩-তে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে তুমুল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, তার পর এলো ১৯৬৯ আর সর্বশেষে ১৯৭১। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যার শুরু, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তার শেষ। তার সার্থকতা।
একুশে বলল, ইতিহাস অত সরল নয়। শুধু সার্থকতার পরে সার্থকতা নয়। কিন্তু তারও পরে সার্থকতার একটা বড় গল্প আছে। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়া। আমার আগে আরও ১৯৫১টি একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে আর চলে গেছে; কিন্তু ১৯৫২র ওই আমি পৃথিবীর সংস্কৃতির ইতিহাসে আলাদা হয়ে গেলাম, আগেকার ১৯৫১টা নিষ্ফলা একুশে ফেব্র“য়ারিও যে গৌরবান্বিত হয়ে উঠল। আমার পরে এসে চলে যাওয়া ২১ ফেব্র“য়ারিগুলোতেও আর কিছু ঘটবে কি-না সন্দেহ; কিন্তু মানুষের সভ্যতার অনাগত হাজার হাজার বছরের সব কটা ২১ ফেব্র“য়ারির মানেও আমারই জন্য কেমন বদলে গেল। পৃথিবীর সবগুলো দেশের ২১ ফেব্র“য়ারিও আমারই সঙ্গে এক হয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আজ এই তেষট্টি বছর পর সেই গৌরব কতটা ধরে রাখতে পারছ তুমি?
একুশে বলল, কী ধরে রাখব? যে মাতৃভাষার জন্য এত কাণ্ড, সেই মাতৃভাষা নিয়ে কী করছ তোমরা? পৃথিবীর সবাই যখন মাতৃভাষা প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু করেছে, সেখানে তোমরা তাকে নিয়ে কী খেলায় মেতেছ আমাকে বলবে? তোমাদের বাপ-মারা বলছে ওসব বাংলা-ফাংলা পড়তে হবে না, দুটো ন, আর তিনটে শ নিয়ে, যুক্তাক্ষর নিয়ে কত কী বিচ্ছিরি প্যাঁচ করে রেখেছে এই ভাষা, আমার সোনার চাঁদ ছেলেমেয়েরা বলে, উঃ কী কঠিন ভাষা। এ শিখে কী হবে। বাংলা দিয়ে কি ধুয়ে খাব? শুনছি তোমাদের পশ্চিমবঙ্গে বাচ্চারা বলছে, ও মা বাংলাটা কী কঠিন গো! ইংরেজি কত সোজা! আর সে কথা শুনে বাপ-মারা বলে, আহারে যে ভাষা শিখতে আমার সোনার চাঁদের এত কষ্ট হয় সে ভাষা শিখে কী হবে? আর তোমাদের বাংলার কী ছিরি! আমি অ্যাকচুয়ালি এ কথাটি মিন করিনি ভাই। বাট টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, ওর কথাটা আমি লাইক করিনি। ও রেস্পেক্টেড লোককে রেস্পেক্ট দিতে জানে না। কার্টেসি কাকে বলে জানে না। ওর এই বিহেভিয়ারে সবাই ইনসাল্টেড ফিল করে। ভদ্রলোকের সোসাইটিতে ওকে ছেড়ে রাখা ডেঞ্জারস? এটাকে বাংলা বলা তোমরা? এ বাংরিজিই নাকি পশ্চিমবঙ্গে এখন তোমাদের জাতীয় ভাষা।
তা ইংরেজি শিখতে গেলে ওরকম একটু-আধটু হবে না? দুটো ভাষার ঘষাঘষিতে ওরকম হতেই পারে তো।
এটা ইংরেজি শেখার নমুনা নাকি? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এরকম বাংলা যারা বলে তাদের বেশিরভাগই একটা ইংরেজি শব্দও শুদ্ধভাবে বলতে পারে না। তারা ইংরেজিও শেখেনি, বাংলাও শেখেনি।
তা কী করবে আমাদের ছেলেমেয়েরা? বাংলা শিখলে কি চাকরি মেলে? সে মেলে ইংরেজি শিখলে। সেটা শিখব না?
ও মা, সে কথা আমি কখন বললাম? ইংরেজি একশবার শিখবে। ইংরেজি শিখবে, ফরাসি-জার্মান-স্প্যানিশ শিখবে, সংস্কৃত-আরবি-ফারসি শিখবে। যা শিখবে সব ভালো করে শিখবে। চালিয়াতি-রকমের শিখবে না। তাই বলে ছেলেমেয়েদের নিজের জন্মভাষাটাকে ভুলিয়ে দেবে কেন? এই সহজ কথাটা লোকে বোঝে না। এই আমার কয়েক দশকের দুঃখ। কিন্তু তাই বলে আমি মনে করি না বাংলা ভাষা উবে গেল বলে। যে ভাষায় দু-বাংলাতেই রোজ একটা করে দৈনিক কাগজ বেরুচ্ছে, নতুন টিভি চ্যানেল হচ্ছে, হাজার হাজার কবি-লেখক হাজার হাজার বই নিক্ষেপ করছেন প্রতি বইমেলায়, লিট্ল ম্যাগাজিনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ, এমনকি লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টোতে পর্যন্ত চলছে বাংলা কাগজ, ইন্টারনেটে ফেসবুকে ইউটিউবে পর্যন্ত বাংলা জায়গা দখল করছে- সে ভাষাকে মেরে ফেলা অত সহজ নয়। কিছু ছেলেমেয়ে ভাষাকে ছেড়ে যাবে তো আরও লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ভাষার কাছে আসবে ওমা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো বলে। একটু থেমে একুশে বলল, আমি কি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি? তার গলাটা ধরা-ধরা মনে হল যেন।
আমি হেসে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললাম, তা হয়তো পড়ছ, সে ঠিক আছে। বলো কী বলছিলে?
আর এই মুখের বাণী? জীবনে কি ভেবেছিলাম কোনো দেশের এক রাজনৈতিক মাথা প্রকাশ্য বক্তৃতার মধ্যে বলবেন অস্রাব্য বদকথা? তাতে হাততালি পড়বে? এজন্যই কি শহীদেরা প্রাণ দিয়েছিল?
আমি একুশেকে বললাম, দেখ, এখন দিনকাল অনেক বদলে গেছে, মানুষের ভাষাও বদলে গেছে। একজন পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাওয়া কবি বলেছেন, এসব শব্দ হল হীরের টুকরো।
হ্যাঁ, হীরের টুকরোই বটে। এও সেদিন বাংলাদেশে এক সংসদ সদস্যের চুদুরবুদুর কথাটা নিয়ে দুবাংলায় কী হৈচৈ পড়ে গেল। তাও সেটা ছিল গ্রাম্যভাষা, সে অর্থে অশালীন নয়। কিন্তু এখন তো অশালীন ভাষা ছুড়ে দেয়া হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো, তোমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ শুনেছি এ ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
আমি হাতজোড় করে বললাম, দোহাই, বাংলাদেশ যেন একটু পিছিয়ে থাকে এই জায়গায়, আমরা অত প্রগতি চাই না আমার বাংলাদেশী ভাই-বোনদের জন্য। একেই সেখানে নানা অশান্তি চলছে, পেট্রলবোমায় মানুষ মরার কথা খবরে পড়ি, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়।
একুশে বলল, তুমি বিদেশী, তোমার এ নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কী আছে। আমাদের কষ্ট আমরাই বুকে চেপে রাখি না হয়।
আমি বললাম, হ্যাঁ, এখন আমি বিদেশী বটে, কিন্তু আমার জন্ম তো তোমার এলাকাতেই হয়েছিল। তোমার গৌরবে আমরাও কিছুটা গৌরব ছিনিয়ে নিতে চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ে আমরাও উৎসব করেছি। আর তোমার সরকার তো আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বলে স্বীকার করেছে। তাই কেন যেন তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখ মিশে যেতে চায়।
একুশ নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কী অর্থহীন এই সব মৃত্যু! যারা বোমা ছুড়ছে, তারা কি জানে না যে, যাদের তারা মারছে তাদের সবাই সরকার পক্ষের, শাসক পক্ষের নয়। যে শিশুগুলো পুড়ে মরছে, বোমা-নিক্ষেপকারী কি জিজ্ঞেস করে তারা কোন দলের? যে অসহায় নারীরা পুড়ল, তারা সবাই কি শাসক দলের? আমাদেরই এক দরদি কবি না একবার লিখেছিলেন- কাণ্ডারি, বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার? ডুবিছের জায়গায় পুড়িছে লিখলেও কথাটা বদলায় না- সন্তান মোর মার। দেশের সন্তান, ভাষার সন্তান। যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল বরকতরা, যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি, সম্মান দিয়েছে মা-বোনেরা, তারা সব আমার সন্তান, একুশে ফেব্র“য়ারির সন্তান। এদের মৃত্যু আমাকে উন্মাদ করে দেয়। একুশের গলায় কান্নার মতো কী একটা জেগে উঠল।
একটু পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একুশে বলল, জান কি? ওই ওরা- বরকত, সালাম, জব্বার থেকে শুরু করে শিলচরের সবাই, পৃথিবীর সব ভাষা শহীদ এখন আমার বুকের মধ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ওই পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো এসে আমার বুকের মধ্যে আশ্রয় চায়। তাদের সঙ্গে আমিও রক্তাক্ত হই। আমিও পুড়ি। ভাবি, কবে আমার কষ্টের শেষ হবে। কবে তোমাদের মুখে বাংলা ভাষা তার জীবন্ত অহংকারী সুন্দর মুখ নিয়ে জেগে উঠবে, কবে আমার দেশের মানুষেরা আগুনের পরীক্ষা পার হয়ে, সবুজের মধ্যকার লাল সূর্যটাকে মুঠোতে ধরে বাংলাদেশে রাঙা আলোর সকাল ছড়িয়ে দেবে।
একুশে আবার একটু থেমে বলল, আমি বড় ঘন ঘন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি আজকাল।
আমি বললাম, এই আবেগ অক্ষয় হোক। ওই আবেগটুকু ছিল বলেই বাঙালি বেঁচে আছে।
পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক
pabitra37@gmail.com
এবার আমি একটু সুযোগ ছিনিয়ে নিয়ে তার হাত ধরে বসালাম। বললাম, বসো, দুটো কথা কই। তুমি ওই সব শহীদের হৃৎপিণ্ড-ছেঁড়া রক্তের চিহ্ন বুকে ধরে আছ সে আজ প্রায় তেষট্টি বছর হল। তুমি তো লক্ষ্য করেছিলে ১৯৪৮ থেকে জিন্নার উর্দু ভাষার পক্ষে বক্তৃতার প্রতিবাদে, সে প্রতিবাদ কীভাবে উত্তাল হতে হতে কী ক্ষমাহীন ক্রোধের জন্ম দিয়েছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে, ক্রোধ থেকে বিদ্রোহে গিয়ে পৌঁছেছিল তা। তার পর ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩-তে রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে তুমুল সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, তার পর এলো ১৯৬৯ আর সর্বশেষে ১৯৭১। ২১ ফেব্রুয়ারিতে যার শুরু, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তার শেষ। তার সার্থকতা।
একুশে বলল, ইতিহাস অত সরল নয়। শুধু সার্থকতার পরে সার্থকতা নয়। কিন্তু তারও পরে সার্থকতার একটা বড় গল্প আছে। ২০০০ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পাওয়া। আমার আগে আরও ১৯৫১টি একুশে ফেব্রুয়ারি এসেছে আর চলে গেছে; কিন্তু ১৯৫২র ওই আমি পৃথিবীর সংস্কৃতির ইতিহাসে আলাদা হয়ে গেলাম, আগেকার ১৯৫১টা নিষ্ফলা একুশে ফেব্র“য়ারিও যে গৌরবান্বিত হয়ে উঠল। আমার পরে এসে চলে যাওয়া ২১ ফেব্র“য়ারিগুলোতেও আর কিছু ঘটবে কি-না সন্দেহ; কিন্তু মানুষের সভ্যতার অনাগত হাজার হাজার বছরের সব কটা ২১ ফেব্র“য়ারির মানেও আমারই জন্য কেমন বদলে গেল। পৃথিবীর সবগুলো দেশের ২১ ফেব্র“য়ারিও আমারই সঙ্গে এক হয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, আজ এই তেষট্টি বছর পর সেই গৌরব কতটা ধরে রাখতে পারছ তুমি?
একুশে বলল, কী ধরে রাখব? যে মাতৃভাষার জন্য এত কাণ্ড, সেই মাতৃভাষা নিয়ে কী করছ তোমরা? পৃথিবীর সবাই যখন মাতৃভাষা প্রাণপণে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই শুরু করেছে, সেখানে তোমরা তাকে নিয়ে কী খেলায় মেতেছ আমাকে বলবে? তোমাদের বাপ-মারা বলছে ওসব বাংলা-ফাংলা পড়তে হবে না, দুটো ন, আর তিনটে শ নিয়ে, যুক্তাক্ষর নিয়ে কত কী বিচ্ছিরি প্যাঁচ করে রেখেছে এই ভাষা, আমার সোনার চাঁদ ছেলেমেয়েরা বলে, উঃ কী কঠিন ভাষা। এ শিখে কী হবে। বাংলা দিয়ে কি ধুয়ে খাব? শুনছি তোমাদের পশ্চিমবঙ্গে বাচ্চারা বলছে, ও মা বাংলাটা কী কঠিন গো! ইংরেজি কত সোজা! আর সে কথা শুনে বাপ-মারা বলে, আহারে যে ভাষা শিখতে আমার সোনার চাঁদের এত কষ্ট হয় সে ভাষা শিখে কী হবে? আর তোমাদের বাংলার কী ছিরি! আমি অ্যাকচুয়ালি এ কথাটি মিন করিনি ভাই। বাট টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি, ওর কথাটা আমি লাইক করিনি। ও রেস্পেক্টেড লোককে রেস্পেক্ট দিতে জানে না। কার্টেসি কাকে বলে জানে না। ওর এই বিহেভিয়ারে সবাই ইনসাল্টেড ফিল করে। ভদ্রলোকের সোসাইটিতে ওকে ছেড়ে রাখা ডেঞ্জারস? এটাকে বাংলা বলা তোমরা? এ বাংরিজিই নাকি পশ্চিমবঙ্গে এখন তোমাদের জাতীয় ভাষা।
তা ইংরেজি শিখতে গেলে ওরকম একটু-আধটু হবে না? দুটো ভাষার ঘষাঘষিতে ওরকম হতেই পারে তো।
এটা ইংরেজি শেখার নমুনা নাকি? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এরকম বাংলা যারা বলে তাদের বেশিরভাগই একটা ইংরেজি শব্দও শুদ্ধভাবে বলতে পারে না। তারা ইংরেজিও শেখেনি, বাংলাও শেখেনি।
তা কী করবে আমাদের ছেলেমেয়েরা? বাংলা শিখলে কি চাকরি মেলে? সে মেলে ইংরেজি শিখলে। সেটা শিখব না?
ও মা, সে কথা আমি কখন বললাম? ইংরেজি একশবার শিখবে। ইংরেজি শিখবে, ফরাসি-জার্মান-স্প্যানিশ শিখবে, সংস্কৃত-আরবি-ফারসি শিখবে। যা শিখবে সব ভালো করে শিখবে। চালিয়াতি-রকমের শিখবে না। তাই বলে ছেলেমেয়েদের নিজের জন্মভাষাটাকে ভুলিয়ে দেবে কেন? এই সহজ কথাটা লোকে বোঝে না। এই আমার কয়েক দশকের দুঃখ। কিন্তু তাই বলে আমি মনে করি না বাংলা ভাষা উবে গেল বলে। যে ভাষায় দু-বাংলাতেই রোজ একটা করে দৈনিক কাগজ বেরুচ্ছে, নতুন টিভি চ্যানেল হচ্ছে, হাজার হাজার কবি-লেখক হাজার হাজার বই নিক্ষেপ করছেন প্রতি বইমেলায়, লিট্ল ম্যাগাজিনে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে দেশ, এমনকি লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টোতে পর্যন্ত চলছে বাংলা কাগজ, ইন্টারনেটে ফেসবুকে ইউটিউবে পর্যন্ত বাংলা জায়গা দখল করছে- সে ভাষাকে মেরে ফেলা অত সহজ নয়। কিছু ছেলেমেয়ে ভাষাকে ছেড়ে যাবে তো আরও লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ভাষার কাছে আসবে ওমা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো বলে। একটু থেমে একুশে বলল, আমি কি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি? তার গলাটা ধরা-ধরা মনে হল যেন।
আমি হেসে তাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললাম, তা হয়তো পড়ছ, সে ঠিক আছে। বলো কী বলছিলে?
আর এই মুখের বাণী? জীবনে কি ভেবেছিলাম কোনো দেশের এক রাজনৈতিক মাথা প্রকাশ্য বক্তৃতার মধ্যে বলবেন অস্রাব্য বদকথা? তাতে হাততালি পড়বে? এজন্যই কি শহীদেরা প্রাণ দিয়েছিল?
আমি একুশেকে বললাম, দেখ, এখন দিনকাল অনেক বদলে গেছে, মানুষের ভাষাও বদলে গেছে। একজন পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে যাওয়া কবি বলেছেন, এসব শব্দ হল হীরের টুকরো।
হ্যাঁ, হীরের টুকরোই বটে। এও সেদিন বাংলাদেশে এক সংসদ সদস্যের চুদুরবুদুর কথাটা নিয়ে দুবাংলায় কী হৈচৈ পড়ে গেল। তাও সেটা ছিল গ্রাম্যভাষা, সে অর্থে অশালীন নয়। কিন্তু এখন তো অশালীন ভাষা ছুড়ে দেয়া হচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো, তোমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মুখে কিছুই আটকাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গ শুনেছি এ ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে গেছে।
আমি হাতজোড় করে বললাম, দোহাই, বাংলাদেশ যেন একটু পিছিয়ে থাকে এই জায়গায়, আমরা অত প্রগতি চাই না আমার বাংলাদেশী ভাই-বোনদের জন্য। একেই সেখানে নানা অশান্তি চলছে, পেট্রলবোমায় মানুষ মরার কথা খবরে পড়ি, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়।
একুশে বলল, তুমি বিদেশী, তোমার এ নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কী আছে। আমাদের কষ্ট আমরাই বুকে চেপে রাখি না হয়।
আমি বললাম, হ্যাঁ, এখন আমি বিদেশী বটে, কিন্তু আমার জন্ম তো তোমার এলাকাতেই হয়েছিল। তোমার গৌরবে আমরাও কিছুটা গৌরব ছিনিয়ে নিতে চেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ে আমরাও উৎসব করেছি। আর তোমার সরকার তো আমাকে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু বলে স্বীকার করেছে। তাই কেন যেন তোমার সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমার সুখ-দুঃখ মিশে যেতে চায়।
একুশ নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, কী অর্থহীন এই সব মৃত্যু! যারা বোমা ছুড়ছে, তারা কি জানে না যে, যাদের তারা মারছে তাদের সবাই সরকার পক্ষের, শাসক পক্ষের নয়। যে শিশুগুলো পুড়ে মরছে, বোমা-নিক্ষেপকারী কি জিজ্ঞেস করে তারা কোন দলের? যে অসহায় নারীরা পুড়ল, তারা সবাই কি শাসক দলের? আমাদেরই এক দরদি কবি না একবার লিখেছিলেন- কাণ্ডারি, বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার? ডুবিছের জায়গায় পুড়িছে লিখলেও কথাটা বদলায় না- সন্তান মোর মার। দেশের সন্তান, ভাষার সন্তান। যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল বরকতরা, যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে ৩০ লাখ বাঙালি, সম্মান দিয়েছে মা-বোনেরা, তারা সব আমার সন্তান, একুশে ফেব্র“য়ারির সন্তান। এদের মৃত্যু আমাকে উন্মাদ করে দেয়। একুশের গলায় কান্নার মতো কী একটা জেগে উঠল।
একটু পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একুশে বলল, জান কি? ওই ওরা- বরকত, সালাম, জব্বার থেকে শুরু করে শিলচরের সবাই, পৃথিবীর সব ভাষা শহীদ এখন আমার বুকের মধ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ওই পুড়ে যাওয়া মানুষগুলো এসে আমার বুকের মধ্যে আশ্রয় চায়। তাদের সঙ্গে আমিও রক্তাক্ত হই। আমিও পুড়ি। ভাবি, কবে আমার কষ্টের শেষ হবে। কবে তোমাদের মুখে বাংলা ভাষা তার জীবন্ত অহংকারী সুন্দর মুখ নিয়ে জেগে উঠবে, কবে আমার দেশের মানুষেরা আগুনের পরীক্ষা পার হয়ে, সবুজের মধ্যকার লাল সূর্যটাকে মুঠোতে ধরে বাংলাদেশে রাঙা আলোর সকাল ছড়িয়ে দেবে।
একুশে আবার একটু থেমে বলল, আমি বড় ঘন ঘন আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি আজকাল।
আমি বললাম, এই আবেগ অক্ষয় হোক। ওই আবেগটুকু ছিল বলেই বাঙালি বেঁচে আছে।
পবিত্র সরকার : সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা; লেখক
pabitra37@gmail.com
No comments