খুনিরা দিব্যি চলে গেল, পুলিশ নীরবে দেখল
একুশের
বইমেলার কারণে টিএসসি মোড়ে ছিল বিপুল মানুষের সমাগম। ছিল চারপাশ ঘিরে তিন
স্তরে পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনী। এ রকম কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে লেখক ও
ব্লগার অভিজিৎ রায় কী করে খুন হলেন এবং খুনিরা কী করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে
গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে বলছেন, ঘটনাস্থল ও এর আশপাশে অস্ত্র হাতে পুলিশ সদস্যরা থাকলেও তাঁরা ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। হামলাকারীদের ধাওয়াও করেননি তাঁরা।
অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় কুমার রায় ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘পুলিশ হয়তো আমার ছেলের খুন ঠেকাতে পারত না। কিন্তু পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তারা তো খুনিদের ধরতে পারত।’
পুলিশ যে ঘটনাস্থলেই ছিল, সে কথা পুলিশ কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পুলিশ নয়, সেখানে অনেক সাধারণ লোকও ছিলেন।
রমনা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘একজন পুলিশ ঘটনা দেখে মনে করেছিল, মারামারি হচ্ছে। এ রকম যে ঘটবে, সেটা আগে বুঝতে পারেনি।’
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎকে। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর জখম হন। তিনি এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি শঙ্কামুক্ত নন বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
যে জায়গায় অভিজিতের ওপর হামলা হয়েছে, সে পথ দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বইমেলায় যাওয়া-আসা করেন। আর ঘটনাস্থল থেকে টিএসসি মোড় আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথের দূরত্ব কয়েক গজ। টিএসসি মোড়ে মেলার জন্য ব্যারিকেড দিয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসই পাহারায় রয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া শাহবাগ থানা সেখান থেকে খুব কাছেই। শাহবাগ মোড়, বইমেলা পেরিয়ে দোয়েল চত্বর, ফুলার রোডের মোড়, নীলক্ষেতসহ ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখে ছিল সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা।
তবে পুলিশ এ ঘটনা না বুঝলেও একটি গোষ্ঠী আগে থেকে ঘোষণা দিয়েই অভিজিৎকে খুন করে। এমনকি খুনের পর ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের একটি সংগঠন ‘টুইট’ করে খুনের দায় স্বীকার করে। এখন তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা মনে করছেন, এ খুনের সঙ্গে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা আছে।
অভিজিৎ খুনের ঘটনায় তাঁর বাবা অজয় রায় বাদী হয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় তিনি কোনো আসামির নাম বা কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। তবে গতকাল বিকেলে তিনি নিজের বাসায় প্রথম আলোকে বলেন, ব্লগে লেখালেখির কারণে উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত-শিবির। এদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল বেলা একটার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হত্যাকাণ্ডের স্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের দায়িত্ব ডিবির কাছে এখনো না এলেও কাজ শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি।’
আগের জঙ্গি হামলার সঙ্গে এ হামলার মিল আছে কি না, জানতে চাইলে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনা আলাদা। প্রতিটি ঘটনার প্যাটার্ন আলাদা। ভিকটিমও আলাদা। আমরা কাজ করছি, সময় ধরে বলা যাবে না। তবে আমরা অপরাধী খুঁজে বের করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার এস এম শিবলী নোমান প্রথম আলোকে বলেন, আনসার বাংলা-৭ নামের একটি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে টুইট করেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে তারা ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রথম টুইট করা হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে, যাতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহু আকবর...বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন...’ পরের টুইটে অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়েছে, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অপরাধের’ জন্য ইসলামবিরোধী ব্লগার আমেরিকান বাঙালি অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে।’
হামলার পর মাটিতে লুটিয়ে থাকা অভিজিতের পাশে তাঁর স্ত্রীর রক্তাক্ত একটি ছবি শেয়ার করে লেখা হয় ‘এক্সক্লুসিভ!’ এতে বলা হয়েছে, ‘এটা স্বামীর মাথা ধরে থাকা অভিজিৎ রায়ের রক্তাক্ত স্ত্রী। শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। গত তিন থেকে চার বছর ধরে সে শীর্ষ টার্গেটে ছিল।’
সূত্র জানায়, জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের করা খুনের তালিকায় ৪ নম্বরে ছিলেন লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ অনুসারী ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র ডিবিকে এ তথ্য দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা।
ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার তৎকালীন তদন্ত তদারক কর্মকর্তা উপকমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ ছাত্র এহসান রেজা, ফয়সাল, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ, নাফিস ইমতিয়াজ ও মাকসুদুল হাসান ওরফে অনীক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি পুলিশকে বলেছিলেন, তাঁরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান ও তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীর খুতবা ও বয়ানে অংশ নিতেন। জসীমউদ্দিন রাহমানী খুতবা ও বয়ানে মহানবী (সা.) ও ধর্মকে অবমাননাকারী ব্লগারদের কতল বা খুন করতে উৎসাহিত করতেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা আটজন ব্লগারকে খুন করার জন্য তালিকা করেন। জসীমউদ্দিন রাহমানী এখন কারাগারে আছেন।
ব্লগার রাজীব খুনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে এমন একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। এতেও লেখক-ব্লগার অভিজিতের নাম রয়েছে।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্বে থাকা রানা পলাতক আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই খুনেও রানার সম্পৃক্ততা আছে। এ ছাড়া ব্লগারদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার জন্য শফিউর রহমান ফারাবীকে সন্দেহজনক গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। ফারাবী অভিজিৎকে হত্যা করতে চান—এমন মন্তব্য ফেসবুকেও করেছেন। এতে বলা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’
বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফুচকা বিক্রেতা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, হামলা করেছে দুজন। একজনের গায়ে ছিল সাদা শার্ট, অন্যজন কোট পরে ছিল। বয়স ৩০-৩৫ বছরের মতো। তারা মাত্র এক মিনিট সময় নিয়েছে। হামলার পর দুজন দুই দিকে চলে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হামলার পর অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী ঘটনাস্থলে পড়ে কাতরালেও কেউ হাসপাতালে নেওয়ার আগ্রহ দেখাননি।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে অভিজিতের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হিমঘরে রাখা হয়। ময়নাতদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অভিজিতের মাথার পেছনের তিন স্থানের হাড় ভেদ করে মস্তিষ্ক কেটে যায়। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া তাঁর পিঠ ও ভ্রুর ওপর জখম ছিল।
অভিজিতের ছোট ভাই অরিজিৎ রায়ের স্ত্রী কেয়া বর্মণ বলেন, অভিজিতের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে গবেষণার জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, অভিজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কাল রোববার সকাল ১০টায় মৃতদেহ বড় মগবাজারের বাসায় আনা হবে। এরপর ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে বলছেন, ঘটনাস্থল ও এর আশপাশে অস্ত্র হাতে পুলিশ সদস্যরা থাকলেও তাঁরা ছিলেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়। হামলাকারীদের ধাওয়াও করেননি তাঁরা।
অভিজিতের বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় কুমার রায় ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘পুলিশ হয়তো আমার ছেলের খুন ঠেকাতে পারত না। কিন্তু পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে তারা তো খুনিদের ধরতে পারত।’
পুলিশ যে ঘটনাস্থলেই ছিল, সে কথা পুলিশ কর্মকর্তারাই স্বীকার করেছেন। পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার আবদুল বাতেন প্রথম আলোকে বলেন, শুধু পুলিশ নয়, সেখানে অনেক সাধারণ লোকও ছিলেন।
রমনা অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) এস এম শিবলী নোমান আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘একজন পুলিশ ঘটনা দেখে মনে করেছিল, মারামারি হচ্ছে। এ রকম যে ঘটবে, সেটা আগে বুঝতে পারেনি।’
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলন চত্বরের উল্টো দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসংলগ্ন ফুটপাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎকে। এ ঘটনায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা গুরুতর জখম হন। তিনি এখন রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি শঙ্কামুক্ত নন বলে পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে।
যে জায়গায় অভিজিতের ওপর হামলা হয়েছে, সে পথ দিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বইমেলায় যাওয়া-আসা করেন। আর ঘটনাস্থল থেকে টিএসসি মোড় আর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথের দূরত্ব কয়েক গজ। টিএসসি মোড়ে মেলার জন্য ব্যারিকেড দিয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসই পাহারায় রয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া শাহবাগ থানা সেখান থেকে খুব কাছেই। শাহবাগ মোড়, বইমেলা পেরিয়ে দোয়েল চত্বর, ফুলার রোডের মোড়, নীলক্ষেতসহ ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশমুখে ছিল সার্বক্ষণিক পুলিশি পাহারা।
তবে পুলিশ এ ঘটনা না বুঝলেও একটি গোষ্ঠী আগে থেকে ঘোষণা দিয়েই অভিজিৎকে খুন করে। এমনকি খুনের পর ‘আনসার বাংলা-৭’ নামের একটি সংগঠন ‘টুইট’ করে খুনের দায় স্বীকার করে। এখন তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তাঁরা মনে করছেন, এ খুনের সঙ্গে জঙ্গিদের সংশ্লিষ্টতা আছে।
অভিজিৎ খুনের ঘটনায় তাঁর বাবা অজয় রায় বাদী হয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন। মামলায় তিনি কোনো আসামির নাম বা কোনো কারণ উল্লেখ করেননি। তবে গতকাল বিকেলে তিনি নিজের বাসায় প্রথম আলোকে বলেন, ব্লগে লেখালেখির কারণে উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদের মদদ দিয়েছে জামায়াত-শিবির। এদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল বেলা একটার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হত্যাকাণ্ডের স্থল পরিদর্শন করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ডিবির উপকমিশনার (দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের দায়িত্ব ডিবির কাছে এখনো না এলেও কাজ শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি।’
আগের জঙ্গি হামলার সঙ্গে এ হামলার মিল আছে কি না, জানতে চাইলে কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনা আলাদা। প্রতিটি ঘটনার প্যাটার্ন আলাদা। ভিকটিমও আলাদা। আমরা কাজ করছি, সময় ধরে বলা যাবে না। তবে আমরা অপরাধী খুঁজে বের করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পুলিশের রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার এস এম শিবলী নোমান প্রথম আলোকে বলেন, আনসার বাংলা-৭ নামের একটি সংগঠন এই হামলার দায় স্বীকার করে টুইট করেছে। এ হত্যাকাণ্ডকে তারা ‘বিজয়’ হিসেবে দাবি করেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রথম টুইট করা হয়েছে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে, যাতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহু আকবর...বাংলাদেশে আজ একটি বিশাল সাফল্য। টার্গেট ইজ ডাউন...’ পরের টুইটে অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রীর একটি ছবি শেয়ার করে বলা হয়েছে, ‘ইসলামের বিরুদ্ধে ‘অপরাধের’ জন্য ইসলামবিরোধী ব্লগার আমেরিকান বাঙালি অভিজিৎ রায়কে রাজধানী ঢাকায় হত্যা করা হয়েছে।’
হামলার পর মাটিতে লুটিয়ে থাকা অভিজিতের পাশে তাঁর স্ত্রীর রক্তাক্ত একটি ছবি শেয়ার করে লেখা হয় ‘এক্সক্লুসিভ!’ এতে বলা হয়েছে, ‘এটা স্বামীর মাথা ধরে থাকা অভিজিৎ রায়ের রক্তাক্ত স্ত্রী। শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। গত তিন থেকে চার বছর ধরে সে শীর্ষ টার্গেটে ছিল।’
সূত্র জানায়, জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের করা খুনের তালিকায় ৪ নম্বরে ছিলেন লেখক-ব্লগার অভিজিৎ রায়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের পাঁচ অনুসারী ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র ডিবিকে এ তথ্য দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন ডিবির কর্মকর্তারা।
ব্লগার রাজীব হত্যা মামলার তৎকালীন তদন্ত তদারক কর্মকর্তা উপকমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পাঁচ ছাত্র এহসান রেজা, ফয়সাল, নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ, নাফিস ইমতিয়াজ ও মাকসুদুল হাসান ওরফে অনীক জিজ্ঞাসাবাদে ডিবি পুলিশকে বলেছিলেন, তাঁরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান ও তাত্ত্বিক নেতা মুফতি জসীমউদ্দিন রাহমানীর খুতবা ও বয়ানে অংশ নিতেন। জসীমউদ্দিন রাহমানী খুতবা ও বয়ানে মহানবী (সা.) ও ধর্মকে অবমাননাকারী ব্লগারদের কতল বা খুন করতে উৎসাহিত করতেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা আটজন ব্লগারকে খুন করার জন্য তালিকা করেন। জসীমউদ্দিন রাহমানী এখন কারাগারে আছেন।
ব্লগার রাজীব খুনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে এমন একটি তালিকা দেওয়া হয়েছিল। এতেও লেখক-ব্লগার অভিজিতের নাম রয়েছে।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ব্লগার রাজীব হত্যাকাণ্ডের পর থেকে পরিকল্পনাকারী ও নেতৃত্বে থাকা রানা পলাতক আছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই খুনেও রানার সম্পৃক্ততা আছে। এ ছাড়া ব্লগারদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার জন্য শফিউর রহমান ফারাবীকে সন্দেহজনক গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। ফারাবী অভিজিৎকে হত্যা করতে চান—এমন মন্তব্য ফেসবুকেও করেছেন। এতে বলা হয়, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব না। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে।’
বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফুচকা বিক্রেতা আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, হামলা করেছে দুজন। একজনের গায়ে ছিল সাদা শার্ট, অন্যজন কোট পরে ছিল। বয়স ৩০-৩৫ বছরের মতো। তারা মাত্র এক মিনিট সময় নিয়েছে। হামলার পর দুজন দুই দিকে চলে যায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হামলার পর অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী ঘটনাস্থলে পড়ে কাতরালেও কেউ হাসপাতালে নেওয়ার আগ্রহ দেখাননি।
গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে অভিজিতের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ হিমঘরে রাখা হয়। ময়নাতদন্তকারী ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ধারালো অস্ত্রের আঘাতে অভিজিতের মাথার পেছনের তিন স্থানের হাড় ভেদ করে মস্তিষ্ক কেটে যায়। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া তাঁর পিঠ ও ভ্রুর ওপর জখম ছিল।
অভিজিতের ছোট ভাই অরিজিৎ রায়ের স্ত্রী কেয়া বর্মণ বলেন, অভিজিতের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজে গবেষণার জন্য দান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, অভিজিৎ রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কাল রোববার সকাল ১০টায় মৃতদেহ বড় মগবাজারের বাসায় আনা হবে। এরপর ১১টা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে রাখা হবে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
No comments