ঘুমের ঘাটে by জাহেদ মোতালেব
ছোট বোন পারুল অদ্ভুত ধরনের। ধানের পাতার মতো সুন্দর। কেবল স্বপ্ন দেখে। কত রকম যে তার স্বপ্ন! কেউ শুনে শেষ করতে পারবে না। বিরক্তি চলে আসতে পারে। বলবে, যা তো, তোর স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়। একদিন সে সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুমের মধ্যে পাথরঘাটা হয়ে যায় ঘুমের ঘাট। ঘুমের ঘাটে একদল দস্যু আসে। তারা পারুলকে নিয়ে যায়। সুলতান কী করবে? ঘুমের ঘাটে একটা জাহাজ তৈরি করার কথা ভাবে। মনে হয় ইতিহাসের ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর পৃষ্ঠা দিয়ে তৈরি হবে জাহাজের পাল। পাথরঘাটা কিংবা বন্দরগ্রামের পুরোনো সেই সব বাড়ির কাঠ, যাতে এখনো পর্তুগিজ দস্যু বা আরাকানিদের গন্ধ রয়ে গেছে, তা দিয়ে তৈরি হবে জাহাজ। তারপর সে বেরিয়ে পড়বে। কীভাবে পারুলকে খুঁজবে, ব্রিজঘাটে বসে সম্ভবত তা-ই ভাবছিল। বাবলু এসে তার সামনে মেলে ধরে আসমানতারা, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের উপন্যাস। সে পড়ে: ‘জীবন তো এক। ওই আগুনের মতো। মনে হয় রূপ তার অন্তহীন।’ বাঁ হাতে বইটা সরিয়ে দেয়।
বাবলু বলল, ‘চা খাবি?’
সুলতান দেখে, গাঙচিলগুলো ইচ্ছেমতো উড়ছে। তার মনটাও আজ উড়ুউড়ু। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে পারুলের সঙ্গে। কথাগুলো যদি ক্যাসেটের ফিতা হয়ে যায়, ফিতা নিয়ে সে ছেলেবেলার মতো দৌড়াবে। পেছনে পারুলকে কান্না করতে দেখলে থামবে। তাকে ফিতা দিয়ে দেবে। তখন হাসি ফুটবে তার মুখে। বাবলু তার কলেজজীবনের বন্ধু। থিসিস নিয়ে কথা বলতে চায়। সে ‘অমানুষের ইতিহাস’ বিষয়ে চিন্তা করে। তাকে ‘মধ্যযুগে সমাজে নারীর ভূমিকা’ নিয়ে থিসিস লিখতে হবে। সে ওই সময়ের সমাজের কথা ভাবে। নিজেকে প্রশ্ন করে, সমাজ কীভাবে চলে? মনে হয়, সমাজ নারীর চোখে বাসা বাঁধে। কিন্তু পুরুষ এসে বাসাটায় ময়লা জমায়, ভেঙে ফেলতে চায়। এমন কথা থিসিসে লিখতে পারব? ভাবে সে। সুলতান ভাবে, সময়টা ঝামেলার মহারাজ। পাখি হয়ে ঠোঁটে পোকা নিয়ে কেবল ওড়ে। দুপুরে মা ডিম মামলেট করেছিল। একটা ডিম তারা চারজনে ভাগ করে খেত। আজ ডিমটা তিন ভাগ হয়েছে। তাই পারুলের কথা বেশি মনে পড়ছে। মামলেট সে খুবই পছন্দ করত। সে কি মামলেট হয়ে ভোগে চলে গেছে? এ কথা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। কষ্ট যেন কচুরিপানা, কর্ণফুলীর পানিতে ভাসে। বাবলুর মন বিষণ্ন। মুখটা এখন জোয়ারের পানির মতো থমথমে। সে কি পারুলের কথা ভাবছে? মাঝি যেভাবে বসে বইঠা চালায়, তার ভঙ্গি তেমন। মনে হয়, নৌকা চালিয়ে সে কোথাও চলে যাচ্ছে।
দুই বছর ধরে সুলতান বেকার। আসমানতারার প্রচ্ছদ দেখে। আপনমনে বলে, ‘প্রলেতারিয়েত কী রকম বেঁচে থাকে বুঝতে পারছি।’ নগরের লাইটগুলো মানুষের মুখে রং মাখতে মাখতে ঝাপসা হয়ে গেছে। সুলতান মাথা নিচু করে হাঁটে। বাসায় যাচ্ছে। একটা লোককে তাড়া করেছে রাস্তার মেয়েটা। বলে, ‘আমার টাকা দিয়ে যা।’ লোকটার পিছু পিছু মেয়েটা কর্ণফুলীর পাড়ে পৌঁছে যায়। সুলতানও তাদের পিছে হাঁটে। লবণের কারখানার গন্ধ, পানি আর স্রোতের গন্ধে সে ভুলে যায় কেন এসেছে। তার মনে হয়, সামনে অন্ধকারের মাঠ। এখানে কি কোথাও ঘাট ছিল? সেই ঘাটে অনেক কাল আগে সে একবার হারিয়ে গিয়েছিল! তার ইচ্ছে করে হারানো সেই সময়কে খুঁজে পেতে। তাই বুক ভরে বাতাস নেয়। তার চোখে পারুলের মতো টলটল করে কান্না। হতে পারে কৃষ্ণপক্ষের রাত অথবা রুপালি জোছনার। তাতে কিছু যায়-আসে না। কানফুল হারানো মেয়েটি কর্ণফুলী থেকে কাঁদতে কাঁদতে উঠে এলেও কেউ দেখতে পাবে না। কারণ, রাত এখন বয়স্ক মানুষের মতো থুত্থুড়ে।
অনেক দিন আগে এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় কোনো পর্তুগিজ, ফরাসি কিংবা ইংরেজ পারুলের মতো কাউকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কি না, কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের পানিতে মিশিয়ে গিলে খেয়েছিল কি না, তা আজ কে বলতে পারে? সেই নারীর চোখের রং পারুলকে নিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের চোখে আছে কি না, তারা ওসব দস্যুর বংশধর কি না, তা-ও বা কে জানতে চাইবে? কিন্তু মানুষ যে এখনো পুরোনো মানুষের মতো রয়ে গেছে, তা কি পারুল জানত না?
সুলতান হাঁটছে ধীর পায়ে। এই শরতেও পায়ে পায়ে কুয়াশা। পুরোনো গির্জার ওপর যে ঘণ্টা কিংবা সেন্ট প্লাসিডস স্কুল, সারিবদ্ধ কবর আর ফুল ছুঁয়ে কে যেন এদিকে আসে। এসে তার কানে কানে বলে পাথরঘাটায় পাথরচাপা পড়া কোনো কথা। কিন্তু কথাগুলো কুয়াশা হয়ে যায়। তাই সে বুঝতে পারে না। ভাবে, প্রতিটা দিনের মধ্যেই হয়তো লুকানো থাকে ইতিহাস। এ রকম রাতে কেন একটা পুরুষ কুকুরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে? কেন খোয়া ওঠা রাস্তার মতো মেয়েটা রাস্তারই সঙ্গী হয়ে থাকে? এসব প্রশ্ন তার কাছে কেবলই কুয়াশা। সেই কুয়াশা নিয়ে সে শীতের বাড়ি বেড়াতে যায়। দুপুরে ভাত খেয়ে পারুলের সঙ্গে রোদ পোহায়। পারুলকে ছায়া দিয়ে দাঁড়ায়। তখন পারুল মোড়া থেকে উঠে তার কানটা টেনে দেয়। সুলতান মায়ের কাছে নালিশ করে। মা হাসে। সেই হাসিতে শীত কেটে উষ্ণতা হাসনাহেনার গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পাথরঘাটার সেই পাথরগুলো আজ কোথায়? পারুলের উজ্জ্বল চোখের ঘুম-ঘুম ভাব হয়ে তা কি হারিয়ে গেছে? নাকি এ পাথর সুলতানের দুই চোখে চাপা পড়ে আছে! চাপা পড়া পাথরে ঘুমের হাট বসেছে?
ঘরে গেলে পাগলপ্রায় মা জিজ্ঞেস করে, ‘পারুল কোথায়?’
চুলে হাত বুলিয়ে চুপ করে বসে থাকে সুলতান। মা আবার জানতে চায়। সে হেসে বলে, ‘মা! আজ একটা ঘটনা ঘটছে। দেখলাম, পারুলের মতো একটা মেয়ে...’
এ কথা শুনে মার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। সুলতান ভাবে, পাথরঘাটায়, এ নগরে কিংবা দূর দূর গ্রামে যেসব দস্যু লুটপাট চালিয়েছে, তাদেরই কোনো বংশধর হয়তো নিয়ে গেছে পারুলকে। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল, পুলিশ কিছুই করতে পারল না। মাঝিরঘাটের নসু মালুমকে দিয়ে এবার সত্যি সত্যি জাহাজটা বানাবে। পারুলকে খুঁজে পেতেই হবে। ভাবতে ভাবতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তবে তার মধ্যে বানের পানির মতো রাগ জমে। এই পানিতে কী ভেসে যায় কে জানে!
বাবলু বলল, ‘চা খাবি?’
সুলতান দেখে, গাঙচিলগুলো ইচ্ছেমতো উড়ছে। তার মনটাও আজ উড়ুউড়ু। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে পারুলের সঙ্গে। কথাগুলো যদি ক্যাসেটের ফিতা হয়ে যায়, ফিতা নিয়ে সে ছেলেবেলার মতো দৌড়াবে। পেছনে পারুলকে কান্না করতে দেখলে থামবে। তাকে ফিতা দিয়ে দেবে। তখন হাসি ফুটবে তার মুখে। বাবলু তার কলেজজীবনের বন্ধু। থিসিস নিয়ে কথা বলতে চায়। সে ‘অমানুষের ইতিহাস’ বিষয়ে চিন্তা করে। তাকে ‘মধ্যযুগে সমাজে নারীর ভূমিকা’ নিয়ে থিসিস লিখতে হবে। সে ওই সময়ের সমাজের কথা ভাবে। নিজেকে প্রশ্ন করে, সমাজ কীভাবে চলে? মনে হয়, সমাজ নারীর চোখে বাসা বাঁধে। কিন্তু পুরুষ এসে বাসাটায় ময়লা জমায়, ভেঙে ফেলতে চায়। এমন কথা থিসিসে লিখতে পারব? ভাবে সে। সুলতান ভাবে, সময়টা ঝামেলার মহারাজ। পাখি হয়ে ঠোঁটে পোকা নিয়ে কেবল ওড়ে। দুপুরে মা ডিম মামলেট করেছিল। একটা ডিম তারা চারজনে ভাগ করে খেত। আজ ডিমটা তিন ভাগ হয়েছে। তাই পারুলের কথা বেশি মনে পড়ছে। মামলেট সে খুবই পছন্দ করত। সে কি মামলেট হয়ে ভোগে চলে গেছে? এ কথা ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল। কষ্ট যেন কচুরিপানা, কর্ণফুলীর পানিতে ভাসে। বাবলুর মন বিষণ্ন। মুখটা এখন জোয়ারের পানির মতো থমথমে। সে কি পারুলের কথা ভাবছে? মাঝি যেভাবে বসে বইঠা চালায়, তার ভঙ্গি তেমন। মনে হয়, নৌকা চালিয়ে সে কোথাও চলে যাচ্ছে।
দুই বছর ধরে সুলতান বেকার। আসমানতারার প্রচ্ছদ দেখে। আপনমনে বলে, ‘প্রলেতারিয়েত কী রকম বেঁচে থাকে বুঝতে পারছি।’ নগরের লাইটগুলো মানুষের মুখে রং মাখতে মাখতে ঝাপসা হয়ে গেছে। সুলতান মাথা নিচু করে হাঁটে। বাসায় যাচ্ছে। একটা লোককে তাড়া করেছে রাস্তার মেয়েটা। বলে, ‘আমার টাকা দিয়ে যা।’ লোকটার পিছু পিছু মেয়েটা কর্ণফুলীর পাড়ে পৌঁছে যায়। সুলতানও তাদের পিছে হাঁটে। লবণের কারখানার গন্ধ, পানি আর স্রোতের গন্ধে সে ভুলে যায় কেন এসেছে। তার মনে হয়, সামনে অন্ধকারের মাঠ। এখানে কি কোথাও ঘাট ছিল? সেই ঘাটে অনেক কাল আগে সে একবার হারিয়ে গিয়েছিল! তার ইচ্ছে করে হারানো সেই সময়কে খুঁজে পেতে। তাই বুক ভরে বাতাস নেয়। তার চোখে পারুলের মতো টলটল করে কান্না। হতে পারে কৃষ্ণপক্ষের রাত অথবা রুপালি জোছনার। তাতে কিছু যায়-আসে না। কানফুল হারানো মেয়েটি কর্ণফুলী থেকে কাঁদতে কাঁদতে উঠে এলেও কেউ দেখতে পাবে না। কারণ, রাত এখন বয়স্ক মানুষের মতো থুত্থুড়ে।
অনেক দিন আগে এ রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার সময় কোনো পর্তুগিজ, ফরাসি কিংবা ইংরেজ পারুলের মতো কাউকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল কি না, কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের পানিতে মিশিয়ে গিলে খেয়েছিল কি না, তা আজ কে বলতে পারে? সেই নারীর চোখের রং পারুলকে নিয়ে যাওয়া দুর্বৃত্তদের চোখে আছে কি না, তারা ওসব দস্যুর বংশধর কি না, তা-ও বা কে জানতে চাইবে? কিন্তু মানুষ যে এখনো পুরোনো মানুষের মতো রয়ে গেছে, তা কি পারুল জানত না?
সুলতান হাঁটছে ধীর পায়ে। এই শরতেও পায়ে পায়ে কুয়াশা। পুরোনো গির্জার ওপর যে ঘণ্টা কিংবা সেন্ট প্লাসিডস স্কুল, সারিবদ্ধ কবর আর ফুল ছুঁয়ে কে যেন এদিকে আসে। এসে তার কানে কানে বলে পাথরঘাটায় পাথরচাপা পড়া কোনো কথা। কিন্তু কথাগুলো কুয়াশা হয়ে যায়। তাই সে বুঝতে পারে না। ভাবে, প্রতিটা দিনের মধ্যেই হয়তো লুকানো থাকে ইতিহাস। এ রকম রাতে কেন একটা পুরুষ কুকুরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে? কেন খোয়া ওঠা রাস্তার মতো মেয়েটা রাস্তারই সঙ্গী হয়ে থাকে? এসব প্রশ্ন তার কাছে কেবলই কুয়াশা। সেই কুয়াশা নিয়ে সে শীতের বাড়ি বেড়াতে যায়। দুপুরে ভাত খেয়ে পারুলের সঙ্গে রোদ পোহায়। পারুলকে ছায়া দিয়ে দাঁড়ায়। তখন পারুল মোড়া থেকে উঠে তার কানটা টেনে দেয়। সুলতান মায়ের কাছে নালিশ করে। মা হাসে। সেই হাসিতে শীত কেটে উষ্ণতা হাসনাহেনার গন্ধের মতো ছড়িয়ে পড়ে। পাথরঘাটার সেই পাথরগুলো আজ কোথায়? পারুলের উজ্জ্বল চোখের ঘুম-ঘুম ভাব হয়ে তা কি হারিয়ে গেছে? নাকি এ পাথর সুলতানের দুই চোখে চাপা পড়ে আছে! চাপা পড়া পাথরে ঘুমের হাট বসেছে?
ঘরে গেলে পাগলপ্রায় মা জিজ্ঞেস করে, ‘পারুল কোথায়?’
চুলে হাত বুলিয়ে চুপ করে বসে থাকে সুলতান। মা আবার জানতে চায়। সে হেসে বলে, ‘মা! আজ একটা ঘটনা ঘটছে। দেখলাম, পারুলের মতো একটা মেয়ে...’
এ কথা শুনে মার চোখ দিয়ে পানি গড়ায়। সুলতান ভাবে, পাথরঘাটায়, এ নগরে কিংবা দূর দূর গ্রামে যেসব দস্যু লুটপাট চালিয়েছে, তাদেরই কোনো বংশধর হয়তো নিয়ে গেছে পারুলকে। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল, পুলিশ কিছুই করতে পারল না। মাঝিরঘাটের নসু মালুমকে দিয়ে এবার সত্যি সত্যি জাহাজটা বানাবে। পারুলকে খুঁজে পেতেই হবে। ভাবতে ভাবতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। তবে তার মধ্যে বানের পানির মতো রাগ জমে। এই পানিতে কী ভেসে যায় কে জানে!
No comments