অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে ওরা by নুরুজ্জামান লাবু
অসহ্য
যন্ত্রণা। কারও চোখ-মুখ ঝলসে গেছে, কারওবা হাত-পা কিংবা শরীরের অন্যান্য
অংশ। কেউ কথা বলতে পারছেন একটু-আধটু, কারও সেই শক্তিও নেই। চেহারায় ফুটে
উঠছে যন্ত্রণায় কাতরানোর অভিব্যক্তি। মুখ ছাড়া শরীরের পোড়া অংশগুলোতে
ব্যান্ডেজ বাঁধা। হাতে কিংবা পায়ে লাগানো স্যালাইনের সূচ। কাউকে রাখা হয়েছে
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। কেউ আছেন সাধারণ বা অবজারভেশন ওয়ার্ডে। স্বজনদের
সবার চোখ অশ্রুসিক্ত। প্রিয়জনের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছেন নিজেরাও। যেন
দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরছে তাদের। কারণ যে স্বজন একদিন আগেও ছিল সুস্থ-সবল,
এখন তার ঠিকানা ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট। রাজনৈতিক সহিংসতার আগুনে
শুধু নিজে নয়, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাদের স্বপ্ন। ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে সাজানো
সংসার। হাতছানি দিয়ে ডাকছে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে প্রতিদিনই একজন-দুজন করে সহিংসতার আগুনে পোড়া রোগী
আসছিল। কিন্তু শুক্রবার রাতের চিত্র ছিল পুরোটাই ভিন্ন। একজন-দুজন নয়, একে
একে ৩০ জন নারী-পুরুষকে নেয়া হয় বার্ন ইউনিটে। এদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে
যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রল
বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে দগ্ধ হয় ওই বাসে থাকা অন্তত ৩০ যাত্রী।
যাদের মধ্যে ৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন বার্ন ইউনিটের পরিচালক
ডা. সামন্ত লাল সেন।
ইয়াসিন আরাফাত (৩৫) ও সাদিয়া জাহান পারভীন (২৫)। স্বামী-স্ত্রী। ইয়াসিন চাকরি করেন গাজীপুরের এমএসটি ফার্মাসিউটিক্যালের কারখানায় ফার্মাসিস্ট হিসেবে। স্ত্রী সাদিয়া জাহান পারভীনও ফার্মাসিস্ট। তিনি চাকরি করেন সোমাটেক ফার্মাসিউটিক্যাল নামে আরেক প্রতিষ্ঠানে। ইয়াসিন গাজীপুরে থাকেন, আর স্ত্রী পারভীন থাকেন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কাঠেরপুল এলাকায়। শুক্রবার অফিস শেষ করে গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসেন ইয়াসিন। স্ত্রী অপর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ধানমন্ডি গিয়েছিলেন। দু’জন ধানমন্ডিতে একত্র হন। তারপর গুলিস্থান গিয়ে সেই গ্লোরি পরিবহনের বাসটিতে ওঠেন। ইয়াসিন আরাফাত বলছিলেন, কাঠেরপুলি এলাকায় বাসটি আস্তে যাচ্ছিল। তাদের নামার কথা সেখানে। সিট থেকে উঠেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু মুহূর্তেই আগুনের গোলা এসে লাগলো বাসে। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো বাস। তিনি দৌড়ে দরজা দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন। বাসের যাত্রীরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। যে যেভাবে পারছে পড়িমরি করে নামার চেষ্টা করছে। নেমেছিলেন তিনিও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখেন স্ত্রী পারভীন নেই। মুহূর্তেই জ্বলতে থাকা বাসটিতে আবার উঠলেন, নাহ ভেতরে কেউ নেই। আবার নেমে আসেন ঠিকই, ততক্ষণে মাথার চুল, চোখ-মুখ ও দুই হাত আগুনে ঝলসে গেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ইয়াসিনের সঙ্গে থাকা মামা সাইফুল জানান, ইয়াসিনের পেছনে থাকা তার স্ত্রী পারভীন আগুন দেখে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছে শ্বাসনালীও। তাকে রাখা হয়েছে দোতালার ব্লু ইউনিটে। সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের রিম নামে দেড় বছরের একটি মেয়ে আছে। সে আছে দাদা-দাদির কাছে। সাইফুল বলেন, এই পরিবারটির এখন কি হবে। সুখের সংসারটি এভাবে তছনছ হয়ে গেল। আগুনে পোড়া এই ক্ষত তো তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
কেরানীগঞ্জের মামাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন নাজমুল হোসেন (২১)। রাতে গুলিস্থান হয়ে ভুলতা গাউছিয়ার বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিল বন্ধু সালমান সরকার হৃদয় (২০)। দুই বন্ধুই বাসের পেছন থেকে তিন নম্বর সিটে বসে ছিলেন। হৃদয় বলেন, হঠাৎ আগুন দেখে দাঁড়িয়ে যান তিনি। মাথা নিচু করে আগুনের আঁচ থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন প্রথমে। পরমুহূর্তেই জানালার গ্লাসটা এক লাত্থিতে ভেঙে সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসেন। আর নাজমুল বেরোতে গিয়ে একবার পড়ে গিয়েছিলেন বাসের মাঝখানের করিডোরে। পরে সেই জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনিও। নাজমুলের মুখসহ ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর হৃদয়ের পুড়ে গেছে ৬ শতাংশ। হৃদয় জানান, আমার জ্যাকেটেও আগুন ধরেছিল। আমি নিচে নেমে মাাটিতে গড়াগড়ি করে আগুন নিভিয়েছি। নাজমুলের বাবা মো. হানিফ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে মুগড়াপাড়া কলেজে ডিগ্রি পড়ার পাশাপাশি ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান করতো। তার আয়েই মূলত সংসার চলতো। এখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, যারা এ ধরনের কার্যকলাপ করে তাদের যেন দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার হয়। গরিব মানুষ যেন চইল্যা ফিরা খাইতে পারে, সরকার যেন সেই ব্যবস্থা করে।
আলামীন হোসেন অপু (২৭) কাজ করেন একটি গার্মেন্টে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। সেখানেই থাকেন তিনি। দশ দিন আগে সন্তান হয়েছে তার। স্ত্রী-সন্তান রয়েছে শশুরবাড়ি গুলশানের নর্দ্দায়। শুক্রবারে গার্মেন্ট বন্ধ ছিল। এই সুযোগে শিশু সন্তানকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে যান মা রহিমা বেগমকেও। রাতে শশুরবাড়ি থেকে মা-ছেলে ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ি। গুলিস্থানে গিয়ে মাকে তুলে দেন দোহারের গাড়িতে। আর অপু নিজে ওঠেন গ্লোরি পরিবহনের সেই বাসে, রূপগঞ্জের কর্মস্থলে ফেরার জন্য। কিন্তু ফেরার পথেই দগ্ধ হন তিনি। কথা বলতে পারছিলেন না অপু। মা রহিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দেশে এসব কি শুরু হইছে। আমার ছেলেডা আমারে ছাইড়া যাইতে না যাইতেই এমন পুইড়া গেল। এখন ওর ভবিষ্যৎ কি হবে? বলেই কাঁদছিলেন তিনি।
ভাতিজা আলামীনের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছিলেন মোজাফফর মোল্লা (৬০)। সঙ্গে ছিল ভায়রা মান্নান, শাজাহান, ভাতিজা আলামীন ও আলামীনের বন্ধু রফিকুল একসঙ্গে যাচ্ছিলেন মেয়ের বাড়িতে। পথে আগুনে মোজাফফর মোল্লা, মান্নান, শাজাহান দগ্ধ হয়েছেন। আলামীন ও রফিকুল দ্রুত বের হয়ে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছেন অল্পের জন্য। মোজাফফর মোল্লার স্ত্রী বিউটি বেগম জানান, তারা মোহাম্মদপুর বেড়িবাধে থাকেন। বছর খানেক আগে আগুনে তাদের বস্তির ঘর ও দোকান পুড়ে যায়। বর্তমানে তার স্বামী জামাইয়ের দোকানে দিন হাজিরার বিনিময়ে বসতেন। এবার নিজেই পুড়ে আহত হলেন। বিউটি বেগম বলেন, গরিবের ওপর একের পর এক ঝড় আসতেছে। যারা রাজনীতি করে তাদের কিছু হয় না। পুইড়া মরতে হইতেছে আমাগো। এখন আমি স্বামীরে চিকিৎসা করামু কি দিয়া আর সংসার চালামু কি দিয়া। বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিউটি বেগম।
শুক্রবারের এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি দগ্ধ হয়েছেন রাজমিস্ত্রিদের ঠিকাদার নূর আলম (৪০)। স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরে বোনের বাড়ি গিয়েছিলেন। রাতে সেখান থেকে ফিরছিলেন বাসায়। বাসে পেট্রবোমা নিক্ষেপে নূর আলমের শরীরের ৪৮ ভাগ ঝলসে গিয়েছে। দুই হাত, মুখ ও কোমর থেকে ওপরের অংশ পুরোটা ঝলসে গেছে আগুনে। মুখ ছাড়া পুরো শরীর ব্যান্ডেজে বাঁধা। কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট ও চোখ ফুলে গেছে। আগুনে পুড়ে কিছুটা বিকৃত হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। পাশে বসা শাশুড়ি শামেলা বলেন, এসব লেখে কি হবে? লিখলে কি ছেলেটা আগের মতো হবে? যারা আগুন দিয়া মানুষ পুড়াইতেছে তাদের ধরাইয়া দেন। তাদের শাস্তি দেন। দিনমজুর জমির আলী (৪৪) গাজীপুরের কাপাসিয়া হালমোড় এলাকায় থাকতেন। তার শ্বশুরবাড়ি রূপগঞ্জের বরফা এলাকায়। শাশুড়ি আম্বিয়া বেগমকে আনতে যাচ্ছিলেন রূপগঞ্জের বরফায়। গুলিস্থান থেকে গ্লোরি পরিবহনে উঠেছিলেন তিনি। দগ্ধ হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে। তার ছেলে রুবেল জানান, তার বাবার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে। রাতেই তারা মোবাইলে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন।
বার্ন ইউনিটে দুই মন্ত্রী: রাজনৈতিক সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ৭৮ জন ব্যক্তি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। এর মধ্যে ৫২ জন এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যার মধ্যে ৩০ জন দগ্ধ হয়েছেন শুক্রবার রাতেই। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বেগম জিয়া নিজেকে গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে দাবি করলেও বর্তমানে সন্ত্রাসের নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। দেশের জনগণ চায়, যারা সহিংসতা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এখন হঠাৎ করে চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। হামলাকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নাশকতা তৈরির রসদসহ অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গাড়িতে আগুন, বোমায় আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি, দগ্ধদের সুস্থ করে তুলুন। সরকার তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে অবরোধের আগুনে দগ্ধদের খোঁজ নিতে বার্ন ইউনিটে গিয়ে ভিড় না করতে মন্ত্রী, এমপিসহ সবার প্রতি আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অবরোধের আগুনে যারা দগ্ধ হয়েছেন তাদের খোঁজ নিতে হলে হাসপাতালে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ নিন। তাদের সাহায্য করতে চাইলে করুন। আমরা কেউ ডাক্তার নই, দর্শনার্থী হিসেবে বার্ন ইউনিটে আসবেন না।
বিকালে বার্ন ইউনিটে যান সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসীন আলী। মহসীন আলী এসময় বলেন, বার্ন ইউনিটের ভেতরের দৃশ্য দেখার পর আমি বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি তিন-চার দিন এখানে এসেছি। যারা এ ধরনের কাজ করেছে তারা মানুষ হলে তা করতে পারত না। তিনি দগ্ধদের জন্য আপাতত ৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন বলে জানান। মহসীন আলী বলেন, বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ বন্ধ করতে আত্মরক্ষার জন্য গাড়ি চালকদের কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্র দেয়া হবে। তিনি বলেন, পুলিশ-র্যাব যদি গুলি করতে চায় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে। কিন্তু চালকদের কাছে যদি লাইসেন্স করা অস্ত্র দেয়া হয় তাহলে তারা আত্মরক্ষার্থে নাশকতাকারীদের দমন করতে পারবে। তবে এটা তার ব্যক্তিগত মতামত বলেন জানান তিনি। বলেন, বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করবেন তিনি।
ইয়াসিন আরাফাত (৩৫) ও সাদিয়া জাহান পারভীন (২৫)। স্বামী-স্ত্রী। ইয়াসিন চাকরি করেন গাজীপুরের এমএসটি ফার্মাসিউটিক্যালের কারখানায় ফার্মাসিস্ট হিসেবে। স্ত্রী সাদিয়া জাহান পারভীনও ফার্মাসিস্ট। তিনি চাকরি করেন সোমাটেক ফার্মাসিউটিক্যাল নামে আরেক প্রতিষ্ঠানে। ইয়াসিন গাজীপুরে থাকেন, আর স্ত্রী পারভীন থাকেন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল কাঠেরপুল এলাকায়। শুক্রবার অফিস শেষ করে গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসেন ইয়াসিন। স্ত্রী অপর একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ধানমন্ডি গিয়েছিলেন। দু’জন ধানমন্ডিতে একত্র হন। তারপর গুলিস্থান গিয়ে সেই গ্লোরি পরিবহনের বাসটিতে ওঠেন। ইয়াসিন আরাফাত বলছিলেন, কাঠেরপুলি এলাকায় বাসটি আস্তে যাচ্ছিল। তাদের নামার কথা সেখানে। সিট থেকে উঠেও দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু মুহূর্তেই আগুনের গোলা এসে লাগলো বাসে। দাউ দাউ করে জ্বলতে লাগলো বাস। তিনি দৌড়ে দরজা দিয়ে নেমে গিয়েছিলেন। বাসের যাত্রীরা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। যে যেভাবে পারছে পড়িমরি করে নামার চেষ্টা করছে। নেমেছিলেন তিনিও। কিন্তু পেছন ফিরে দেখেন স্ত্রী পারভীন নেই। মুহূর্তেই জ্বলতে থাকা বাসটিতে আবার উঠলেন, নাহ ভেতরে কেউ নেই। আবার নেমে আসেন ঠিকই, ততক্ষণে মাথার চুল, চোখ-মুখ ও দুই হাত আগুনে ঝলসে গেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই তার। স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। ইয়াসিনের সঙ্গে থাকা মামা সাইফুল জানান, ইয়াসিনের পেছনে থাকা তার স্ত্রী পারভীন আগুন দেখে জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছে শ্বাসনালীও। তাকে রাখা হয়েছে দোতালার ব্লু ইউনিটে। সাইফুল ইসলাম জানান, তাদের রিম নামে দেড় বছরের একটি মেয়ে আছে। সে আছে দাদা-দাদির কাছে। সাইফুল বলেন, এই পরিবারটির এখন কি হবে। সুখের সংসারটি এভাবে তছনছ হয়ে গেল। আগুনে পোড়া এই ক্ষত তো তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
কেরানীগঞ্জের মামাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন নাজমুল হোসেন (২১)। রাতে গুলিস্থান হয়ে ভুলতা গাউছিয়ার বাসায় ফিরছিলেন। সঙ্গে ছিল বন্ধু সালমান সরকার হৃদয় (২০)। দুই বন্ধুই বাসের পেছন থেকে তিন নম্বর সিটে বসে ছিলেন। হৃদয় বলেন, হঠাৎ আগুন দেখে দাঁড়িয়ে যান তিনি। মাথা নিচু করে আগুনের আঁচ থেকে বাঁচার চেষ্টা করেন প্রথমে। পরমুহূর্তেই জানালার গ্লাসটা এক লাত্থিতে ভেঙে সেখান দিয়ে বেরিয়ে আসেন। আর নাজমুল বেরোতে গিয়ে একবার পড়ে গিয়েছিলেন বাসের মাঝখানের করিডোরে। পরে সেই জানালা দিয়ে বেরিয়ে আসেন তিনিও। নাজমুলের মুখসহ ১৩ শতাংশ পুড়ে গেছে। আর হৃদয়ের পুড়ে গেছে ৬ শতাংশ। হৃদয় জানান, আমার জ্যাকেটেও আগুন ধরেছিল। আমি নিচে নেমে মাাটিতে গড়াগড়ি করে আগুন নিভিয়েছি। নাজমুলের বাবা মো. হানিফ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে মুগড়াপাড়া কলেজে ডিগ্রি পড়ার পাশাপাশি ভুলতা গাউছিয়া মার্কেটে মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকান করতো। তার আয়েই মূলত সংসার চলতো। এখন পরিবারের সবাইকে নিয়ে পথে বসা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। তিনি বলেন, সরকারের কাছে আমার অনুরোধ, যারা এ ধরনের কার্যকলাপ করে তাদের যেন দৃষ্ঠান্তমূলক বিচার হয়। গরিব মানুষ যেন চইল্যা ফিরা খাইতে পারে, সরকার যেন সেই ব্যবস্থা করে।
আলামীন হোসেন অপু (২৭) কাজ করেন একটি গার্মেন্টে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে। সেখানেই থাকেন তিনি। দশ দিন আগে সন্তান হয়েছে তার। স্ত্রী-সন্তান রয়েছে শশুরবাড়ি গুলশানের নর্দ্দায়। শুক্রবারে গার্মেন্ট বন্ধ ছিল। এই সুযোগে শিশু সন্তানকে দেখতে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে নিয়ে যান মা রহিমা বেগমকেও। রাতে শশুরবাড়ি থেকে মা-ছেলে ফিরে যাচ্ছিলেন বাড়ি। গুলিস্থানে গিয়ে মাকে তুলে দেন দোহারের গাড়িতে। আর অপু নিজে ওঠেন গ্লোরি পরিবহনের সেই বাসে, রূপগঞ্জের কর্মস্থলে ফেরার জন্য। কিন্তু ফেরার পথেই দগ্ধ হন তিনি। কথা বলতে পারছিলেন না অপু। মা রহিমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, দেশে এসব কি শুরু হইছে। আমার ছেলেডা আমারে ছাইড়া যাইতে না যাইতেই এমন পুইড়া গেল। এখন ওর ভবিষ্যৎ কি হবে? বলেই কাঁদছিলেন তিনি।
ভাতিজা আলামীনের বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাচ্ছিলেন মোজাফফর মোল্লা (৬০)। সঙ্গে ছিল ভায়রা মান্নান, শাজাহান, ভাতিজা আলামীন ও আলামীনের বন্ধু রফিকুল একসঙ্গে যাচ্ছিলেন মেয়ের বাড়িতে। পথে আগুনে মোজাফফর মোল্লা, মান্নান, শাজাহান দগ্ধ হয়েছেন। আলামীন ও রফিকুল দ্রুত বের হয়ে যাওয়ায় বেঁচে গিয়েছেন অল্পের জন্য। মোজাফফর মোল্লার স্ত্রী বিউটি বেগম জানান, তারা মোহাম্মদপুর বেড়িবাধে থাকেন। বছর খানেক আগে আগুনে তাদের বস্তির ঘর ও দোকান পুড়ে যায়। বর্তমানে তার স্বামী জামাইয়ের দোকানে দিন হাজিরার বিনিময়ে বসতেন। এবার নিজেই পুড়ে আহত হলেন। বিউটি বেগম বলেন, গরিবের ওপর একের পর এক ঝড় আসতেছে। যারা রাজনীতি করে তাদের কিছু হয় না। পুইড়া মরতে হইতেছে আমাগো। এখন আমি স্বামীরে চিকিৎসা করামু কি দিয়া আর সংসার চালামু কি দিয়া। বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিউটি বেগম।
শুক্রবারের এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশি দগ্ধ হয়েছেন রাজমিস্ত্রিদের ঠিকাদার নূর আলম (৪০)। স্ত্রীকে নিয়ে থাকতেন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে। শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরে বোনের বাড়ি গিয়েছিলেন। রাতে সেখান থেকে ফিরছিলেন বাসায়। বাসে পেট্রবোমা নিক্ষেপে নূর আলমের শরীরের ৪৮ ভাগ ঝলসে গিয়েছে। দুই হাত, মুখ ও কোমর থেকে ওপরের অংশ পুরোটা ঝলসে গেছে আগুনে। মুখ ছাড়া পুরো শরীর ব্যান্ডেজে বাঁধা। কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট ও চোখ ফুলে গেছে। আগুনে পুড়ে কিছুটা বিকৃত হয়ে গেছে মুখমণ্ডল। পাশে বসা শাশুড়ি শামেলা বলেন, এসব লেখে কি হবে? লিখলে কি ছেলেটা আগের মতো হবে? যারা আগুন দিয়া মানুষ পুড়াইতেছে তাদের ধরাইয়া দেন। তাদের শাস্তি দেন। দিনমজুর জমির আলী (৪৪) গাজীপুরের কাপাসিয়া হালমোড় এলাকায় থাকতেন। তার শ্বশুরবাড়ি রূপগঞ্জের বরফা এলাকায়। শাশুড়ি আম্বিয়া বেগমকে আনতে যাচ্ছিলেন রূপগঞ্জের বরফায়। গুলিস্থান থেকে গ্লোরি পরিবহনে উঠেছিলেন তিনি। দগ্ধ হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে। তার ছেলে রুবেল জানান, তার বাবার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে। রাতেই তারা মোবাইলে খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন।
বার্ন ইউনিটে দুই মন্ত্রী: রাজনৈতিক সহিংসতার আগুনে দগ্ধ হয়ে এখন পর্যন্ত ৭৮ জন ব্যক্তি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন। এর মধ্যে ৫২ জন এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছেন। যার মধ্যে ৩০ জন দগ্ধ হয়েছেন শুক্রবার রাতেই। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে দগ্ধ রোগীদের দেখতে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। এ সময় তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার প্রতিহিংসার আগুনে দগ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। বেগম জিয়া নিজেকে গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে দাবি করলেও বর্তমানে সন্ত্রাসের নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। দেশের জনগণ চায়, যারা সহিংসতা চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। মোহাম্মদ নাসিম বলেন, এখন হঠাৎ করে চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে। হামলাকারীদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নাশকতা তৈরির রসদসহ অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। গাড়িতে আগুন, বোমায় আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি, দগ্ধদের সুস্থ করে তুলুন। সরকার তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে অবরোধের আগুনে দগ্ধদের খোঁজ নিতে বার্ন ইউনিটে গিয়ে ভিড় না করতে মন্ত্রী, এমপিসহ সবার প্রতি আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। অবরোধের আগুনে যারা দগ্ধ হয়েছেন তাদের খোঁজ নিতে হলে হাসপাতালে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে খোঁজ নিন। তাদের সাহায্য করতে চাইলে করুন। আমরা কেউ ডাক্তার নই, দর্শনার্থী হিসেবে বার্ন ইউনিটে আসবেন না।
বিকালে বার্ন ইউনিটে যান সমাজকল্যাণমন্ত্রী মহসীন আলী। মহসীন আলী এসময় বলেন, বার্ন ইউনিটের ভেতরের দৃশ্য দেখার পর আমি বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। আমি তিন-চার দিন এখানে এসেছি। যারা এ ধরনের কাজ করেছে তারা মানুষ হলে তা করতে পারত না। তিনি দগ্ধদের জন্য আপাতত ৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন বলে জানান। মহসীন আলী বলেন, বাসে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ বন্ধ করতে আত্মরক্ষার জন্য গাড়ি চালকদের কাছে লাইসেন্স করা অস্ত্র দেয়া হবে। তিনি বলেন, পুলিশ-র্যাব যদি গুলি করতে চায় তাহলে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি লাগে। কিন্তু চালকদের কাছে যদি লাইসেন্স করা অস্ত্র দেয়া হয় তাহলে তারা আত্মরক্ষার্থে নাশকতাকারীদের দমন করতে পারবে। তবে এটা তার ব্যক্তিগত মতামত বলেন জানান তিনি। বলেন, বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করবেন তিনি।
No comments