মিসরে বিপ্লবীরাই এখন কারাগারে
(মিসরে হোসনি মোবারক-বিরোধী গণ-আন্দোলনের চার বছর পূর্ণ হয়েছে আজ ২৫ জানুয়ারি। গত চার বছরে দেশটিতে কিছুই বদলায়নি। বরং আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী শাসন কায়েম হয়েছে। ছবি: এএফপি) ভাগ্যের
নির্মম পরিহাস বুঝি একেই বলে! মিসরে চার বছর আগে স্বৈরশাসক হোসনি
মোবারক-বিরোধী গণ-আন্দোলনে লাখো বিপ্লবী রাজপথে নেমেছিলেন। তাঁদের অনেকেই
এখন কারাগারে। আর কারাগারে বন্দী ক্ষমতাচ্যুত মোবারক মুক্তির অপেক্ষায়।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে জানানো হয়, আজ ২৫ জানুয়ারি মিসরে
মোবারক-বিরোধী গণ-আন্দোলনের চার বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু গত চার বছরে
মিসরে কিছু বদলায়নি। বিফলে গেছে সাড়াজাগানো ‘বিপ্লব’। ২০১১ সালে আরব
বসন্তের অন্যতম ঘটনা ছিল মিসরে মোবারক-বিরোধী গণ-আন্দোলন। দুই সপ্তাহের
বেশি সময় ধরে ওই গণ-আন্দোলনে পতন ঘটে এক সময়ের লৌহমানব মোবারকের। নিহত হন
আট শতাধিক বিক্ষোভকারী। বিপ্লব শেষে বন্দী হন মোবারক ও তাঁর বেশ কয়েকজন
সহযোগী। বিক্ষোভকারীদের হত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে তাঁদের বিচার
শুরু হয়। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলে এখন মিসরের শাসন ক্ষমতা এসেছে
প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসির হাতে। তিনি ছিলেন সাবেক সেনাপ্রধান।
মোবারকের শাসনামলের এই সেনা কর্মকর্তা উর্দি ছাড়লেও স্বৈরশাসনের দুর্গন্ধ
থেকে মুক্ত নন। বরং তাঁর কর্মকাণ্ডে যেন মোবারকের অপচ্ছায়াই মূর্ত হয়ে
উঠছে। হত্যা ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ থেকে মোবারকের একের পর এক
খালাস পাওয়ার ঘটনাকে এখন অনেক বিশ্লেষকই বাঁকা চোখে দেখছেন।
বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে ২০১১ সালের ২৪ মে মোবারককে
বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর আদেশ দেওয়া হয়। বিচারে ২০১২ সালের ২ জুন
তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে আপিল কোর্ট
মোবারকের ওই দণ্ডাদেশ প্রত্যাখ্যান করে মামলাটির পুনর্বিচার করার নির্দেশ
দেন। গত বছরের নভেম্বরে ওই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে মোবারক ও তাঁর
সাতজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে হত্যার অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়
তহবিলের অর্থ আত্মসাতের একটি মামলায় ২০১৪ সালে মিসরের একটি আদালত
মোবারককে কারাদণ্ডাদেশ দেন। কিন্তু আপিল আদালত ওই দণ্ড বাতিল করে
পুনর্বিচারের আদেশ দেন। দিন কয়েক আগেই মোবারকের দুই ছেলে কারাগার থেকে
বেরিয়েছেন। মোবারকসহ তাঁদের বিরুদ্ধে একটি দুর্নীতির মামলা পুনর্বিচারাধীন
রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব হিউম্যান রাইটসের অভিযোগ, মানবাধিকার
লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের অব্যাহতি এবং রাজনৈতিক কর্মীদের কারাদণ্ড
দিয়ে মিসরের বিচার বিভাগ দ্বৈতনীতি প্রদর্শন করছে। বিপ্লবে অংশ নেওয়া
জিয়াদ আল-এলাইমি বলেন, মোবারকের রায় আমাদের এই বার্তা দেয় যে কর্তৃপক্ষ
যতই দুর্নীতি ও নিপীড়ন করুক না কেন, তা কোনো বিষয় নয়। তাঁরা সব সময়
শাস্তির বাইরে থাকবেন। এটা খুবই কষ্টদায়ক।’ এলাইমি বলেন, ২০১১ সালের
বিপ্লব ব্যর্থ হলে আমাদের ফাঁসি হতো। এখন আমরা আমাদের সেই রাজনৈতিক
অবস্থানের মূল্য দিচ্ছি। বিপ্লবীরা বলছেন, ২০১১ সালে তীব্র গণ-আন্দোলনে তিন
দশকের শাসক মোবারকের পতনের আনন্দ এখন নিরানন্দে পরিণত হয়েছে। মিসরের
এখনকার শাসক মোবারকের চেয়েও বেশি স্বৈরাচারী। বিনা অনুমতিতে বিক্ষোভ করার
অভিযোগে মোবারক-বিরোধী গণ-আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক বিপ্লবী এখন কারাগারে।
তাঁদের মধ্যে অন্যতম মোবারক-বিরোধী আন্দোলনের নেতা আহমেদ মাহের ও মোহাম্মদ
আদেল। এ দুজনকে তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। মোবারকের পতনের পর
দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি। ২০১৩
সালে সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন
সেনাপ্রধান সিসি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি মোবারকের চেয়েও নিপীড়নমূলক
শাসন প্রবর্তন করেছেন। দমন-পীড়নে সাবেক স্বৈরশাসককে ছাড়িয়ে গেছেন এই
নব্য শাসক। সিসির আমলে নৃশংস অভিযানে মুরসি-সমর্থক ও মুসলিম ব্রাদারহুডের
প্রায় দেড় হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে কারাবন্দী
করা হয়েছে। গণহারে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ। মোবারক-বিরোধী
বিপ্লবী জিয়াদ আল-এলাইমির ভাষ্য, ‘গত চার বছরে কিছুই বদলায়নি। আমরা এখনো
একই স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ দেখছি। দেখছি একই দুর্নীতি, স্বাধীনতা হরণ।’
No comments