মানুষ বিক্রির হাটে হতাশার অন্ধকার by সিরাজুস সালেকিন
বুধবার।
সকাল ৯টা। মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদ মোড়। অর্ধশতাধিক লোকের জটলা। পাশে
রাখা কোদাল, বাঁশের খুঁচি। পেশায় কেউ রাজমিস্ত্রি। আর কেউবা মাটি কাটার
শ্রমিক। বাইরে হাড়কাঁপানো শীত। পরনে জীর্ণশীর্ণ কাপড়। তবুও কাজের আশায়
এসেছেন কাজের হাটে। মোহাম্মদপুরের কাঁটাসুর, রায়েরবাজার, ঢাকা উদ্যান,
আদাবর ও শ্যামলী এলাকার বস্তিতে থাকেন এই শ্রমজীবী মানুষ। শিয়া মসজিদের এই
শ্রমের হাটে এভাবেই কাজের আশায় প্রতিটি সকাল পার করেন অর্ধশতাধিক নির্মাণ
শ্রমিক। কেউ কাজ পান না। এ অবস্থায় মানুষ বিক্রির হাটে নেমেছে অমানিশার
অন্ধকার। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজমিস্ত্রির দৈনিক হাজিরা ৬০০,
তার সহযোগীর ৪০০ ও শ্রমিকের ৩০০ টাকা। এমনিতেই গত কয়েকবছর ধরে নির্মাণ কাজ
কমে গেছে। তার ওপর গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা তাদের ওপর আমানবিকভাবে
চেপে বসেছে। হরতাল-অবরোধের কারণে কাজ নেই। বাসায় তিনবেলা ঠিকমতো রান্না হয়
না। জমানো টাকা বলতেও কিছু নেই। সকাল বেলা সবাই এই হাটে ভিড় করেন। অধিকাংশই
কাজ পান না। যারা কাজ পান তাদের ন্যায্য মজুরি দেয়া হচ্ছে না বলেও অভিযোগ
আছে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন- কবে শেষ হবে হরতাল-অবারোধ? কবে শেষ হবে তাদের
দুঃখের দিন। গতকাল সকালে শিয়া মসজিদের শ্রমের হাটে প্রতিবেদককে পেয়ে সবাই
মিলে ঘিরে ধরে। জানতে চায়, ভাই কি লাগবো? মিস্ত্রির কাজ করাবেন? নাকি মাটি
কাটার কাজ। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। চাঁদপুরের মফিজুর রহমান
ঢাকায় আছেন ১২ বছর। রাজমিস্ত্রির কাজ করে ৬ সদস্যের পরিবার চালান। অবরোধের
কারণে দুই সপ্তাহ থেকে কোন কাজ পাননি। কিভাবে সংসার চলছে- জানতে চাইলে
বলেন, বাড়ি থাইক্কা চাউল নিয়া আইছিলাম। কিছু ট্যাহা জমানো আছিলো। কিন্তু
হেইগুলাও শ্যাষ। অহন কি খামু হেই চিন্তাই করতাছি। কিশোরগঞ্জের ফজলু মিয়ার
সংসারে দুই স্ত্রী। মোট ৮ সদস্যের পরিবার। সকালে কিছু না খেয়েই কাজের খোঁজে
এসেছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে আক্ষেপ করে বলেন, গরিবের কুনো দাম নাইক্কা।
গরিব মরলে কার কি? আরেক রাজমিস্ত্রি মৌলু মিয়ার ৬ মেয়ে। শরীরে জ্বর নিয়েই
কাজের হাটে এসেছেন। যদি কেউ কাজে নেয় সেই আশায়। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি জিজ্ঞেস
করেন, কি খবর লেখবাইন? অবরোধ কবে শ্যাষ অইবো হেই খবর দ্যানযে। হবিগঞ্জ
থেকে ঢাকায় নতুন এসেছেন রাজমিস্ত্রির সহকারী শামসুল হক। তিনি জানান, কাজ না
থাকায় বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারেননি। বাসার মালিক ঘরে তালা ঝুলিয়ে
দিয়েছে। আত্মীয়ের বাসায় থাকছেন। হাটে কাজের খোঁজে আসা রাজমিস্ত্রি আবুল
কাশেম জানান, হরতাল-অবরোধের কারণে মহাসড়কে গাড়ি চলাচল করছে না। ফলে
রাজধানীতে নির্মাণ সামগ্রীর সরবরাহ কমে গেছে। কাজ না থাকায় মানবেতর
জীবনযাপন করছেন। এই কাজের হাটে রয়েছেন কিছু নারী শ্রমিক। তারা অধিকাংশই
মাটি কাটার কাজ করেন। এদের মধ্যে একজন বেদেনা বেগম। রাস্তার পাশে মাথায় হাত
দিয়ে বসেছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘হরতাল প্রত্যাহার করার ক্ষমতা
থাকলে করেন। প্যাপারে লেইখ্যা কি হইবো। অ্যামন হরতাল দ্যাশে মানুষ মরলেও
মুখ দেহন যায় না। মাটি দেওন যায় না। নূরজাহান বেগম অভিযোগ করে বলেন, ভোট
দিয়া প্রধানমন্ত্রী বানাইলাম। আর হ্যায় গরিবের খোঁজ রাখতাছে না। কি খায়া
বাঁছি আছি কেউ দ্যাখে না। একইভাবে দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বলে
জানালেন নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ির রশিদ, সিরাজ মিয়া, তাহের মিয়া, সালাম,
ফাইজুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জের ইটনার সোহেল মিয়া ও আমির উদ্দিন। অবরোধে কাজের
অভাবে কাঠমিস্ত্রি ও রংমিস্ত্রিদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। মোহাম্মদপুরের টাউন
হল বাজারে কাজের খোঁজে এসেছেন ১৫-২০জন কাঠমিস্ত্রি। এদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব
বয়সের ভুট্টু বলেন, অ্যামন হরতাল জীবনে দেহিনাই। আমাগোর হইছে মরার দশা। কাম
পাইনা। কাম পাইলে ডরে বাসে উঠি না। কহন যে আগুন দ্যায়। কাঠমিস্ত্রি হাবুল
মিয়া তিনি জানান, একজন কাঠমিস্ত্রির দৈনিক হাজিরা ৭০০-৮০০ টাকা। চুক্তিতে
কাজ পেলে আয় আরও বেশি হয়। কিন্তু টানা-হরতাল অবরোধের কারণে কেউ কাজে নিচ্ছে
না। তার পাশে দাঁড়ানো রংমিস্ত্রি মেসু মিয়া দুঃখ করে বলেন, পরিবার থাকে
দ্যাশে। নিজেই খাইতে পারি না। দ্যাশে ট্যাকা পাঠামু ক্যামনু। প্যাপারে
লেইখ্যা কি হইবো? গরিব মরলে তো আর প্যাপারে আইবো না!
No comments