বাল্যবিবাহ রোধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে -প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠক

(প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দিচ্ছেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। পাশে রাশেদা কে চৌধূরী l ছবি: প্রথম আলো) বর্তমান যুগে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিহার্য হলেও এই শিক্ষায় এখনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। নিরাপত্তার অভাব, বাল্যবিবাহসহ বিভিন্ন কারণে এই শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ কম। নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। এ জন্য দরকার সচেতনতা। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণে মেয়েদের অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধকতা: উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। প্রথম আলোর উদ্যোগে ও ইউসেপ বাংলাদেশের সহযোগিতায় এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ছয় বছর আগে ২০০৯ সালে তাঁরা যখন সরকারের দায়িত্ব নেন, তখন পর্যন্ত কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ছিল অবহেলিত। তখন দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১ শতাংশ ছিল কারিগরি শিক্ষায়। সরকার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে গত ছয় বছরে আট গুণ শিক্ষার্থী বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী ৮ লাখ ২২ হাজার ৫৮৮। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৪ হাজার ৯২৪ জন নারী। বাকি প্রায় ছয় লাখ ছেলে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তাঁরা কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে শিল্প-কারখানার সঙ্গে সংযোগ করে দেবেন। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে অনেকে আগ্রহও দেখিয়েছেন। কারিগরি শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, প্রতি বিভাগে একটি করে মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট করা হচ্ছে। এর মধ্যে চারটিতে পাঠদান চলমান ও তিনটির জন্য প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়াও ভর্তির ক্ষেত্রে নারীদের জন্য আলাদাভাবে ২০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে।
দক্ষ জনবলের অভাবকে বড় সমস্যা উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এখন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৪২০ জনকে সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য ২০ জন করে পাঠানো হচ্ছে। এর বাইরে আরও ৪০০-৫০০ জনকে সংক্ষিপ্ত কোর্স করানো হচ্ছে। বাস্তবে বাজারে কি চাহিদা তা যদি উদ্যোক্তা, মালিক সবাই মিলে ঠিক করা যায়, তাহলে সুবিধা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শ্রম অনুযায়ী মেয়ে ও ছেলেদের বেতন সমান করার জন্য মালিক-উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান শিক্ষামন্ত্রী। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ২০ শতাংশকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক ধারায় আনা হবে বলেও ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ করলে ভালো রিটার্ন আসে, এটা প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষার চেয়ে বড় বিনিয়োগ ও সুরক্ষা আর কিছু হতে পারে না। কারিগরি শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যে বিষয়ে পড়ছে সে বিষয়ে চাকরি পাওয়া উচিত।
ইউসেপ, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক জাকী হাসান কারিগরি শিক্ষার নারীদের নিয়ে নিজেদের করা একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, সাধারণ শিক্ষায় যেসব শিক্ষার্থী পড়ছে তাদের মধ্যে ৪৩ শতাংশ সাধারণ শিক্ষায় থাকতে চায়, ৩৭ শতাংশ সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি দক্ষতামূলক শিক্ষায় পড়তে চায় এবং মাত্র ২০ শতাংশ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় আগ্রহী।
ঝরে পড়ার কারণ উল্লেখ করে জাকী হাসান বলেন, ২৭টি ঘটনার মধ্যে দেখা গেছে ১৫ জন ঝরে পড়েছে বাল্যবিবাহের কারণে। এ ছাড়া যাতায়াত, সামাজিক বাধা, নিরাপত্তার অভাবসহ আরও কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেন তিনি। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল হক তালুকদার বলেন, কারিগরি শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি বাধা নেই। বাধা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। এ জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি জানান, তাঁরা মেয়েদেরও এই শিক্ষায় আনতে গুরুত্ব দিয়েছেন।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি তপন চৌধুরী বলেন, শিল্প-কারখানার চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। তিনি শিল্প-কারখানা ঢাকার বাইরে করারও পরামর্শ দেন। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল সচিবালয়ের পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী জনবল তৈরি হচ্ছে না, এটা সত্য। এ জন্যই সরকার জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কাউন্সিল করেছে। ইউসেপ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হওয়া মরিয়ম সুলতানা শোনান তাঁর জীবনের কাহিনি। তিনি জানান, তাঁর পড়ার মতো অবস্থা ছিল না। তখন ইউসেপ থেকে চার বছর পড়ে অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। পরে সাধারণ শিক্ষায় পড়েন। তখন পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় অনেকে গার্মেন্টসে চাকরির পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁর আগ্রহ ইলেকট্রনিকসের প্রতি। এরপর মাত্র এক হাজার টাকার বেতনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। সেখানে ছেলেমেয়েদের বেতনের বৈষম্য প্রচণ্ড। ওই প্রতিষ্ঠানে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি প্রথম হন। তখন তাঁর বেতন ধরা হয় তিন হাজার টাকা, অথচ ছেলেদের পাঁচ হাজার টাকা। পরে আরেকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। এই সময় তাঁর বাবা মারা যান। পরিবার থেকে বিয়ের জন্য চাপ আসে। শেষ পর্যন্ত বিয়েটাও হয়ে যায়। এ সময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসার চিন্তা করেন। তাঁর স্বামী ডিপ্লোমা প্রকৌশলী হওয়ায় বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারেন। পরে আইপিএস ও ইউপিএসের ব্যবসা শুরু করেন। এখন অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিজের থাকার জন্য ফ্ল্যাটও কিনেছেন, ব্যবসাও ভালো।
পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদ উল্লাহ আজিম বলেন, চাহিদা অনুযাযী কর্মসংস্থান করার জন্য শিক্ষাক্রম তৈরি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা চাহিদা মোতাবেক করতে হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারিগরি শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। তিনি জানান, বর্তমানে গার্মেন্টসে যত কর্মী আছেন তাঁর মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। ইউসেপের বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান এম এ মতিন চৌধুরী বলেন, জীবনভিত্তিক দক্ষতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। শিল্প-কারখানায় মেয়েদের চাকরি দিতে চাইলে আবাসনের (ডরমেটরি) ব্যবস্থা করতে হবে। দাতা সংস্থা ডিএফআইডির মানব উন্নয়ন টিমের টিম লিডার ক্যারোলিনা সানার্স চাহিদাভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়নের প্রতি জোর দেন। আইএলওর উপদেষ্টা কিশোর কুমার সিং বলেন, যারা বস্তিতে থাকে তাদের শিক্ষায় নিয়ে আসা একটি চ্যালেঞ্জ।
নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের প্রথম সচিব (শিক্ষা) এলা দ্য ভোগ্দ বলেন, মেয়েদের নিরাপত্তা ও স্যানিটেশনের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেভ দ্য চিলড্রেনের উপকর্মসূচি পরিচালক নিশাত মির্জা বলেন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য আলাদা বাথরুম থাকতে হবে। ইউসেপ বাংলাদেশের পরিচালক হাবিবুর রহমান তাঁদের বিভিন্ন কার্যক্রমের তথ্য তুলে ধরেন।

No comments

Powered by Blogger.