পার্বতীপুরে তরুণকে হত্যা- আদিবাসীদের ৫৫টি বাড়িতে ভাঙচুর–আগুন, লুটপাট
() দিনাজপুরের
পার্বতীপুর উপজেলার বড়দল সরকারপাড়া গ্রামে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে
গতকাল শনিবার সকালে আদিবাসীদের লাঠি ও তীরের আঘাতে শাফিউল ইসলাম (২০)
নামের এক তরুণ নিহত হয়েছেন। এ ঘটনার পর হাজারো নারী-পুরুষ আদিবাসীদের
বাড়িঘরে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করে ও লুটপাট চালায়। পুলিশ ও কয়েকজন
প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সকাল সাড়ে আটটার দিকে বর্গাচাষি কামরুজ্জামান ও
সবেদুল ইসলাম সেচযন্ত্র দিয়ে জমিতে পানি দিচ্ছিলেন। এ সময় জহুরুল হক ও
তাঁর ছেলে ভবানীপুর কামিল মাদ্রাসার আলিম শ্রেণির ছাত্র শাফিউল ইসলামও
সেখানে ছিলেন। কিছুক্ষণ পর তির-ধনুক হাতে ১৪ জন আদিবাসী এখানে আসেন। তাঁরা
প্রথমে সেচযন্ত্রটি বন্ধ করে দেন। শাফিউল এর প্রতিবাদ করলে আদিবাসীরা লাঠি
দিয়ে তাঁকে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় একজন আদিবাসী একটি তির তাঁর
পেটে ঢুকিয়ে দেন। একপর্যায়ে ছেলেকে রক্ষা করতে আসেন বাবা। আদিবাসীরা বাবা
জহুরুল হকের মাথায়ও লাঠি দিয়ে কয়েকটি আঘাত করেন। তিনিও মাটিতে লুটিয়ে
পড়েন। পরিবারের সদস্যরা অ্যাম্বুলেন্সে করে দুজনকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে নেওয়ার পথে শাফিউল মারা যান। গুরুতর অবস্থায় জহুরুলকে
হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
পার্থ সারথী রায় বলেন, জহুরুলের আঘাত গুরুতর। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে নিহত
শাফিউলের গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলো থেকে হাজারো নারী-পুরুষ একজোট হয়ে
আদিবাসী-অধ্যুষিত হাবিবপুর চিড়াকুটা গ্রাম ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে আক্রমণ
চালিয়ে গ্রামটির ৫৫টি বাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টা
পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা এ তাণ্ডব চলে। কয়েকজন আদিবাসী বলেন,
হামলাকারীরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে আদিবাসীদের সোনাদানা ও টাকাপয়সা ছাড়াও
গরু-ছাগল, ধান-চাল, সেচযন্ত্র, থালাবাসনসহ অন্যান্য মালামাল লুট করে নিয়ে
যায়। এমনকি কয়েকটি বাড়ির আঙিনা থেকে নলকূপ খুলে নিয়ে যায়। গৃহবধূ
নেলিমা হেমব্রম (২৮) জানান, গ্রামটিতে মোট ৫৫টি আদিবাসী পরিবারের বাস। সকাল
সাড়ে নয়টার দিকে পুরো গ্রাম হাজারো নারী-পুরুষ ঘিরে ফেলে। পুলিশও
উপস্থিত ছিল। পুলিশ গ্রাম থেকে ১৯ জন আদিবাসী পুরুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর
নারী-পুরুষো একযোগে বাড়ি বাড়ি হামলা চালায়। দুপুর ১২টায় ঘটনাস্থলে
গিয়ে দেখা যায়, হাজারো মানুষ বড়দল সরকারপাড়া গ্রামের বিরোধপূর্ণ জমির
পাশে রাস্তায় ভিড় করছেন। সেখান থেকে উত্তর দিকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে
হাবীবপুর চিড়াকুটা গ্রাম থেকে আদিবাসীদের পুড়ে যাওয়া বাড়ি থেকে ধোঁয়া
উড়ছিল। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিটকে সেই আগুন নেভাতে দেখা যায়।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জহুরুলের ছোট ভাই মো. জাহিদুল হক বলেন, হাবীবপুর
মৌজায় আদিবাসীদের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ মোট জমির পরিমাণ ২১ একর। তাঁর বাবা মো.
আলী দিনাজপুর শহরের মো. আজিজার রহমান চৌধুরীর কাছ থেকে ১৯৭৯ সালে ১৪ একর
জমি কিনেছেন। কিন্তু জমিগুলো চাষ করতেন আদিবাসীরা। দুই বছর আগে আদিবাসীদের
সঙ্গে আপস-মীমাংসা হয়। চার বিঘা জমি আদিবাসীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পর
থেকে জমিগুলো জহুরুল হক, জিয়াউল হক ও জাহিদুল হক চাষ করছেন। স্থানীয়
মোস্তফাপুর ইউপির চেয়ারম্যান মো. মতিয়ার রহমান বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর ২০
থেকে ২৫ জন আদিবাসী তির-ধনুক নিয়ে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। পরে
তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর হাজারো মানুষ চোখের সামনেই
লুটপাট করে বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিল। দুপুর ১২টার দিকে জেলা প্রশাসক আহমদ
শামীম আল রাজী এবং পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরা সবার সঙ্গে
কথা বলেন এবং শান্ত থাকার অনুরোধ জানান। আহমদ শামীম আল রাজী প্রথম আলোকে
বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের বাড়িগুলো প্রশাসনের উদ্যোগে মেরামত করে
দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে পরিবারপ্রতি ২০ কেজি করে
চাল ও প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন
বলেন, আদিবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চিড়াকুটা গ্রামে ২০ সদস্যের একটি
পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে।
No comments