৫ জানুয়ারির নির্বাচন দুর্নীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে: শাহদীন মালিক
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, “রাষ্ট্রে আইন অমান্য করার প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমান সরকারের আমলে এই প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে কিছু কারণ রয়ে গেছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন তার অন্যতম। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সঠিক, এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। সরকারের লোকজন সেই মিথ্যাচারই নিয়মিত করে যাচ্ছেন।’ সাপ্তাহিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। শাহদীন মালিক বলেন, “৫ জানুয়ারির নির্বাচন আপনি ছক বাঁধা আইনের ফ্রেমে ফেলতে পারেন। কিন্তু নৈতিক প্রশ্নে একটি শিশুও এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, এমন ডাহা মিথ্যার ওপর ভর করে সরকার যখন বলে যে, জনগণ তাদের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার রায় দিয়েছে, তখন আইনের যেকোনো বিধান লঙ্ঘন করাই তাদের পক্ষে সহজ হয়ে যায়। এর আলামত ইতোমধ্যেই লক্ষণীয়। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতেও জালিয়াতি হচ্ছে। সর্বত্রই জালিয়াতির ছড়াছড়ি। আমি জোর করেই বলব, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দুর্নীতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসন উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তারা দলের কর্মকর্তা হয়ে কাজ করেছেন, এইচ টি ইমাম সাহেবের বক্তব্যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে। এই আশঙ্কা থেকেই ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিল। একই দাবিতে বিএনপি ও তার শরিক দলগুলোও আন্দোলন করছে। এইচ টি ইমামের বক্তব্য যদি ঠিক হয়, তাহলে বিএনপি জোটের আন্দোলনের ন্যায্যতা আছে। সুতরাং ভবিষ্যতে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে পাব না, এটি আরেকবার প্রমাণ হলো। ” ড. শাহদীন বলেন, “এইচ টি ইমাম সাহেবের বক্তব্যের আরেকটি দিক হচ্ছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী হতে হলে সরকার দলীয় সংগঠনের অনুগত হতে হবে। এটি একেবারে সংবিধান পরিপন্থী কথা। এর জন্য দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে বলে মনে করি। বলা এবং কাজে এমন স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো ভেঙে পড়ছে।” মন্ত্রীদের লাভজনক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের ঘটনা পুরনো। সম্প্রতি আপনি এই অভিযোগে তিন জন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন। এখন কেন? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, “হ্যাঁ, বিষয়টি পুরনো। কিন্তু সম্প্রতি একটি দৈনিকে এ নিয়ে রিপোর্ট হয়। যে চার মন্ত্রীর বিরুদ্ধে রিপোর্ট হয়, তাদের মধ্যে তিনজনই লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিচালনা পর্ষদে চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের কথা স্বীকার করেন। আরেকজন পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে ওই সাংবাদিক যোগাযোগ করতে পারেননি। মিডিয়ার কাছে স্বীকার করার পর বিষয়টি আলাদা আবেদন রাখে। আমিও কোম্পানিগুলোর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করে দেখলাম, ঘটনা সত্য। এ কারণেই আমি উকিল নোটিশ পাঠিয়েছি। একদিকে মন্ত্রী, অন্যদিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে থাকা যায় না।” সরকারও সুখে আছে, জনগণও রাস্তায় নেই। সমাজ ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কা কেন করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সরকার সুখে আছে, তা শুধু মুখে বলে। সরকারের ভেতরে অনেক অস্থিরতা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোগুলো ভেঙে পড়ছে। দুর্নীতি দমন কমিশন অথর্ব। কোনো কাজ করতে পারছে না। যেন, দুর্নীতিবাজদের নির্দোষ প্রমাণ করতেই দুদক গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সরকারের আজ্ঞাবহ। নির্লজ্জভাবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে। একজন পাগলও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। ষোড়শ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে। মানুষ সঠিক বিচার পাবে না, এটি ধরেই নিচ্ছে। পুলিশের নাম শুনলেই মানুষ গালি দেয়, এড়িয়ে চলে। রাষ্ট্রের কাঠামো এগুলোই এবং তা ভেঙেও পড়ছে। এই ধারণা আমার একার নয়, সমাজের সবাই জানে। ” শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে শাহদীন মালিক বলেন, “নৈতিকতার সর্বনাশ করছে ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থা। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকান। দেখবেন, সেখানে শিক্ষার প্রতিযোগিতার চেয়ে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা অনেক বেশি। পুরো ক্যাম্পাস সরকারি ছাত্র সংগঠনের কাছে জিম্মি। ছাত্রদের সন্ত্রাসে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছে। কোনো পাণ্ডিত্য নেই। ছাত্র বা শিক্ষকদের কেউ আর বৃত্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রাখতে পারছে না। উচ্চশিক্ষার মতো জায়গায় চাটুকারিতায় ভরপুর। মাফিয়া ধরনের খবর আসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। এমন অস্থিরতা তো সর্বত্রই।” সরকার তো ব্যবস্থাও নিচ্ছে। যেমন, দুদকের মামলায় সরকারদলীয় সাংসদ কারাগারে। এত অনেক বড় দৃষ্টান্ত? এ প্রসঙ্গে বলেন, “ব্যালেন্স করার জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। বিরোধী দলের একেক জন নেতার বিরুদ্ধে পঞ্চাশের অধিক মামলা। সেখানে কক্সবাজারের এক সাংসদকে আটক করে সরকার ভারসাম্য দেখাতে চাইছে। কিন্তু এসব লোক দেখানো, তা সবাই জানি। পুলিশ প্রশাসন কী নগ্নভাবে কাজ করছে, তা সবারই জানা। পুলিশের এমন নগ্নতা ইতিপূর্বে কখনো দেখা যায়নি। সচিবালয়ের কাছে একটি পুরনো ময়লার গাড়ি পোড়ানো মামলায় যখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবকেও আসামি করা হয়, তখন পুলিশ এবং বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থায় ধস নামে। পুলিশকে দিয়ে যখন এমন একটি মিথ্যা মামলা জোর করে করানো হয়, তখন তার নিজের দায় ভুলে যায়। এমন করতে করতে যে কোনো অপরাধ করাই পুলিশের স্বাভাবিক হয়ে যায়। গর্তে পড়ার প্রথম সিঁড়ি ভেঙে গেছে। সমাজ যেকোনো সময় গর্তে পড়বে।” এমন অস্থিরতার পরেও তো দেশ, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে? সরকার তো মধ্য আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা বলছে? –এর উত্তরে এই আইনবিদ বলেন, “দেশ এগিয়ে যাচ্ছে কাদের অবদানে সেটা বিবেচ্য বিষয়। সরকার না বললেও মানুষ বসে থাকে না। মানুষ এগিয়ে যায়। এখানে সরকারের উচ্ছসিত হওয়ার কিছু নেই। বরং সরকারগুলোর বাধার কারণেই মানুষ যথাসম্ভব এগিয়ে যেতে পারছে না। বাংলাদেশ ২০২১ সালে মধ্য আয়ে এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে বলে যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তার আগে সুশাসন নিয়ে কথা বলা উচিত। আফ্রিকার অনেক দেশের সরকার ৫০ বছর আগে থেকে এমন স্বপ্ন দেখিয়ে আসছে। কিন্তু তারা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছে। গণতন্ত্র নেই অথচ এগিয়ে যাচ্ছে, আপনি চীন বাদে আরেকটি দেশকে দেখান? সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে সবই মুখ থুবড়ে পড়েছে। চীন এগিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব কমিটমেন্টের ওপর ভর করে। বাঙালি শাসন ব্যবস্থায় এমন কোনো কমিটমেন্ট নেই এবং অদূর ভবিষ্যতে কেউ কমিটমেন্ট দিতে পারবে বলেও মনে হয় না। আইনের শাসনের প্রশ্নেই সোভিয়েত ব্লক ভেঙে গেছে। তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে ঠিক, কিন্তু বারবারই পিছিয়ে পড়ছে। সুতরাং বর্তমান সরকার যে পথে হাঁটছে সে পথে উন্নয়ন হয় না।”
No comments