কোনো প্রাপ্তি ছাড়াই শেষ হতে পারে সম্মেলন
দক্ষিণ
এশিয়ার সর্ববৃহৎ সংগঠন দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ১৮তম
শীর্ষ সম্মেলনের মূল পর্ব শুরু হচ্ছে আজ। ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য আরও
ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’- এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সম্মেলনে যোগ দিতে মঙ্গলবার
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু এসে পৌঁছেছেন সার্কভুক্ত ৮টি দেশের রাষ্ট্র ও
সরকার প্রধান। শীর্ষ সম্মেলনকে ঘিরে কাঠমান্ডুতে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা
ব্যবস্থা। সার্ক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ‘হিমালয়কন্যা’খ্যাত নেপাল সেজেছে
সাজ সাজ রবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে কোনো ধরনের প্রাপ্তি ছাড়াই এবারের সার্ক
সম্মেলন শেষ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এবারের সার্ক সম্মেলনে সার্কভুক্ত
দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি করতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং
বিদ্যুৎবিষয়ক চুক্তি হওয়ার কথা থাকলেও এ সংক্রান্ত চুক্তি হচ্ছে না বলে
জানা যায়। তবে বিদ্যুতের সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তি করতে বাংলাদেশ এখনও
চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী জানান। এ বিষয়ে
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বৈঠক শেষে এক
ব্রিফিংয়ে মঙ্গলবার বলেন, সড়ক ও রেল যোগাযোগবিষয়ক চুক্তি না হলেও
বিদ্যুৎবিষয়ক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। বিষয়গুলো নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হলেও
পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একমত হতে না পারায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে
বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সহায়তার যে চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ
এখনও আশাবাদী বলেও জানান তিনি। সার্ক সম্মেলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
অনুষঙ্গ সার্কভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক শেষে তিনি
একথা জানান। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে
কোনো বড় অর্জন ছাড়াই শেষ হবে এবারের সার্ক সম্মেলন।
২২ নভেম্বর থেকে শুরু হয় ১৮তম সার্ক সম্মেলনের মূল পর্বের প্রস্তুতিমূলক নানা আনুষ্ঠানিকতা। প্রথম ২ দিন সার্কের প্রোগ্রামিং ও স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক শেষে মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে কাঠমান্ডু ঘোষণা চূড়ান্ত হয়। আর আজ সার্ক সম্মেলনের মূল পর্ব শুরু হবে কাঠমান্ডুর ভ্রীকুটি মণ্ডপে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় সভাগৃহের নগর মিলনায়তনে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানেই চলবে শীর্ষ সম্মেলনের দু’দিনের নানা আনুষ্ঠানিকতা। নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও সার্কের বিদায়ী চেয়ারপারসন আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম। এ সময় তার সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাও বাদ্যের তালে তালে প্রদীপ প্রজ্বলন করবেন। এর আগে আটটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা মূল সম্মেলন মঞ্চে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করবেন। আসন গ্রহণের আগে তারা ফটোসেশনেও অংশ নেবেন।
সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ অঞ্চলের সব শীর্ষ নেতাই মঙ্গলবারই কাঠমান্ডু এসে পৌঁছেন। এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজা পাকসে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং স্বাগতিক নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। সার্ক সদস্য দেশগুলো ছাড়াও ৯টি পর্যবেক্ষক দেশ থেকে প্রায় ৩৫০ জন অতিথি অংশ নিচ্ছেন এ সম্মেলনে। এছাড়া সম্মেলনের খবর সংগ্রহ করতে সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের প্রায় চারশ’ গণমাধ্যমকর্মীও এখন নেপালে অবস্থান করছেন। সর্বশেষ ১৭তম সার্ক সম্মেলন হয়েছিল মালদ্বীপে ২০১১ সালে। আর ১৮তম সম্মেলনের আগে নেপালে আরও দু’বার ২০০২ সালে অষ্টম এবং ১৯৮৭ সালে তৃতীয় সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রস্তুত কাঠমান্ডু : রূপসী নগরী কাঠমান্ডু সার্ক সম্মেলনকে ঘিরে বর্ণাঢ্য সাজে সেজেছে। পাহাড়ের ঢাল কেটে তৈরি নগরের উঁচু-নিচু সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে স্থাপিত বর্ণাঢ্য তোরণ, সার্কভুক্ত আট দেশের পতাকা ও শীর্ষ নেতাদের প্রতিকৃতি সার্ক সম্মেলনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। সাজসজ্জার পাশাপাশি কাঠমান্ডুতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নেপালের সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ফোর্স, পুলিশ ও জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের ২৬ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে রাজধানী কাঠমান্ডুতে। রাজধানীর বাইরে থেকেও নিরাপত্তাকর্মীরা সর্বক্ষণিক সতর্ক প্রহরায়।
একই ক্যাম্পাসে ৮ রাষ্ট্রপ্রধান : নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্চিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থল রাষ্ট্রীয় সভাগৃহকে ঘিরেও। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা সাত শীর্ষ নেতারা থাকবেন নেপালের ক্রাউন প্লাজা সলটি হোটেলে। হোটেলকে ঘিরেও নেয়া হয়েছে অনুরূপ নিরাপত্তা বলয়। যে মঞ্চে সার্ক শীর্ষ নেতারা মিলিত হবেন, সেই নগর মিলনায়তন ছাড়া ও সলটি হোটেল প্রাঙ্গণেও স্থাপন করা হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। সম্মেলন উপলক্ষে গড়ে তোলা পুলিশের একটি পৃথক ইউনিট সম্মেলন স্থলসহ সার্কভুক্ত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের যাতায়াতের স্থানগুলোতে দায়িত্ব পালন করছে। সম্মেলন শেষ হলেও আট শীর্ষ নেতারা নেপাল ত্যাগ না করা পর্যন্ত এই হাই সিকিউরিটি অ্যালার্ম বজায় থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রী পৌঁছেছেন : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পৌঁছেন। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৪টা ২০ মিনিট) প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৭১ ভিভিআইপি ফ্লাইটটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। এর আগে বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী বামদেব গৌতম। এ সময় নেপালের চিফ অব প্রটোকল কালী প্রসাদ পোখরেল এবং নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় নেপালের সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বিমানবন্দরের এই উষ্ণ অভ্যর্থনা শেষে প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাযাত্রা সহকারে হোটেল ক্রাউন প্লাজা সলটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংবর্ধনার সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্য সচিব একেএম শামীম চৌধুরী। পড়ন্ত বিকালে সবুজাভ এয়ারপোর্টে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানাকে।
আজ সার্ক সম্মেলনের মূল পর্বের উদ্বোধনী অধিবেশনে সার্কের অন্য সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত থাকবেন ও ভাষণ দেবেন। এদিন শেখ হাসিনার নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আশরাফ ঘানি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা অবকাশের জন্য হেলিকপ্টারে কাঠমান্ডু থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নেপালের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র নয়নাভিরাম ধুলিখেলের ‘দাওয়ারিকা রিসোর্ট’ যাবেন। এদিনই দুপুরে সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হতে পারে।
সেখান থেকে ফিরে শীর্ষ নেতারা সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। অন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রপতি ভবনে নেপালের রাষ্ট্রপতি ড. রামবরন যাদবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তারা নেপালের রাষ্ট্রপতির দেয়া ভোজসভায়ও যোগ দেবেন। একই হোটেলে থাকাকালে শেখ হাসিনার অন্য দেশগুলোর প্রধানদের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে। শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
পৌঁছেছেন অন্য সার্ক নেতারাও : এর আগে মঙ্গলবার বিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন। পরে তিনি সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলেন। এছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন, শ্রীলঙকার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজা পাকসে এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিও আগে-পরে কাঠমান্ডু পৌঁছেন। সবাইকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ মান সিং।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত : কাঠমান্ডুর হোটেল সলটিতে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্কভুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ৩৬তম বৈঠক। সকাল থেকে দিনব্যাপী এ বৈঠকে সার্ক বিদ্যুৎ সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি, সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চালু করার বিষয়ে চুক্তিসহ সার্ক ডেভলপমেন্ট গোল-২০১৫ সালের প্রতিবেদন, কার্যতালিকা তৈরি এবং কাঠমান্ডু ঘোষণাসহ আঞ্চলিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এদিন সকাল ৯টায় বৈঠকটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক গামিনী লক্ষ্মণ পেইরিস নির্ধারিত সময়ে না আসায় তাকে ছাড়াই বৈঠক শুরু হয় এক ঘণ্টা পরে। তবে শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাঠমান্ডু বিমানবন্দর থেকে সকাল ১১টায় হোটেল সলটিতে এসে বৈঠকে যোগ দেন। সার্কভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ছাড়াও সমমর্যাদা সম্পন্ন পদের কর্মকর্তা ও সচিবরা বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী। তার সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ, আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী জারার আহমাদ ওসমানী, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লইনপো রিনজিন দোরজে, শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক গামিনী লক্ষণ পেইরিস এবং মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুনিয়া মামনুন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের শুরুতে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুনিয়া মামনুন নেপালের পররষ্ট্রমন্ত্রী মাহেন্দ্র বাহাদুর পান্ডের কাছে চেয়ারের দায়িত্ব তুলে দেন। আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত তিনি এই চেয়ারের দায়িত্বে থাকবেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহেন্দ্র বাহাদুর পান্ডে সার্কের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সার্ক সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের জনগণের অনুভূতি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করার জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। এতে সার্ক উপকৃত হবে। সার্ক রাষ্ট্রগুলোর সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এটি ব্যবহার করতে পারলে পারস্পরিক সম্প্রীতি আরও ঘনিষ্ঠ হবে। সার্কের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সংযোগ বাড়াতে সার্ককে আরও গতিশীল করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২২ নভেম্বর থেকে শুরু হয় ১৮তম সার্ক সম্মেলনের মূল পর্বের প্রস্তুতিমূলক নানা আনুষ্ঠানিকতা। প্রথম ২ দিন সার্কের প্রোগ্রামিং ও স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক শেষে মঙ্গলবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে কাঠমান্ডু ঘোষণা চূড়ান্ত হয়। আর আজ সার্ক সম্মেলনের মূল পর্ব শুরু হবে কাঠমান্ডুর ভ্রীকুটি মণ্ডপে অবস্থিত রাষ্ট্রীয় সভাগৃহের নগর মিলনায়তনে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানেই চলবে শীর্ষ সম্মেলনের দু’দিনের নানা আনুষ্ঠানিকতা। নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ও সার্কের বিদায়ী চেয়ারপারসন আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম। এ সময় তার সঙ্গে নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালাও বাদ্যের তালে তালে প্রদীপ প্রজ্বলন করবেন। এর আগে আটটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা মূল সম্মেলন মঞ্চে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করবেন। আসন গ্রহণের আগে তারা ফটোসেশনেও অংশ নেবেন।
সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এ অঞ্চলের সব শীর্ষ নেতাই মঙ্গলবারই কাঠমান্ডু এসে পৌঁছেন। এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজা পাকসে, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং স্বাগতিক নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। সার্ক সদস্য দেশগুলো ছাড়াও ৯টি পর্যবেক্ষক দেশ থেকে প্রায় ৩৫০ জন অতিথি অংশ নিচ্ছেন এ সম্মেলনে। এছাড়া সম্মেলনের খবর সংগ্রহ করতে সার্কভুক্ত দেশগুলো ছাড়াও আরও কয়েকটি দেশের প্রায় চারশ’ গণমাধ্যমকর্মীও এখন নেপালে অবস্থান করছেন। সর্বশেষ ১৭তম সার্ক সম্মেলন হয়েছিল মালদ্বীপে ২০১১ সালে। আর ১৮তম সম্মেলনের আগে নেপালে আরও দু’বার ২০০২ সালে অষ্টম এবং ১৯৮৭ সালে তৃতীয় সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রস্তুত কাঠমান্ডু : রূপসী নগরী কাঠমান্ডু সার্ক সম্মেলনকে ঘিরে বর্ণাঢ্য সাজে সেজেছে। পাহাড়ের ঢাল কেটে তৈরি নগরের উঁচু-নিচু সড়কগুলোর মোড়ে মোড়ে স্থাপিত বর্ণাঢ্য তোরণ, সার্কভুক্ত আট দেশের পতাকা ও শীর্ষ নেতাদের প্রতিকৃতি সার্ক সম্মেলনের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে বারবার। সাজসজ্জার পাশাপাশি কাঠমান্ডুতে নেয়া হয়েছে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। নেপালের সেনাবাহিনী, আর্মড পুলিশ ফোর্স, পুলিশ ও জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের ২৬ হাজার নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েন করা হয়েছে রাজধানী কাঠমান্ডুতে। রাজধানীর বাইরে থেকেও নিরাপত্তাকর্মীরা সর্বক্ষণিক সতর্ক প্রহরায়।
একই ক্যাম্পাসে ৮ রাষ্ট্রপ্রধান : নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা গড়ে তোলা হয়েছে নিশ্চিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলন স্থল রাষ্ট্রীয় সভাগৃহকে ঘিরেও। সম্মেলনে যোগ দিতে আসা সাত শীর্ষ নেতারা থাকবেন নেপালের ক্রাউন প্লাজা সলটি হোটেলে। হোটেলকে ঘিরেও নেয়া হয়েছে অনুরূপ নিরাপত্তা বলয়। যে মঞ্চে সার্ক শীর্ষ নেতারা মিলিত হবেন, সেই নগর মিলনায়তন ছাড়া ও সলটি হোটেল প্রাঙ্গণেও স্থাপন করা হয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। সম্মেলন উপলক্ষে গড়ে তোলা পুলিশের একটি পৃথক ইউনিট সম্মেলন স্থলসহ সার্কভুক্ত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের যাতায়াতের স্থানগুলোতে দায়িত্ব পালন করছে। সম্মেলন শেষ হলেও আট শীর্ষ নেতারা নেপাল ত্যাগ না করা পর্যন্ত এই হাই সিকিউরিটি অ্যালার্ম বজায় থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা।
প্রধানমন্ত্রী পৌঁছেছেন : সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু পৌঁছেন। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় বিকাল ৪টা ৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় ৪টা ২০ মিনিট) প্রধানমন্ত্রী ও তার সফর সঙ্গীদের বহনকারী বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৭১ ভিভিআইপি ফ্লাইটটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে। এর আগে বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী বামদেব গৌতম। এ সময় নেপালের চিফ অব প্রটোকল কালী প্রসাদ পোখরেল এবং নেপালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় নেপালের সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। বিমানবন্দরের এই উষ্ণ অভ্যর্থনা শেষে প্রধানমন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিক মোটর শোভাযাত্রা সহকারে হোটেল ক্রাউন প্লাজা সলটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সংবর্ধনার সময় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা, তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, তথ্য সচিব একেএম শামীম চৌধুরী। পড়ন্ত বিকালে সবুজাভ এয়ারপোর্টে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রী ও শেখ রেহানাকে।
আজ সার্ক সম্মেলনের মূল পর্বের উদ্বোধনী অধিবেশনে সার্কের অন্য সদস্য দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উপস্থিত থাকবেন ও ভাষণ দেবেন। এদিন শেখ হাসিনার নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা, আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ড. আশরাফ ঘানি ও মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা অবকাশের জন্য হেলিকপ্টারে কাঠমান্ডু থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নেপালের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র নয়নাভিরাম ধুলিখেলের ‘দাওয়ারিকা রিসোর্ট’ যাবেন। এদিনই দুপুরে সেখানে শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক হতে পারে।
সেখান থেকে ফিরে শীর্ষ নেতারা সার্ক শীর্ষ সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। অন্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাঠমান্ডুর রাষ্ট্রপতি ভবনে নেপালের রাষ্ট্রপতি ড. রামবরন যাদবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তারা নেপালের রাষ্ট্রপতির দেয়া ভোজসভায়ও যোগ দেবেন। একই হোটেলে থাকাকালে শেখ হাসিনার অন্য দেশগুলোর প্রধানদের সঙ্গেও বৈঠক হতে পারে। শুক্রবার দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
পৌঁছেছেন অন্য সার্ক নেতারাও : এর আগে মঙ্গলবার বিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কাঠমান্ডু ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেন। পরে তিনি সংক্ষিপ্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে কথা বলেন। এছাড়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিন তোবগে, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন, শ্রীলঙকার প্রেসিডেন্ট মাহেন্দ্র রাজা পাকসে এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানিও আগে-পরে কাঠমান্ডু পৌঁছেন। সবাইকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান নেপালের উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ মান সিং।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত : কাঠমান্ডুর হোটেল সলটিতে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে সার্কভুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের ৩৬তম বৈঠক। সকাল থেকে দিনব্যাপী এ বৈঠকে সার্ক বিদ্যুৎ সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের জন্য সার্ক আঞ্চলিক রেল সহযোগিতা চুক্তি, সার্ক পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযান চালু করার বিষয়ে চুক্তিসহ সার্ক ডেভলপমেন্ট গোল-২০১৫ সালের প্রতিবেদন, কার্যতালিকা তৈরি এবং কাঠমান্ডু ঘোষণাসহ আঞ্চলিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশকিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এদিন সকাল ৯টায় বৈঠকটি শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক গামিনী লক্ষ্মণ পেইরিস নির্ধারিত সময়ে না আসায় তাকে ছাড়াই বৈঠক শুরু হয় এক ঘণ্টা পরে। তবে শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী কাঠমান্ডু বিমানবন্দর থেকে সকাল ১১টায় হোটেল সলটিতে এসে বৈঠকে যোগ দেন। সার্কভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ছাড়াও সমমর্যাদা সম্পন্ন পদের কর্মকর্তা ও সচিবরা বৈঠকে যোগ দেন। বৈঠকে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম মাহমুদ আলী। তার সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ, আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী জারার আহমাদ ওসমানী, ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লইনপো রিনজিন দোরজে, শ্রীলংকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক গামিনী লক্ষণ পেইরিস এবং মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুনিয়া মামনুন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের শুরুতে মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুনিয়া মামনুন নেপালের পররষ্ট্রমন্ত্রী মাহেন্দ্র বাহাদুর পান্ডের কাছে চেয়ারের দায়িত্ব তুলে দেন। আগামী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন পর্যন্ত তিনি এই চেয়ারের দায়িত্বে থাকবেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহেন্দ্র বাহাদুর পান্ডে সার্কের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সার্ক সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রের জনগণের অনুভূতি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগের মাধ্যমে এ অঞ্চলের সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করার জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। এতে সার্ক উপকৃত হবে। সার্ক রাষ্ট্রগুলোর সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে। এটি ব্যবহার করতে পারলে পারস্পরিক সম্প্রীতি আরও ঘনিষ্ঠ হবে। সার্কের সঙ্গে সাধারণ জনগণের সংযোগ বাড়াতে সার্ককে আরও গতিশীল করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
No comments