জনগণের সঙ্গে সার্কের সংশ্লিষ্টতা আরও বাড়াতে হবে : এম হুমায়ূন কবির by মোহাম্মদ কবীর আহমদ
যুগান্তর : সার্কের অগ্রগতি নিয়ে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করে থাকেন। এ সংস্থার সামগ্রিক অগ্রগতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
এম হুমায়ূন কবির : দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে যারা হতাশা ব্যক্ত করেন, আমি তাদের সঙ্গে একমত হলেও এ বিষয়ে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বিষয়টি দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, নিকট প্রতিবেশী দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যকার আলাপ-আলোচনাটাও সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্কের সদস্যরাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যখন আলোচনায় বসেন কিংবা সার্কের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন আলোচনা হয়- তার একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি। কূটনীতিতে এটাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। এ ছাড়া সাফটার আওতায় বাংলাদেশসহ অন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলো ভারতের মতো অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে- এটাও সার্কের সহযোগিতারই একটি প্রতিফলন। কাজেই এ অঞ্চলের দেশগুলোর সার্বিক উন্নয়নে সার্কের ভূমিকা একেবারে নগণ্য- একথা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা ঠিক যে, সার্কের প্রতি এ অঞ্চলের জনগণের যে ব্যাপক প্রত্যাশা ছিল, সে প্রেক্ষাপটে সার্কের অর্জন বড়ই কম। সার্কের সাফল্য আরও থাকা উচিত ছিল। পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপ- এদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্কের গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।
যুগান্তর : ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ান তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখতে পারছে, সার্ক তা পারছে না কেন?
হুমায়ূন কবির : ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বা আসিয়ানের মতো সার্ক কেন এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে না- এ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিবর্তে দ্বন্দ্ব বা অসহযোগিতার প্রভাবই বেশি ছিল এবং এখনও যে তা নেই সে কথা বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের দেশগুলোর একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। পারস্পরিক সংঘাত ইউরোপের দেশগুলোতেও ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ বুঝতে পেরেছেন, সংঘাতের চেয়ে সহযোগিতার মূল্য অনেক বেশি। এ অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতাকে ক্রমাগত শক্তিশালী করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। সে তুলনায় এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব জোরালো, এমনটি লক্ষ করা যায়নি। ইইউর অগ্রগতির নেপথ্যে যে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে তা হল, এ সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইইউভুক্ত অগ্রসর দেশগুলোর নেতৃত্ব প্রদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে ইইউভুক্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ তাদের ভিশন বা লক্ষ্য অনুযায়ী ইউরোপকে সাজানোর জোরালো চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সে জন্য ইইউ উন্নয়নের মডেল হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছে।
অন্যদিকে সার্ক গঠনের শুরুতেই ভারতের সন্দেহ ছিল- অন্য ছোট রাষ্ট্রগুলো ভারতের বিরুদ্ধে দল বাঁধার চেষ্টা করছে কি-না; পাকিস্তানের সন্দেহ ছিল, অন্যান্য রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু করছে কি-না। পারস্পরিক এ অবিশ্বাস এখনও বলা যায় আছে- যদিও অতিসম্প্রতি ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। কারণ ভারত এখন বুঝতে পেরেছে- সার্ক এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা কার্যকর বাহন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয়ভাবে যেসব ইস্যুর মীমাংসা সম্ভব হচ্ছে না, ভারত মনে করে সেসব ইস্যু সার্কের আওতায় কোনো একসময় ইতিবাচকভাবে নিষ্পন্ন করা সম্ভব। আমরা লক্ষ করছি- অর্থনৈতিকভাবে সার্কের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে ভারতের উত্থান হচ্ছে এবং ভারত মনে করছে, তার অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য সার্ক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় গত এক দশক ধরে ভারত সার্কের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আসছে। সে কারণেই সাফটা তাত্ত্বিকভাবে মোটামুটি কার্যকর হয়েছে; কিন্তু এখনও অনেক শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। সেগুলো আমাদের অতিক্রম করতে হবে। তবে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। কাজেই সার্ককে ইইউ বা আসিয়ানের সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হবে। নিশ্চয়ই আমরা ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। এর নেপথ্যে অনেক কারণও রয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, নেতৃত্বের ভিশন, রাষ্ট্রগুলোর আয়তন, পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস- এগুলো সার্কের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এবং যতদিন এ বিষয়গুলো নেতিবাচক ভূমিকায় থাকবে ততদিন সার্ক এখন যেভাবে যাচ্ছে সেভাবেই যাবে এবং এ অবস্থা কখনোই আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ানের পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ অবস্থার সম্ভবত পরিবর্তন হচ্ছে।
যুগান্তর : গত দু’বছর সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ এটি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ূন কবির : সার্কে এ ধরনের অনিয়ম নতুন নয়। এ সংস্থা ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এবারে সার্কের ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এ থেকেই স্পষ্ট, এ সম্মেলন বহুবার স্থগিত হয়েছে। এ ব্যত্যয়কে আমি বড় করে দেখতে চাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব অক্ষুণœ থাকলে এ অনিয়ম সার্কের লক্ষ্য অর্জনে খুব একটা ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হয় না। তবে সার্ক সম্মেলন যাতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতে পারে- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।
যুগান্তর : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা এত পিছিয়ে থাকার পরও বলা হয়েছে, সার্কের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে সার্কের কী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত, যাতে আমাদের অর্জন পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থা বুঝতে পারি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আর কী ধরনের সংযোজন দরকার, যাতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্জন স্পষ্ট হয়?
হুমায়ূন কবির : সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়- এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য সন্তুষ্টির বিষয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এমডিজিকে সামনে রেখে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষার বিস্তার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা- এ ধরনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু ধারা তিন দশক ধরে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। সার্কের অন্য দেশগুলো লক্ষ্য অর্জনে আরও জোরালোভাবে এগিয়ে যাক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সার্কের ভূমিকা এখনও আমাদের নজরে আসছে না। পোস্ট মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-এর আলোকে আমরা মনে করি, উন্নত ও অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে জোরালো করার জন্য নৈতিক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখা উচিত। একই সঙ্গে সার্কের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সার্কভুক্ত সব দেশ সহযোগিতা অব্যাহত রাখলে এসব দেশের লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য আসতে পারে।
যুগান্তর : সার্কে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ নেই। অথচ সার্কের সদস্য দেশগুলোর বেশিরভাগ সমস্যাই দ্বিপক্ষীয়। এ বিষয়টি সার্কের অগ্রগতির পথে বাধা বলে মনে করেন কি?
হুমায়ূন কবির : সার্কের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ নেই- এটা সত্য; কিন্তু সার্ক সম্মেলন চলাকালে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। এসব অনানুষ্ঠানিক আলোচনার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যেকোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে দুই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধান করা হয়। একটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে শুরু করে বহুপক্ষীয় আলোচনায় যাওয়া, অপরটি হল বহুপক্ষীয় দিক থেকে আলোচনা শুরু করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। সার্ক কাঠামোতে বহুপক্ষীয় আলোচনার সূত্র ধরে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে। এখনও আমরা আশায় আছি- এ প্রক্রিয়ায় হয়তো একসময় কার্যকর ফল মিলবে। সার্কের বিদ্যমান কাঠামোর পাশাপাশি আরও সৃজনশীল কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে সার্কের গঠনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে কি-না? এতে ভারতের সম্মতি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
হুমায়ূন কবির : সার্কের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। তবে এর বর্তমান কাঠামোতে কেবল ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এ পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের সম্মতিতে তা করা যেতে পারে। তবে সার্কের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না। কারণ ভারত ছাড়া সার্কের অন্য দেশগুলোর কারও সঙ্গে কারও সীমান্ত নেই। ভারত যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়টি সার্কে নিয়ে আসে, তাহলে সার্কের অন্যান্য দেশ এতে স্বস্তিবোধ নাও করতে পারে। কাজেই ভারত যদি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয় এবং অন্য দেশগুলো যদি তাতে স্বস্তিবোধ করে বা তারা যদি দেশটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, তাহলে আমার ধারণা সার্কের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেবল সম্মতি নয়- ভারতকে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।
যুগান্তর : সার্কের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি কী হতে পারে?
হুমায়ূন কবির : এর জন্য সার্ক চার্টারে পরিবর্তন আনতে হবে। সদস্যরাষ্ট্রগুলো একমত হলে এ ধরনের পরিবর্তন তেমন জটিল কোনো কাজ নয়।
যুগান্তর : এ পরিবর্তনের উদ্যোগ তো বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নিতে হবে- আওয়াজটা তুলতে হবে...
হুমায়ূন কবির : এ বিষয়ে আওয়াজ যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। কিছু কিছু আওয়াজ তো উঠছেই। সার্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ‘সর্বসম্মত’ যে বিষয়টি রয়েছে, এটা কি আমাদের জন্য খুব উপযোগী? এতে কি আমরা উপকৃত হয়েছি? এ ধরনের আলাপ-আলোচনা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ আলোচনাটা শুরু হয়নি। থিংকট্যাংক লেভেলে, সুশীল সমাজের আলাপ-আলোচনায় এ বিষয়গুলো ইতিমধ্যে উঠে এসেছে।
যুগান্তর : সামগ্রিকভাবে সার্কের দেশগুলো যাতে দ্রুত উপকৃত হতে পারে- সে জন্য আর কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
হুমায়ূন কবির : এ বিষয়ে ইতিমধ্যে যেসব আলোচনা করেছি তার সঙ্গে আরও যা
যোগ করতে চাই তা হল, ইইউকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া। প্রথমদিকে মাত্র কয়েকটি দেশ মিলে ইইউ প্রতিষ্ঠা করলেও সংস্থাটির কর্মপদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে।
যুগান্তর : বিশেষ প্রয়োজনে ইইউভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সংস্থাটির শীর্ষপর্যায়ে বৈঠকের আয়োজন করা যায়। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কাক্সিক্ষত গতি আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সার্কে এ রকম পদ্ধতি চালু করা কতটা সম্ভব?
হুমায়ূন কবির : সেটা তো হতেই পারে এবং সেটা হয়তো বাঞ্ছনীয়ও। কিন্তু সেটা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ সদ্ভাব-আস্থা-বিশ্বাস দরকার- সেটা কি এ অঞ্চলে আছে? ভারত-পাকিস্তান কি সে পর্যায়ে আছে? সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সার্কভুক্ত দেশের সব শীর্ষ নেতাকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভারতে এলে পাকিস্তানে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেসব বিভিন্নভাবে আমরা শুনেছি। কাজেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার দ্বিপক্ষীয়, বিশেষত জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে জরুরি। এর অভাবে অবিশ্বাস-অনাস্থা বাড়তে থাকে।
যুগান্তর : জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন?
হুমায়ূন কবির : সার্কের কর্মকাণ্ড বর্তমানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। কৃষি খাত, স্বাস্থ্য খাত, অপরাধ দমন, মাদকবিরোধী কর্মসূচি- এরকম অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড কী করে জনগণের সামনে তুলে ধরা যায় এবং বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে কী করে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়- এ বিষয়ে আরও ভাবতে হবে।
সার্কের একটি অন্যতম সমস্যা হল- এটি একটি সুপার বুরোক্র্যাটিক অর্গানাইজেশন ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যতক্ষণ আপামর জনগণের সঙ্গে সার্কের সংশ্লিষ্টতা না বাড়বে, যতক্ষণ জনগণ সার্কের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত না হবে- ততক্ষণ পর্যন্ত সার্কের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সার্কের কর্মপদ্ধতি নিয়ে যখন আমি আলোচনা করব, তখন জনসম্পৃক্ততা কী করে বাড়ানো যায়, জনগণ কীভাবে সার্কের কাজটা দেখবে- সেটাও আমাকে চিন্তা করতে হবে। কারণ সবকিছুই করা হচ্ছে জনগণের কল্যাণে এবং সবকিছুর লক্ষ্যই জনগণ।
যুগান্তর : সার্ক ব্যাংক গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে? এ ধরনের উদ্যোগ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
হুমায়ূন কবির : সার্কের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোই ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডটি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হল, সার্ক ব্যাংক কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থের প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সেই অর্থ দেবে কে? সার্কভুক্ত দেশগুলো গত প্রায় ৩০ বছরে একটিও সার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেই তো হবে না। এর কাজ তো দেখাতে হবে। ব্যাংকটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে ব্যাংকের বিনিয়োগটি লাভজনক হতে হবে। সার্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এ ব্যাংককে লাভজনক করতে না পারলে এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একে কী করে প্রকৃত অর্থে লাভবান করা যায়, তাও খুঁজে বের করতে হবে।
যুগান্তর : জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সার্কভুক্ত দেশগুলো কী উদ্যোগ নিতে পারে? এ ক্ষেত্রে নেপালের বিদ্যুৎ সংকটের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
হুমায়ূন কবির : নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানোর জন্য বিনিয়োগ লাগবে, যথাযথ পরিকল্পনা লাগবে, এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এসব সম্পন্ন করা হলেই তো সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ৮৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে দেশটিতে উৎপাদন হয় মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট।
যুগান্তর : নেপালে কখনও কখনও নাকি প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো লোডশেডিং করা হয়?
হুমায়ূন কবির : নেপালের জনসংখ্যা বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ। আমাদের তুলনায় তাদের অন্তত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। তারা তা করতে পারছে না। কাজেই লোডশেডিং তো হবেই। নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তার সামান্যতমও দেশটি কাজে লাগাতে পারেনি।
যুগান্তর : এ অঞ্চলের দেশগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে কী উদ্যোগ
নেয়া উচিত?
হুমায়ূন কবির : দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে কয়লাকে এক নম্বর বা প্রধান জ্বালানি হিসেবে রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে প্রচুর কয়লা রয়েছে। জলবিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান- এ তিনটি দেশে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে যেসব সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানো হলে এটিও জ্বালানি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আগামী দিনের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক উপকরণ বা জ্বালানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি এমনভাবে বিস্তৃত যে, এককভাবে কোনো দেশ বিদ্যুৎ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরিবর্তে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কাজটি অনেক সহজ হবে। ইতিমধ্যে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক দেশগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রীদের সম্মেলনে সার্ক গ্রিড নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। পাকিস্তান এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি। ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে সার্কের সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি-না তা আলোচিত হবে। পাকিস্তান রাজি থাকলে এবারের কাঠমান্ডু সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রসারের অন্যতম অন্তরায় অশুল্ক বাধা। এ সমস্যা দূর করতে কী করণীয়?
হুমায়ূন কবির : ভারত বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। কাজেই অশুল্ক বাধা দূর করতে ভারত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে গবেষণা খাতে কী ধরনের নতুন কর্মসূচি নেয়া যায়, যা দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে?
হুমায়ূন কবির : দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই এক বড় সমস্যা। দারিদ্র্য বিমোচনে যে কয়েকটি বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করে তার অন্যতম হল শিক্ষা ও দক্ষতা। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভারত অনেক এগিয়ে রয়েছে। অন্যান্য দেশে শিক্ষার প্রসার হলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। একটা দক্ষিণ এশীয় মান নির্ধারণ করা যায় কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাঠ্যক্রমে সমতা বা অভিন্ন মান রক্ষা করার বিষয়টি কী করে নিশ্চিত করা যায় তা আলোচনা করতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, ইংরেজি- এ ধরনের মৌলিক বিষয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে একই পাঠ্যসূচি অনুসরণ করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় সংযুক্ত হলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এটি বিশেষভাবে সহায়তা করবে। মৌলিক বিষয়ে একই পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হলে যৌথ উদ্যোগের উচ্চতর গবেষণায় দ্রুত ইতিবাচক ফল মিলবে। আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দক্ষ কর্মীর চলাচল আরও বাড়বে। বর্তমানে ভারতের প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী বাংলাদেশে কর্মরত। আমাদের দেশের দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়লে অন্য দেশে তাদের চাহিদা বড়বে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে যে বিবর্তন হচ্ছে অর্থাৎ আমরা কৃষি অর্থনীতি থেকে শিল্পকারখানাভিত্তিক অর্থনীতিতে যাচ্ছি- এসব শিল্পকারখানায় দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়বে। ভারতের বর্তমান সরকার শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নেপাল ও ভুটানেও শিল্পকারখানা স্থাপনে জোরালো চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলায় সক্ষম হয়। সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মান রক্ষার (Commonly acceptable standard) বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে- যাতে প্রকৃত অর্থে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মান বজায় থাকে। এতে আগামী দিনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। এ অঞ্চলের সব দেশই কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। এসব দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলায় বিদ্যমান গবেষণা ও সহযোগিতাকে আরও বিস্তৃত করতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
হুমায়ূন কবির : ধন্যবাদ।
এম হুমায়ূন কবির : দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে যারা হতাশা ব্যক্ত করেন, আমি তাদের সঙ্গে একমত হলেও এ বিষয়ে বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে বিষয়টি দেখতে চাই। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, নিকট প্রতিবেশী দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যকার আলাপ-আলোচনাটাও সুসম্পর্ক রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্কের সদস্যরাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দ যখন আলোচনায় বসেন কিংবা সার্কের বিভিন্ন পর্যায়ে যখন আলোচনা হয়- তার একটা ইতিবাচক প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি। কূটনীতিতে এটাকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করি। এ ছাড়া সাফটার আওতায় বাংলাদেশসহ অন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলো ভারতের মতো অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে- এটাও সার্কের সহযোগিতারই একটি প্রতিফলন। কাজেই এ অঞ্চলের দেশগুলোর সার্বিক উন্নয়নে সার্কের ভূমিকা একেবারে নগণ্য- একথা বলা ঠিক হবে না। তবে এটা ঠিক যে, সার্কের প্রতি এ অঞ্চলের জনগণের যে ব্যাপক প্রত্যাশা ছিল, সে প্রেক্ষাপটে সার্কের অর্জন বড়ই কম। সার্কের সাফল্য আরও থাকা উচিত ছিল। পারস্পরিক যোগাযোগ সম্পর্ক উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপ- এদিক থেকে বিবেচনা করলে সার্কের গুরুত্ব আমাদের কাছে স্পষ্ট হতে পারে।
যুগান্তর : ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ান তার সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নে যে ভূমিকা রাখতে পারছে, সার্ক তা পারছে না কেন?
হুমায়ূন কবির : ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বা আসিয়ানের মতো সার্ক কেন এ অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছে না- এ বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার, ঐতিহাসিকভাবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিবর্তে দ্বন্দ্ব বা অসহযোগিতার প্রভাবই বেশি ছিল এবং এখনও যে তা নেই সে কথা বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এ অঞ্চলের দেশগুলোর একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। পারস্পরিক সংঘাত ইউরোপের দেশগুলোতেও ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ বুঝতে পেরেছেন, সংঘাতের চেয়ে সহযোগিতার মূল্য অনেক বেশি। এ অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতাকে ক্রমাগত শক্তিশালী করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। সে তুলনায় এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব জোরালো, এমনটি লক্ষ করা যায়নি। ইইউর অগ্রগতির নেপথ্যে যে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে তা হল, এ সংস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইইউভুক্ত অগ্রসর দেশগুলোর নেতৃত্ব প্রদান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে ইইউভুক্ত দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ তাদের ভিশন বা লক্ষ্য অনুযায়ী ইউরোপকে সাজানোর জোরালো চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। সে জন্য ইইউ উন্নয়নের মডেল হিসেবে গুরুত্ব লাভ করেছে।
অন্যদিকে সার্ক গঠনের শুরুতেই ভারতের সন্দেহ ছিল- অন্য ছোট রাষ্ট্রগুলো ভারতের বিরুদ্ধে দল বাঁধার চেষ্টা করছে কি-না; পাকিস্তানের সন্দেহ ছিল, অন্যান্য রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিছু করছে কি-না। পারস্পরিক এ অবিশ্বাস এখনও বলা যায় আছে- যদিও অতিসম্প্রতি ভারত তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে। কারণ ভারত এখন বুঝতে পেরেছে- সার্ক এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের একটা কার্যকর বাহন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দ্বিপক্ষীয়ভাবে যেসব ইস্যুর মীমাংসা সম্ভব হচ্ছে না, ভারত মনে করে সেসব ইস্যু সার্কের আওতায় কোনো একসময় ইতিবাচকভাবে নিষ্পন্ন করা সম্ভব। আমরা লক্ষ করছি- অর্থনৈতিকভাবে সার্কের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে ভারতের উত্থান হচ্ছে এবং ভারত মনে করছে, তার অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য সার্ক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এসব দিক বিবেচনায় গত এক দশক ধরে ভারত সার্কের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আসছে। সে কারণেই সাফটা তাত্ত্বিকভাবে মোটামুটি কার্যকর হয়েছে; কিন্তু এখনও অনেক শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আছে। সেগুলো আমাদের অতিক্রম করতে হবে। তবে ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে বলে আমি মনে করি। কাজেই সার্ককে ইইউ বা আসিয়ানের সঙ্গে তুলনা করলে পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হবে। নিশ্চয়ই আমরা ওই জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। এর নেপথ্যে অনেক কারণও রয়েছে। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, নেতৃত্বের ভিশন, রাষ্ট্রগুলোর আয়তন, পারস্পরিক বিশ্বাস-অবিশ্বাস- এগুলো সার্কের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এবং যতদিন এ বিষয়গুলো নেতিবাচক ভূমিকায় থাকবে ততদিন সার্ক এখন যেভাবে যাচ্ছে সেভাবেই যাবে এবং এ অবস্থা কখনোই আমাদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা আসিয়ানের পর্যায়ে পৌঁছাতে সাহায্য করবে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ অবস্থার সম্ভবত পরিবর্তন হচ্ছে।
যুগান্তর : গত দু’বছর সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। অর্থাৎ এটি অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
হুমায়ূন কবির : সার্কে এ ধরনের অনিয়ম নতুন নয়। এ সংস্থা ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এবারে সার্কের ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এ থেকেই স্পষ্ট, এ সম্মেলন বহুবার স্থগিত হয়েছে। এ ব্যত্যয়কে আমি বড় করে দেখতে চাই না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব অক্ষুণœ থাকলে এ অনিয়ম সার্কের লক্ষ্য অর্জনে খুব একটা ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে হয় না। তবে সার্ক সম্মেলন যাতে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হতে পারে- এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার চেষ্টা অব্যাহত রাখা উচিত।
যুগান্তর : বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আমরা এত পিছিয়ে থাকার পরও বলা হয়েছে, সার্কের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করে সার্কের কী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত, যাতে আমাদের অর্জন পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থা বুঝতে পারি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় আর কী ধরনের সংযোজন দরকার, যাতে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অর্জন স্পষ্ট হয়?
হুমায়ূন কবির : সার্ক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়- এটা নিশ্চয়ই আমাদের জন্য সন্তুষ্টির বিষয়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এমডিজির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া আমাদের দেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করার জন্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। এমডিজিকে সামনে রেখে আমরা দারিদ্র্য বিমোচন, নারী শিক্ষার বিস্তার, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা- এ ধরনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইতিবাচক কিছু ধারা তিন দশক ধরে বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছি। সার্কের অন্য দেশগুলো লক্ষ্য অর্জনে আরও জোরালোভাবে এগিয়ে যাক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। সে ক্ষেত্রে ওই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সার্কের ভূমিকা এখনও আমাদের নজরে আসছে না। পোস্ট মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল-এর আলোকে আমরা মনে করি, উন্নত ও অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে জোরালো করার জন্য নৈতিক, আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা অব্যাহত রাখা উচিত। একই সঙ্গে সার্কের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সার্কভুক্ত সব দেশ সহযোগিতা অব্যাহত রাখলে এসব দেশের লক্ষ্য অর্জনে সাফল্য আসতে পারে।
যুগান্তর : সার্কে দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ নেই। অথচ সার্কের সদস্য দেশগুলোর বেশিরভাগ সমস্যাই দ্বিপক্ষীয়। এ বিষয়টি সার্কের অগ্রগতির পথে বাধা বলে মনে করেন কি?
হুমায়ূন কবির : সার্কের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ নেই- এটা সত্য; কিন্তু সার্ক সম্মেলন চলাকালে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ অনানুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। এসব অনানুষ্ঠানিক আলোচনার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। যেকোনো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে দুই পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধান করা হয়। একটি হচ্ছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে শুরু করে বহুপক্ষীয় আলোচনায় যাওয়া, অপরটি হল বহুপক্ষীয় দিক থেকে আলোচনা শুরু করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। সার্ক কাঠামোতে বহুপক্ষীয় আলোচনার সূত্র ধরে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যেতে পারে। এখনও আমরা আশায় আছি- এ প্রক্রিয়ায় হয়তো একসময় কার্যকর ফল মিলবে। সার্কের বিদ্যমান কাঠামোর পাশাপাশি আরও সৃজনশীল কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখা যেতে পারে।
যুগান্তর : এ ক্ষেত্রে সার্কের গঠনতন্ত্রে কোনো পরিবর্তন আনার প্রয়োজন আছে কি-না? এতে ভারতের সম্মতি পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?
হুমায়ূন কবির : সার্কের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। তবে এর বর্তমান কাঠামোতে কেবল ভারতের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এ পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের সম্মতিতে তা করা যেতে পারে। তবে সার্কের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা অস্বীকার করা যায় না। কারণ ভারত ছাড়া সার্কের অন্য দেশগুলোর কারও সঙ্গে কারও সীমান্ত নেই। ভারত যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়টি সার্কে নিয়ে আসে, তাহলে সার্কের অন্যান্য দেশ এতে স্বস্তিবোধ নাও করতে পারে। কাজেই ভারত যদি এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয় এবং অন্য দেশগুলো যদি তাতে স্বস্তিবোধ করে বা তারা যদি দেশটির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, তাহলে আমার ধারণা সার্কের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তনের একটা উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কেবল সম্মতি নয়- ভারতকে এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে।
যুগান্তর : সার্কের গঠনতন্ত্র পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি কী হতে পারে?
হুমায়ূন কবির : এর জন্য সার্ক চার্টারে পরিবর্তন আনতে হবে। সদস্যরাষ্ট্রগুলো একমত হলে এ ধরনের পরিবর্তন তেমন জটিল কোনো কাজ নয়।
যুগান্তর : এ পরিবর্তনের উদ্যোগ তো বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে নিতে হবে- আওয়াজটা তুলতে হবে...
হুমায়ূন কবির : এ বিষয়ে আওয়াজ যে একেবারে নেই, তা বলা যাবে না। কিছু কিছু আওয়াজ তো উঠছেই। সার্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ‘সর্বসম্মত’ যে বিষয়টি রয়েছে, এটা কি আমাদের জন্য খুব উপযোগী? এতে কি আমরা উপকৃত হয়েছি? এ ধরনের আলাপ-আলোচনা বিভিন্ন পর্যায়ে হয়; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ আলোচনাটা শুরু হয়নি। থিংকট্যাংক লেভেলে, সুশীল সমাজের আলাপ-আলোচনায় এ বিষয়গুলো ইতিমধ্যে উঠে এসেছে।
যুগান্তর : সামগ্রিকভাবে সার্কের দেশগুলো যাতে দ্রুত উপকৃত হতে পারে- সে জন্য আর কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?
হুমায়ূন কবির : এ বিষয়ে ইতিমধ্যে যেসব আলোচনা করেছি তার সঙ্গে আরও যা
যোগ করতে চাই তা হল, ইইউকে উদাহরণ হিসেবে নেয়া। প্রথমদিকে মাত্র কয়েকটি দেশ মিলে ইইউ প্রতিষ্ঠা করলেও সংস্থাটির কর্মপদ্ধতিতে আকৃষ্ট হয়ে সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে।
যুগান্তর : বিশেষ প্রয়োজনে ইইউভুক্ত দেশগুলোর শীর্ষ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হলে অল্প সময়ের ব্যবধানে সংস্থাটির শীর্ষপর্যায়ে বৈঠকের আয়োজন করা যায়। এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কাক্সিক্ষত গতি আসার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সার্কে এ রকম পদ্ধতি চালু করা কতটা সম্ভব?
হুমায়ূন কবির : সেটা তো হতেই পারে এবং সেটা হয়তো বাঞ্ছনীয়ও। কিন্তু সেটা হওয়ার জন্য যে পরিমাণ সদ্ভাব-আস্থা-বিশ্বাস দরকার- সেটা কি এ অঞ্চলে আছে? ভারত-পাকিস্তান কি সে পর্যায়ে আছে? সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী সার্কভুক্ত দেশের সব শীর্ষ নেতাকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভারতে এলে পাকিস্তানে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেসব বিভিন্নভাবে আমরা শুনেছি। কাজেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার দ্বিপক্ষীয়, বিশেষত জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে জরুরি। এর অভাবে অবিশ্বাস-অনাস্থা বাড়তে থাকে।
যুগান্তর : জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবেন?
হুমায়ূন কবির : সার্কের কর্মকাণ্ড বর্তমানে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়ে থাকে। কৃষি খাত, স্বাস্থ্য খাত, অপরাধ দমন, মাদকবিরোধী কর্মসূচি- এরকম অনেক ধরনের কাজ হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ড কী করে জনগণের সামনে তুলে ধরা যায় এবং বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে কী করে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যায়- এ বিষয়ে আরও ভাবতে হবে।
সার্কের একটি অন্যতম সমস্যা হল- এটি একটি সুপার বুরোক্র্যাটিক অর্গানাইজেশন ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যতক্ষণ আপামর জনগণের সঙ্গে সার্কের সংশ্লিষ্টতা না বাড়বে, যতক্ষণ জনগণ সার্কের মাধ্যমে সরাসরি উপকৃত না হবে- ততক্ষণ পর্যন্ত সার্কের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। সার্কের কর্মপদ্ধতি নিয়ে যখন আমি আলোচনা করব, তখন জনসম্পৃক্ততা কী করে বাড়ানো যায়, জনগণ কীভাবে সার্কের কাজটা দেখবে- সেটাও আমাকে চিন্তা করতে হবে। কারণ সবকিছুই করা হচ্ছে জনগণের কল্যাণে এবং সবকিছুর লক্ষ্যই জনগণ।
যুগান্তর : সার্ক ব্যাংক গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে? এ ধরনের উদ্যোগ সদস্যরাষ্ট্রগুলোর উন্নয়নে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
হুমায়ূন কবির : সার্কের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোই ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। সার্ক ডেভেলপমেন্ট ফান্ডটি ঠিকমতো কাজে লাগানো যায়নি। এ অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে যে প্রশ্নটি এসে যায় তা হল, সার্ক ব্যাংক কীভাবে কাজে লাগানো যাবে? ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হলে অর্থের প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় সেই অর্থ দেবে কে? সার্কভুক্ত দেশগুলো গত প্রায় ৩০ বছরে একটিও সার্ক প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করলেই তো হবে না। এর কাজ তো দেখাতে হবে। ব্যাংকটিকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে ব্যাংকের বিনিয়োগটি লাভজনক হতে হবে। সার্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু এ ব্যাংককে লাভজনক করতে না পারলে এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি একে কী করে প্রকৃত অর্থে লাভবান করা যায়, তাও খুঁজে বের করতে হবে।
যুগান্তর : জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সার্কভুক্ত দেশগুলো কী উদ্যোগ নিতে পারে? এ ক্ষেত্রে নেপালের বিদ্যুৎ সংকটের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।
হুমায়ূন কবির : নেপালে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে প্রচুর সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানোর জন্য বিনিয়োগ লাগবে, যথাযথ পরিকল্পনা লাগবে, এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। এসব সম্পন্ন করা হলেই তো সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে। নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে ৮৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে দেশটিতে উৎপাদন হয় মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট।
যুগান্তর : নেপালে কখনও কখনও নাকি প্রায় ২০ ঘণ্টার মতো লোডশেডিং করা হয়?
হুমায়ূন কবির : নেপালের জনসংখ্যা বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগ। আমাদের তুলনায় তাদের অন্তত ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। তারা তা করতে পারছে না। কাজেই লোডশেডিং তো হবেই। নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যে ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে তার সামান্যতমও দেশটি কাজে লাগাতে পারেনি।
যুগান্তর : এ অঞ্চলের দেশগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে কী উদ্যোগ
নেয়া উচিত?
হুমায়ূন কবির : দক্ষিণ এশিয়ার বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে কয়লাকে এক নম্বর বা প্রধান জ্বালানি হিসেবে রাখতে হবে। কারণ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে প্রচুর কয়লা রয়েছে। জলবিদ্যুতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ভুটানে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান- এ তিনটি দেশে গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশে যেসব সম্ভাবনা আছে, তা কাজে লাগানো হলে এটিও জ্বালানি নিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর আগামী দিনের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক উপকরণ বা জ্বালানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি এমনভাবে বিস্তৃত যে, এককভাবে কোনো দেশ বিদ্যুৎ খাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরিবর্তে আন্তঃদেশীয় সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে কাজটি অনেক সহজ হবে। ইতিমধ্যে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সার্ক দেশগুলোর জ্বালানি ও বিদ্যুৎমন্ত্রীদের সম্মেলনে সার্ক গ্রিড নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। পাকিস্তান এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানায়নি। ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত মন্ত্রী পর্যায়ের সিদ্ধান্তকে সার্কের সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচনা করা যায় কি-না তা আলোচিত হবে। পাকিস্তান রাজি থাকলে এবারের কাঠমান্ডু সম্মেলন দক্ষিণ এশিয়ায় বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশগুলোর বিনিয়োগ ও বাণিজ্য প্রসারের অন্যতম অন্তরায় অশুল্ক বাধা। এ সমস্যা দূর করতে কী করণীয়?
হুমায়ূন কবির : ভারত বাংলাদেশকে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশ এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে প্রাপ্ত শুল্কমুক্ত সুবিধার সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না। কাজেই অশুল্ক বাধা দূর করতে ভারত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
যুগান্তর : সার্কভুক্ত দেশগুলোর যৌথ উদ্যোগে গবেষণা খাতে কী ধরনের নতুন কর্মসূচি নেয়া যায়, যা দেশগুলোর টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে?
হুমায়ূন কবির : দারিদ্র্য দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের জন্যই এক বড় সমস্যা। দারিদ্র্য বিমোচনে যে কয়েকটি বিষয় প্রধান ভূমিকা পালন করে তার অন্যতম হল শিক্ষা ও দক্ষতা। সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভারত অনেক এগিয়ে রয়েছে। অন্যান্য দেশে শিক্ষার প্রসার হলেও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। একটা দক্ষিণ এশীয় মান নির্ধারণ করা যায় কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর পাঠ্যক্রমে সমতা বা অভিন্ন মান রক্ষা করার বিষয়টি কী করে নিশ্চিত করা যায় তা আলোচনা করতে হবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত, ইংরেজি- এ ধরনের মৌলিক বিষয়ে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে একই পাঠ্যসূচি অনুসরণ করার বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এই মৌলিক বিষয়ের পাশাপাশি প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি- এসব বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিষয় সংযুক্ত হলে সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনগণের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধিতে এটি বিশেষভাবে সহায়তা করবে। মৌলিক বিষয়ে একই পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হলে যৌথ উদ্যোগের উচ্চতর গবেষণায় দ্রুত ইতিবাচক ফল মিলবে। আগামী দিনগুলোতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দক্ষ কর্মীর চলাচল আরও বাড়বে। বর্তমানে ভারতের প্রায় পাঁচ লাখ কর্মী বাংলাদেশে কর্মরত। আমাদের দেশের দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়লে অন্য দেশে তাদের চাহিদা বড়বে। বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোতে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের দক্ষ কর্মীর চাহিদা তৈরি হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে যে বিবর্তন হচ্ছে অর্থাৎ আমরা কৃষি অর্থনীতি থেকে শিল্পকারখানাভিত্তিক অর্থনীতিতে যাচ্ছি- এসব শিল্পকারখানায় দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়বে। ভারতের বর্তমান সরকার শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য দেশীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। নেপাল ও ভুটানেও শিল্পকারখানা স্থাপনে জোরালো চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। কাজেই আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবেলায় সক্ষম হয়। সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মান রক্ষার (Commonly acceptable standard) বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর সহযোগিতা বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে- যাতে প্রকৃত অর্থে শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্য মান বজায় থাকে। এতে আগামী দিনের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। এ অঞ্চলের সব দেশই কম-বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ। এসব দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলায় বিদ্যমান গবেষণা ও সহযোগিতাকে আরও বিস্তৃত করতে হবে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ
হুমায়ূন কবির : ধন্যবাদ।
No comments