সার্ক সম্মেলনে গুরুত্ব পাক ফুড ব্যাংকের বাস্তবায়ন by আবদুল লতিফ মন্ডল
২০০৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) ১৩তম শীর্ষ সম্মেলনে এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘সার্ক ফুড ব্যাংক’ গঠনের প্রস্তাব করে ভারত। ২০০৭ সালে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ১৪তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে সার্ক ফুড ব্যাংক গঠনের চুক্তি হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন (কেবল ভুটানের শ্রম ও মানবসম্পদমন্ত্রী সে দেশের পক্ষে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন)। এ চুক্তিটি ১৯৮৮ সালের ‘সার্ক ফুড সিকিউরিটি রিজার্ভ প্রতিষ্ঠা চুক্তি’র স্থলাভিষিক্ত হয়। তবে হতাশার কথা হল, গঠনের পর সাত বছর পার হতে চললেও কার্যকর হয়নি সার্ক ফুড ব্যাংক।
সার্ক ফুড ব্যাংক অকার্যকর থাকা অবস্থায় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সার্কের প্রোগ্রামিং কমিটির বৈঠকের মধ্য দিয়ে ২২ নভেম্বর শুরু হয়েছে সার্কের ১৮তম সম্মেলন। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর সার্কের আটটি সদস্য দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠকের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ১৮তম সার্ক সম্মেলন। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য গভীর সমন্বয়’। আমরা চাইব, এ অঞ্চলের দেশগুলোতে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চলতি সার্ক সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গুরুত্ব পাক সার্ক ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের বিষয়টিও।
সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা চুক্তির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সদস্য দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং তারা আরও অনুধাবন করে যে, একটি আঞ্চলিক খাদ্য মজুদ স্থাপনা তাদের খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি সাধনে সহায়ক হবে।
২০০৭ সালে সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সার্কভুক্ত দেশগুলো যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে সার্ক ফুড ব্যাংক স্থাপনের উদ্দেশ্যাবলী সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হল- এই ব্যাংক ক. স্বাভাবিক সময়ে খাদ্যাভাব এবং জরুরি অবস্থায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তায় মজুদ হিসেবে কাজ করবে; খ. সার্কভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক সহায়তা দেবে; গ. সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ও আঞ্চলিক সংহতি জোরদার এবং যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক খাদ্যাভাব দূর করবে। চুক্তির অন্য প্রধান বিষয়গুলো হল- খাদ্যশস্যের (ধান ও গম) মজুদ, মজুদের গুণগত মান, খাদ্যশস্য উত্তোলন, মজুদ থেকে খাদ্যশস্য ছাড়করণের পদ্ধতি, মজুদ পুনর্ভরণ, কোনো সদস্যের নিজ মজুদের অংশ থেকে খাদ্যশস্য উত্তোলনের পদ্ধতি, খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি এবং ফুড ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফুড ব্যাংক বোর্ডের গঠন ও কার্যাবলি।
সার্ক ফুড ব্যাংক স্থাপন চুক্তিতে ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টন খাদ্যশস্যের মজুদ গড়ে তোলার বিধান রাখা হয়েছে। সদস্য দেশগুলোর জন্য সার্ক ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্য মজুদের যে পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে তা হল- বাংলাদেশ ৪০ হাজার, ভুটান ১৮০, ভারত ১ লাখ ৫৩ হাজার ২০০, মালদ্বীপ ২০০, নেপাল ৪ হাজার, পাকিস্তান ৪০ হাজার এবং শ্রীলংকা ৪ হাজার টন। আফগানিস্তানের জন্য কোনো মজুদের পরিমাণ ওই চুক্তিতে নির্ধারণ করা হয়নি।
২০১০ সালের ২৭-২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ফুড ব্যাংকের চতুর্থ বোর্ড সভায় খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ৪ লাখ টনে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশের পেছনের কারণগুলো হল- ক. দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার বিপরীতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি খ. সার্কভুক্ত দেশগুলোয় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, যার ফলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশংকা এবং গ. দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে জরুরি খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্যের মজুদের অপর্যাপ্ততা।
২০১২ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ফুড ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের বিশেষ সভায় বাংলাদেশ ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ৪ লাখ টনে উন্নীত করার সুপারিশ পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্নে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টন। তবে সময়ের ব্যবধানে এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করতে মজুদের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে। সাব-সাহারা অঞ্চলের পরেই এ অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি। বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বাস দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। এখানকার প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার। উল্লেখ্য, সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করতে বাংলাদেশ সবসময় আন্তরিক।
শুধু তা-ই নয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার, আয়বৈষম্য ও সম্পদের অসম বণ্টন, প্রযুক্তি ব্যবহারে ধীরগতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ঝুঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতিসহ বিভিন্ন দিক থেকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উপায় উদ্ভাবনে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের একসঙ্গে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করা হলে এটি এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ইক্যুইটিবিডি (ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ, বাংলাদেশ) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সার্ক ফিড ও ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। সেমিনারে ১৮তম সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেমিনারে বলা হয়, বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক-২০১৪ অনুযায়ী নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের সহজ লভ্যতা ও খাদ্যমানের বিষয়ে ১০৯টি দেশের ওপর পরিচালিত জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অবস্থানও আশাপ্রদ নয়। সেমিনারে আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার কৃষির জন্য মারাত্মক হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এশিয়ার দেশগুলোর প্রকৃত উৎপাদন ৪-১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে সার্ক ফিড ও সার্ক ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন বক্তারা।
সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, সম্প্রতি কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ‘সাউথ এশিয়া রিজিওনাল পলিসি ফোরাম অন ডিজাস্টার, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এগ্রিকালচার/ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক সংলাপে যোগদানকারী ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সার্ক ফুড ব্যাংককে কার্যকর ও শক্তিশালী করার জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, এবারের সার্ক সম্মেলনে সার্ক ফুড ব্যাংক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশে নতুন সরকার এসেছে। তাই ফুড ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাছাড়া কত সময়ের জন্য খাদ্য মজুদ রাখা হবে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তবে অচিরেই এসব সমস্যা কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, কোনো কোনো মহলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এর আগে ১৯৮৮ সালের সার্ক ফুড সিকিউরিটি রিজার্ভ প্রতিষ্ঠা চুক্তিটি সফল হয়নি। সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করার অস্বাভাবিক দেরি দেখে তারা এর ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্দিহান।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সার্ক কাঠামোর আওতায় বেশ কয়েকটি ভালো উদ্যোগের মধ্যে সার্ক ফুড ব্যাংক অন্যতম। তাই দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের অবস্থার উন্নয়নে একযোগে কাজ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক পন্থা হিসেবে সার্ক ফুড ব্যাংককে দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সার্ক ফুড ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে যত শিগগির সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করতে এগিয়ে আসবেন, ততই তা এ অঞ্চলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
সার্ক ফুড ব্যাংক অকার্যকর থাকা অবস্থায় নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে সার্কের প্রোগ্রামিং কমিটির বৈঠকের মধ্য দিয়ে ২২ নভেম্বর শুরু হয়েছে সার্কের ১৮তম সম্মেলন। ২৬ ও ২৭ নভেম্বর সার্কের আটটি সদস্য দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তানের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠকের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ১৮তম সার্ক সম্মেলন। এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য গভীর সমন্বয়’। আমরা চাইব, এ অঞ্চলের দেশগুলোতে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য চলতি সার্ক সম্মেলনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গুরুত্ব পাক সার্ক ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের বিষয়টিও।
সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা চুক্তির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সদস্য দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং তারা আরও অনুধাবন করে যে, একটি আঞ্চলিক খাদ্য মজুদ স্থাপনা তাদের খাদ্য নিরাপত্তার উন্নতি সাধনে সহায়ক হবে।
২০০৭ সালে সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সার্কভুক্ত দেশগুলো যে চুক্তি স্বাক্ষর করে, তাতে সার্ক ফুড ব্যাংক স্থাপনের উদ্দেশ্যাবলী সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হল- এই ব্যাংক ক. স্বাভাবিক সময়ে খাদ্যাভাব এবং জরুরি অবস্থায় সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তায় মজুদ হিসেবে কাজ করবে; খ. সার্কভুক্ত দেশগুলোর জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক সহায়তা দেবে; গ. সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ও আঞ্চলিক সংহতি জোরদার এবং যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে আঞ্চলিক খাদ্যাভাব দূর করবে। চুক্তির অন্য প্রধান বিষয়গুলো হল- খাদ্যশস্যের (ধান ও গম) মজুদ, মজুদের গুণগত মান, খাদ্যশস্য উত্তোলন, মজুদ থেকে খাদ্যশস্য ছাড়করণের পদ্ধতি, মজুদ পুনর্ভরণ, কোনো সদস্যের নিজ মজুদের অংশ থেকে খাদ্যশস্য উত্তোলনের পদ্ধতি, খাদ্যশস্যের মূল্য নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি এবং ফুড ব্যাংক পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফুড ব্যাংক বোর্ডের গঠন ও কার্যাবলি।
সার্ক ফুড ব্যাংক স্থাপন চুক্তিতে ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টন খাদ্যশস্যের মজুদ গড়ে তোলার বিধান রাখা হয়েছে। সদস্য দেশগুলোর জন্য সার্ক ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্য মজুদের যে পরিমাণ নির্ধারিত হয়েছে তা হল- বাংলাদেশ ৪০ হাজার, ভুটান ১৮০, ভারত ১ লাখ ৫৩ হাজার ২০০, মালদ্বীপ ২০০, নেপাল ৪ হাজার, পাকিস্তান ৪০ হাজার এবং শ্রীলংকা ৪ হাজার টন। আফগানিস্তানের জন্য কোনো মজুদের পরিমাণ ওই চুক্তিতে নির্ধারণ করা হয়নি।
২০১০ সালের ২৭-২৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ফুড ব্যাংকের চতুর্থ বোর্ড সভায় খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ৪ লাখ টনে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। এ সুপারিশের পেছনের কারণগুলো হল- ক. দক্ষিণ এশিয়ায় কৃষিজমির পরিমাণ ক্রমাগত হ্রাস পাওয়ার বিপরীতে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি খ. সার্কভুক্ত দেশগুলোয় ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, যার ফলে ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার আশংকা এবং গ. দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে জরুরি খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্যের মজুদের অপর্যাপ্ততা।
২০১২ সালের মে মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সার্ক ফুড ব্যাংক পরিচালনা বোর্ডের বিশেষ সভায় বাংলাদেশ ফুড ব্যাংকে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ৪ লাখ টনে উন্নীত করার সুপারিশ পুনর্ব্যক্ত করে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সার্ক ফুড ব্যাংক প্রতিষ্ঠালগ্নে খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ২ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টন। তবে সময়ের ব্যবধানে এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করতে মজুদের পরিমাণ বাড়ানো দরকার। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে। সাব-সাহারা অঞ্চলের পরেই এ অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি। বিশ্বের প্রায় ৪০ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বাস দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। এখানকার প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার। উল্লেখ্য, সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করতে বাংলাদেশ সবসময় আন্তরিক।
শুধু তা-ই নয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চ হার, আয়বৈষম্য ও সম্পদের অসম বণ্টন, প্রযুক্তি ব্যবহারে ধীরগতি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের ঝুঁকি, প্রাকৃতিক সম্পদের ঘাটতিসহ বিভিন্ন দিক থেকে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন, দারিদ্র্য হ্রাস, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি মোকাবেলা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উপায় উদ্ভাবনে সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতাদের একসঙ্গে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করা হলে এটি এ অঞ্চলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
পত্রপত্রিকা সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ইক্যুইটিবিডি (ইক্যুইটি অ্যান্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ, বাংলাদেশ) আয়োজিত এক সেমিনারে বক্তারা দক্ষিণ এশিয়ায় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সার্ক ফিড ও ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। সেমিনারে ১৮তম সার্ক সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেমিনারে বলা হয়, বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক-২০১৪ অনুযায়ী নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা, খাদ্যের সহজ লভ্যতা ও খাদ্যমানের বিষয়ে ১০৯টি দেশের ওপর পরিচালিত জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮তম। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর অবস্থানও আশাপ্রদ নয়। সেমিনারে আরও বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তন দক্ষিণ এশিয়ার কৃষির জন্য মারাত্মক হুমকি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এশিয়ার দেশগুলোর প্রকৃত উৎপাদন ৪-১০ শতাংশ কমে যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে মুক্তি পেতে সার্ক ফিড ও সার্ক ফুড ব্যাংক বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন বক্তারা।
সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যে, সম্প্রতি কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত ‘সাউথ এশিয়া রিজিওনাল পলিসি ফোরাম অন ডিজাস্টার, ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এগ্রিকালচার/ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক সংলাপে যোগদানকারী ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে সার্ক ফুড ব্যাংককে কার্যকর ও শক্তিশালী করার জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, এবারের সার্ক সম্মেলনে সার্ক ফুড ব্যাংক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সার্কভুক্ত প্রায় প্রতিটি দেশে নতুন সরকার এসেছে। তাই ফুড ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাছাড়া কত সময়ের জন্য খাদ্য মজুদ রাখা হবে তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। তবে অচিরেই এসব সমস্যা কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, কোনো কোনো মহলের রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এর আগে ১৯৮৮ সালের সার্ক ফুড সিকিউরিটি রিজার্ভ প্রতিষ্ঠা চুক্তিটি সফল হয়নি। সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করার অস্বাভাবিক দেরি দেখে তারা এর ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্দিহান।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সার্ক কাঠামোর আওতায় বেশ কয়েকটি ভালো উদ্যোগের মধ্যে সার্ক ফুড ব্যাংক অন্যতম। তাই দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের অবস্থার উন্নয়নে একযোগে কাজ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সহায়ক পন্থা হিসেবে সার্ক ফুড ব্যাংককে দ্রুত কার্যকর করতে হবে। এ অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সার্ক ফুড ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না। সার্কভুক্ত দেশগুলোর নেতারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে যত শিগগির সার্ক ফুড ব্যাংক কার্যকর করতে এগিয়ে আসবেন, ততই তা এ অঞ্চলের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments