শ্রম আইনে শ্রমিকবান্ধব সংশোধনী আনতে হবে by মেসবাহ উদ্দীন আহমেদ
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র কি হঠাৎ করেই জিএসপি স্থগিত করল বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রমমানের
উন্নয়ন না হলে জিএসপি সুবিধা বাতিলের ঘোষণা দিল! রানা প্লাজাই কি এর
অন্যতম কারণ! বা ওয়াশিংটন পোস্টে বেরোনো খালেদা জিয়ার চিঠিই কি এর কারণ?
নাকি ড. ইউনূস? বা আমিনুলের মৃত্যুকে কি আমরা এর কারণ ধরব? নাকি কারণ আরও
গূঢ় ও ব্যাপক! যারা এই শ্রম-সম্পর্কিত বিষয়ে জানেন; তারা অবশ্যই অবহিত আছেন
যে, নব্বই দশক থেকেই আমেরিকার কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন এএফএল-সিআইও ও
ইউরোপীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো বাংলাদেশের শিশুশ্রম ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা
বলে আসছিল। এবং এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছিল মানবাধিকার
সংস্থা। তারা এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রচার চালায়। ক্রেতাদের যেমন এই
বিষয়গুলো বিবেচনা করার জন্য চাপ দিতে থাকে, তেমনই এই সংগঠনগুলো বাংলাদেশ
সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করে। চাপ ক্রমে তীব্র হতে থাকে এবং একসময় সেটি
প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে তখন সাফ সাফই জানিয়ে
দেয় যে, শ্রমমানের উন্নতি না হলে তারা বাংলাদেশকে বাণিজ্যে যে সব
সুযোগ-সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে, তা বন্ধ করে দেবে। আমরা গোড়া থেকেই এ রকমই একটা
আশংকা করে আসছিলাম। আমরা গভীর উদ্বিগ্ন ছিলাম এই শংকায় যে, ট্রেড
ইউনিয়নবিহীন পোশাক শিল্পে হয় শ্রমিক বিস্ফোরণ ঘটবে অথবা দেশের এই
গুরুত্বপূর্ণ খাতটি পশ্চিমের দেয়া সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হবে। অমন অঘটনটি
ঘটবে, তবেই সবার টনক নড়বে। এখন এমন হল, বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকায় শিরোনাম,
মূল প্রবন্ধ, প্রেসিডেন্ট ওবামা থেকে মহামান্য পোপ, আমেরিকান সিনেট,
ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট- সবাই তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে সরব হলেন। তারপর
আমাদের একটু বোধোদয় হল। তারপরও আমাদের দু’একজন মন্ত্রী বললেন, না এটা তেমন
কিছুই না, এরকম ঘটনা ঘটতেই পারে।
তবে শুধু আশংকা করে করেই আমরা, শ্রমিকরা ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা, নিরস্ত ছিলাম না। অমন ভয়াবহ পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না ঘটে, সে জন্য বাংলাদেশের শ্রমিকরা এবং শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা অনেক চেষ্টাও করে যায়। কিন্তু কে শোনে শ্রমিকদের কথা! কে কর্ণপাত করে সত্য ভাষণে! বিগত দুই-তিন বছর ধরে এমনকি শ্রমিক-মালিক-সরকারের ত্রিপক্ষীয় সভাও হয় না! যেখানে বিষয় গুলো নিয়ে কথা বলা যেত।
আইএলও অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে আসছে। চেষ্টা করে চলছে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের বাজারটি বহাল রাখার জন্য। নানা উদ্যোগ নিয়েছে যেন বাংলাদেশ ইউরোপ ও আমেরিকায় বাজারটি না হারায়। আইএলও খুব সাফল্যের সঙ্গে শিশুশ্রম নিরসনে পোশাক শিল্পকে সাহায্য করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আইএলও শত চেষ্টা করেও অন্যান্য শ্রমমানের উন্নয়নের গুরুত্বটি বাংলাদেশ সরকার ও মালিকদের বোঝাতে সমর্থ হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ও মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর দাবি ও নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাকে অবহেলা তো করেছেই; উপরন্তু ক্রেতা-দাতারা যে মান চেয়ে এসেছে, তারা সেগুলো বরাবর পাশ কাটিয়ে গেছে। এরা ট্রেড ইউনিয়নের পরিবর্তে গঠন করতে আগ্রহী হয়েছে পার্টিসিপিটরি কমিটি। আগুন লাগলে বা বিপদ আপদে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অব্যবহারযোগ্য লোহার সিঁড়ি ইত্যাদি বানিয়ে দায় সারতে চেয়েছে। এবং মূল করণীয় কর্ম থেকে বরাবর রয়ে গেছে দূরে। এসব করে যে বিদেশী ক্রেতাদের বা দাতাদের মানানো যাবে না; এই গূঢ় সত্যটি উপলব্ধি করার শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের কর্তাদের ছিল না। লোহার সিঁড়ির হালচাল বা ইত্যাকার গৌণ বিষয়াদি পর্যবেক্ষণের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন করে তারা। সেই কমিটি নিরাপদ কর্মসংস্থান আছে কিনা- এসব বৃত্তান্ত দেখেশুনে আসতে নানা ফ্যাক্টরিতেও যায়। এরা ফ্যাক্টরিতে খানিকটা ঘুরেফিরে এসে কাগজে টিক মার্কও দিয়ে যেতে থাকে। এই রানা প্লাজাও ওই কমিটি কর্তৃক টিক মার্কপ্রাপ্ত। রানা প্লাজার ধস হয়তো শ্রমমানের বিষয়ে দাতা-ক্রেতাদের কঠোর হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের যে অভিযোগ, সেটিকে গুরুত্বের সঙ্গে কদাপি নেয়া হয়নি। বরং সেতুবিষয়ক কর্মকর্তাদের ঘুষ নেয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে যথাযথ কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে কী করা হল? করা হল যেনতেন হালকা-পাতলা আবোলতাবোল কিছু কাজ। একেই বোধ হয় শাক দিয়ে মাছ ঢাকার উদ্যোগ-চেষ্টা বলে! এতদিন ধরে পোশাক শিল্পের কমপ্লায়েন্সের বিষয়েও ওই একই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসে শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যার তদন্ত দাবি করেন। আর তার এই দাবিতে আমাদের পলিসি মেকাররা বিস্মিত হয়ে একশেষ! আমিনুল কে, সে তো বড় কোনো নেতা নয়। তার বিষয়ে মার্কিনিদের এত গরজ কেন! যেন বড় নেতা হলেই তদন্ত ও বিচারের দাবি হতে পারে। টিভিতে টকশোতে দেখেছি অনেকের এই ধরনের প্রতিক্রিয়া। দেশের সাধারণ কেউ ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে না এই দেশে!
রানা প্লাজার ধসের পর পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে সরকার থেকেই এখন বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা বলেছেন, শ্রম আইন ২০০৬-এ কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে যার ফলে পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে। বর্তমান শ্রম আইনে ইউনিয়ন করার প্রধান বাধা হল শ্রমিকরা রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন, ইউনিয়ন গঠন করার জন্য আবেদন করলে সেখানে জমা দেয়া কমিটির ও ইউনিয়নের সদস্য তালিকা মালিক বা কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে অবহিত করবেন। তাদের অনুমতি ও সত্যতা যাচাই করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই মালিকরা যখন আগের থেকেই জানতে পারেন, তখন ট্রেড ইউনিয়ন গঠন যেন না হয় সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে সেটাই পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন না হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। যে কারণে সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে না, সেটা হল সরকার ও মালিকদের পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন না হওয়ার নীতি। এ বিষয়ে পোশাক শিল্পের মালিকদের লবি খুবই তৎপর ও শক্ত অবস্থানে। যে কারণে কোনো রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় না, ইউনিয়ন না হওয়ার আর একটি বড় বাধা ফ্যাক্টরি শ্রমিকরা কারখানার প্রাঙ্গণে বা কোনো হলে একত্র হতে পারে না। তাদের বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ এরকম সুযোগ-সুবিধা ফ্যাক্টরিতে নেই।
শ্রম আইনে যে সব সংশোধনী আনা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হল প্রস্তাবিত ইউনিয়নের তালিকা রেজিস্ট্রেশনের পূর্বেই মালিকদের কাছে না পাঠানো। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পোশাক শিল্পে ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে বক্তব্যের ফলে তা ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে আবহাওয়া তৈরি হতে সাহায্য করবে।
কেবিনেট কর্তৃক অনুমোদিত শ্রম আইন সংশোধনীতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের শাসনের শেষ প্রান্তে এসে ২০০০ সালে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়, যে ঘোষণার বিরুদ্ধে মালিক পক্ষ হাইকোর্টে রিট করলে ঘোষণাটি বাতিল হয়। বিচারকরা তাদের অবজারভেশনে বলেছেন ন্যূনতম মজুরি আইন যথাযথ অনুসরণ না করে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৩৮ ও ১৩৯ ধারায় নিম্নতম মজুরি বোর্ড প্রতিষ্ঠা ও ১৩৯ ধারায় নিম্নতম মজুরি হারের সুপারিশে বিভিন্ন সেক্টরে নিম্নতম মজুরির ঘোষণার সঙ্গে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে কোথাও ঘণ্টা, দিন বা মাসের ভিত্তিতে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একজন শ্রমিক যেখানেই কাজ করুক না কেন, তাকে এই ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। আর যে সেক্টরে মজুরি বোর্ড আছে সেখানে সেই বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত নিম্নতম মজুরি কার্যকর থাকবে। তবে সেটা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির নিচে হবে না। পাকিস্তান ও ভারতে এই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে বিভিন্ন প্রদেশ। পাকিস্তানে সর্বনিম্ন মজুরি হল ১০ হাজার রুপি। ইসলামাবাদে সাড়ে ১০ হাজার।
মুটে-মজুর বিভিন্ন পেশার মানুষ যারা ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করেন তাদেরও শ্রম আইনে আনা উচিত। এদের শ্রম আইনের আওতায় না আনলে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এর আওতার বাইরে থাকবে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে ইনফরমাল শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয় এসব শ্রমজীবী মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পায়, বিভিন্ন স্বাস্থ্য স্কিমের আওতায় তাদের আনা হয়েছে। শ্রম আইনের ধারা ১-এর ৪ উপধারাসহ সব ধারা বা উপধারায় শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার রহিত করা হয়েছে তা বাতিল করার প্রয়োজন। ধারা ২(৬১)-এর ‘শিল্প প্রতিষ্ঠান’ সংজ্ঞায় ধানকল, করাতকল, মাছধরার ট্রলার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, সমুদ্রগামী জাহাজসহ অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকদের যুক্ত করতে হবে।
শ্রম আইনের ১৮০ ধারার খ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত না থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তা বা সদস্য হতে পারবে না, এই বিধানের ফলে ইউনিয়ন অকার্যকর করার জন্য কর্তৃপক্ষ তার অপছন্দের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বরখাস্ত করে সহজেই তাকে ইউনিয়ন থেকে অপসারণ করতে পারবেন। অথচ আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-এ শ্রমিকের নেতা নির্বাচনের কথা রয়েছে যা বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলংকায় এরকম বিধিনিষেধ নেই। তারা শ্রমিক নয় এমন লোককেও নেতা নির্বাচিত করতে পারে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনীতিক নেতা ও সমাজসেবক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ভারত উপমহাদেশে কেন, ইউরোপেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠে সোস্যাল ডেমোক্রেট ও সমাজসেবীদের দ্বারা।
কোনো কারণ ছাড়াই একজন শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার অবাধ অধিকার শ্রম আইনের ২৬ ধারায় দেয়া হয়েছে, যা একেবারেই অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক। একটি লোক দীর্ঘদিন এক ট্রেডে কাজ করে অবদান রাখছে। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা অর্জন করেছে, তাকে বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া নিতান্তই অমানবিক।
মালিক পক্ষের সুপারিশে সরকার তার সংশোধনীতে ৩২ ধারা ২৭ (৩) ধারা সংযোজন করেছে। সেটা হল কোনো শ্রমিক বিনা নোটিশে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে কিংবা চাকরি পরিত্যাগ করলে তার পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে। এটা একটি অগণতান্ত্রিক সংযোজন। বর্তমান শ্রম আইন ধারা ১-এর ৪ উপধারায় শ্রমিক সংগঠন না করার ওপর সরকারের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, সরকার ইচ্ছা করলে জরুরি সার্ভিস ঘোষণা করে এসব প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করা বা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে পারবে। এ বিধি অগণতান্ত্রিক ও আইএলও সনদবিরোধী।
বাংলাদেশেও এ সুযোগ ছিল, ১৯৭৭ সাল থেকে এই বিধি-নিষেধ করা হয়েছে। আমরা আশা করব শ্রম আইনে শ্রমিকের ও শিল্পের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি
তবে শুধু আশংকা করে করেই আমরা, শ্রমিকরা ও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা, নিরস্ত ছিলাম না। অমন ভয়াবহ পরিস্থিতির যেন উদ্ভব না ঘটে, সে জন্য বাংলাদেশের শ্রমিকরা এবং শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তরা অনেক চেষ্টাও করে যায়। কিন্তু কে শোনে শ্রমিকদের কথা! কে কর্ণপাত করে সত্য ভাষণে! বিগত দুই-তিন বছর ধরে এমনকি শ্রমিক-মালিক-সরকারের ত্রিপক্ষীয় সভাও হয় না! যেখানে বিষয় গুলো নিয়ে কথা বলা যেত।
আইএলও অনেকদিন থেকেই বাংলাদেশের শ্রমমানের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে আসছে। চেষ্টা করে চলছে ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের বাজারটি বহাল রাখার জন্য। নানা উদ্যোগ নিয়েছে যেন বাংলাদেশ ইউরোপ ও আমেরিকায় বাজারটি না হারায়। আইএলও খুব সাফল্যের সঙ্গে শিশুশ্রম নিরসনে পোশাক শিল্পকে সাহায্য করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আইএলও শত চেষ্টা করেও অন্যান্য শ্রমমানের উন্নয়নের গুরুত্বটি বাংলাদেশ সরকার ও মালিকদের বোঝাতে সমর্থ হয়নি। বাংলাদেশ সরকার ও মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনগুলোর দাবি ও নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনাকে অবহেলা তো করেছেই; উপরন্তু ক্রেতা-দাতারা যে মান চেয়ে এসেছে, তারা সেগুলো বরাবর পাশ কাটিয়ে গেছে। এরা ট্রেড ইউনিয়নের পরিবর্তে গঠন করতে আগ্রহী হয়েছে পার্টিসিপিটরি কমিটি। আগুন লাগলে বা বিপদ আপদে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অব্যবহারযোগ্য লোহার সিঁড়ি ইত্যাদি বানিয়ে দায় সারতে চেয়েছে। এবং মূল করণীয় কর্ম থেকে বরাবর রয়ে গেছে দূরে। এসব করে যে বিদেশী ক্রেতাদের বা দাতাদের মানানো যাবে না; এই গূঢ় সত্যটি উপলব্ধি করার শক্তি ও সামর্থ্য আমাদের কর্তাদের ছিল না। লোহার সিঁড়ির হালচাল বা ইত্যাকার গৌণ বিষয়াদি পর্যবেক্ষণের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন করে তারা। সেই কমিটি নিরাপদ কর্মসংস্থান আছে কিনা- এসব বৃত্তান্ত দেখেশুনে আসতে নানা ফ্যাক্টরিতেও যায়। এরা ফ্যাক্টরিতে খানিকটা ঘুরেফিরে এসে কাগজে টিক মার্কও দিয়ে যেতে থাকে। এই রানা প্লাজাও ওই কমিটি কর্তৃক টিক মার্কপ্রাপ্ত। রানা প্লাজার ধস হয়তো শ্রমমানের বিষয়ে দাতা-ক্রেতাদের কঠোর হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের যে অভিযোগ, সেটিকে গুরুত্বের সঙ্গে কদাপি নেয়া হয়নি। বরং সেতুবিষয়ক কর্মকর্তাদের ঘুষ নেয়ার উদ্যোগের বিরুদ্ধে যথাযথ কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে কী করা হল? করা হল যেনতেন হালকা-পাতলা আবোলতাবোল কিছু কাজ। একেই বোধ হয় শাক দিয়ে মাছ ঢাকার উদ্যোগ-চেষ্টা বলে! এতদিন ধরে পোশাক শিল্পের কমপ্লায়েন্সের বিষয়েও ওই একই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসে শ্রমিক নেতা আমিনুলের হত্যার তদন্ত দাবি করেন। আর তার এই দাবিতে আমাদের পলিসি মেকাররা বিস্মিত হয়ে একশেষ! আমিনুল কে, সে তো বড় কোনো নেতা নয়। তার বিষয়ে মার্কিনিদের এত গরজ কেন! যেন বড় নেতা হলেই তদন্ত ও বিচারের দাবি হতে পারে। টিভিতে টকশোতে দেখেছি অনেকের এই ধরনের প্রতিক্রিয়া। দেশের সাধারণ কেউ ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার রাখে না এই দেশে!
রানা প্লাজার ধসের পর পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে সরকার থেকেই এখন বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা বলেছেন, শ্রম আইন ২০০৬-এ কিছু সংশোধনী আনা হচ্ছে যার ফলে পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে। বর্তমান শ্রম আইনে ইউনিয়ন করার প্রধান বাধা হল শ্রমিকরা রেজিস্ট্রার অব ট্রেড ইউনিয়ন, ইউনিয়ন গঠন করার জন্য আবেদন করলে সেখানে জমা দেয়া কমিটির ও ইউনিয়নের সদস্য তালিকা মালিক বা কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে অবহিত করবেন। তাদের অনুমতি ও সত্যতা যাচাই করার জন্য। স্বাভাবিকভাবেই মালিকরা যখন আগের থেকেই জানতে পারেন, তখন ট্রেড ইউনিয়ন গঠন যেন না হয় সেরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তবে সেটাই পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন না হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। যে কারণে সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে না, সেটা হল সরকার ও মালিকদের পোশাক শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন না হওয়ার নীতি। এ বিষয়ে পোশাক শিল্পের মালিকদের লবি খুবই তৎপর ও শক্ত অবস্থানে। যে কারণে কোনো রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয় না, ইউনিয়ন না হওয়ার আর একটি বড় বাধা ফ্যাক্টরি শ্রমিকরা কারখানার প্রাঙ্গণে বা কোনো হলে একত্র হতে পারে না। তাদের বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ এরকম সুযোগ-সুবিধা ফ্যাক্টরিতে নেই।
শ্রম আইনে যে সব সংশোধনী আনা হচ্ছে, তার মধ্যে একটি হল প্রস্তাবিত ইউনিয়নের তালিকা রেজিস্ট্রেশনের পূর্বেই মালিকদের কাছে না পাঠানো। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পোশাক শিল্পে ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে বক্তব্যের ফলে তা ইউনিয়ন গঠন করার পক্ষে আবহাওয়া তৈরি হতে সাহায্য করবে।
কেবিনেট কর্তৃক অনুমোদিত শ্রম আইন সংশোধনীতে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়নি। অথচ এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের শাসনের শেষ প্রান্তে এসে ২০০০ সালে একটি জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করা হয়, যে ঘোষণার বিরুদ্ধে মালিক পক্ষ হাইকোর্টে রিট করলে ঘোষণাটি বাতিল হয়। বিচারকরা তাদের অবজারভেশনে বলেছেন ন্যূনতম মজুরি আইন যথাযথ অনুসরণ না করে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৩৮ ও ১৩৯ ধারায় নিম্নতম মজুরি বোর্ড প্রতিষ্ঠা ও ১৩৯ ধারায় নিম্নতম মজুরি হারের সুপারিশে বিভিন্ন সেক্টরে নিম্নতম মজুরির ঘোষণার সঙ্গে জাতীয় ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশে কোথাও ঘণ্টা, দিন বা মাসের ভিত্তিতে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আছে। এর অর্থ দাঁড়ায় একজন শ্রমিক যেখানেই কাজ করুক না কেন, তাকে এই ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। আর যে সেক্টরে মজুরি বোর্ড আছে সেখানে সেই বোর্ড কর্তৃক ঘোষিত নিম্নতম মজুরি কার্যকর থাকবে। তবে সেটা জাতীয় ন্যূনতম মজুরির নিচে হবে না। পাকিস্তান ও ভারতে এই ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে বিভিন্ন প্রদেশ। পাকিস্তানে সর্বনিম্ন মজুরি হল ১০ হাজার রুপি। ইসলামাবাদে সাড়ে ১০ হাজার।
মুটে-মজুর বিভিন্ন পেশার মানুষ যারা ঠিকা ভিত্তিতে কাজ করেন তাদেরও শ্রম আইনে আনা উচিত। এদের শ্রম আইনের আওতায় না আনলে অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এর আওতার বাইরে থাকবে। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে ইনফরমাল শ্রমিকদের শ্রম আইনের আওতায় আনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয় এসব শ্রমজীবী মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পায়, বিভিন্ন স্বাস্থ্য স্কিমের আওতায় তাদের আনা হয়েছে। শ্রম আইনের ধারা ১-এর ৪ উপধারাসহ সব ধারা বা উপধারায় শ্রমিকের সংগঠন করার অধিকার রহিত করা হয়েছে তা বাতিল করার প্রয়োজন। ধারা ২(৬১)-এর ‘শিল্প প্রতিষ্ঠান’ সংজ্ঞায় ধানকল, করাতকল, মাছধরার ট্রলার, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, সমুদ্রগামী জাহাজসহ অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকদের যুক্ত করতে হবে।
শ্রম আইনের ১৮০ ধারার খ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত না থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তা বা সদস্য হতে পারবে না, এই বিধানের ফলে ইউনিয়ন অকার্যকর করার জন্য কর্তৃপক্ষ তার অপছন্দের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি বা বরখাস্ত করে সহজেই তাকে ইউনিয়ন থেকে অপসারণ করতে পারবেন। অথচ আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮-এ শ্রমিকের নেতা নির্বাচনের কথা রয়েছে যা বাংলাদেশ সরকার অনুসমর্থন করেছে। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল বা শ্রীলংকায় এরকম বিধিনিষেধ নেই। তারা শ্রমিক নয় এমন লোককেও নেতা নির্বাচিত করতে পারে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনীতিক নেতা ও সমাজসেবক ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ভারত উপমহাদেশে কেন, ইউরোপেও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে ওঠে সোস্যাল ডেমোক্রেট ও সমাজসেবীদের দ্বারা।
কোনো কারণ ছাড়াই একজন শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার অবাধ অধিকার শ্রম আইনের ২৬ ধারায় দেয়া হয়েছে, যা একেবারেই অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক। একটি লোক দীর্ঘদিন এক ট্রেডে কাজ করে অবদান রাখছে। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা অর্জন করেছে, তাকে বিনা কারণে চাকরিচ্যুত করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়া নিতান্তই অমানবিক।
মালিক পক্ষের সুপারিশে সরকার তার সংশোধনীতে ৩২ ধারা ২৭ (৩) ধারা সংযোজন করেছে। সেটা হল কোনো শ্রমিক বিনা নোটিশে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে কিংবা চাকরি পরিত্যাগ করলে তার পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে। এটা একটি অগণতান্ত্রিক সংযোজন। বর্তমান শ্রম আইন ধারা ১-এর ৪ উপধারায় শ্রমিক সংগঠন না করার ওপর সরকারের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, সরকার ইচ্ছা করলে জরুরি সার্ভিস ঘোষণা করে এসব প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন করা বা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে পারবে। এ বিধি অগণতান্ত্রিক ও আইএলও সনদবিরোধী।
বাংলাদেশেও এ সুযোগ ছিল, ১৯৭৭ সাল থেকে এই বিধি-নিষেধ করা হয়েছে। আমরা আশা করব শ্রম আইনে শ্রমিকের ও শিল্পের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি
No comments