নারীর অধিকার-হেফাজত আমিরের নসিহত ও তেঁতুলতত্ত্ব by আবু সাঈদ খান

একদা নারী ছিল অবরোধবাসিনী। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীর প্রচেষ্টায় উনিশ শতকে হিন্দু নারীরা যখন শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছিলেন, পুরুষের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন, তখনও বাংলার মুসলিম নারীরা গৃহবন্দি।
এমনই পটভূমিতে বেগম রোকেয়া নারী জাগরণের ঢেউ তুলেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছিলেন_ 'জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা...।' বেগম রোকেয়া-নজরুলের পথ ধরে নারীরা এগিয়ে এসেছেন অনেক দূর। বাংলাদেশের নারীরা এখন সর্বক্ষেত্রেই পুরুষের সহযাত্রী। বেগম রোকেয়া 'স্ত্রীজাতির অবনতি' প্রবন্ধে লিখেছেন, "পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদের যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীন জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডীকেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডীম্যাজিস্ট্রেট, লেডীব্যারিস্টার, লেডীজজ সবই হইব। পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী লেডী ারপবৎড়ু হইয়া দেশের সমস্ত নারীকে 'রানী' করিয়া ফেলিব!! উপার্জ্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা 'স্বামীর' গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারিব না? আমরা যদি রাজকীয় কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া ছাড়িয়া দাও। নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জ্জন করুক।"
বেগম রোকেয়ার সব ইচ্ছাই আজ পূরণ হয়েছে। সকল বাধার অর্গল ভেঙে কেরানি থেকে ম্যাজিস্ট্রেট, ব্যারিস্টার, জজ_ সবই হয়েছেন নারী। এখন ভাইসরয় পদ বিলুপ্ত; তাই নারীর আর ভাইসরয় হওয়ার সুযোগ নেই। তবে নারী বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হয়েছেন। কৃষি, গার্মেন্ট শিল্পসহ সর্বত্রই পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করেছেন। কিন্তু সম্প্রতি সেই নারীকে আবার ঘরে ফেরার, 'অবরোধবাসিনী' করার আওয়াজ উঠেছে। আগে অত্যন্ত অনুচ্চ স্বরে 'কাঠমোল্লারা' নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে কথা বলত। নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিত। তাতে কেউ আমল দিত না, ফলাও করে সংবাদমাধ্যমে তাদের এসব কথা প্রচারও হতো না। মনে করা হতো, বিলীয়মান পশ্চাৎপদ চিন্তার ক্ষীণ আস্ফালন। এখন আওয়াজ আর ক্ষীণ নেই। তা হেফাজতের আলেম-তালবে আলেমদের গগনবিদারী আওয়াজে পরিণত হয়েছে। গত ৫ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন 'হেফাজতে ইসলাম' লাখো মানুষের জমায়েতে '১৩ দফা' দাবি ঘোষণা করেছে। ওই ১৩ দফায় অন্যান্য দাবির সঙ্গে নারীনীতি বাতিল ও নারীদের অবাধ চলাফেরা বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। হেফাজতের কর্মীরা ওইদিন নারী সাংবাদিকদের শাসিয়েছে। 'লজ্জা নেই, মাথায় কাপড় দাও, মেয়েরা তোমরা কেন সাংবাদিক হবে' ইত্যাদি বলে কয়েকজন নারী সাংবাদিককে নাজেহাল করেছে। তাদের হাতে ইটিভির সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তারপর থেকে সংবাদমাধ্যমে তাদের এ বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। টিভি টক শোতে হেফাজতের নেতাদের ডেকে দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে ব্যাখ্যা শোনানো হচ্ছে। অনেক বুদ্ধিজীবী, যাদের কেউ কেউ বাম চিন্তার ধারক বলে পরিচিত ছিলেন, তারাও ১৩ দফার 'মাহাত্ম্য' বর্ণনা করে চলেছেন। আমাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়, ৫ এপ্রিল মতিঝিলে হেফাজতের সমাবেশে প্রধান বিরোধী নেতারা হাজির হন এবং নৈতিক সমর্থন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী ১৩ দফার যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়ার কথা বলেছেন। তবে ৬ মে হেফাজতিদের তাণ্ডবের পর ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে গেছে।
৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অপর মহাসমাবেশ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে_ '১৩ দফা দাবি না মেনে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। প্রয়োজনে তারাই সরকার গঠন করবে।' হেফাজতের নির্দেশিত পথে দেশ চললে কিংবা হেফাজতি সরকার গঠন হলে নারীদের অবস্থা কী হবে_ সেটি হাটহাজারীর ওয়াজ মাহফিলে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর দেওয়া বক্তব্য থেকে আরও স্পষ্ট বোঝা যায়।
ওই বক্তব্যের ভিডিওচিত্র এখন সংবাদপত্র, বৈদ্যুতিন মাধ্যম ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। আমির সাহেবের বক্তব্যের পক্ষে হেফাজতের নেতারা যুক্তিও উপস্থাপন করছেন। দেখা যাক কী আছে তার বক্তব্যে?
শাহ আহমদ শফী নারীদের গৃহের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, 'তোমরা জাহিলিয়াতের সময়ের মতো বেপর্দায় ঘর থেকে বাইর হইও না। উলঙ্গ অবস্থায় মাঠে-ঘাটে-হাটে আপনারা মহিলারা মার্কেট করতে যাবেন না। স্বামী আছে, সন্তান আছে। তাদের যাইতে বলবেন। আপনি কেন যাবেন? আপনি স্বামীর ঘরের মধ্যে থাকবেন, উনার আসবাবপত্র এগুলার হেফাজত করবেন। ছেলেসন্তানদের লালন-পালন করবেন। এগুলা আপনার কাজ। আপনি বাইরে কেন যাবেন?' (জনকণ্ঠ, ৯ জুলাই ২০১৩)
তিনি নারীদের উচ্চশিক্ষার বিরোধিতা করে বলেছেন, 'আপনারা মেয়েদের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতেছেন। কেন করাইতেছেন? তাদের ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াইবেন, যাতে বিবাহ-শাদি দিলে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব রাখতে পারে। আপনারা মেয়েদের স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে পড়াইতেছেন। লাখ লাখ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পর আপনার মেয়ে নিজে নিজে একটা স্বামী জোগাড় কইরা চইলা যাবে। আপনার কথা স্মরণ করবে না।' (সূত্র :ঐ)
তিনি উচ্চশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে না করার পরামর্শ দিয়েছেন, শিক্ষিত মেয়েদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যায় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, 'জন্মনিয়ন্ত্রণ কেন করেন? বার্থ কন্ট্রোল কেন করেন? বার্থ কন্ট্রোল হলো মরদ থাইক্যা খাসী কইরা ফেলা, মহিলাদের জন্মদানী সেলাই কইরা ফেলা। বার্থ কন্ট্রোল করলে কেউ ডেথ কন্ট্রোল করতে পারবা না। রিজিকের মালিক আল্লাহ। খাওয়ান তো উনি । তুমি কেন বার্থ কন্ট্রোল করবা? বড় গুনাইর কাজ এইটা। পারলে চারটা পর্যন্ত বিবাহ করবা। খাওইয়াবো তো আল্লাহ।' (সূত্র :ঐ)
শফী সাহেব মেয়েদের গার্মেন্ট শিল্পে কাজের বিরোধী। তার ভাষায়, 'গার্মেন্টে কেন দিচ্ছেন আপনার মেয়েকে? সকাল ৭-৮টায় যায়, রাত ১০-১২টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সঙ্গে ঘোরাফেরা করে তুমি তো জান না। কতজনের সঙ্গে আপনার মেয়ে চলছে তা তো জানেন না। জেনা কইরা টাকা কামাই করতেছে, বরকত থাকবে কেমনে।' (সূত্র :ঐ)
বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার বিরোধিতা করে তিনি বলেছেন, 'মেয়েরা তেঁতুলের মতো। ছোট একটা ছেলে তেঁতুল খাইতেছে, তা দেখে আপনার মুখ দিয়ে লালা বাইর অইব। তেঁতুল গাছের নিচ দিয়ে আপনি হাইট্যা যান, তা দেখলে আপনার মুখ দিয়া লালা ঝরবে। ঠিক মহিলাদের দেখলেও দিলের মাঝে লালা ঝরবে। বিবাহ করতে মন চায়। লাভ মেরিজ, কোর্ট মেরিজ করতে মন চায়। দিনরাত মেয়েদের সঙ্গে লেখাপড়া করতেছেন, আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। রাস্তাঘাটে মেয়েদের সঙ্গে চলাফেরা করতেছেন। আপনার দিল ঠিক রাখতে পারবেন না। যতই বুজুর্গ হন, আপনার মনের মাঝে কুখেয়াল আইস্যা যাবে। এটা মনের জেনা, দিলের জেনা। এইটা এক সময় আসল জেনায় পরিণত হবে।' (সূত্র :ঐ)
মহিলা দেখলে বৃদ্ধেরও মনের মাঝে লালা না ঝরলে তাকে পুরুষত্বহীন বলে তিনি অভিহিত করেছেন। তার ভাষায় মেয়েরা 'বাইশ তালের।'
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা মিশ্রিত ওই বক্তৃতায় নারীকে ঘরে ফেরানোর তাগাদা দেওয়া হয়েছে বারবার। এ বক্তব্য গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি তীব্র উপেক্ষাই শুধু নয়, ইসলামের উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিপন্থী। ইসলাম নারীদের গৃহবন্দি করার কথা বলেনি, বরং নারীর মানবিক অধিকার সমুন্নত করেছে। এটি কারও অজানা থাকার কথা নয়, নবীপত্নী হজরত খাদিজা (রা.) ব্যবসা পরিচালনা করেছেন। যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন নবীর (সা.) অপর পত্নী হজরত আয়েশা (রা.)। হাদিসে 'মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত' বলা হয়েছে। (সহি বোখারী শরীফ)। সন্তান পুরুষ হলেও যে মায়ের পদতলে তার স্থান, সেই মাতৃরূপী নারীকে গৃহবন্দি করা পুরুষ সন্তানদের কর্তব্য নয়। সেই অকর্তব্যকেই কর্তব্য বলে ফতোয়া দিয়েছেন হেফাজত আমির।
এতদিন স্বল্পশিক্ষিত মোল্লা-মৌলভীরা এমন কথা বলছিলেন। এবার তা উচ্চারিত হচ্ছে হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর জবানিতে, যিনি হেফাজতিদের আধ্যাত্মিক নেতা এবং আল্লামা খেতাবেও ভূষিত। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, আল্লামা/আল্লামি আরবি শব্দ 'আল্লামাহ' থেকে এসেছে_ যার অর্থ মহাবিদ্বান বা পণ্ডিত। সম্রাট আকবর উজির ও সুপণ্ডিত আবুল ফজলের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে আল্লামি খেতাব দিয়েছিলেন। আল্লামা খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান উর্দুর্ কবি ও দার্শনিক ইকবাল।
আমির সাহেবের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়! তার ডাকে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়, জান দিতে প্রস্তুত থাকে তার অনুসারী হাজারো আলেম-তালবে আলেম। আরও ভাববার বিষয়_ ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি হেফাজতের প্রতি তোষণ নীতি অব্যাহত রেখেছে। সদ্য সমাপ্ত ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের প্রার্থীর সপক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলাম এখন বিরোধী জোটে একাত্ম হয়েছে। ৬ মের ঘটনায় হেফাজতের সঙ্গে মহাজোট আওয়ামী লীগের দূরত্ব বাড়লেও তলে তলে ঐক্য গড়ার চেষ্টা রয়েছে বলে শোনা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আজ থেকে শতবর্ষ আগে বেগম রোকেয়ার সৃষ্ট আন্দোলনের পথ বেয়ে নারী যখন আজ জজ, ব্যারিস্টার, পাইলট, সচিব, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার পর্যন্ত হয়েছেন. কৃষি ও শিল্পে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করেছেন, তখন জাতি কি হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে শতবর্ষের সব অর্জন বিসর্জন দিয়ে পেছনে ফিরতে থাকবে?
এটি বোধগম্য যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নারীদের অবরোধবাসিনী করার পক্ষে নয়। হেফাজতের তত্ত্ব মেনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বোরকা পরে অন্তঃপুরে যাবেন না সত্য, কিন্তু ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটি হেফাজতিদের প্রতি যে তোষণ নীতি গ্রহণ করেছে, তা কি সমর্থনযোগ্য? এসব অপতৎপরতা রুখে না দাঁড়ালে নারীর অগ্রযাত্রা শুধু ব্যাহত হবে না, তা সমাজের জন্য ভয়াবহ সর্বনাশ ডেকে আনবে। গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে বাধা আরও প্রকট হবে। এই কূপমণ্ডূকতা-ধর্মান্ধতা সমাজ প্রগতির পথে কাঁটা হয়ে ফুটবে।

সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com

No comments

Powered by Blogger.