মিসরে গণতন্ত্র অধরাই by তানিম ইশতিয়াক
মিসর আবার অগি্নগর্ভ হয়ে উঠেছে। মুরসি
সমর্থকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিতে অর্ধশতাধিক নিহত হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে
দেশটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
মিসরের সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্টবিরোধী বিক্ষোভের অজুহাতে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত মিসরের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে
ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু এই অভ্যুত্থানকে এখনও অভ্যুত্থান হিসেবে ঘোষণা
করেনি গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘও এ ব্যাপারে আশ্চর্যজনক
নীরবতা বা দায়সারা ভূমিকা পালন করছে। মুরসিকে ক্ষমতায় পুনর্বহাল না করা
পর্যন্ত তার সমর্থকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এ জন্য তারা
জীবন দিতেও প্রস্তুত। একদিনে ৫৩ জন নিহতের পর মুসলিম ব্রাদারহুড
সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে 'গণহত্যার' অভিযোগ এনে তাদের প্রতিরোধে 'গণজাগরণের'
ডাক দিয়েছে। আরও 'গণহত্যা' বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ আহ্বান
করেছে ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি। মুরসির
অপসারণে সমর্থন দেওয়া কট্টরপন্থি সালাফিস্ট নুর পার্টিও এই ঘটনাকে গণহত্যা
আখ্যায়িত করে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। মিসরের
রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপকে অগ্রহণযোগ্য এবং অবৈধ বলে মন্তব্য করেছে
ইরান। বলা যায়, ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে মিসর। প্রশ্ন হচ্ছে, মিসরের
রাজনৈতিক এ অচলাবস্থার সমাধান কীভাবে হবে? গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎই-বা কী?
মুরসির শাসন সম্পর্কে দেশবাসীর ক্ষোভ থাকতে পারে। গত এক বছরে দেশে বিদ্যুৎ
উৎপাদনের অবস্থা কাঙ্ক্ষিত মানে আসেনি, জ্বালানি সরবরাহে সমূহ সংকট,
মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব কমারও লক্ষণ নেই, বিনিয়োগকারীরা দেশ ছাড়ছে। লিবিয়া ও
কাতারের সহায়তা ছাড়া মিসরের মুদ্রাকে বাঁচানোও কঠিন হতো। কিন্তু মনে রাখা
দরকার, এই আর্থিক সংকটের অনেকটাই মোবারক জমানার অবদান। মুরসি মিসরের দীর্ঘ
ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, তার ক্ষমতার নীতিগত,
সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক বৈধতা আছে। মেয়াদ ফুরাবার আগে তাকে পদচ্যুত করা
সেনাবাহিনীর কাজ হতে পারে না। ক্ষমতা থেকে মুরসি কিংবা তার মুসলিম
ব্রাদারহুড সরে গেলেই সব সমাধান হয়ে যাবে না। দেশের শাসনব্যবস্থায় এখন যে
শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা কে পূরণ করবে? বিরোধীদের অনেকে সেনানায়কদের
ফেরাতে চান, কেউ কেউ মোবারককেও! এটা কি জনসাধারণের দাবি? প্রতিবেশী সিরিয়ার
দৃষ্টান্ত মুরসি-বিরোধীদের রাস্তার আন্দোলনে উৎসাহিত করে থাকতে পারে।
সিরিয়ায় যা ঘটছে, তার অনুরূপ পরিণতির জন্য মিসরের জনগণ কি প্রস্তুত? বিগত
সাত দশক ধরে মুসলিম ব্রাদারহুডই প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে মুখর রয়েছে। একের পর
এক সেনাসমর্থিত স্বৈরাচারী শাসকের স্বেচ্ছাচারের শিকারও ছিলেন প্রধানত
ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীরাই। সে সময় কিন্তু আজকের গণতন্ত্রীদের অধিকাংশেরই
দেখা মেলেনি। প্রেসিডেন্ট মুরসি যেসব অগণতান্ত্রিক ডিক্রি জারি করছেন, তার
বিরোধিতা অবশ্যই কাম্য। তবে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করে শাসনপ্রণালিতে
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করায় তার যাবতীয়
পদক্ষেপকে 'গণতান্ত্রিক' বলে মান্য করা দরকার। ব্রাদারহুডের নেতৃত্বকেও
উপলব্ধি করতে হবে, তাদের একক প্রয়াসে মিসর স্বৈরাচারমুক্ত হয়নি,
গণতন্ত্রীদের ভূমিকা ছিল। তাই তাদেরও সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। দরকষাকষি চলুক,
কে ক্ষমতার কতটা অংশীদারিত্ব পাবে তা নিয়ে দ্বন্দ্বও স্বাভাবিক। গণতন্ত্রে এ
ধরনের বিরোধ কাম্যও বটে। তবে গণতন্ত্র উৎখাত করে সামরিক সরকার নিয়ে এলে
সমস্যার সমাধান হবে না। মুরসিবিরোধী জনতা সরকারের পতন চেয়েছিল, তবে নিশ্চয়
তারা সামরিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চায়নি। মিসরের জনগণের বিভক্তিতে
সেনাবাহিনীর এ সুযোগ নেওয়ায় ক্ষতি হয়েছে গণতন্ত্রের। সেনাবাহিনীকে বুঝতে
হবে গুলি চালিয়ে জনগণের দাবিকে পাশ কাটানো যাবে না। মোবারকবিরোধী আন্দোলনের
ইতিহাস সে কথারই সাক্ষ্য দেয়।
স তানিম ইশতিয়াক :শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
স তানিম ইশতিয়াক :শিক্ষার্থী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments