লিমন যেন ন্যায়বিচার পায় by আহমেদ সুমন
র্যাবের
গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কলেজছাত্র লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি
মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়ায় সরকারকে সাধুবাদ জানাই। গত ১ জুলাই
দেশের প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে ঝালকাঠির আদালত চত্বরে লিমনের কান্নার ছবি
প্রকাশিত হয়। র্যাবের দায়ের করা অস্ত্র মামলার শুনানি শেষে বিচারক অভিযোগ
গঠনের আদেশ দিলে লিমন কান্নায় ভেঙে পড়েন। পরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই ইতিপূর্বে
র্যাব কর্তৃক দায়ের করা সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগটি বিচারের জন্য
মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বলা প্রয়োজন, মাঝে এসব
মামলা একটু স্থবির হয়ে পড়েছিল। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের একটি
উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন লিমনের বিরুদ্ধে তাদের
কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধি করে। লিমনের আইনজীবী মানিক আচার্য বলেছেন,
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গত ২৩ জুন লিমন ও তার
মা-বাবাকে ডেকে র্যাবের সঙ্গে আপস মীমাংসা করার জন্য প্রস্তাব দেন। সেটা
সফল না হওয়ায় হঠাৎ করেই লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা র্যাবের দুটি মামলা গতি
বৃদ্ধি পেয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেল, মানবাধিকার
কমিশনের চেয়ারম্যান আপস-মীমাংসার অংশ হিসেবে লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা
মামলা এবং লিমন পঙ্গুত্ববরণ করার দায়ে র্যাবের অপরাধী সদস্যদের বিরুদ্ধে
লিমনের দায়ের করা মামলা তুলে নেয়ার প্রস্তাব দেন। এ প্রস্তাবে লিমন রাজি না
হওয়ায় আপস-মীমাংসা ভেস্তে যায়। যে কোনো ঘটনার আপস-মীমাংসা আইনত সিদ্ধ।
কিন্তু ঘটনা বিশেষে কখনও কখনও ন্যায়বিচারও ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে এমন ঘটনাই
ঘটতে যাচ্ছিল। যা হোক, শেষ পর্যন্ত সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে বলেই মনে
হয়।
র্যাব সদস্য নিরপরাধ নিরস্ত্র লিমনের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে তাকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিল। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে লিমন থানা গড়িয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। র্যাব তাদের গতানুগতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগসহ আরও কয়েকটি অভিযোগে লিমনের নামে একাধিক মামলা দায়ের করে। আমরা দু’পক্ষের মধ্যে মারামারি হলে থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা করতে দেখি। এখানে কারও অপরাধ একটু বেশি বা কম থাকতে পারে। কিন্তু সাতুরিয়া গ্রামের পাশে সেতুর কাছে লিমনের সঙ্গে তো র্যাব সদস্যদের গুলিবিনিময় হয়নি। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটেনি। গ্রামের এক কিশোর যেখানে র্যাব আসছে শুনলে দৌড়ে পালায়, সে কি র্যাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগতে পারে? অথচ র্যাব লিমনের নামে সেই অভিযোগে এনে মামলা দায়ের করে। র্যাবের মামলাটি যে লিমনের যৌক্তিক মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার আরও একটা অস্ত্র ছিল, তা অনুধাবনের জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। অপরাধীকে অপরাধের শাস্তি দেয়া ন্যায়বিচারের অংশ। এ অবস্থায় আপস-মীমাংসার প্রস্তাবে লিমন সম্মত হলে ন্যায় উপেক্ষিত হতো বৈকি।
লিমনের ঘটনাটি দু’বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ সাতুরিয়া গ্রামের লিমন হোসেন নিজেদের গরু আনতে মাঠে গেলে কথিত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারকে ধরার অভিযানে যাওয়া র্যাব সদস্যরা লিমনের পায়ে গুলি চালায়। লিমনের পরিবার এর প্রতিকার চাইতে গেলে তাদের ওপর শুরু হয় একের পর এক অত্যাচার, অবিচার। ঘটনাটি এতদিন ধরে চলবে ভাবিনি। লিমন বনাম রাষ্ট্র নিয়ে অনেকেই গণমাধ্যমে আলোচনা করেছেন, সংবাদপত্রে লিখেছেন। ভেবেছি, অনেক আগেই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার নিরীহ লিমনের প্রতি সংবেদনশীল হবে। লিমনের বিরুদ্ধে সাজানো সব অভিযোগ থেকে তাকে নিষ্কৃতি দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক লিমনের চেয়ে সরকারি অস্ত্রধারী বাহিনী সরকারের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষ বা একটি পরিবারের ভাবনা সরকারের জন্য জরুরি নয়। জরুরি হল সরকারের বিপদে, বিরোধী দলকে দমনপীড়নে যারা সরকারের হয়ে অস্ত্র হাতে অ্যাকশনে নামে তাদের মন রক্ষা করা! এটি যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশে আমরা এমনটিই লক্ষ্য করছি। অর্থনৈতিক শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ায় রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হল শাসক শ্রেণী তথা ধনবানদের স্বার্থ রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা করা। রাষ্ট্র এখানে নিরপেক্ষ নয়। লিমন বনাম র্যাবের মামলায় রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকেনি। রাষ্ট্র র্যাবের পক্ষাবলম্বন করেছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে পাঁচটি স্তর যথা- প্রতিপাদ্য, প্রমাণ, দৃষ্টান্ত, প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত- এর সবই লিমনের বিপক্ষে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় উপাখ্যানে ঋষি গৌতম যে ন্যায় দর্শন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যক্তির বিশেষ কোনো কাজ বা আচরণকে ন্যায় বলে এবং অপর কোনো কাজকে অন্যায় বলে নির্দিষ্ট করে। বহুকাল আগে ধারণা করা হতো, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠির আদর্শে কেবল ব্যক্তি নয়, সামাজিক সব সংস্থার আচরণও মূল্যায়িত হয়। দ্বন্দ্বমান শ্রেণী বিভক্ত কোনো সমাজের মধ্যে একই কালে একই বিষয়ে ন্যায়-অন্যায়ের পরস্পরবিরোধী পরিমাপক অনুসৃত হতে পারে। ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র বৃহৎ ও স্থায়ী মাপকাঠি হতে পারে মানুষের কল্যাণ- ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের। লিমনের ক্লান্ত-শান্ত অশ্র“ভেজা চোখ বলে দেয়, এখানে ন্যায়বিচার কাঁদছে। মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ন্যায়-অন্যায় মানুষই করে এবং বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণও মানুষ করে। র্যাব সরকারের একটি চৌকস আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বটে। কিন্তু তারাও ভুল বা অন্যায় করতে পারে। এই ভুল বা অন্যায়ের জন্য র্যাবের বেশ কয়েকজন সদস্যদের বিচার হওয়ার খবরও আমরা জানতে পেরেছি। সুতরাং র্যাব ভুল করতে পারে না, এমনটি নয়। তাহলে লিমনের ক্ষেত্রে র্যাবের একটি ‘অন্যায়’কে জায়েজ করতে একের পর এক সাজানো ঘটনা যে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামের একজন নিরীহ নিরস্ত্র ব্যক্তির পক্ষে কি কোনোভাবে রাষ্ট্রের অস্ত্রধারী একটি বাহিনীকে তার কাজে বাধা দেয়া সম্ভব? এটা কি কেউ বিশ্বাস করে? অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অপরাপর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি কর্তৃক র্যাবের কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য লিমনের পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। সরকারের এ অবস্থান মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। লিমনের পায়ে গুলি করার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে র্যাব তথা সরকারের ভূমিকা প্রশংসিত হতো। সরকারের কাছ থেকে সংবেদনশীল আচরণ পাওয়ার যে আকাক্সক্ষা করে জনসাধারণ, তা পূরণ হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ত। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে জনসাধারণের মনোভাবের বিপরীতে অবস্থান নেয়ায় লিমনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও মমত্ববোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এক পায়ে জীবন বয়ে বেড়ানো অনেক কষ্টের, যাতনার। তাছাড়া লিমনের মাথার ওপর ছিল র্যাবের মামলার খড়গ। ‘র্যাবের মামলা থেকে যদি অব্যাহতি পেতাম, মন দিয়ে লেখাপড়া করতে পারতাম’- ঝালকাঠির আদালত চত্বরে লিমনের এ আকুতি সরকারের মনকে অবশেষে নাড়া দিয়েছে?
অপরাধ স্বীকার করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। মহত্ত্ব আছে। লিমনকে গুলি করার মধ্য দিয়ে র্যাবের যে সদস্যরা অপরাধ করেছে, তা স্বীকার না করে একের পর এক মিথ্যার উপাখ্যান সাজানো হয়েছে। র্যাবের দু’-একজন সদস্যকে রক্ষার জন্য পুরো র্যাবকেই বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যে ফেলা হয়েছে। এ কথা কে না জানে যে, একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক মিথ্যা বলতে হয়। বস্তুত র্যাব তথা প্রশাসন এতদিন এ কাজটিই করছে। এক সময় ব্রিটেনের সমাজে একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিলÑ রাজা কোনো ভুল করতে পারে না। আমরা এটাও জানি, নাগরিকদের প্রতি ব্রিটেনের রাজা বা রানীর মমত্ববোধ ও সংবেদনশীল আচরণ তাকে মহিমান্বিত করেছে।
সাতুরিয়া গ্রামের লিমন তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। নিজ দেশের দরিদ্র কলেজছাত্র লিমন ও তার পরিবারের প্রতি সরকার যে আচরণ করেছে, দেশের আর কোনো নাগরিক যেন এমন আচরণের শিকার না হয়।
আহমেদ সুমন : গবেষক ও বিশ্লেষক
র্যাব সদস্য নিরপরাধ নিরস্ত্র লিমনের পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে তাকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করে দিল। ঘটনার প্রতিকার চেয়ে লিমন থানা গড়িয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। র্যাব তাদের গতানুগতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগসহ আরও কয়েকটি অভিযোগে লিমনের নামে একাধিক মামলা দায়ের করে। আমরা দু’পক্ষের মধ্যে মারামারি হলে থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা করতে দেখি। এখানে কারও অপরাধ একটু বেশি বা কম থাকতে পারে। কিন্তু সাতুরিয়া গ্রামের পাশে সেতুর কাছে লিমনের সঙ্গে তো র্যাব সদস্যদের গুলিবিনিময় হয়নি। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনাও ঘটেনি। গ্রামের এক কিশোর যেখানে র্যাব আসছে শুনলে দৌড়ে পালায়, সে কি র্যাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাগতে পারে? অথচ র্যাব লিমনের নামে সেই অভিযোগে এনে মামলা দায়ের করে। র্যাবের মামলাটি যে লিমনের যৌক্তিক মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার আরও একটা অস্ত্র ছিল, তা অনুধাবনের জন্য গবেষণার প্রয়োজন হয় না। অপরাধীকে অপরাধের শাস্তি দেয়া ন্যায়বিচারের অংশ। এ অবস্থায় আপস-মীমাংসার প্রস্তাবে লিমন সম্মত হলে ন্যায় উপেক্ষিত হতো বৈকি।
লিমনের ঘটনাটি দু’বছরেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ সাতুরিয়া গ্রামের লিমন হোসেন নিজেদের গরু আনতে মাঠে গেলে কথিত সন্ত্রাসী মোরশেদ জমাদ্দারকে ধরার অভিযানে যাওয়া র্যাব সদস্যরা লিমনের পায়ে গুলি চালায়। লিমনের পরিবার এর প্রতিকার চাইতে গেলে তাদের ওপর শুরু হয় একের পর এক অত্যাচার, অবিচার। ঘটনাটি এতদিন ধরে চলবে ভাবিনি। লিমন বনাম রাষ্ট্র নিয়ে অনেকেই গণমাধ্যমে আলোচনা করেছেন, সংবাদপত্রে লিখেছেন। ভেবেছি, অনেক আগেই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সরকার নিরীহ লিমনের প্রতি সংবেদনশীল হবে। লিমনের বিরুদ্ধে সাজানো সব অভিযোগ থেকে তাকে নিষ্কৃতি দেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক লিমনের চেয়ে সরকারি অস্ত্রধারী বাহিনী সরকারের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক পর্যায়ের একজন মানুষ বা একটি পরিবারের ভাবনা সরকারের জন্য জরুরি নয়। জরুরি হল সরকারের বিপদে, বিরোধী দলকে দমনপীড়নে যারা সরকারের হয়ে অস্ত্র হাতে অ্যাকশনে নামে তাদের মন রক্ষা করা! এটি যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তাদের সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশে আমরা এমনটিই লক্ষ্য করছি। অর্থনৈতিক শক্তিশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার প্রশাসনিক যন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ায় রাষ্ট্রের মূল চরিত্র হল শাসক শ্রেণী তথা ধনবানদের স্বার্থ রক্ষা ও পৃষ্ঠপোষকতা করা। রাষ্ট্র এখানে নিরপেক্ষ নয়। লিমন বনাম র্যাবের মামলায় রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকেনি। রাষ্ট্র র্যাবের পক্ষাবলম্বন করেছে। ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে পাঁচটি স্তর যথা- প্রতিপাদ্য, প্রমাণ, দৃষ্টান্ত, প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত- এর সবই লিমনের বিপক্ষে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় উপাখ্যানে ঋষি গৌতম যে ন্যায় দর্শন প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তা এক্ষেত্রে অনুপস্থিত।
সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যক্তির বিশেষ কোনো কাজ বা আচরণকে ন্যায় বলে এবং অপর কোনো কাজকে অন্যায় বলে নির্দিষ্ট করে। বহুকাল আগে ধারণা করা হতো, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠির আদর্শে কেবল ব্যক্তি নয়, সামাজিক সব সংস্থার আচরণও মূল্যায়িত হয়। দ্বন্দ্বমান শ্রেণী বিভক্ত কোনো সমাজের মধ্যে একই কালে একই বিষয়ে ন্যায়-অন্যায়ের পরস্পরবিরোধী পরিমাপক অনুসৃত হতে পারে। ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র বৃহৎ ও স্থায়ী মাপকাঠি হতে পারে মানুষের কল্যাণ- ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের। লিমনের ক্লান্ত-শান্ত অশ্র“ভেজা চোখ বলে দেয়, এখানে ন্যায়বিচার কাঁদছে। মানুষ মাত্রই ভুল করতে পারে। ন্যায়-অন্যায় মানুষই করে এবং বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণও মানুষ করে। র্যাব সরকারের একটি চৌকস আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বটে। কিন্তু তারাও ভুল বা অন্যায় করতে পারে। এই ভুল বা অন্যায়ের জন্য র্যাবের বেশ কয়েকজন সদস্যদের বিচার হওয়ার খবরও আমরা জানতে পেরেছি। সুতরাং র্যাব ভুল করতে পারে না, এমনটি নয়। তাহলে লিমনের ক্ষেত্রে র্যাবের একটি ‘অন্যায়’কে জায়েজ করতে একের পর এক সাজানো ঘটনা যে জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গ্রামের একজন নিরীহ নিরস্ত্র ব্যক্তির পক্ষে কি কোনোভাবে রাষ্ট্রের অস্ত্রধারী একটি বাহিনীকে তার কাজে বাধা দেয়া সম্ভব? এটা কি কেউ বিশ্বাস করে? অথচ আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অপরাপর শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি কর্তৃক র্যাবের কৃতকর্মের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য লিমনের পুরো পরিবারকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছিল। সরকারের এ অবস্থান মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। লিমনের পায়ে গুলি করার ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে র্যাব তথা সরকারের ভূমিকা প্রশংসিত হতো। সরকারের কাছ থেকে সংবেদনশীল আচরণ পাওয়ার যে আকাক্সক্ষা করে জনসাধারণ, তা পূরণ হলে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ত। কিন্তু সরকার এক্ষেত্রে জনসাধারণের মনোভাবের বিপরীতে অবস্থান নেয়ায় লিমনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও মমত্ববোধ বহুগুণ বেড়ে গেছে। এক পায়ে জীবন বয়ে বেড়ানো অনেক কষ্টের, যাতনার। তাছাড়া লিমনের মাথার ওপর ছিল র্যাবের মামলার খড়গ। ‘র্যাবের মামলা থেকে যদি অব্যাহতি পেতাম, মন দিয়ে লেখাপড়া করতে পারতাম’- ঝালকাঠির আদালত চত্বরে লিমনের এ আকুতি সরকারের মনকে অবশেষে নাড়া দিয়েছে?
অপরাধ স্বীকার করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। মহত্ত্ব আছে। লিমনকে গুলি করার মধ্য দিয়ে র্যাবের যে সদস্যরা অপরাধ করেছে, তা স্বীকার না করে একের পর এক মিথ্যার উপাখ্যান সাজানো হয়েছে। র্যাবের দু’-একজন সদস্যকে রক্ষার জন্য পুরো র্যাবকেই বিতর্ক ও সমালোচনার মধ্যে ফেলা হয়েছে। এ কথা কে না জানে যে, একটি মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অনেক মিথ্যা বলতে হয়। বস্তুত র্যাব তথা প্রশাসন এতদিন এ কাজটিই করছে। এক সময় ব্রিটেনের সমাজে একটি প্রচলিত বিশ্বাস ছিলÑ রাজা কোনো ভুল করতে পারে না। আমরা এটাও জানি, নাগরিকদের প্রতি ব্রিটেনের রাজা বা রানীর মমত্ববোধ ও সংবেদনশীল আচরণ তাকে মহিমান্বিত করেছে।
সাতুরিয়া গ্রামের লিমন তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। নিজ দেশের দরিদ্র কলেজছাত্র লিমন ও তার পরিবারের প্রতি সরকার যে আচরণ করেছে, দেশের আর কোনো নাগরিক যেন এমন আচরণের শিকার না হয়।
আহমেদ সুমন : গবেষক ও বিশ্লেষক
No comments