সংসদ নির্বাচনের ফল কি স্থানীয় নির্বাচনের মতো হবে? by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাংলাদেশে
চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদান্তে এসে সাধারণত
জনপ্রিয়তা হারায়। কারণ ১৬ কোটি মানুষের দেশে সরকারের পক্ষে গণমানুষের
চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। আর সাধারণ মানুষ যখন দেখেন, তারা সরকারের
কাছে যা আশা করেছিলেন সে আশা খুব কমই পূরণ হয়েছে, তখন তারা সরকারকে সমর্থন
দেন না। ফলে সরকারের জনসমর্থন কমে যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সাধারণ
মানুষের চাহিদা কিন্তু খুবই কম। দেশের অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষ,
যারা সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, তাদের চাহিদা সবচেয়ে কম। তারা রাতারাতি বড়লোক
হতে বা গাড়ি-বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক হতে চান না। তারা শুধু চান দু’বেলা
দু’মুঠো খেতে, কাজের সুযোগ পেতে এবং নিরাপদে চলাফেরা করতে। কাজেই
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারলে
তাদের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়। তবে যারা শিক্ষিত ও সচেতন, তাদের
চাহিদা অন্য রকম। তারা দেখেন, সরকার প্রতিশ্র“ত নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে
পেরেছে কি-না, না পারলে ওই সব ওয়াদা পূরণে সরকার কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে
চেষ্টা করেছে, এমপি-মন্ত্রীরা সমাজের চেহারা বদলাতে নাকি নিজের ও পরিবারের
উন্নয়ন ঘটাতে কাজ করেছেন। তাছাড়া সরকারের কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আছে কি-না সে
বিষয়টিও তারা বিচার করে সরকারকে মূল্যায়ন করেন। আর এ দুই শ্রেণী বাদে
শতকরা পাঁচ-সাত ভাগ উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আছেন, যারা দেখেন জিডিপি বাড়ল
কি-না, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কতটা হল। বিভিন্ন উন্নয়নের সূচকে দেশের অবস্থানের
গতিবিধি বিবেচনাসহ সরকারি কর্মকাণ্ডের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সরকারকে সমর্থন
দেয়ার বিষয়টি তারা বিবেচনা করেন।
ইতিপূর্বের অন্যান্য সরকারের মেয়াদান্তে ওই সরকারগুলো যতটা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, মহাজোট সরকার হয়তো তার চেয়ে কিছুটা বেশি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর প্রধান কারণ হল, এ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে করা ওয়াদা পূরণে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যর্থ হওয়া এবং ওয়াদা না করা কতগুলো বড় কাজে হাত দিয়ে সেগুলোতে সুবিধা করতে না পারা। ওয়াদা করা বিষয়গুলোর মধ্যে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের ব্যর্থতা; দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সুবিধা করতে না পারা; মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব গ্রহণ ও প্রকাশ না করা; দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রত্যাশিত মাত্রায় সাফল্য না পাওয়া; সন্ত্রাস, খুন-গুম, সীমান্ত হত্যা কমাতে না পারা; জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে না পারা প্রভৃতি। আর ওয়াদা না করা কিছু বিষয়ে সরকারের অত্যধিক মনোযোগ জনগণ পছন্দ করেননি। যেমন বিরোধী দলের প্রতি হামলা, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন করা, তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে না দেয়া, বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করা, টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেফতার করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা, আলাপ-আলোচনা না করে এবং সংসদ সদস্য ও জনগণকে না জানিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা আখ্যা দিয়ে সরকারদলীয় এমপি ও নেতা-মন্ত্রীদের মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের একই চরিত্রসম্পন্ন মামলা জিইয়ে রাখা, সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রভৃতি।
নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি মোতাবেক কাজ না করতে পারায় সরকার যে ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, সে বিষয়টি অনেক আগে থেকেই অনুধাবন করা যায়। বিভিন্ন উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভালো না করতে পারার মধ্যে প্রথম সরকারি দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারটি ধরা পড়ে। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে গড়ে ওঠা বিরোধীদলীয় আন্দোলনের ওপর সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন, গ্রেফতার এবং হামলা ও মামলার চরিত্রও সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি বিরক্ত করে তোলে। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চকে প্রাথমিকভাবে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সরকারি সমর্থন দিয়ে হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামাদের প্রতি গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করার বিষয়টিও মানবতাবাদী ও বিবেকবান নাগরিকরা পছন্দ করেননি। দলীয় সরকারের অধীনে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগটি সরকারি দলের কট্টর সমর্থক ছাড়া আর কেউ পছন্দ করেন না। এর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষেত্রে বেপরোয়া লুটপাট এবং পদ্মা সেতু ও রেলওয়ের কালো বিড়ালখ্যাত নিয়োগ-দুর্নীতির বস্তাভরা টাকা ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়া এবং এক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য সরকারকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় করে তোলে। সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি কিছু পত্রিকার জরিপেও উপস্থাপিত হয় এবং এ অজনপ্রিয়তা যে নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রাখবে, সে বিষয়টি নাগরিকদের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে।
সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর যদি কেউ অখুশি হন, তাহলে ওই দলকে তিনি ভোট দেন নাÑ এই সাধারণ ফর্মুলা অনুসারে বিচার করে বলা যায়, এ সরকারের জনপ্রিয়তা অতটা কমেনি, যতটা সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন। কারণ এ রকম হিসাবে দেখা যায়, শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। এদের কয়েকজন ক্ষোভে আর দুঃখে আÍহত্যা পর্যন্ত করেছেন। অন্য সবাই কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। এই ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পারিবারিক সদস্যসহ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ভোটার। গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকার যে আচরণ করেছে তাতে ওই ব্যাংকের সঙ্গে জড়িতরা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা যে পারিবারিক সদস্যসহ আড়াই থেকে তিন কোটির মতো ভোটার, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। হেফাজতে ইসলামের সদস্যদের সঙ্গে গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে যে মারাÍক নির্দয় আচরণ করা হয়েছে, তাতে সরকারের ওপর তারা অসম্ভব ক্ষুব্ধ। হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামা যে পারিবারিক সদস্যসহ কোটিরও বেশি সংখ্যার এক বিশাল ভোটব্যাংক, সে সত্য মনে রাখা দরকার। কাজেই তারা সবাই যদি ভোট দেয়ার সময় সরকার সমর্থক প্রার্থীদের সমর্থন না দেন এবং তাদের সঙ্গে ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশ যদি সরকারের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা বিবেচনায় যুক্ত হন, আর সেই সঙ্গে ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর, দলীয় অন্তর্কোন্দলীয় মনোবেদনা এবং সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারায় না পাওয়ার মনোকষ্টে অসন্তুষ্ট সরকারদলীয়দের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক যদি ব্যালট হাতে পেয়ে সে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটান, তাহলে তো সরকারদলীয় প্রার্থীদের চরম ভরাডুবি হওয়ারই কথা। আর এতসব ভোট যদি বিরোধী দলের শতকরা ৩৫ ভাগের মতো রিজার্ভ ভোটের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে অভাবনীয় ভরাডুবি সুনিশ্চিত। কিন্তু সরকারদলীয় প্রার্থীরা অতটা খারাপ করেননি, যা ১৫ জুনের ৪টি এবং ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েও উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে প্রমাণ করেছেন। তবে নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে এখনও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সংসদ নির্বাচনে এর চেয়ে ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীরা ভালো কাজের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকে নিজ নিজ ভোট কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়ে মেয়র পদ হারালেও উল্লেখযোগ্য হারে ভোট পেয়ে সরকারের মুখ রক্ষা করেছেন। তাদের একজনেরও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। বরিশালে ১৭, সিলেটে ৩৫, রাজশাহীতে ৪৪, খুলনায় ৬১ হাজার এবং গাজীপুরে ১ লাখ ৬ সহস্রাধিক ভোটের ব্যবধানে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা প্রতিপক্ষ ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হলেও নির্বাচনে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টিতে সক্ষম হন। এ চারটি নির্বাচনের পর কালীগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর (৮৪০৬) চেয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী প্রায় দ্বিগুণ (১৬২৪৪) ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জুনের শেষ সপ্তাহে নোয়াখালীর চাটখিলে আওয়ামী লীগ সমর্থক পৌর মেয়রের মৃত্যু-পরবর্তী উপনির্বাচনেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে সরকারি দল সমর্থক প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। আলোচ্য নির্বাচনগুলোর কাউন্সিলর পদগুলোতেও সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটে। চার সিটি নির্বাচনে ১১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপি সমর্থিত ৬৫ জন কাউন্সিলর বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৮ জন কাউন্সিলর জয় পান। কাজেই দেশ পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা, আর্থিক লুটপাট, দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়নের কারণে সরকারের প্রতি বিরক্ত ভোটাররা বিক্ষুব্ধ হেফাজত নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ ১৮ দলের রিজার্ভ ভোটের সঙ্গে যুক্ত হলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের যতটা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার কথা ছিল, তারা কিন্তু তেমনভাবে পরাজিত হননি। মেয়ররা পরাজিত হয়েও মুখ বাঁচানোর মতো ভোট পেয়ে সরকারের সম্মান রক্ষা করেছেন। এসব প্রার্থীর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং স্থানীয় ভাবমূর্তির ফলে তাদের পক্ষে এহেন ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে।
পাঁচটি বড় সিটি নির্বাচনে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে বড় ধাক্কা খেয়ে সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা ভিন্ন বিবেচনায় ভোট দেবেন। কাজেই সরকারের ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ ভোটারদের কাছে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তাদের প্রার্থীরা ভালো করবেন বলে তারা মনে করছেন। কিন্তু আসলে কি তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে? যেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ভালো রেকর্ড নিয়ে চারজন ডাকসাইটে মেয়র প্রার্থীর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবি হল, গাজীপুরে পরাজিত না হওয়ার রেকর্ডধারী, দুর্নামহীন ও আকর্ষণীয় প্রার্থী চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেন, সেখানে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিকারী অধিকাংশ এমপি- জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় যাদের অনেকে ইতিমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না- তারা সংসদ নির্বাচনে ভালো করবেন কিভাবে? ইতিমধ্যে জনবিচ্ছিন্ন যেসব এমপিকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে- যাদের কেউ কেউ হামলার শিকার হয়েছেন, দু’-একজনের ওপর প্রস্তর বা পাদুকা নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে- এমন সব এমপির জনপ্রিয়তা অনুধাবনে জরিপ বা গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না। সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন সূত্রে জরিপ করে এমপিদের জনপ্রিয়তার দুরবস্থা অবগত হয়ে প্রায় ১৫০ আসনে প্রার্থী বদলের চিন্তা করছেন (যুগান্তর, ২৮-০৬-১৩)। এ তালিকায় সাধারণ এমপিদের সঙ্গে অনেক ডাকসাইটে সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীও রয়েছেন। এলাকার উন্নয়ন না করতে পারলেও অনেক এমপি নিজের ও পরিবারের ব্যাপক উন্নয়ন করে গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছেন। এরা মনোনয়ন পেলে ভোটার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবেন। আসলে প্রথম থেকেই সরকারি দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পেশাদারিত্বের সঙ্গে যেমন পরিচালিত হয়নি, তেমনি এমপিদের পারফরম্যান্স দেখভালের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও গৃহীত হয়নি। এর ফলে অনেক এমপি দলীয় ইমেজ ও জনপ্রিয়তার কথা ভুলে ফ্রিস্টাইলে কাজ করে অজনপ্রিয় হয়েছেন। ফলে সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থা হয়েছে ওই বোকা ছাত্রের মতো, যে সারা বছর লেখাপড়া না করে পরীক্ষার আগের রাতে সারারাত জেগে লেখাপড়া করে ভালো ফল করতে চেয়ে ফেল করে। সরকারি দল গত সাড়ে চার বছর সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ না করে নির্বাচনের প্রাক্কালে রাতারাতি সাংগঠনিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে ভালো ফল করার যে চেষ্টা করতে চাইছে, তার ফল যে পাঁচ সিটি নির্বাচনের ফলের মতো হবে না এমনটা বলা যায় না।
পাটীগণিতের হিসাবে তো নিরপেক্ষভাবে সংসদ নির্বাচন হলে বর্তমান জনপ্রিয়তায় সরকারদলীয় প্রার্থীদের ফলাফল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতোই খারাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। সরকারদলীয় ডাকসাইটে মেয়র প্রার্থীরা অনেক উন্নয়ন কাজ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নাম না থাকা সত্ত্বেও এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ব্যাপক প্রচারণার সুযোগ পেয়ে এবং তাদের দু’-একজনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কখনোই পরাজয়ের রেকর্ড না থাকা সত্ত্বেও যদি প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের কাছে বিস্তর ভোটে পরাজিত হতে হয়, তাহলে তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয় অধিকাংশ এমপি অপেক্ষাকৃত কম ভালো কাজ করে কী করে সংসদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো করবেন? সরকারও বিভিন্ন জরিপ করে দলীয় এমপিদের জনপ্রিয়তার দুরবস্থা বুঝতে পেরেছে। সে কারণে সরকার বুঝেছে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হলে সরকারি দল নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। আর এজন্যই নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে সরকার বিরোধী দলকে বিভিন্ন কলাকৌশলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে সচেষ্ট। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলের উদাহরণ দিয়ে সরকারি দলের নেতারা বিরোধী দলকে সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখতে আহ্বান করছে। কিন্তু উভয় বড় দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে যেখানে পারস্পরিক বিশ্বাস অনুপস্থিত, আলাপ-আলোচনা, এমনকি মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ, সেখানে বিরোধী দল কিভাবে বিশ্বাস করবে যে সরকারি দলের অধীনে ক্ষমতা বদলের সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সরকারি আহ্বানকে যদি বিরোধীদলীয় নেতারা চতুর শিয়াল পণ্ডিত কর্তৃক গোশতের টুকরা মুখে গাছের ডালে বসা কাককে তার ‘সুমিষ্ট’ গানের গলার প্রশংসা করার মতো মতলবি আচরণ মনে করেন, তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়?
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইতিপূর্বের অন্যান্য সরকারের মেয়াদান্তে ওই সরকারগুলো যতটা জনপ্রিয়তা হারিয়েছিল, মহাজোট সরকার হয়তো তার চেয়ে কিছুটা বেশি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। এর প্রধান কারণ হল, এ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে করা ওয়াদা পূরণে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যর্থ হওয়া এবং ওয়াদা না করা কতগুলো বড় কাজে হাত দিয়ে সেগুলোতে সুবিধা করতে না পারা। ওয়াদা করা বিষয়গুলোর মধ্যে বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে মূল্যসন্ত্রাসী সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকারের ব্যর্থতা; দুর্নীতি, দলীয়করণ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে সুবিধা করতে না পারা; মন্ত্রী-এমপিদের সম্পদের হিসাব গ্রহণ ও প্রকাশ না করা; দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রত্যাশিত মাত্রায় সাফল্য না পাওয়া; সন্ত্রাস, খুন-গুম, সীমান্ত হত্যা কমাতে না পারা; জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে না পারা প্রভৃতি। আর ওয়াদা না করা কিছু বিষয়ে সরকারের অত্যধিক মনোযোগ জনগণ পছন্দ করেননি। যেমন বিরোধী দলের প্রতি হামলা, মামলা, নিপীড়ন, নির্যাতন করা, তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে না দেয়া, বাকস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা করা, টেলিভিশন চ্যানেল ও সংবাদপত্র বন্ধ ও সম্পাদককে গ্রেফতার করে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা, আলাপ-আলোচনা না করে এবং সংসদ সদস্য ও জনগণকে না জানিয়ে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা আখ্যা দিয়ে সরকারদলীয় এমপি ও নেতা-মন্ত্রীদের মামলা প্রত্যাহার করে নিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের একই চরিত্রসম্পন্ন মামলা জিইয়ে রাখা, সর্বসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রভৃতি।
নির্বাচনী প্রতিশ্র“তি মোতাবেক কাজ না করতে পারায় সরকার যে ক্রমাগতভাবে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে, সে বিষয়টি অনেক আগে থেকেই অনুধাবন করা যায়। বিভিন্ন উপনির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভালো না করতে পারার মধ্যে প্রথম সরকারি দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার ব্যাপারটি ধরা পড়ে। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে গড়ে ওঠা বিরোধীদলীয় আন্দোলনের ওপর সরকারের নিপীড়ন, নির্যাতন, গ্রেফতার এবং হামলা ও মামলার চরিত্রও সাধারণ মানুষকে সরকারের প্রতি বিরক্ত করে তোলে। এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চকে প্রাথমিকভাবে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সরকারি সমর্থন দিয়ে হেফাজতে ইসলামের আলেম-ওলামাদের প্রতি গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ করার বিষয়টিও মানবতাবাদী ও বিবেকবান নাগরিকরা পছন্দ করেননি। দলীয় সরকারের অধীনে নিজেরা ক্ষমতায় থেকে স্বনিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগটি সরকারি দলের কট্টর সমর্থক ছাড়া আর কেউ পছন্দ করেন না। এর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষেত্রে বেপরোয়া লুটপাট এবং পদ্মা সেতু ও রেলওয়ের কালো বিড়ালখ্যাত নিয়োগ-দুর্নীতির বস্তাভরা টাকা ধরা পড়ার মধ্য দিয়ে দুর্নীতি প্রকাশ পাওয়া এবং এক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য সরকারকে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় করে তোলে। সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি কিছু পত্রিকার জরিপেও উপস্থাপিত হয় এবং এ অজনপ্রিয়তা যে নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব রাখবে, সে বিষয়টি নাগরিকদের মুখে মুখে আলোচিত হতে থাকে।
সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর যদি কেউ অখুশি হন, তাহলে ওই দলকে তিনি ভোট দেন নাÑ এই সাধারণ ফর্মুলা অনুসারে বিচার করে বলা যায়, এ সরকারের জনপ্রিয়তা অতটা কমেনি, যতটা সাধারণ মানুষ ভেবেছিলেন। কারণ এ রকম হিসাবে দেখা যায়, শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী এ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। এদের কয়েকজন ক্ষোভে আর দুঃখে আÍহত্যা পর্যন্ত করেছেন। অন্য সবাই কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। এই ৩৩ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী পারিবারিক সদস্যসহ প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ভোটার। গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সরকার যে আচরণ করেছে তাতে ওই ব্যাংকের সঙ্গে জড়িতরা সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। গ্রামীণ ব্যাংকের ৮৪ লাখ ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা যে পারিবারিক সদস্যসহ আড়াই থেকে তিন কোটির মতো ভোটার, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। হেফাজতে ইসলামের সদস্যদের সঙ্গে গভীর রাতে বাতি নিভিয়ে যে মারাÍক নির্দয় আচরণ করা হয়েছে, তাতে সরকারের ওপর তারা অসম্ভব ক্ষুব্ধ। হাজার হাজার কওমি মাদ্রাসার ধর্মপ্রাণ আলেম-ওলামা যে পারিবারিক সদস্যসহ কোটিরও বেশি সংখ্যার এক বিশাল ভোটব্যাংক, সে সত্য মনে রাখা দরকার। কাজেই তারা সবাই যদি ভোট দেয়ার সময় সরকার সমর্থক প্রার্থীদের সমর্থন না দেন এবং তাদের সঙ্গে ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশ যদি সরকারের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা বিবেচনায় যুক্ত হন, আর সেই সঙ্গে ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর, দলীয় অন্তর্কোন্দলীয় মনোবেদনা এবং সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারায় না পাওয়ার মনোকষ্টে অসন্তুষ্ট সরকারদলীয়দের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থক যদি ব্যালট হাতে পেয়ে সে বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটান, তাহলে তো সরকারদলীয় প্রার্থীদের চরম ভরাডুবি হওয়ারই কথা। আর এতসব ভোট যদি বিরোধী দলের শতকরা ৩৫ ভাগের মতো রিজার্ভ ভোটের সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনে অভাবনীয় ভরাডুবি সুনিশ্চিত। কিন্তু সরকারদলীয় প্রার্থীরা অতটা খারাপ করেননি, যা ১৫ জুনের ৪টি এবং ৬ জুলাই গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীরা পরাজিত হয়েও উল্লেখযোগ্য ভোট পেয়ে প্রমাণ করেছেন। তবে নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নিয়ে এখনও সতর্কতার সঙ্গে কাজ করলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের সংসদ নির্বাচনে এর চেয়ে ভালো করার সুযোগ রয়েছে।
চারটি সিটি নির্বাচনে সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থীরা ভালো কাজের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকে নিজ নিজ ভোট কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়ে মেয়র পদ হারালেও উল্লেখযোগ্য হারে ভোট পেয়ে সরকারের মুখ রক্ষা করেছেন। তাদের একজনেরও জামানত বাজেয়াপ্ত হয়নি। বরিশালে ১৭, সিলেটে ৩৫, রাজশাহীতে ৪৪, খুলনায় ৬১ হাজার এবং গাজীপুরে ১ লাখ ৬ সহস্রাধিক ভোটের ব্যবধানে সরকারি দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা প্রতিপক্ষ ১৮ দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থীদের কাছে পরাজিত হলেও নির্বাচনে তীব্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টিতে সক্ষম হন। এ চারটি নির্বাচনের পর কালীগঞ্জ পৌরসভার নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থীর (৮৪০৬) চেয়ে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী প্রায় দ্বিগুণ (১৬২৪৪) ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। জুনের শেষ সপ্তাহে নোয়াখালীর চাটখিলে আওয়ামী লীগ সমর্থক পৌর মেয়রের মৃত্যু-পরবর্তী উপনির্বাচনেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর কাছে সরকারি দল সমর্থক প্রার্থীর পরাজয় ঘটে। আলোচ্য নির্বাচনগুলোর কাউন্সিলর পদগুলোতেও সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের ভরাডুবি ঘটে। চার সিটি নির্বাচনে ১১৮টি সাধারণ ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপি সমর্থিত ৬৫ জন কাউন্সিলর বিজয়ী হলেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২৮ জন কাউন্সিলর জয় পান। কাজেই দেশ পরিচালনায় সরকারের ব্যর্থতা, আর্থিক লুটপাট, দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়নের কারণে সরকারের প্রতি বিরক্ত ভোটাররা বিক্ষুব্ধ হেফাজত নেতা-কর্মী-সমর্থকসহ ১৮ দলের রিজার্ভ ভোটের সঙ্গে যুক্ত হলে সরকারদলীয় প্রার্থীদের যতটা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার কথা ছিল, তারা কিন্তু তেমনভাবে পরাজিত হননি। মেয়ররা পরাজিত হয়েও মুখ বাঁচানোর মতো ভোট পেয়ে সরকারের সম্মান রক্ষা করেছেন। এসব প্রার্থীর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এবং স্থানীয় ভাবমূর্তির ফলে তাদের পক্ষে এহেন ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে।
পাঁচটি বড় সিটি নির্বাচনে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে বড় ধাক্কা খেয়ে সরকারদলীয় মন্ত্রী-এমপিরা বলছেন, সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা ভিন্ন বিবেচনায় ভোট দেবেন। কাজেই সরকারের ‘উন্নয়ন কর্মকাণ্ড’ ভোটারদের কাছে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তাদের প্রার্থীরা ভালো করবেন বলে তারা মনে করছেন। কিন্তু আসলে কি তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা আছে? যেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ভালো রেকর্ড নিয়ে চারজন ডাকসাইটে মেয়র প্রার্থীর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভরাডুবি হল, গাজীপুরে পরাজিত না হওয়ার রেকর্ডধারী, দুর্নামহীন ও আকর্ষণীয় প্রার্থী চরমভাবে প্রত্যাখ্যাত হলেন, সেখানে নির্বাচনী এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টিকারী অধিকাংশ এমপি- জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ায় যাদের অনেকে ইতিমধ্যে নির্বাচনী এলাকায় যেতে পারছেন না- তারা সংসদ নির্বাচনে ভালো করবেন কিভাবে? ইতিমধ্যে জনবিচ্ছিন্ন যেসব এমপিকে এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে- যাদের কেউ কেউ হামলার শিকার হয়েছেন, দু’-একজনের ওপর প্রস্তর বা পাদুকা নিক্ষেপের ঘটনাও ঘটেছে- এমন সব এমপির জনপ্রিয়তা অনুধাবনে জরিপ বা গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না। সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন সূত্রে জরিপ করে এমপিদের জনপ্রিয়তার দুরবস্থা অবগত হয়ে প্রায় ১৫০ আসনে প্রার্থী বদলের চিন্তা করছেন (যুগান্তর, ২৮-০৬-১৩)। এ তালিকায় সাধারণ এমপিদের সঙ্গে অনেক ডাকসাইটে সরকারদলীয় নেতা ও মন্ত্রীও রয়েছেন। এলাকার উন্নয়ন না করতে পারলেও অনেক এমপি নিজের ও পরিবারের ব্যাপক উন্নয়ন করে গণমাধ্যমে প্রচার পেয়েছেন। এরা মনোনয়ন পেলে ভোটার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হবেন। আসলে প্রথম থেকেই সরকারি দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পেশাদারিত্বের সঙ্গে যেমন পরিচালিত হয়নি, তেমনি এমপিদের পারফরম্যান্স দেখভালের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও গৃহীত হয়নি। এর ফলে অনেক এমপি দলীয় ইমেজ ও জনপ্রিয়তার কথা ভুলে ফ্রিস্টাইলে কাজ করে অজনপ্রিয় হয়েছেন। ফলে সরকারদলীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অবস্থা হয়েছে ওই বোকা ছাত্রের মতো, যে সারা বছর লেখাপড়া না করে পরীক্ষার আগের রাতে সারারাত জেগে লেখাপড়া করে ভালো ফল করতে চেয়ে ফেল করে। সরকারি দল গত সাড়ে চার বছর সাংগঠনিক কাজে মনোনিবেশ না করে নির্বাচনের প্রাক্কালে রাতারাতি সাংগঠনিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে ভালো ফল করার যে চেষ্টা করতে চাইছে, তার ফল যে পাঁচ সিটি নির্বাচনের ফলের মতো হবে না এমনটা বলা যায় না।
পাটীগণিতের হিসাবে তো নিরপেক্ষভাবে সংসদ নির্বাচন হলে বর্তমান জনপ্রিয়তায় সরকারদলীয় প্রার্থীদের ফলাফল স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতোই খারাপ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলের উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য। সরকারদলীয় ডাকসাইটে মেয়র প্রার্থীরা অনেক উন্নয়ন কাজ করে উল্লেখযোগ্য দুর্নাম না থাকা সত্ত্বেও এবং কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ব্যাপক প্রচারণার সুযোগ পেয়ে এবং তাদের দু’-একজনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কখনোই পরাজয়ের রেকর্ড না থাকা সত্ত্বেও যদি প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের কাছে বিস্তর ভোটে পরাজিত হতে হয়, তাহলে তুলনামূলকভাবে কম জনপ্রিয় অধিকাংশ এমপি অপেক্ষাকৃত কম ভালো কাজ করে কী করে সংসদ নির্বাচনে প্রতিপক্ষের চেয়ে ভালো করবেন? সরকারও বিভিন্ন জরিপ করে দলীয় এমপিদের জনপ্রিয়তার দুরবস্থা বুঝতে পেরেছে। সে কারণে সরকার বুঝেছে যে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ নির্বাচন হলে সরকারি দল নির্বাচনে ভালো করতে পারবে না। আর এজন্যই নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে সরকার বিরোধী দলকে বিভিন্ন কলাকৌশলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে সচেষ্ট। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফলের উদাহরণ দিয়ে সরকারি দলের নেতারা বিরোধী দলকে সরকারের ওপর বিশ্বাস রাখতে আহ্বান করছে। কিন্তু উভয় বড় দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বে যেখানে পারস্পরিক বিশ্বাস অনুপস্থিত, আলাপ-আলোচনা, এমনকি মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ, সেখানে বিরোধী দল কিভাবে বিশ্বাস করবে যে সরকারি দলের অধীনে ক্ষমতা বদলের সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে? দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সরকারি আহ্বানকে যদি বিরোধীদলীয় নেতারা চতুর শিয়াল পণ্ডিত কর্তৃক গোশতের টুকরা মুখে গাছের ডালে বসা কাককে তার ‘সুমিষ্ট’ গানের গলার প্রশংসা করার মতো মতলবি আচরণ মনে করেন, তাহলে কি তাদের দোষ দেয়া যায়?
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments