সিটি করপোরেশনে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া by মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
গত ১৫ জুন চার বিভাগীয় এবং ৬ জুলাই নবগঠিত
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। স্থানীয় সরকারের
সবচেয়ে বড় ইউনিট হওয়ার কারণে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গুরুত্ব ও
ফলাফল নিঃসন্দেহে অনেক অর্থই বহন করে।
অধিকন্তু জাতীয়
নির্বাচনের প্রাক্কালে, অর্থাৎ ছয় মাস বাকি থাকতে সাধারণ ভোটারদের ভোটদানের
সুযোগ ঘটায় পাঁচ সিটি করপোরেশনের ভোটারদের মধ্যে নানা বিষয়ে প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করার মতো অপ্রত্যাশিত বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ফলে নির্বাচনটি মোটেও
স্থানীয় সরকার চরিত্রের নির্বাচনে থাকেনি। ভোটারদের বেশির ভাগই প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করেছে জাতীয় রাজনীতির নানা ইস্যুতে। ফলে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের
ধারণা ও বাস্তবতা বাস্তবে খুব একটা কাজ করেনি। এতে ওই পাঁচটি সিটি
করপোরেশন পাঁচ বছর কোন চেহারায় আবির্ভূত হবে, তা বলা না গেলেও ভবিষ্যতে এই
পাঁচ সিটি করপোরেশনই বোধ হয় জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে পরবর্তী সংসদ
নির্বাচনের ব্যারোমিটারযন্ত্রে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। এর ভালো-মন্দ দুটোই
তলিয়ে দেখার রয়েছে। ভালো দিকটি হচ্ছে, যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন,
মেয়াদের শেষ প্রান্তে সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন কতটুকু আছে বা নেই, তেমন
একটি ধারণা দেশব্যাপী জানানো ও দেখার বিষয় হিসেবে ঘটতে পারে; অন্যদিকে
পাঁচ সিটি করপোরেশনের এমন ভূমিকা নিজেদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে
দাঁড়াতে পারে। জাতীয় রাজনীতির মহড়া দেওয়ার ভূমিকা বারবার এগুলোর ওপর বর্তে
গেলে আখেরে নিজেদেরই ক্ষতি হতে পারে। ভবিষ্যতে অবশ্য এর গতিপ্রকৃতি কোন
দিকে মোড় নেবে, তা এখনই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে ২০০৮ সালে যেমনি চার
বিভাগীয় সিটি করপোরেশন, এবারও গাজীপুরসহ পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন জাতীয়
সংসদ নির্বাচনেরই মহড়ায় অবতীর্ণ হওয়ার মতো বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে
হচ্ছে। ২০০৮ সালে চার সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ ভোটার পূর্ববর্তী চারদলীয়
জোট সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানিয়েছিল, এবারও পাঁচ সিটি করপোরেশনের
বেশির ভাগ ভোটার বর্তমান সরকারের বিপক্ষেই তাদের ভোট প্রদান করেছে। ২০০৮
সালে তারা চারদলীয় জোটের বিপরীতে ১৪ দলীয় জোট-সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল
ভোটে বিজয়ী করেছে, এবারও তারা ১৪ দলীয় জোট-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থীদের বাদ
দিয়ে ১৮ দলীয় জোট-সমর্থিত প্রার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী করেছে। এখানে মেয়র
পদপ্রার্থীদের ব্যক্তিগত যোগ্যতা, দক্ষতা, কর্মনিষ্ঠা, সততা ও অভিজ্ঞতা
সংখ্যাগরিষ্ঠের বিবেচনায় থাকেনি, গুরুত্ব পায়নি, ভোটদানের ক্ষেত্রে সরকারি
দল বা জোটের বিরোধিতা করার প্রবণতাই বিশেষভাবে কার্যকর হয়েছে। বিজয়ী
প্রার্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটারদের নেগেটিভ ভোটে জয়লাভ করেছেন, প্রার্থীদের
দোষত্রুটি তেমন একটা আমলে নেওয়া হয়নি। মেয়র পদপ্রার্থীদের এবার ভোটারদের
কাছে তাঁদের যোগ্যতার বড় ধরনের কোনো পরীক্ষা দিতে হয়নি। আগামীবার পাঁচ সিটি
করপোরেশন নির্বাচনে পরিস্থিতি কেমন হবে, তা তখনই কেবল বলা যাবে। আপাতত
পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকারের সাড়ে চার বছরের আমলনামার ওপর ভিত্তি
করে প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো একটি নির্বাচনে পরিণত হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সরকার সাড়ে চার বছরে কি জনগণের চাহিদা তেমনভাবে পূরণ
করতে পারেনি? এর উত্তরে যেকোনো সচেতন মানুষই স্বীকার করবেন যে বর্তমান
সরকারের এই মেয়াদে দেশে অনেক খাতেই ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। বিশ্ব অর্থনীতির
বাস্তবতায় সব কিছু বিবেচনা করলে স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশ এই সময়ে
প্রতিকূল বিশ্ব মন্দায় থেকেও তাক লাগানোর মতো উন্নয়ন ঘটাতে পেরেছে। দেশের
গ্রামীণ অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, কায়িক শ্রমের বাজারমূল্য
শ্রমজীবী মানুষকে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মোটামুটি একটি জায়গায় নিয়ে এসেছে,
দেশের গার্মেন্টশিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে,
অভ্যন্তরীণভাবেও নানা প্রতিকূলতার পরও বেশ প্রসার ঘটিয়েছে, ব্যবসা-বাণিজ্য,
ব্যাংকিং-ব্যবস্থা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ, রেমিট্যান্স প্রবাহ,
শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ধারার সৃষ্টি, শিক্ষা খাতে বড় ধরনের
পরিবর্তন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুগান্তকারী ব্যবস্থা নেওয়া, তথ্য-প্রযুক্তির
ব্যাপক প্রসার ঘটানো, আইনশৃঙ্খলা কাঙ্ক্ষিত মানে না হলেও মোটামুটি
নিয়ন্ত্রণে রাখা, যোগাযোগব্যবস্থায় বেশ কিছু অগ্রগতি সাধন, রেল-ব্যবস্থাকে
শৃঙ্খলমুক্ত করা, দেশে জঙ্গিবাদকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি
দৃশ্যমান সাফল্য রয়েছে।
সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিরোধী দল প্রচারণায় কাজে লাগিয়েছে পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ। বিষয়গুলো নিয়ে সরকার যে ধরনের ব্যাখ্যা গোড়া থেকেই দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা তারা করেনি, করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। ফলে জনমনে এসব নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ক্ষোভ, হতাশা ও অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের উত্তর সরকার গুরুত্বের সঙ্গে না দেওয়ায় সাধারণ ভোটাররা বিরোধীদের প্রচার-অপপ্রচারকেই বিশ্বাস করছে বলেই মনে হচ্ছে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটিকে মনে রেখে ভোট প্রদান করেছে বলে মনে হচ্ছে। তাতেও সরকার সমর্থক মেয়র পদপ্রার্থীদের ভোট হ্রাস পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক, অধ্যাপক ইউনূস এবং নিরীহ ছাত্র লিমনকে নিয়ে টানাটানির বিষয়টি মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি; বরং বাড়াবাড়ি, একগুঁয়েমির পর্যায়ে পড়েছে বলে মনে হয়েছে। এ দিকটি সাধারণ ভোটারদের কাছে সরকারের অগ্রহণযোগ্য আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর প্রতিটির প্রতিই সহানুভূতিশীল ভোটারদের ভোট সরকারদলীয় মেয়র পদপ্রার্থীরা হারিয়েছেন। এর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের লাগামছাড়া কর্মকাণ্ড, মিডিয়ায় শিরোনাম হয়ে ওঠা, টেন্ডারবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হওয়া, বিশ্বজিৎ হত্যায় যুক্ত হওয়া। এসব নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়াটা দৃশ্যমান ছিল, সরকার ছাত্রলীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে- এমন ধারণা দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে দেশব্যাপী একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে রাজনীতিতে দিন বদলের যে হাওয়া বইছে, তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে প্রমাণ রাখার চেষ্টা করবে। শুরুতে তেমন মনোভাবই সরকারের আচরণ ও কথাবার্তায় প্রকাশিত হলেও ছাত্রলীগকে ২০০১-২০০৬ সালের জোট সরকারের আমলের ছাত্রদলের অবস্থান থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, কর্মকাণ্ড ও মনোভাব বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা সরকার জানে। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেতিবাচক অনেক ভোট পড়েছে। একটি বড়সংখ্যক ভোটার স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নামে গজিয়ে ওঠা নানা সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডে মোটেও সন্তুষ্ট নন। তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকার সমর্থক মেয়রদের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছেন অনেকে। অথচ সাধারণ মানুষের এসব ভোট সরকারের উলি্লখিত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে পক্ষেই পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে প্রতিদিন প্রচার-প্রচারণায় সচল থাকা ব্যর্থতাগুলো বিপুলসংখ্যক ভোটারকে সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে, তাঁদের এখন বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীর বাক্সেই নির্ভর করতে হচ্ছে, সেটিই তাঁরা করেছেন।
গাজীপুরে বিপুলসংখ্যক ভোটারের অনুপস্থিতির কারণকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। অভিযোগ আছে, দলের কর্মী ও সমর্থক পর্যায়ের অনেকেই নানা অভিযোগ, মান-অভিমান, পাওয়া না-পাওয়া থেকে ভোট দিতে আসেননি, প্রতিপক্ষের বাক্সেও ভোট দেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, কাউন্সিলর হিসেবে দলের যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁরাও নিজ দলের মেয়র পদপ্রার্থীর জন্য ভোট প্রার্থনা করেননি- এমন অভিযোগও রয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে ভোট বিনিময়ের মারাত্মক অভিযোগও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছে তা মোটেও যথেষ্ট নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেওয়ার গ্রহণযোগ্য যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত ও ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে পারেনি, সাধারণ জনমনস্তত্ত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অন্ধবিশ্বাস রয়েছে, আওয়ামী লীগ তা না কাটিয়ে যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে মানুষ মোটেও সন্তুষ্ট হচ্ছে না, বিশ্বাস করার পর্যায়ে নেই। এর ফলেও লাভবান হচ্ছে ১৮ দল, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট। বিষয়টি নিয়ে গত দুই বছর যেসব বাগ্বিতণ্ডা মিডিয়াসহ সর্বত্র চলছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান মোটেও হচ্ছে না; বরং নির্বাচনকালে কারচুপি করার কোনো অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে, এমনটিই অটুট আছে, প্রচারিতও হচ্ছে। বাঙালির সন্দেহপ্রবণতা নতুন কিছু নয়। এটি দূর করা খুব সহজ কাজ নয়। আওয়ামী লীগদলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে স্বচ্ছ অবস্থানটি বারবার বলছে, তা কিন্তু এ দেশের সন্দেহপ্রবণ ভোটারদের একটি বড় অংশ আস্থায় নিচ্ছে না, বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ নিজে হয়তো দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে; কিন্তু প্রতিপক্ষ দল সে ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি না দিলে আওয়ামী লীগের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হবে না, সেটি একপক্ষীয় হয়েই থাকবে। বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় গিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রতিশ্রুতি এ পর্যন্ত দেয়নি। তাদের কোনো শাসন আমলে তেমন রেকর্ড নেই। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগকে এককভাবে নয়, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সম্মতিতে বা প্রতিশ্রুতিতে আসতে হবে, তবেই দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ধারা বহাল থাকবে। আপাতত দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দ্বিধাবিভক্ত ও বিভ্রান্তিতে আছে। তেমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ শুধু দশম জাতীয় সংসদ নয়, পরবর্তী নির্বাচনগুলোও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, কার্যক্রম, অর্থায়ন, আইনি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উচ্চতর স্তরে নেওয়ার বিষয়গুলোও সিরিয়াসলি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে আমাদের নানা দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, সংকীর্ণতা, অবিমৃষ্যকারিতা, শঠতা, চাতুরীপনা, অন্ধভাবে পক্ষ নেওয়ার মানসিকতা রয়েছে। এসব কাটিয়ে না উঠতে পারলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত খুব একটা হবে না। আমাদের যেকোনো নির্বাচনব্যবস্থাই এখন নানা অবিশ্বাস্য নেতিবাচক বিশ্বাস, প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডনির্ভর হয়ে উঠছে, ইতিবাচক বিষয়গুলো ভীষণ পরাজিত হচ্ছে। এর উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। নতুবা দেশের গণতন্ত্রের অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে বিরোধী দল প্রচারণায় কাজে লাগিয়েছে পদ্মা সেতু, হলমার্ক, ডেসটিনিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগ। বিষয়গুলো নিয়ে সরকার যে ধরনের ব্যাখ্যা গোড়া থেকেই দেওয়া প্রয়োজন ছিল তা তারা করেনি, করতে ব্যর্থ হয়েছে বলা চলে। ফলে জনমনে এসব নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ক্ষোভ, হতাশা ও অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের উত্তর সরকার গুরুত্বের সঙ্গে না দেওয়ায় সাধারণ ভোটাররা বিরোধীদের প্রচার-অপপ্রচারকেই বিশ্বাস করছে বলেই মনে হচ্ছে। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেটিকে মনে রেখে ভোট প্রদান করেছে বলে মনে হচ্ছে। তাতেও সরকার সমর্থক মেয়র পদপ্রার্থীদের ভোট হ্রাস পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রামীণ ব্যাংক, অধ্যাপক ইউনূস এবং নিরীহ ছাত্র লিমনকে নিয়ে টানাটানির বিষয়টি মোটেও গ্রহণযোগ্য হয়নি; বরং বাড়াবাড়ি, একগুঁয়েমির পর্যায়ে পড়েছে বলে মনে হয়েছে। এ দিকটি সাধারণ ভোটারদের কাছে সরকারের অগ্রহণযোগ্য আচরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর প্রতিটির প্রতিই সহানুভূতিশীল ভোটারদের ভোট সরকারদলীয় মেয়র পদপ্রার্থীরা হারিয়েছেন। এর সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত হয়েছে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের লাগামছাড়া কর্মকাণ্ড, মিডিয়ায় শিরোনাম হয়ে ওঠা, টেন্ডারবাজি, নিজেদের মধ্যে মারামারিতে লিপ্ত হওয়া, বিশ্বজিৎ হত্যায় যুক্ত হওয়া। এসব নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নেওয়াটা দৃশ্যমান ছিল, সরকার ছাত্রলীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে- এমন ধারণা দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০০৮-২০০৯ সালে দেশব্যাপী একটি ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে রাজনীতিতে দিন বদলের যে হাওয়া বইছে, তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে প্রমাণ রাখার চেষ্টা করবে। শুরুতে তেমন মনোভাবই সরকারের আচরণ ও কথাবার্তায় প্রকাশিত হলেও ছাত্রলীগকে ২০০১-২০০৬ সালের জোট সরকারের আমলের ছাত্রদলের অবস্থান থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। ফলে দেশব্যাপী ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, কর্মকাণ্ড ও মনোভাব বেড়েছে। এতে সাধারণ মানুষ কতটা ক্ষুব্ধ হয়েছে, তা সরকার জানে। এরই প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেতিবাচক অনেক ভোট পড়েছে। একটি বড়সংখ্যক ভোটার স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নামে গজিয়ে ওঠা নানা সংগঠনের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ডে মোটেও সন্তুষ্ট নন। তারই প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকার সমর্থক মেয়রদের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছেন অনেকে। অথচ সাধারণ মানুষের এসব ভোট সরকারের উলি্লখিত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাব হিসেবে পক্ষেই পড়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অদূরদর্শিতার কারণে প্রতিদিন প্রচার-প্রচারণায় সচল থাকা ব্যর্থতাগুলো বিপুলসংখ্যক ভোটারকে সরকারের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে দিয়েছে, তাঁদের এখন বিরোধী দলের সমর্থিত প্রার্থীর বাক্সেই নির্ভর করতে হচ্ছে, সেটিই তাঁরা করেছেন।
গাজীপুরে বিপুলসংখ্যক ভোটারের অনুপস্থিতির কারণকে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। অভিযোগ আছে, দলের কর্মী ও সমর্থক পর্যায়ের অনেকেই নানা অভিযোগ, মান-অভিমান, পাওয়া না-পাওয়া থেকে ভোট দিতে আসেননি, প্রতিপক্ষের বাক্সেও ভোট দেওয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে, কাউন্সিলর হিসেবে দলের যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁরাও নিজ দলের মেয়র পদপ্রার্থীর জন্য ভোট প্রার্থনা করেননি- এমন অভিযোগও রয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে ভোট বিনিময়ের মারাত্মক অভিযোগও রয়েছে।
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন নিয়ে যেসব বক্তব্য দিচ্ছে তা মোটেও যথেষ্ট নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দেওয়ার গ্রহণযোগ্য যুক্তি, তথ্য-উপাত্ত ও ব্যাখ্যা আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে পারেনি, সাধারণ জনমনস্তত্ত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতি এক ধরনের অন্ধবিশ্বাস রয়েছে, আওয়ামী লীগ তা না কাটিয়ে যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছে, তাতে মানুষ মোটেও সন্তুষ্ট হচ্ছে না, বিশ্বাস করার পর্যায়ে নেই। এর ফলেও লাভবান হচ্ছে ১৮ দল, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট। বিষয়টি নিয়ে গত দুই বছর যেসব বাগ্বিতণ্ডা মিডিয়াসহ সর্বত্র চলছে, তাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান মোটেও হচ্ছে না; বরং নির্বাচনকালে কারচুপি করার কোনো অভিপ্রায় সরকারের রয়েছে, এমনটিই অটুট আছে, প্রচারিতও হচ্ছে। বাঙালির সন্দেহপ্রবণতা নতুন কিছু নয়। এটি দূর করা খুব সহজ কাজ নয়। আওয়ামী লীগদলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে স্বচ্ছ অবস্থানটি বারবার বলছে, তা কিন্তু এ দেশের সন্দেহপ্রবণ ভোটারদের একটি বড় অংশ আস্থায় নিচ্ছে না, বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ নিজে হয়তো দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবে; কিন্তু প্রতিপক্ষ দল সে ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি না দিলে আওয়ামী লীগের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হবে না, সেটি একপক্ষীয় হয়েই থাকবে। বিএনপি বা ১৮ দলীয় জোট ক্ষমতায় গিয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রতিশ্রুতি এ পর্যন্ত দেয়নি। তাদের কোনো শাসন আমলে তেমন রেকর্ড নেই। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগকে এককভাবে নয়, বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সম্মতিতে বা প্রতিশ্রুতিতে আসতে হবে, তবেই দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ধারা বহাল থাকবে। আপাতত দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ দ্বিধাবিভক্ত ও বিভ্রান্তিতে আছে। তেমন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ শুধু দশম জাতীয় সংসদ নয়, পরবর্তী নির্বাচনগুলোও অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, কার্যক্রম, অর্থায়ন, আইনি ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ও দক্ষতা উচ্চতর স্তরে নেওয়ার বিষয়গুলোও সিরিয়াসলি নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাতীয়ভাবে আমাদের নানা দুর্বলতা, ত্রুটি-বিচ্যুতি, সংকীর্ণতা, অবিমৃষ্যকারিতা, শঠতা, চাতুরীপনা, অন্ধভাবে পক্ষ নেওয়ার মানসিকতা রয়েছে। এসব কাটিয়ে না উঠতে পারলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত খুব একটা হবে না। আমাদের যেকোনো নির্বাচনব্যবস্থাই এখন নানা অবিশ্বাস্য নেতিবাচক বিশ্বাস, প্রচারণা ও কর্মকাণ্ডনির্ভর হয়ে উঠছে, ইতিবাচক বিষয়গুলো ভীষণ পরাজিত হচ্ছে। এর উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। নতুবা দেশের গণতন্ত্রের অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
No comments