টিআইবির কারসাজি? by আজিজুল পারভেজ ও নুরে আলম দুর্জয়
বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির পরিমাপক জরিপ
হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) যে 'গ্লোবাল করাপশন
ব্যারোমিটার' জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, এর সঙ্গে মিলছে না
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদন।
টিআইয়ের প্রতিবেদনে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে
রাজনৈতিক দলকে মনে করে যে ৫১টি দেশের মানুষ, সে তালিকায় বাংলাদেশের নাম
নেই। কিন্তু টিআইবির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও পুলিশ প্রশাসনকে
বাংলাদেশের মানুষ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে।
কালের কণ্ঠের কাছে টিআইবি দাবি করেছে, এটি উপস্থাপনাগত ত্রুটি। কিছু
'গ্যাপ'-এর কারণে উপস্থাপনায় এ তারতম্য হয়েছে। জরিপের পরিসংখ্যানগত কোনো
ত্রুটি নেই।
কিন্তু দেশের রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা এই ত্রুটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলকে খারাপ দেখানোর জন্যই উদ্দেশ্যমূলকভাবে টিআইবি এমন কাজ করেছে।
'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১৩' রিপোর্টটি মঙ্গলবার সারা বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে টিআই। ওই দিন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবেদনকে টিআইবি 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২' হিসেবে প্রকাশ করে। একই প্রতিবেদন দুই জায়গায় দুই সালের নামে প্রকাশ করাকেও টিআইবির পক্ষ থেকে যোগাযোগের 'গ্যাপ' বলে স্বীকার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠে 'টিআই-টিআইবির এ পার্থক্য কেন' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
টিআইয়ের গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ৫১টি দেশের মানুষ তাদের দেশের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু সেই ৫১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। সে তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, মালদ্বীপ ও নেপালের নাম রয়েছে। এই রিপোর্টে যে ৩৬টি দেশের মানুষ মনে করে যে পুলিশ হচ্ছে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত, সেসব দেশের তালিকায় অবশ্য বাংলাদেশের নাম রয়েছে। টিআইয়ের প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, ১২টি জনসম্পৃক্ত খাত বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পুলিশকে চিহ্নিত করেছে। পুলিশের পয়েন্ট মার্ক ৩.৯। এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিচার বিভাগ (৩.৫)। তৃতীয় স্থানে এসেছে রাজনৈতিক দল (৩.৪)। এরপর ক্রমানুসারে রয়েছে সংসদ/আইনসভা (৩.২), চিকিৎসা/স্বাস্থ্য (২.৯), পরিষেবা (২.৯), ব্যবসা/বেসরকারি খাত (২.৬), শিক্ষাব্যবস্থা (২.০), গণমাধ্যম (২.০), এনজিও (১.৭), সেনাবাহিনী (১.৫) এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (১.৫)।
টিআইবির গবেষণা পরিচালক রফিক হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, জরিপ পরিচালনাকালে একজন উত্তরদাতার কাছে ১২টি খাত বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়েছিল- নিচের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন? প্রতিটি খাত বা প্রতিষ্ঠানের পাশে পাঁচটি উত্তর ছিল। ১. একেবারেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, ২. কম দুর্নীতিগ্রস্ত, ৩. দুর্নীতিগ্রস্ত, ৪. বেশ দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ৫. খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত। রফিক হাসান বলেন, টিআইবি ২ থেকে ৫ পর্যন্ত উত্তরকে একসঙ্গে যোগফল করে দেখিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও পুলিশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু টিআই তাদের রিপোর্টে ৪ ও ৫ নম্বর উত্তরকে যোগ করে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত যারা, তাদেরই শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে। এতে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বাংলাদেশে কেবল পুলিশের নাম এসেছে।
উপস্থাপনাগত এই ত্রুটির বিষয়টি সম্পর্কে টিআইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে টিআইবির পক্ষ থেকে গতকালই ই-মেইল পাঠানো হয়েছে বলে রফিক হাসান জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'দুই প্রতিবেদনে যে তারতম্য দেখা গেছে, তা টেকনিক্যাল সমস্যা। আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করিনি। বাংলাদেশের মানুষ যে মতামত দিয়েছে, আমরা কেবল তা-ই প্রকাশ করেছি। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতার কথা বলি। আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী হোক। তাতে আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।'
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঠিক একই রকম কাণ্ড করেছিল টিআইবি। এখন আবার নির্বাচন সামনে রেখে এটা করল। রাজনীতি খারাপ, তৃতীয় শক্তি আসুক- এ উদ্দেশ্য নিয়েই এরা এই কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, 'বিদেশের টাকায় গবেষণা করে যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তাদের সততা ও নৈতিকতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।'
টিআইবির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যে প্রতিবেদন টিআইবি দিয়েছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টিআইবি যে জরিপ করেছে সেটা সম্পর্কেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জরিপের নমুনায়ন নিয়ে এবং কারা জরিপে অংশ নিয়েছে সে বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির যে দলেরই হোক, একজন প্রতিনিধি সাধারণ মানুষের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁদের অনেক ভূমিকাও আছে। এভাবে ঢালাও দোষারোপ করা মোটেও ঠিক হয়নি।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'টিআইয়ের মূল রিপোর্টের সঙ্গে টিআইবির রিপোর্টের অসংগতি থাকলে তার ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে। এমনিতেই তাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব বিষয়ের অধিকতর তদন্ত হওয়া উচিত।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের রিপোর্টে মিল থাকা উচিত। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে টিআইবি এটা করেছে, তারাই তা ভালো জানে। টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তারা জরিপ সংস্থা হয়ে থাকলে আরো ব্যাপকতর জরিপ করা উচিত। মাত্র এক হাজার ৮০০ জনের মতামত নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।'
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, টিআইবি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলকে কেন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাল এটা খতিয়ে দেখা উচিত। রাজনৈতিক দলকে এভাবে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা উচিত। রাজনীতি নিয়ে যাদের প্রশ্ন করেছে তারা কারা, তারা রাজনীতিবিদ্বেষী কি না এটা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি আরো বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সেসব দলের নেতৃত্বে যাঁরা সরকার পরিচালনা করেন, তাঁদের মধ্যে দুর্নীতি নেই সেটা আমি বলব না। কমবেশি দুর্নীতি সবখানেই থাকে।'
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, টিআইবি ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে তারাই দায়ী থাকবে। এ জন্য তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে।
বার্লিনভিত্তিক টিআই ১০৭টি দেশের এক লাখ ১৪ হাজার ২৭০ জনের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর এই জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বয়সের এক হাজার ৮২২ জন তথ্যদাতার কাছ থেকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের (বৈশ্বিক) ধারণা এবং বাংলাদেশের মানুষের ধারণার চিত্র তুলে ধরা হয়।
মঙ্গলবার প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদনে দুর্নীতির শীর্ষ খাত বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ মানুষের মতানুযায়ী রাজনৈতিক দল আর পুলিশ প্রশাসন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। একই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিকে উদ্বেগজনক মনে করে বৈশ্বিকভাবে ৬৫ শতাংশ মানুষ আর বাংলাদেশে উদ্বেগজনক মনে করেছে ৪৫ শতাংশ মানুষ।
প্রতিবেদন চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় : টিআইবির 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' জরিপ প্রতিবেদনের পূর্ণাঙ্গ কপি চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার বিকেলে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার প্রকাশিত 'হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ এর সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন' শীর্ষক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনও তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
টিআইবির লিখিত ব্যাখ্যা : গতরাত ৯টা ৩৯ মিনিটে টিআইবি প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে 'বাংলাদেশ সংক্রান্ত টিআইবির তথ্য সঠিক' বলে দাবি করা হয়েছে। টিআইবি প্রকাশিত 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' বাংলাদেশ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে টিআইয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের আপাতদৃষ্টিতে বৈসাদৃশ্য রয়েছে বলে মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, উপস্থাপনার কারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে টিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং বিষয়টি তারা অনতিবিলম্বে সংশোধন করার ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি টিআইবি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
কিন্তু দেশের রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ ও বুদ্ধিজীবীরা এই ত্রুটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলকে খারাপ দেখানোর জন্যই উদ্দেশ্যমূলকভাবে টিআইবি এমন কাজ করেছে।
'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১৩' রিপোর্টটি মঙ্গলবার সারা বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে টিআই। ওই দিন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবেদনকে টিআইবি 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১২' হিসেবে প্রকাশ করে। একই প্রতিবেদন দুই জায়গায় দুই সালের নামে প্রকাশ করাকেও টিআইবির পক্ষ থেকে যোগাযোগের 'গ্যাপ' বলে স্বীকার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠে 'টিআই-টিআইবির এ পার্থক্য কেন' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
টিআইয়ের গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-২০১৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে দেখা যায়, ৫১টি দেশের মানুষ তাদের দেশের চরম দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাজনৈতিক দলের কথা উল্লেখ করেছে। কিন্তু সেই ৫১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। সে তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, মালদ্বীপ ও নেপালের নাম রয়েছে। এই রিপোর্টে যে ৩৬টি দেশের মানুষ মনে করে যে পুলিশ হচ্ছে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত, সেসব দেশের তালিকায় অবশ্য বাংলাদেশের নাম রয়েছে। টিআইয়ের প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, ১২টি জনসম্পৃক্ত খাত বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে পুলিশকে চিহ্নিত করেছে। পুলিশের পয়েন্ট মার্ক ৩.৯। এ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বিচার বিভাগ (৩.৫)। তৃতীয় স্থানে এসেছে রাজনৈতিক দল (৩.৪)। এরপর ক্রমানুসারে রয়েছে সংসদ/আইনসভা (৩.২), চিকিৎসা/স্বাস্থ্য (২.৯), পরিষেবা (২.৯), ব্যবসা/বেসরকারি খাত (২.৬), শিক্ষাব্যবস্থা (২.০), গণমাধ্যম (২.০), এনজিও (১.৭), সেনাবাহিনী (১.৫) এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান (১.৫)।
টিআইবির গবেষণা পরিচালক রফিক হাসান কালের কণ্ঠকে জানান, জরিপ পরিচালনাকালে একজন উত্তরদাতার কাছে ১২টি খাত বা প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে জানতে চাওয়া হয়েছিল- নিচের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত মনে করেন? প্রতিটি খাত বা প্রতিষ্ঠানের পাশে পাঁচটি উত্তর ছিল। ১. একেবারেই দুর্নীতিগ্রস্ত নয়, ২. কম দুর্নীতিগ্রস্ত, ৩. দুর্নীতিগ্রস্ত, ৪. বেশ দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ৫. খুবই দুর্নীতিগ্রস্ত। রফিক হাসান বলেন, টিআইবি ২ থেকে ৫ পর্যন্ত উত্তরকে একসঙ্গে যোগফল করে দেখিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল ও পুলিশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু টিআই তাদের রিপোর্টে ৪ ও ৫ নম্বর উত্তরকে যোগ করে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত যারা, তাদেরই শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে। এতে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে বাংলাদেশে কেবল পুলিশের নাম এসেছে।
উপস্থাপনাগত এই ত্রুটির বিষয়টি সম্পর্কে টিআইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে টিআইবির পক্ষ থেকে গতকালই ই-মেইল পাঠানো হয়েছে বলে রফিক হাসান জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের কাছে জানতে চাওয়া হলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, 'দুই প্রতিবেদনে যে তারতম্য দেখা গেছে, তা টেকনিক্যাল সমস্যা। আমরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু করিনি। বাংলাদেশের মানুষ যে মতামত দিয়েছে, আমরা কেবল তা-ই প্রকাশ করেছি। আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতার কথা বলি। আমরা চাই রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী হোক। তাতে আমাদের গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে।'
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ঠিক একই রকম কাণ্ড করেছিল টিআইবি। এখন আবার নির্বাচন সামনে রেখে এটা করল। রাজনীতি খারাপ, তৃতীয় শক্তি আসুক- এ উদ্দেশ্য নিয়েই এরা এই কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, 'বিদেশের টাকায় গবেষণা করে যারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে তাদের সততা ও নৈতিকতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।'
টিআইবির প্রতিবেদন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল সম্পর্কে যে প্রতিবেদন টিআইবি দিয়েছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। টিআইবি যে জরিপ করেছে সেটা সম্পর্কেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। জরিপের নমুনায়ন নিয়ে এবং কারা জরিপে অংশ নিয়েছে সে বিষয়টিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির যে দলেরই হোক, একজন প্রতিনিধি সাধারণ মানুষের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তাঁদের অনেক ভূমিকাও আছে। এভাবে ঢালাও দোষারোপ করা মোটেও ঠিক হয়নি।'
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'টিআইয়ের মূল রিপোর্টের সঙ্গে টিআইবির রিপোর্টের অসংগতি থাকলে তার ব্যাখ্যা তাদের দিতে হবে। এমনিতেই তাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব বিষয়ের অধিকতর তদন্ত হওয়া উচিত।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, 'টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের রিপোর্টে মিল থাকা উচিত। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে টিআইবি এটা করেছে, তারাই তা ভালো জানে। টিআইবির রিপোর্ট নিয়ে এর আগেও বিতর্ক হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তারা জরিপ সংস্থা হয়ে থাকলে আরো ব্যাপকতর জরিপ করা উচিত। মাত্র এক হাজার ৮০০ জনের মতামত নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের ওপর তা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।'
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, টিআইবি বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলকে কেন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাল এটা খতিয়ে দেখা উচিত। রাজনৈতিক দলকে এভাবে উপস্থাপন করার উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখা উচিত। রাজনীতি নিয়ে যাদের প্রশ্ন করেছে তারা কারা, তারা রাজনীতিবিদ্বেষী কি না এটা স্পষ্ট করতে হবে। তিনি আরো বলেন, 'বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সেসব দলের নেতৃত্বে যাঁরা সরকার পরিচালনা করেন, তাঁদের মধ্যে দুর্নীতি নেই সেটা আমি বলব না। কমবেশি দুর্নীতি সবখানেই থাকে।'
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ারের মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, টিআইবি ভুল তথ্য দিয়ে থাকলে তারাই দায়ী থাকবে। এ জন্য তাদের ব্যাখ্যা দিতে হবে।
বার্লিনভিত্তিক টিআই ১০৭টি দেশের এক লাখ ১৪ হাজার ২৭০ জনের ধারণা ও অভিজ্ঞতার ওপর এই জরিপ পরিচালনা করে। বাংলাদেশে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা-বয়সের এক হাজার ৮২২ জন তথ্যদাতার কাছ থেকে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে তথ্য সংগৃহীত হয়। এর ভিত্তিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের (বৈশ্বিক) ধারণা এবং বাংলাদেশের মানুষের ধারণার চিত্র তুলে ধরা হয়।
মঙ্গলবার প্রকাশিত টিআইবির প্রতিবেদনে দুর্নীতির শীর্ষ খাত বা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ মানুষের মতানুযায়ী রাজনৈতিক দল আর পুলিশ প্রশাসন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। একই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, রাজনৈতিক দলের দুর্নীতিকে উদ্বেগজনক মনে করে বৈশ্বিকভাবে ৬৫ শতাংশ মানুষ আর বাংলাদেশে উদ্বেগজনক মনে করেছে ৪৫ শতাংশ মানুষ।
প্রতিবেদন চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয় : টিআইবির 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' জরিপ প্রতিবেদনের পূর্ণাঙ্গ কপি চেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার বিকেলে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার প্রকাশিত 'হেফাজতে ইসলাম, বাংলাদেশ এর সমাবেশ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন' শীর্ষক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনও তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
টিআইবির লিখিত ব্যাখ্যা : গতরাত ৯টা ৩৯ মিনিটে টিআইবি প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে 'বাংলাদেশ সংক্রান্ত টিআইবির তথ্য সঠিক' বলে দাবি করা হয়েছে। টিআইবি প্রকাশিত 'গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার ২০১২' বাংলাদেশ প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যের সঙ্গে টিআইয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যের আপাতদৃষ্টিতে বৈসাদৃশ্য রয়েছে বলে মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, উপস্থাপনার কারণে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে টিআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে এবং বিষয়টি তারা অনতিবিলম্বে সংশোধন করার ব্যবস্থা করবে বলে জানিয়েছে। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য সংবাদমাধ্যমের প্রতি টিআইবি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।
No comments