বাংলাদেশে ফার্ম-ডির ভবিষ্যৎ by মোহাম্মদ নুরুন্নবী ও এসএম নাসির উদ্দিন
১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম চালু
হয় ডিপার্টমেন্ট অব ফার্মেসি এবং ১৯৯৫ সালে এটিকে পূর্ণাঙ্গ অনুষদে উন্নীত
করা হয়। আক্ষরিক অর্থেই একটা সময় ছিল যখন ফার্মেসি থেকে সাধারণ অনার্স পাস
করা মানে আমেরিকায় যাওয়া নিশ্চিত।
সেই সময়ে যারা
ফার্মেসিতে পড়াশোনা করেছেন তাদের ৯০ শতাংশেরও বেশি এখন আমেরিকা, কানাডা,
অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যে। গড়ে ওঠে বাপা (বাংলাদেশি-আমেরিকান
ফার্মাসিস্ট অ্যাসোসিয়েশন)-আমেরিকার রিটেইল, ক্লিনিক, হসপিটালে বাংলাদেশি
ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। মধ্যপ্রাচ্যেও রিটেইল, ক্লিনিক,
হসপিটালে বাংলাদেশি ফার্মাসিস্টদের ভালো প্রভাব ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান এবং তার পরের বাংলাদেশে ওষুধের উৎস বলতে বহুজাতিক কোম্পানি ও হাতেগোনা দু'একটি দেশীয় কোম্পানিই সম্বল ছিল। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় ন্যাশনাল ড্রাগ অ্যাক্ট বা জাতীয় ওষুধ নীতি আর এর সঙ্গেই শুরু হয় দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর অগ্রযাত্রা এবং সে সঙ্গে হ্রাস পেতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য। রাতারাতি গড়ে ওঠে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। দেশীয় অবকাঠামোয় ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়। গত শতাব্দীর শেষ দশককে বলা যায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিকশিত হওয়ার দশক। তখন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কার্যকরী সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনে এক উজ্জ্বল ভূমিকার স্বাক্ষর রাখে। প্রায় ৯৭% জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এখন দেশেই উৎপাদন হয়। এছাড়াও এই শিল্পকে কেন্দ্র করে অনেক ছোটখাটো শিল্প বিকশিত হয়েছে, হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং সর্বোপরি আমরা মোটামুটিভাবে ওষুধ উৎপাদনে নিজেদের স্বয়ংসম্পন্ন দাবি করতে পারছি। আর পেশাজীবী হিসেবে এই শিল্প বিকাশে যারা সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন ফার্মাসিস্ট। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ফার্মেসি শিক্ষার ওপর জোর দেয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক শিক্ষাক্রম চালু আছে এবং এসব বিদ্যাপীঠ থেকে বছরে প্রায় ২০০০ শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করছেন। দুঃখজনক একটি সত্য হচ্ছে, গত এক দশকে যেভাবে ফার্মেসি শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, ঠিক সেভাবে এ পেশার চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হয়নি। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে এই পেশাজীবীদের ঠাঁই হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ৮টি সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কৌশলগত আর পেশাগত রেষারেষির জের ধরে এই সিদ্ধান্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
ফার্মাসিস্ট এবং এই পেশা নিয়ে শুরু থেকে আন্দোলন করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। এখন এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, দেশে দু'ধরনের কোর্স চালু থাকতে পারে; ৪ বছরের ফার্মেসি এবং ৫-৬ বছরের ফার্ম-ডি। যারা পাস করে দেশেই চাকরি করতে চান তারা ৪ বছরের ফার্মেসি করবেন আর যারা উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য উন্নত দেশগুলোতে যাবেন তারা ফার্ম-ডি কোর্সে ভর্তি হবেন। ২০০৭ সালের শেষ দিকে পিজিএ (ফার্মাসিস্ট গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন) নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে। সেই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন কিছু সিনিয়র বাংলাদেশি ফার্মাসিস্ট, যারা আমেরিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মালিক, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা. দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়ানো হয় সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান বা ডিন, ইউজিসির প্রতিনিধি। আলোচনা শেষে ইউজিসিতে ফার্ম-ডি কোর্স চালুর জন্য অনুমতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।
এরপর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনেকবার আবেদন করেছে, ইউজিসি ইন্সপেকশন করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই ফার্ম-ডি চালুর অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই পেশার সঙ্গে জড়িত অনেকের আশা ছিল বর্তমান ইউজিসির চেয়ারম্যান এ বিষয়ের একটা সমাধান দেবেন। কেননা তিনি নিজেও একজন ফার্মাসিস্ট। ইউজিসি একটি সরকারি সংস্থা, যাদের কাজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অনুমতি দেওয়া, সঠিকভাবে কাজ চলছে কি-না তদারক করা, নতুন বিভাগ খুলতে চাইলে সবকিছু যাচাই করে অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়া, কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে না চললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
এর মাঝেই আমরা দেখছি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনের ১০% সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও বহাল তবিয়তে চলছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক বা অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকলেও অনেক বিভাগ খোলা হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ২-৩ জন লেকচারার দিয়ে একটা পুরো বিভাগ চলছে। অন্যথায় বছরে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাত উচ্চশিক্ষার জন্য। আমাদের মধ্যম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও নিচু মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হতো সেই হাজারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবি, জাবি, রাবি, খুবিতেই আগে ফার্মেসি পড়ানো হতো। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে প্রথম দিকে ফার্মেসি পড়ানো শুরু করে এশিয়া প্যাসিফিক এবং ইউএসটিসি, তারপর ইউডা, ইস্ট-ওয়েস্ট, স্টামফোর্ড, নর্থ-সাউথ; এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় ২০টিরও বেশি এবং এর মাঝে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক অনেক ভালো।
সঙ্গত কারণেই ইউজিসির সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন আসে, যখন তারা ঢাবির ফার্মেসি বিভাগকেও ফার্ম-ডি চালু করার অনুমতি দেয় না। যে অনুষদে আছেন কয়েক ডজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক, খ্যাতনামা গবেষক, বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। গবেষণার সুবিধাও আপেক্ষিকভাবেই ভালো। এছাড়া জাবি, রাবি এবং খুবিতেও অনেক নামকরা ও খ্যাতনামা গবেষক- শিক্ষক রয়েছেন। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গেলেও দেখা যায় বেশ কিছু খ্যাতনামা শিক্ষক ও গবেষক আছেন সেই বিভাগে। এত কিছুর পরও যখন ইউজিসি ফার্ম-ডি চালুর অনুমতি প্রদানে গড়িমসি করে তখন স্বভাবতই বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়।
গত কয়েক বছরে ফার্ম-ডি কোর্স চালু না হওয়ার কারণে আমাদের দেশের ফার্মাসিস্টরা উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত বিশ্বের চাকরির বাজারে প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা এমনকি স্কলারশিপ প্রোগ্রামেও আবেদন করতে পারছে না ক্ষেত্রবিশেষে। আমেরিকা-কানাডার পাশাপাশি জাপান-কোরিয়াতেও ফার্মাসিস্টদের উচ্চশিক্ষার পথ সংকুচিত বা একেবারেই বন্ধ। সে সঙ্গে দেশের ওষুধ শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের পথে এসেছে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এফডিএ অনুমোদিত ওষুধ কারখানা একটিও নেই। এখন পর্যন্ত একটিও নতুন মলিকুল আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি, যাকে আমরা নিজেদের সম্পদ হিসেবে দাবি করতে পারি।
আমরা জানি, দু'একটি নয়, শত শত প্রতিকূলতা রয়েছে। শিক্ষক সংকট, অপর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু জটিল বিষয় পড়ানো হয়, যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও ক্ষেত্রবিশেষে পাওয়া কঠিন। ফার্মেসিতেই একটা কোর্স ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি, আরেকটা বিষয় আছে হসপিটাল ফার্মেসি, আরেকটা বিষয় আছে ড্রাগ ডিজাইন। এ রকম আরও কিছু জটিল বিষয় আছে, যার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক পুরো দেশেই হাতেগোনা কয়েকজন। তাই বলে কি এ বিষয়গুলো আমরা পড়ব না বা পড়ানো হচ্ছে না? নাকি প্রতি বছর শত শত ফার্মাসিস্ট আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে না? শুধু ইউজিসি এবং ফার্মেসি কাউন্সিলের গোঁড়ামির জন্য প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে তাদের স্বপ্ন পূরণে। ফার্মেসি কাউন্সিলে এ জন্য গত ৬-৭ বছর ফার্মাসিস্টরা নিবন্ধন করাতে পারছেন না। আমরা বিশ্বাস করি, রোগ হলে তার চিকিৎসাটা জরুরি, কিন্তু রোগের ভয়ে সব কাজ ফেলে রাখাটাও নিরেট নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমরা আশাবাদী হতে চাই, আমরা চাই ইউজিসির সুমতি হোক, সুমতি হোক ফার্মেসি কাউন্সিলের। বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, চিকিৎসক, মন্ত্রণালয় আর সরকারের হস্তক্ষেপেই সব জটিলতা কেটে যাক।
মোহাম্মদ নুরুন্নবী :ফার্মাসিস্ট এবং গবেষক ক্যান্সার ন্যানো প্রযুক্তি, দক্ষিণ কোরিয়া
mnurunnabi@gmail.com
এসএম নাসির উদ্দিন : ফার্মাসিস্ট এবং গবেষক, নিউক্লিয়ার মেডিসিন
দক্ষিণ কোরিয়া
smnasir85@gmail.com
পূর্ব পাকিস্তান এবং তার পরের বাংলাদেশে ওষুধের উৎস বলতে বহুজাতিক কোম্পানি ও হাতেগোনা দু'একটি দেশীয় কোম্পানিই সম্বল ছিল। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য ছিল একচেটিয়া। ১৯৮২ সালে প্রণীত হয় ন্যাশনাল ড্রাগ অ্যাক্ট বা জাতীয় ওষুধ নীতি আর এর সঙ্গেই শুরু হয় দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর অগ্রযাত্রা এবং সে সঙ্গে হ্রাস পেতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আধিপত্য। রাতারাতি গড়ে ওঠে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি। দেশীয় অবকাঠামোয় ওষুধ উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত এক সুবিশাল কর্মযজ্ঞের সূচনা হয়। গত শতাব্দীর শেষ দশককে বলা যায় বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প বিকশিত হওয়ার দশক। তখন থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ কার্যকরী সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনে এক উজ্জ্বল ভূমিকার স্বাক্ষর রাখে। প্রায় ৯৭% জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এখন দেশেই উৎপাদন হয়। এছাড়াও এই শিল্পকে কেন্দ্র করে অনেক ছোটখাটো শিল্প বিকশিত হয়েছে, হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং সর্বোপরি আমরা মোটামুটিভাবে ওষুধ উৎপাদনে নিজেদের স্বয়ংসম্পন্ন দাবি করতে পারছি। আর পেশাজীবী হিসেবে এই শিল্প বিকাশে যারা সবচেয়ে অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন ফার্মাসিস্ট। এ কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ফার্মেসি শিক্ষার ওপর জোর দেয়। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক শিক্ষাক্রম চালু আছে এবং এসব বিদ্যাপীঠ থেকে বছরে প্রায় ২০০০ শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করছেন। দুঃখজনক একটি সত্য হচ্ছে, গত এক দশকে যেভাবে ফার্মেসি শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, ঠিক সেভাবে এ পেশার চাকরির বাজার সম্প্রসারিত হয়নি। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে এই পেশাজীবীদের ঠাঁই হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেশ কয়েক বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ৮টি সরকারি হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কৌশলগত আর পেশাগত রেষারেষির জের ধরে এই সিদ্ধান্ত আর আলোর মুখ দেখেনি।
ফার্মাসিস্ট এবং এই পেশা নিয়ে শুরু থেকে আন্দোলন করে আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। এখন এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, দেশে দু'ধরনের কোর্স চালু থাকতে পারে; ৪ বছরের ফার্মেসি এবং ৫-৬ বছরের ফার্ম-ডি। যারা পাস করে দেশেই চাকরি করতে চান তারা ৪ বছরের ফার্মেসি করবেন আর যারা উচ্চশিক্ষা বা চাকরির জন্য উন্নত দেশগুলোতে যাবেন তারা ফার্ম-ডি কোর্সে ভর্তি হবেন। ২০০৭ সালের শেষ দিকে পিজিএ (ফার্মাসিস্ট গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশন) নিয়ে সেমিনার আয়োজন করে। সেই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন কিছু সিনিয়র বাংলাদেশি ফার্মাসিস্ট, যারা আমেরিকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মালিক, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা. দেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি পড়ানো হয় সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান বা ডিন, ইউজিসির প্রতিনিধি। আলোচনা শেষে ইউজিসিতে ফার্ম-ডি কোর্স চালুর জন্য অনুমতি দেওয়ার আবেদন করা হয়।
এরপর অনেক বিশ্ববিদ্যালয় অনেকবার আবেদন করেছে, ইউজিসি ইন্সপেকশন করেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কেই ফার্ম-ডি চালুর অনুমতি দেওয়া হয়নি। এই পেশার সঙ্গে জড়িত অনেকের আশা ছিল বর্তমান ইউজিসির চেয়ারম্যান এ বিষয়ের একটা সমাধান দেবেন। কেননা তিনি নিজেও একজন ফার্মাসিস্ট। ইউজিসি একটি সরকারি সংস্থা, যাদের কাজ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে অনুমতি দেওয়া, সঠিকভাবে কাজ চলছে কি-না তদারক করা, নতুন বিভাগ খুলতে চাইলে সবকিছু যাচাই করে অনুমতি দেওয়া বা না দেওয়া, কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে না চললে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
এর মাঝেই আমরা দেখছি, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনের ১০% সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও বহাল তবিয়তে চলছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষক বা অভিজ্ঞ শিক্ষক না থাকলেও অনেক বিভাগ খোলা হচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ২-৩ জন লেকচারার দিয়ে একটা পুরো বিভাগ চলছে। অন্যথায় বছরে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাত উচ্চশিক্ষার জন্য। আমাদের মধ্যম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও নিচু মানের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হতো সেই হাজারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাবি, জাবি, রাবি, খুবিতেই আগে ফার্মেসি পড়ানো হতো। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে প্রথম দিকে ফার্মেসি পড়ানো শুরু করে এশিয়া প্যাসিফিক এবং ইউএসটিসি, তারপর ইউডা, ইস্ট-ওয়েস্ট, স্টামফোর্ড, নর্থ-সাউথ; এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় ২০টিরও বেশি এবং এর মাঝে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক অনেক ভালো।
সঙ্গত কারণেই ইউজিসির সার্বিক কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন আসে, যখন তারা ঢাবির ফার্মেসি বিভাগকেও ফার্ম-ডি চালু করার অনুমতি দেয় না। যে অনুষদে আছেন কয়েক ডজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী শিক্ষক, খ্যাতনামা গবেষক, বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিধারী। গবেষণার সুবিধাও আপেক্ষিকভাবেই ভালো। এছাড়া জাবি, রাবি এবং খুবিতেও অনেক নামকরা ও খ্যাতনামা গবেষক- শিক্ষক রয়েছেন। নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গেলেও দেখা যায় বেশ কিছু খ্যাতনামা শিক্ষক ও গবেষক আছেন সেই বিভাগে। এত কিছুর পরও যখন ইউজিসি ফার্ম-ডি চালুর অনুমতি প্রদানে গড়িমসি করে তখন স্বভাবতই বিভিন্ন প্রশ্নের উদয় হয়।
গত কয়েক বছরে ফার্ম-ডি কোর্স চালু না হওয়ার কারণে আমাদের দেশের ফার্মাসিস্টরা উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত বিশ্বের চাকরির বাজারে প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন। আমাদের ছেলেমেয়েরা এমনকি স্কলারশিপ প্রোগ্রামেও আবেদন করতে পারছে না ক্ষেত্রবিশেষে। আমেরিকা-কানাডার পাশাপাশি জাপান-কোরিয়াতেও ফার্মাসিস্টদের উচ্চশিক্ষার পথ সংকুচিত বা একেবারেই বন্ধ। সে সঙ্গে দেশের ওষুধ শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের পথে এসেছে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এফডিএ অনুমোদিত ওষুধ কারখানা একটিও নেই। এখন পর্যন্ত একটিও নতুন মলিকুল আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি, যাকে আমরা নিজেদের সম্পদ হিসেবে দাবি করতে পারি।
আমরা জানি, দু'একটি নয়, শত শত প্রতিকূলতা রয়েছে। শিক্ষক সংকট, অপর্যাপ্ত ল্যাব সুবিধা, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কিছু জটিল বিষয় পড়ানো হয়, যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ শিক্ষকও ক্ষেত্রবিশেষে পাওয়া কঠিন। ফার্মেসিতেই একটা কোর্স ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি, আরেকটা বিষয় আছে হসপিটাল ফার্মেসি, আরেকটা বিষয় আছে ড্রাগ ডিজাইন। এ রকম আরও কিছু জটিল বিষয় আছে, যার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক পুরো দেশেই হাতেগোনা কয়েকজন। তাই বলে কি এ বিষয়গুলো আমরা পড়ব না বা পড়ানো হচ্ছে না? নাকি প্রতি বছর শত শত ফার্মাসিস্ট আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে না? শুধু ইউজিসি এবং ফার্মেসি কাউন্সিলের গোঁড়ামির জন্য প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী বঞ্চিত হচ্ছে তাদের স্বপ্ন পূরণে। ফার্মেসি কাউন্সিলে এ জন্য গত ৬-৭ বছর ফার্মাসিস্টরা নিবন্ধন করাতে পারছেন না। আমরা বিশ্বাস করি, রোগ হলে তার চিকিৎসাটা জরুরি, কিন্তু রোগের ভয়ে সব কাজ ফেলে রাখাটাও নিরেট নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমরা আশাবাদী হতে চাই, আমরা চাই ইউজিসির সুমতি হোক, সুমতি হোক ফার্মেসি কাউন্সিলের। বিশেষজ্ঞ শিক্ষক, চিকিৎসক, মন্ত্রণালয় আর সরকারের হস্তক্ষেপেই সব জটিলতা কেটে যাক।
মোহাম্মদ নুরুন্নবী :ফার্মাসিস্ট এবং গবেষক ক্যান্সার ন্যানো প্রযুক্তি, দক্ষিণ কোরিয়া
mnurunnabi@gmail.com
এসএম নাসির উদ্দিন : ফার্মাসিস্ট এবং গবেষক, নিউক্লিয়ার মেডিসিন
দক্ষিণ কোরিয়া
smnasir85@gmail.com
No comments