ব্রিটেনে স্টুডেন্ট ভিসা বন্ধের নেপথ্যে নির্বাচন by শফিকুল ইসলাম জীবন
স্টুডেন্ট ভিসাকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে কি
ঘটছে, নেপথ্য কারণগুলোই বা কী? ব্রিটেনে বাংলাদেশী শিার্থীদের ভিসা বন্ধের
সিদ্ধানত্মে দেশে বিদেশে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক চাঞ্চল্য।
ইউকে বর্ডার এজেন্সি সূত্র জানিয়েছে আপাতত বাংলাদেশী ছাত্রদের ভিসা আবেদন
গ্রহণ করা না হলেও ব্রিটেনে অবস্থানকারী বর্তমান ছাত্র সমাজের ওপর এর কোন
প্রভাব পড়বে না। তাছাড়া ১ জানুয়ারির আগে যারা স্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে গেছে
তারাও নির্বিঘ্নে ব্রিটেনে যেতে পারবে।
স্টুডেন্ট ভিসাকে কেন্দ্র করে স্বপ্নের ব্রিটেনে সৃষ্টি হয়েছে একটি অমানবিক অধ্যায়। যার চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্রিটিশ প্রশাসন। রাজস্ব আয়ের একটি লাভজনক খাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের আর কিছু করার ছিল না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ব্রিটেন গেলেও ছাত্রদের কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ব্রিটিশ সরকার। ফলে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রণশীল ও বিরোধী দলগুলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। যার পরবতর্ীতে ব্রিটিশ সরকার সাময়িকভাবে বাংলাদেশসহ এশীয় তিনটি দেশের স্টুডেন্ট ভিসা স্থগিত করেছে। ব্রিটেনে জুন মাসে নির্বাচনের আগে এটি প্রত্যাহারের সম্ভাবনা কম।
লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপল আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব স্টেশনের সামনে ইদানীং বাংলাদেশী কিছু শিার্থীর জটলা দেখলে, ঢাকার বাংলামোটর মোড়ে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত কিছু ুধার্ত মানুষের মলিন মুখের কথা মনে পড়ে। দিনের পর দিন গোসল নেই, খাওয়া নেই। এরা সদ্য বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসা। পূর্ব লন্ডনের এই এলাকাটি মূলত বাংলাদেশী অধু্যষিত। বাংলাদেশ থেকে আসা হিথ্রো কিংবা গ্যাটউইক বিমান বন্দর থেকে বেশিরভাগ শিার্থী প্রথমদিনেই চলে আসে এই এলাকাটিতে। বলা যায় হোয়াইট চ্যাপল বাংলাদেশী নতুন ছাত্রদের মিলনস্থল।
গত সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যনত্ম বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে স্টুডেন্ট ভিসায় গেছে প্রায় চলিস্নশ হাজার। এদের আশি ভাগ এখনও বেকার। এখনও কোন কাজের সন্ধান হয়নি। চুলগুলো উসকোখুসকো। বৈরী আবহাওয়ায় মসৃণ ত্বক আর ঠোঁটে চিড় ধরেছে। তারওপর ভরা শীতের মৌসুম। হঠাৎ হঠাৎ তাপমাত্রা নামে মাইনাস টু-তে। হিমেল তুষারপাতে সাদা হয়ে যায় আপাদমসত্মক। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় একেকটি বুলেট। সবার ঘাড়ে একটি করে ব্যাগ। শীতে থর থর করে কাঁপছে কেউ কেউ। কোথায় যাবে, কোন্দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারে না কিছুই। মাইলের পর মাইল হেঁটে দোকানে দোকানে ঘুরেও একটি কাজ জুটছে না।
এখনও অনেকের থাকার জায়গাটা ঠিক হয়নি। তাই কাউকে কাউকে দেখা যায় কিছু বাঙালী দোকানের কাঁচের জানালায় ভিড় করতে। এ জানালাগুলোয় হাতে লিখে বাসাভাড়ার বিজ্ঞাপন সাঁটা হয়। একটি ছোট রম্নমের সাপ্তাহিক ভাড়া ৯০ থেকে ১৪০ পাউন্ড। একটি সিঙ্গেল সিট নিতে হলে সপ্তাহে লাগে ইউটিলিটিসহ কমপ ে৫০ পাউন্ড। কোন একক ছাত্রের প েএকটি রম্নম ভাড়া নিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তাই তিন চারজন মিলে একটি রম্নম নিতে দেখা যায়। যা ব্রিটেন স্বাস্থ্যনীতির পরিপন্থী। জানুয়ারি থেকে লন্ডন ট্রান্সপোর্টের ভাড়া বিশ শতাংশ বেড়েছে। সাপ্তাহিক বাসপাস কিনতে এখন লাগছে ১৪ পাউন্ড আশি পেন্স। লন্ডন ট্রান্সপোর্টে ছাত্ররা ত্রিশ ভাগ ছাড় পায়।
সেন্ট্রাল লন্ডনের এখন যে যানজট পরিস্থিতি তাতে বাসে কাজে কিংবা গনত্মব্যে পেঁৗছুতে দশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগে এক ঘণ্টা। ফলে আন্ডারগ্রাউন্ড টিউবের বিকল্প নেই। টিউব ভাড়া আরও বেশি কয়েকগুণ। ফলে অনেকের প েটিউবে যাতায়াত করা দুরূহ। রান্না করে খেলে একজন বাংলাদেশী ছাত্রের লাগে পনেরো পাউন্ড। সব মিলে প্রতি মাসে খরচ পড়ে নিদেনপ ে৪০০ পাউন্ড_যা বাংলাদেশী টাকায় এখন প্রায় পঁয়তালিশ হাজার টাকা। এই টাকা দেশ থেকে কোন ছাত্র নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। আমি দেখেছি সরকারের অনেক বড় আমলা কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছেলেমেয়েকেও ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, বার্গার কিংয়ের মতো চেইন রেস্টুরেন্টগুলোতে ফোর পরিষ্কার করতে। লন্ডনের চেন স্টোরগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ফ্যাশন শপ, টেসকো, আসডা, সেইন্সবারি, সমারফিল্ডের একটি পার্টটাইম জবকে আমাদের ছেলেমেয়েরা সম্মানের মনে করে। ইদানীং সিকিউরিটি গার্ডের দিকে ঝুঁকছে অনেকে_কারণ কোন প্রতিষ্ঠানে এই পদে কাজ করলে অনেক বেশি ঘণ্টা পাওয়া যায়। লন্ডনে যতো ঘণ্টা কাজ করা যায় সে হারে আয়ও হয় বেশি। একটি স্টোরে প্রতিদিন আট ঘণ্টার শিপ্ট হলে সিকিউরিটি পদে পাওয়া যায় বারো থেকে ষোল ঘন্টার শিপ্ট। হলিডে ছাড়া কোন ছাত্রের সপ্তায় বিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করার সুযোগ নেই। ঘণ্টা প্রতি পাওয়া যায় সাড়ে পাঁচ থেকে বড়জোর সাত পাউন্ড। সে হিসেবে লন্ডনে একজন ছাত্রের মাসে চার শ' থেকে পাঁচ শ' পাউন্ড আয়ের সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে যারা কাজ করে তারা ইউকে বর্ডার এজেন্সির দৃষ্টিতে অপরাধী। আর একজন বৈধ অবৈধ ইমিগ্রান্ট শনাক্ত করার প্রাথমিক উৎসগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সু্যরেন্স, কর্মস্থলের পে সিস্নপ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট। আবার এই তিনটি প্রমাণছাড়া ইউকে বর্ডার এজেন্সি কোন বিদেশী ছাত্রের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন গ্রহণ করে না। আবার এনআই এবং ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করা যায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একজন বিদেশী ছাত্রের বৈধভাবে অবস্থান করা ছাড়া উপায় নেই।
লন্ডনের বিশাল অর্থনৈতিক যজ্ঞে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট খাতের অবস্থান নতুন করে বলার নেই। ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বারো সহস্রাধিক রেস্টুরেন্ট। এ সব রেস্টুরেন্টে ক্যাশ ইন হ্যান্ডে চাকরি করা যায়। তবে যে হারে খাটুনি সে হারে পারিশ্রমিক তারা দেয় না। এর ওপর মানসিক নির্যাতনের অনেক অভিযোগের প্রমাণ আছে রেস্টুরেন্টগুলোয়। নিতানত্ম বাধ্যবাধকতা ছাড়া বাংলাদেশী কোন ছাত্র রেস্টুরেন্টগুলোয় যেতে চায় না। লন্ডনের বাইরের কিছু রেস্টুরেন্ট কমর্ীদের ফ্রি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও তুলনামূলকভাবে কিছু বেশি পারিশ্রমিক দেয়। এ কারণে অনেকে স্টুডেন্ট ভিসায় এসে লন্ডনের বাইরের শহরগুলোয় চলে যায়। ইউকে বর্ডার এজেন্সি এখন ছাত্রদের প্রগ্রেস রিপোর্ট, কাসে উপস্থিতির হার ও কলেজ ও কর্মস্থলের দূরত্বের মধ্যে অসঙ্গিত পেলে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে ছাত্ররা লন্ডনের বাইরে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছে না। লন্ডনে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ভিসা কলেজগুলো এখন অতীত। আগে তারা কিছু পাউন্ডের বিনিময়ে ছাত্রদের চটকদার প্রগ্রেস রিপোর্ট তৈরি থেকে শুরম্নু করে উপস্থিতির হারসহ ইউকে বর্ডার এজেন্সির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সরবরাহ দিত। সামপ্রতিক পয়েন্টভিত্তিক ভিসা ব্যবস্থা চালুসহ শিা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনার ফলে অসংখ্য শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্রিটেনের শিা বাণিজ্যকে এখন একটি জাতীয় স্ক্যান্ডাল হিসেবেও সমালোচনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে শুক্রবার ব্রিটিশ সংসদে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শেষ পর্যনত্ম ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ফিল উলাস এমপিদের কাছে স্বীকার করেন যে স্টুডেন্ট ভিসা পদ্ধতি কঠোর আগের আগে ব্রিটেনে অসংখ্য ভুয়া ছাত্রের আগমন ঘটেছে। এদের প্রকৃত সংখ্যা বর্ডার এজেন্সির কাছে নেই। তবে ২ হাজারের বেশি ভুয়া কলেজ এ সব ছাত্রকে ব্রিটেনে এনেছে বলে তিনি সংসদে উলেস্নখ করেন। এদিন হোম এ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির সভায় ব্রিটেনের কলেজ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং এ্যাসোসিয়েশন ইংলিশ ইউকে'র প্রধান টনি মিলনস বলেন, কলেজগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এই খাত একটি জাতীয় স্ক্যান্ডালে পরিণত হয়েছে। আমরা এক দশক ধরেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলাম।
ব্রিটিশ সংসদের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি বরাবরই ইমিগ্রান্ট বিরোধী ভুমিকা রেখে আসছে। এই দলের অন্যতম নেতা লন্ডনের বর্তমান মেয়র বরিস জনসন পরিবর্তিত ইমিগ্রেশন নীতি প্রয়োগে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই দলের ইশতেহারে ইমিগ্রেশনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ড্যাভিড ক্যামেরন তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে স্টুডেন্ট ভিসা আরও কঠোর করা, অবৈধ ইমিগ্রান্টতের ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার এবং ইমিগ্রান্টদের সংখ্যা ব্যাপকহারে কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। মতাসীন সরকারী দল লেবার পার্টি চলমান অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইমিগ্রান্টদের আধিক্য নিয়ে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এই চাপ সামাল দিতে না পেরে সমপ্রতি ইমিগ্রেশন নীতি আরও কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপীয় ছাড়া নন ইউরোপীয় ব্যক্তিদের ব্রিটেনে এখন কার্যত স্থান নেই। ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় নাগরিক দিয়ে শূন্য পদ পুরণ করার পরই আমাদের মতো নন ইউরোপীয় ব্যক্তিদের চাকরি বিবেচনা করার নির্দেশ জারি করেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। ফলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চাকরির আবেদন গ্রহণ করার আগে দেখছে গায়ের চামড়ার রঙ। ইউরোপীয় নন ইউরোপীয় বৈষম্য এখন চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
এর ওপর চলছে অর্থনৈতিক সুনামি। বিগত কয়েক মাসে ব্রিটেনের অর্থনীতি কিছুটা গতি ফিরে এলেও বাড়ছে বেকারত্বের হার। প্রতিনিয়ত চাউর হচ্ছে কোম্পানিগুলোর লোকবল ছাঁটায়ের খবর। অর্থনৈতিক মন্দা সামলাতে না পেরে এবং ব্যাপক লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে শত বছরের পুরনো বেশ কিছু কোম্পানি। ফলে খোদ ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর মাঝেই চলছে হাহাকার। সেখানে বাংলাদেশী নতুন ছাত্রদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এখন কোথায়_তা সহজে অনুমান করা যায়। স্বপ্নের মোহ তবু কাটছে না। ব্রিটিশ হাইকমিশনের ঢাকা, সিলেট এবং চট্টগ্রাম অফিসে প্রতিদিন কাঁড়ি কাঁড়ি আবেদনপত্র জমা পড়ছে। যা ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্যও বিপত্তির সৃষ্টি করছে। ব্রিটেনের রাজস্ব আয়ের একটি বড় খাত হচ্ছে স্টুডেন্টসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ইমিগ্রান্ট। রাজস্ব আয়ের প্রভাব ফেলবে জেনেও শেষ পর্যনত্ম ১ জানুয়ারি থেকে স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
স্টুডেন্ট ভিসাকে কেন্দ্র করে স্বপ্নের ব্রিটেনে সৃষ্টি হয়েছে একটি অমানবিক অধ্যায়। যার চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্রিটিশ প্রশাসন। রাজস্ব আয়ের একটি লাভজনক খাত হওয়া সত্ত্বেও তাদের আর কিছু করার ছিল না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ব্রিটেন গেলেও ছাত্রদের কাজের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না ব্রিটিশ সরকার। ফলে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে রণশীল ও বিরোধী দলগুলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। যার পরবতর্ীতে ব্রিটিশ সরকার সাময়িকভাবে বাংলাদেশসহ এশীয় তিনটি দেশের স্টুডেন্ট ভিসা স্থগিত করেছে। ব্রিটেনে জুন মাসে নির্বাচনের আগে এটি প্রত্যাহারের সম্ভাবনা কম।
লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপল আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব স্টেশনের সামনে ইদানীং বাংলাদেশী কিছু শিার্থীর জটলা দেখলে, ঢাকার বাংলামোটর মোড়ে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাকবলিত কিছু ুধার্ত মানুষের মলিন মুখের কথা মনে পড়ে। দিনের পর দিন গোসল নেই, খাওয়া নেই। এরা সদ্য বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে আসা। পূর্ব লন্ডনের এই এলাকাটি মূলত বাংলাদেশী অধু্যষিত। বাংলাদেশ থেকে আসা হিথ্রো কিংবা গ্যাটউইক বিমান বন্দর থেকে বেশিরভাগ শিার্থী প্রথমদিনেই চলে আসে এই এলাকাটিতে। বলা যায় হোয়াইট চ্যাপল বাংলাদেশী নতুন ছাত্রদের মিলনস্থল।
গত সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যনত্ম বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেনে স্টুডেন্ট ভিসায় গেছে প্রায় চলিস্নশ হাজার। এদের আশি ভাগ এখনও বেকার। এখনও কোন কাজের সন্ধান হয়নি। চুলগুলো উসকোখুসকো। বৈরী আবহাওয়ায় মসৃণ ত্বক আর ঠোঁটে চিড় ধরেছে। তারওপর ভরা শীতের মৌসুম। হঠাৎ হঠাৎ তাপমাত্রা নামে মাইনাস টু-তে। হিমেল তুষারপাতে সাদা হয়ে যায় আপাদমসত্মক। ঝিরঝিরে বৃষ্টির ফোঁটাকে মনে হয় একেকটি বুলেট। সবার ঘাড়ে একটি করে ব্যাগ। শীতে থর থর করে কাঁপছে কেউ কেউ। কোথায় যাবে, কোন্দিকে যাবে বুঝে উঠতে পারে না কিছুই। মাইলের পর মাইল হেঁটে দোকানে দোকানে ঘুরেও একটি কাজ জুটছে না।
এখনও অনেকের থাকার জায়গাটা ঠিক হয়নি। তাই কাউকে কাউকে দেখা যায় কিছু বাঙালী দোকানের কাঁচের জানালায় ভিড় করতে। এ জানালাগুলোয় হাতে লিখে বাসাভাড়ার বিজ্ঞাপন সাঁটা হয়। একটি ছোট রম্নমের সাপ্তাহিক ভাড়া ৯০ থেকে ১৪০ পাউন্ড। একটি সিঙ্গেল সিট নিতে হলে সপ্তাহে লাগে ইউটিলিটিসহ কমপ ে৫০ পাউন্ড। কোন একক ছাত্রের প েএকটি রম্নম ভাড়া নিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। তাই তিন চারজন মিলে একটি রম্নম নিতে দেখা যায়। যা ব্রিটেন স্বাস্থ্যনীতির পরিপন্থী। জানুয়ারি থেকে লন্ডন ট্রান্সপোর্টের ভাড়া বিশ শতাংশ বেড়েছে। সাপ্তাহিক বাসপাস কিনতে এখন লাগছে ১৪ পাউন্ড আশি পেন্স। লন্ডন ট্রান্সপোর্টে ছাত্ররা ত্রিশ ভাগ ছাড় পায়।
সেন্ট্রাল লন্ডনের এখন যে যানজট পরিস্থিতি তাতে বাসে কাজে কিংবা গনত্মব্যে পেঁৗছুতে দশ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে লাগে এক ঘণ্টা। ফলে আন্ডারগ্রাউন্ড টিউবের বিকল্প নেই। টিউব ভাড়া আরও বেশি কয়েকগুণ। ফলে অনেকের প েটিউবে যাতায়াত করা দুরূহ। রান্না করে খেলে একজন বাংলাদেশী ছাত্রের লাগে পনেরো পাউন্ড। সব মিলে প্রতি মাসে খরচ পড়ে নিদেনপ ে৪০০ পাউন্ড_যা বাংলাদেশী টাকায় এখন প্রায় পঁয়তালিশ হাজার টাকা। এই টাকা দেশ থেকে কোন ছাত্র নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। আমি দেখেছি সরকারের অনেক বড় আমলা কিংবা প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছেলেমেয়েকেও ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, বার্গার কিংয়ের মতো চেইন রেস্টুরেন্টগুলোতে ফোর পরিষ্কার করতে। লন্ডনের চেন স্টোরগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ফ্যাশন শপ, টেসকো, আসডা, সেইন্সবারি, সমারফিল্ডের একটি পার্টটাইম জবকে আমাদের ছেলেমেয়েরা সম্মানের মনে করে। ইদানীং সিকিউরিটি গার্ডের দিকে ঝুঁকছে অনেকে_কারণ কোন প্রতিষ্ঠানে এই পদে কাজ করলে অনেক বেশি ঘণ্টা পাওয়া যায়। লন্ডনে যতো ঘণ্টা কাজ করা যায় সে হারে আয়ও হয় বেশি। একটি স্টোরে প্রতিদিন আট ঘণ্টার শিপ্ট হলে সিকিউরিটি পদে পাওয়া যায় বারো থেকে ষোল ঘন্টার শিপ্ট। হলিডে ছাড়া কোন ছাত্রের সপ্তায় বিশ ঘণ্টার বেশি কাজ করার সুযোগ নেই। ঘণ্টা প্রতি পাওয়া যায় সাড়ে পাঁচ থেকে বড়জোর সাত পাউন্ড। সে হিসেবে লন্ডনে একজন ছাত্রের মাসে চার শ' থেকে পাঁচ শ' পাউন্ড আয়ের সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে যারা কাজ করে তারা ইউকে বর্ডার এজেন্সির দৃষ্টিতে অপরাধী। আর একজন বৈধ অবৈধ ইমিগ্রান্ট শনাক্ত করার প্রাথমিক উৎসগুলো হচ্ছে ন্যাশনাল ইন্সু্যরেন্স, কর্মস্থলের পে সিস্নপ এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট। আবার এই তিনটি প্রমাণছাড়া ইউকে বর্ডার এজেন্সি কোন বিদেশী ছাত্রের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন গ্রহণ করে না। আবার এনআই এবং ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করা যায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একজন বিদেশী ছাত্রের বৈধভাবে অবস্থান করা ছাড়া উপায় নেই।
লন্ডনের বিশাল অর্থনৈতিক যজ্ঞে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট খাতের অবস্থান নতুন করে বলার নেই। ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বারো সহস্রাধিক রেস্টুরেন্ট। এ সব রেস্টুরেন্টে ক্যাশ ইন হ্যান্ডে চাকরি করা যায়। তবে যে হারে খাটুনি সে হারে পারিশ্রমিক তারা দেয় না। এর ওপর মানসিক নির্যাতনের অনেক অভিযোগের প্রমাণ আছে রেস্টুরেন্টগুলোয়। নিতানত্ম বাধ্যবাধকতা ছাড়া বাংলাদেশী কোন ছাত্র রেস্টুরেন্টগুলোয় যেতে চায় না। লন্ডনের বাইরের কিছু রেস্টুরেন্ট কমর্ীদের ফ্রি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা ছাড়াও তুলনামূলকভাবে কিছু বেশি পারিশ্রমিক দেয়। এ কারণে অনেকে স্টুডেন্ট ভিসায় এসে লন্ডনের বাইরের শহরগুলোয় চলে যায়। ইউকে বর্ডার এজেন্সি এখন ছাত্রদের প্রগ্রেস রিপোর্ট, কাসে উপস্থিতির হার ও কলেজ ও কর্মস্থলের দূরত্বের মধ্যে অসঙ্গিত পেলে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে ছাত্ররা লন্ডনের বাইরে যাওয়ার ভরসা পাচ্ছে না। লন্ডনে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ভিসা কলেজগুলো এখন অতীত। আগে তারা কিছু পাউন্ডের বিনিময়ে ছাত্রদের চটকদার প্রগ্রেস রিপোর্ট তৈরি থেকে শুরম্নু করে উপস্থিতির হারসহ ইউকে বর্ডার এজেন্সির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের সরবরাহ দিত। সামপ্রতিক পয়েন্টভিত্তিক ভিসা ব্যবস্থা চালুসহ শিা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনার ফলে অসংখ্য শিা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।
ব্রিটেনের শিা বাণিজ্যকে এখন একটি জাতীয় স্ক্যান্ডাল হিসেবেও সমালোচনা করা হচ্ছে। এ নিয়ে শুক্রবার ব্রিটিশ সংসদে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শেষ পর্যনত্ম ইমিগ্রেশন মন্ত্রী ফিল উলাস এমপিদের কাছে স্বীকার করেন যে স্টুডেন্ট ভিসা পদ্ধতি কঠোর আগের আগে ব্রিটেনে অসংখ্য ভুয়া ছাত্রের আগমন ঘটেছে। এদের প্রকৃত সংখ্যা বর্ডার এজেন্সির কাছে নেই। তবে ২ হাজারের বেশি ভুয়া কলেজ এ সব ছাত্রকে ব্রিটেনে এনেছে বলে তিনি সংসদে উলেস্নখ করেন। এদিন হোম এ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির সভায় ব্রিটেনের কলেজ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ল্যাঙ্গুয়েজ টিচিং এ্যাসোসিয়েশন ইংলিশ ইউকে'র প্রধান টনি মিলনস বলেন, কলেজগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে এই খাত একটি জাতীয় স্ক্যান্ডালে পরিণত হয়েছে। আমরা এক দশক ধরেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিলাম।
ব্রিটিশ সংসদের বিরোধী দল কনজারভেটিভ পার্টি বরাবরই ইমিগ্রান্ট বিরোধী ভুমিকা রেখে আসছে। এই দলের অন্যতম নেতা লন্ডনের বর্তমান মেয়র বরিস জনসন পরিবর্তিত ইমিগ্রেশন নীতি প্রয়োগে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এই দলের ইশতেহারে ইমিগ্রেশনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ড্যাভিড ক্যামেরন তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে স্টুডেন্ট ভিসা আরও কঠোর করা, অবৈধ ইমিগ্রান্টতের ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার এবং ইমিগ্রান্টদের সংখ্যা ব্যাপকহারে কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন। মতাসীন সরকারী দল লেবার পার্টি চলমান অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইমিগ্রান্টদের আধিক্য নিয়ে প্রবল চাপের মুখে রয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এই চাপ সামাল দিতে না পেরে সমপ্রতি ইমিগ্রেশন নীতি আরও কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপীয় ছাড়া নন ইউরোপীয় ব্যক্তিদের ব্রিটেনে এখন কার্যত স্থান নেই। ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় নাগরিক দিয়ে শূন্য পদ পুরণ করার পরই আমাদের মতো নন ইউরোপীয় ব্যক্তিদের চাকরি বিবেচনা করার নির্দেশ জারি করেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। ফলে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চাকরির আবেদন গ্রহণ করার আগে দেখছে গায়ের চামড়ার রঙ। ইউরোপীয় নন ইউরোপীয় বৈষম্য এখন চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
এর ওপর চলছে অর্থনৈতিক সুনামি। বিগত কয়েক মাসে ব্রিটেনের অর্থনীতি কিছুটা গতি ফিরে এলেও বাড়ছে বেকারত্বের হার। প্রতিনিয়ত চাউর হচ্ছে কোম্পানিগুলোর লোকবল ছাঁটায়ের খবর। অর্থনৈতিক মন্দা সামলাতে না পেরে এবং ব্যাপক লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে শত বছরের পুরনো বেশ কিছু কোম্পানি। ফলে খোদ ব্রিটিশ জনগোষ্ঠীর মাঝেই চলছে হাহাকার। সেখানে বাংলাদেশী নতুন ছাত্রদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এখন কোথায়_তা সহজে অনুমান করা যায়। স্বপ্নের মোহ তবু কাটছে না। ব্রিটিশ হাইকমিশনের ঢাকা, সিলেট এবং চট্টগ্রাম অফিসে প্রতিদিন কাঁড়ি কাঁড়ি আবেদনপত্র জমা পড়ছে। যা ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্যও বিপত্তির সৃষ্টি করছে। ব্রিটেনের রাজস্ব আয়ের একটি বড় খাত হচ্ছে স্টুডেন্টসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ইমিগ্রান্ট। রাজস্ব আয়ের প্রভাব ফেলবে জেনেও শেষ পর্যনত্ম ১ জানুয়ারি থেকে স্টুডেন্ট ভিসার আবেদন গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।
No comments