চারটি জরিপ কিছু প্রশ্ন
মাকসুদুল আলম, টোকিও থেকে: আমাদের দেশে সংবাদপত্রের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো পত্রিকাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি।
সোজাসাপ্টা কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত জাতীয় কোনো দৈনিক পত্রিকাই পুরোপুরিভাবে পাঠকের মন জয় করতে পারেনি। নব্বই এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর, ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশীয় সংবাদপত্র গুলোর জনমত জরিপে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পূর্বাভাস ছিল। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও দেশীয় সংবাদপত্র গুলোর জনমত জরিপের ফলাফল ছিল অনুরূপ। এসব জরিপের কোনটার সঙ্গেই বাস্তবতার কোনো মিল নেই। সম্প্রতি মহাজোট সরকারের চার বছরের শাসন শেষে তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক ও নেতিবাচক জনমত জরিপ প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় চারটি জাতীয় দৈনিক। প্রথম আলো, সমকাল, যুগান্তর ও ডেইলি স্টার। বলার অবকাশ রাখে না যে, পত্রিকা চারটির তথাকথিত জনমত জরিপের ফলাফলও চার রকম। বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর মত আমাদের দেশেও সত্যিকারের জনমত জরিপ পরিচালিত হলে, তার ফলাফল এক না হলেও কাছাকাছি হওয়ার কথা। অথচ আমাদের জাতীয় দৈনিকগুলোর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। কোনটার সঙ্গেই কোনটার মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নতো আরো পরে। ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের জনমত জরিপে, বিরোধীদল বিএনপির তুলনায় জনসমর্থন এখনো ৩ শতাংশ বেশি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। তাদের মতানুসারে, বর্তমান সময়ে জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাবে ৪২ ভাগ ভোট, আর বিরোধীদল বিএনপি পাবে ৩৯ ভাগ ভোট। ২৫১০ জন ভোটারের মতামত নিয়ে এই জরিপ পরিচালিত করেছে তারা। সমকালের জরিপে বলা হয়েছে যে, মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল, তার অনেকগুলো অঙ্গীকারই পূরণ হয়নি এখনো। সরকারের ব্যর্থতায় ম্লান হয়ে গেছে সাফল্য। এখনও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা বেশির ভাগ মানুষের। তবে, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। তাদের মতানুসারে, বেশির ভাগ (৬২ শতাংশ) মানুষই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সমঝোতা না হলে, আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো অবস্থা সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে তারা। যুগান্তরের জরিপে বলা হয়েছে যে, জনগনের প্রত্যাশা পূরণে মহাজোট সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তাদের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। সঠিকভাবে সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে ৭২.১৪ শতাংশ। তাদের মতানুসারে, সরকার সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছে দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে। এছাড়াও প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু প্রকল্পের অর্থায়নে কেলেঙ্কারি, ডেসটিনি ও হলমার্কের নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি, শেয়ার বাজারে ভয়াবহ বিপর্যয়, মর্মস্পর্শী শোকগাথা বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডকেও সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে পত্রিকাটি। জনমত জরিপে একধাপ এগিয়ে রয়েছে প্রথম আলো। পত্রিকাটির জরিপ অনুযায়ী, বর্তমান সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের তুলনায় বিরোধীদল বিএনপির প্রতি জনসমর্থন ৯ শতাংশ বেশি। তারা বলেছে যে, সরকারের জনপ্রিয়তা কমেছে। পাশাপাশি আরও বলেছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। আর, বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা কমেছে। সরকারের জনপ্রিয়তা কমলে সরকার প্রধানের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা কিভাবে বাড়ে, তা প্রথম আলোর জরিপ চালনাকারীরাই ভালো জানেন। এমন জটিল ও সুবিধাবাদী ফলাফল সাধারণ আমজনতার মাথায় ঢুকে না। পত্রিকাটির দৈতচারিতা এখানেই শেষ নয়। মানবজমিনের এক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রথম আলোর জনমত জরিপ চার্টে কোন দলের কত জনসমর্থন তা উপস্থাপন করতে গিয়ে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত চার্টে দেখানো হয়েছে যে, বিরোধীদল বিএনপির জনসমর্থন চার বছরে প্রায় ১৯% বেড়েছে। যেমন, ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জনসমর্থন ছিল ৫৬% এ। তখন বিএনপির জনসমর্থন ছিল ২৫% এ। ২০১২ তে এসে সেই আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দাঁড়িয়েছে ৩৫% এ। আর বিএনপির জনসমর্থন দাঁড়িয়েছে ৪৪% এ। অথচ তাদের জরিপেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিরোধীদলের ভূমিকায় বাংলাদেশের ৫৮% মানুষ অখুশি। তার মানে হলো যে, দেশের প্রায় ৬০ ভাগ জনসাধারণ বিরোধীদলের প্রতি অখুশি হলেও সেই বিরোধীদলের প্রতিই তাদের জনসমর্থন রয়েছে। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রতি ভারসাম্য রক্ষাকারী প্রথম আলোর এই জনমত জরিপকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে পত্রিকাটির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন দেশের বিশিষ্ট একটি গবেষণা পরিচালনাকারী সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তাঁর মতে, প্রথম আলোর জরিপটি করা হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা পদ্ধতি প্রয়োগ করে। তিনি বিরোধী দলকে তাদের সফলতা, ব্যর্থতা, জনপ্রিয়তা ও কার্যক্রম সম্পর্কে মানুষের মতামত বিবেচনায় এই জরিপকে কাজে লাগানোর আহ্ববান জানিয়েছেন। সংবাদপত্র একটি রাষ্ট্রের বা সমাজের আয়না। সেই রাষ্ট্রের বা সমাজের দিনবদল বা পরিবর্তনে সংবাদপত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। একথা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, গঠনমূলক সমালোচনা ও স্বাধীন জনমত প্রকাশই সংবাদপত্রের মূলকাজ হওয়া উচিত। একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে, লালন-পালন করতে সংবাদপত্রের ভুমিকা হতে হয় সত, সাহসী, আপসহীন ও পুরোপুরিভাবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। গণমাধ্যম এমন একটি মাধ্যম যেখানে গণমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আশা-ভরসা, সমস্যা-সমাধান, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, অধিকার-অর্জনের চিত্র তুলে ধরা হবে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপনের মাধ্যমে। সরকারীদল, বিরোধীদল, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সমাজ ব্যবস্থার নানা অন্যায়-অনাচার-অসংগতি গঠনমূলক সমলোচনার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে ফুটিয়ে তুলবে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ও নিরীক্ষাধর্মী বিশ্লেষণের মাধ্যমে। নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার অন্তরালে সত্যকে তথ্য প্রমাণসহ পাঠকের কাছে তুলে ধরা হবে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ সংবাদপত্র সাধারণ পাঠককে বিভ্রান্ত করে। তারা কখনো কখনো প্রকৃত সংবাদকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে। কখনো কখনো আংশিক সত্যের সঙ্গে মনের মাধুরী মিশিয়ে আংশিক মিথ্যাও পরিবেশন করে থাকে। যে কোন সংবাদ ইচ্ছাকৃতভাবে বা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করাই মূলত হলুদ সাংবাদিকতা। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সাম্প্রতিক জনমত জরিপকে হলুদ সাংবাদিকতা বললেও বাড়িয়ে বলা হবে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাই মনে করি। সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করলেও, ১৬ কোটি মানুষের দেশে জনমত যাচাই করতে কমপক্ষে ১৬ হাজার মানুষকে প্রশ্ন করতে হয়। ২৫১০ জন ভোটার তো প্রায় একটি বড়সর সংবাদপত্রের কর্পোরেট কর্মীসংখ্যার সমান। জধহফড়স ঝধসঢ়ষরহম এর জন্য এই সংখ্যা খুবই নগন্য। যে কোনো সংবাদপত্রকে দীর্ঘস্থায়ী হতে হলে, সাধারণ মানুষের মনের মাঝে ঠাই করে নিতে হলে, শুধু মুখে মুখে দিনবদলের কথা না বলে, কাজেকর্মেও তার পরিচয় দিতে হবে। প্রবীনদের পাশাপাশি তরুণ ও উঠতি বয়সের পাঠকেরও মতামত প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। বর্জনে অর্জন না থাকলেও দলবাজ শিক্ষক, স্তাবক ও চাটুকার লেখকদেরকে পুরোপুরিভাবে বর্জন করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপনে, সংবাদপত্রের আপসহীন ভুমিকায় রাজনৈতিক দলের প্রতি ভারসাম্য রক্ষা করা বা দৈতচারিতার কোনও সুযোগ নেই।
No comments