বাংলাদেশের সংবিধান স্বয়ম্ভু
বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদ কর্তৃক বিধিবদ্ধ হয় এবং এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসনকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক ফরমান জারি করে বাংলাদেশের সংবিধানের যে সকল সংশোধন করা হয় তার বৈধতা দেয়া।
মোট ১১ দফা সংশোধনী দ্বারা সংবিধানের মৌলিক চরিত্র নষ্ট করা হয় এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলনীতি রাষ্ট্রপতি তাঁর দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন সেটা পরো বিলুপ্ত করা হয়। ওই ১১ দফার মধ্যে চারটির উল্লেখ করছি যদ্দ্বারা আমার উপরোক্ত মন্তব্য দুটোর যথার্থতা অতি সহজেই স্পষ্ট হবে : (১) সংবিধানের প্রস্তাবনা ভাগের ওপরে 'বিসমিল্লাহির রহমানের রহিম' কথাগুলো সংযোজিত হয়। (২) সংবিধানের ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে উলি্লখিত 'ধর্মনিরপেতা' শব্দটির পরিবর্তে 'সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' শব্দগুলো সনি্নবেশিত হয় এবং 'সমাজতন্ত্র' শব্দটির পরে 'অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার' শব্দগুলো যোগ করা হয়। (৩) কতিপয় েেত্র সরকারী অর্থ-ব্যয়ের কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয় এবং (৪) সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হবে এবং সেটা জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হবে কিনা তার একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতা রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়।বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চ কর্তৃক ২০০৫ সালের ২৯ আগস্টে দেয়া রায়ে বলা হয় বাংলাদেশের সংবিধানের উপরোক্ত পঞ্চম সংশোধনী অবশ্যই বেআইনী ও বাতিল গণ্য হবে এবং যে সিদ্ধান্তগুলোর ভিত্তিতে রায়টি দেয়া হয় সেগুলোর কয়েকটি হলো_ (১) বাংলাদেশ হচ্ছে একটি সার্বভৌম গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং আইনের শাসন দ্বারা ও কোন ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত নয়। (২) সামরিক আইনবলে বাংলাদেশে কোন বৈধ আইন নেই এবং (৩) বিচারপতি সায়েম ও তৎপরবতর্ী মেজর জেনারেল জিয়ার শাসনিক কার্যকলাপ বাংলাদেশের সংবিধানের এখতিয়ার কিংবা চৌহদ্দির বাইরে এবং (৪) জাতীয় সংসদের যে কোন আইন প্রণীত ও পাস করার মতা আছে, তবে সেটা সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত মতা দ্বারা সীমাবদ্ধ।
বিএনপি এই রায়টির বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে লিভ পিটিশন করেছিল এবং গতকাল সেটা সরাসরি খারিজ হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগের ওই দ্বৈত বেঞ্চের রায়টি ২৪২ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ রায় এবং সেখানে তাঁদের সিদ্ধান্তের প েআইনী বিস্তর যুক্তি আছে। তবে প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, সে রায় থেকে অতিসংেেপ যে চারটি যুক্তি উল্লেখ করলাম, সেটাই যথেষ্ট যে সায়েম ও জিয়ার সামরিক শাসন বৈধ ছিল না এবং পঞ্চম সংশোধনীও বৈধ ছিল না! আপনি যদি যুক্তিবাদী হন এবং না হওয়ার যখন কোন কারণ দেখছি না, তখন আমি নিশ্চিত আপনার উত্তর হঁ্যাসূচক হবেই এবং তখন আপনার বোধে আসবে আপীল বিভাগের বিচারপতিগণ ন্যায়ত ও আইনত সঠিক কাজই করেছেন।
বাংলাদেশের সংবিধানের আদি সম্মিলিত চরিত্র একটি শব্দ দ্বারা অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। সে শব্দটি হচ্ছে স্বয়ম্ভু অর্থাৎ আপনা-আপনি জন্ম নেয়া এবং কোন বাইরের শক্তি নয় দেশজাত আকাঙ্াই এটার জন্ম দিয়েছে। তার পরিবর্তন কিংবা সংশোধন করার মতা আর কারও থাকতে পারে না। আমাদের সৌভাগ্য সুপ্রীমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদ্বয় এবং অতঃপর আপীল বিভাগের বিচারপতিগণ সেটাই উপলব্ধি করেছেন।
ইতোমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে বাহাত্তরের আদি সংবিধান পুরোপুরি বা হুবহু প্রতিষ্ঠিত করা হবে কিনা। এ প্রশ্নটির উত্তর পূর্বেই আহমদ ছফা দিয়েছেন তাঁর লেখা 'বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র' বইটিতে এবং বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যাক : "আসল ব্যাপার হলো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙ্গে ফেলার জন্য বাংলাদেশের জনগণকে একটি রয়ী যুদ্ধের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা যেমন তেমনি ধর্মও একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ক্রিয়াশীল থেকেছে এগুলো সত্য। কিন্তু আরও একটি সত্য অনুধাবন করার প্রয়োজন রয়েছে এবং সে সত্যটির গুরুত্ব সর্বাধিক। ...শুরু থেকেই এ অঞ্চলের নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্া ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা ঘূর্ণিপথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে আমাদের সময়ে এসে একটি রাষ্ট্রসত্তার আকারে বিকশিত হয়েছে।" এখানে অনায়াসে যোগ করা যায় সে রাষ্ট্রসত্তা বাহাত্তরের আদি সংবিধান দ্বারা নির্দিষ্ট।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
No comments