বাংলাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশকেই উদ্যোগী হতে হবে- জাতীয় কবিতা উসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাংলা ভাষাকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে বাংলাদেশকেই বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের পৰে সম্ভব না। তবে পশ্চিমবঙ্গের আমরা, বাংলাভাষীরা আপনাদের সঙ্গে আছি।
সোমবার দু'দিনব্যাপী চবি্বশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন ভারত থেকে আগত দুই বাংলার খ্যাতিমান কবি ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি আরও বলেন, মানুষের মুখের ভাষাই আসল ভাষা। একটি ভাষা জীবিত থাকে মানুষের কথোপকথনেই। আমরা যাঁরা লিখি, সেই লেখাতে অনেক যতিচিহ্ন থাকে। এর মাধ্যমে ভাষাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। কিন্তু যাঁরা লেখেন না, তাঁদের কথ্য ভাষাই পারে একটি ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে। আর এ চর্চাটি আছে বাংলাদেশে।'নতুন কবিতা নতুন সময়' এ সেস্নাগান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে উৎসবের উদ্বোধন করেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সভাপতিত্ব করেন উৎসবের আয়োজক জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি হাবীবুলস্নাহ সিরাজী। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কবি বেলাল চৌধুরী। গত এক বছরে দেশে-বিদেশে যত শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ও গুণী ব্যক্তিত্বরা মারা গেছেন তাঁদের স্মরণে শোকপ্রসত্মাব পাঠ করেন কবি রবীন্দ্র গোপ। আরও বক্তৃতা করেন উৎসবের আহবায়ক কবি আসাদ চৌধুরী, যুগ্ম আহবায়ক তারিক সুজাত, পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আসলাম সানী, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত।
সৈয়দ শামসুল হক বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার বিচারের রায় কার্যকর করে আমরা এখন অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরম্ন করেছি। সভ্যতা ও আলোর মুখ দেখছি। এখন জাতীয় চার নেতার জেল হত্যা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করছি। এ দাবি মানবতার, বাঙালীর অসত্মিত্বের ও সংস্কৃতির দাবি। তবে এটুকু বললেও কম বলা হবে, এ দাবি সভ্যতার দাবি। তিনি আরও বলেন, শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা তা আজো আমরা ভুলিনি। কবিতা শুধু ভাষার জন্য নয়, মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের জন্যও কবিতা। এ জন্য দেশ ও ভাষার বিরম্নদ্ধে যখনই কোন অাঁচড় এসেছে, তখন রাজনীতিকদের চেয়েও আগে অস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী কলম নিয়ে কবিরাই এগিয়ে এসেছে প্রথমে। মানুষের অনত্মরে জ্বালিয়ে দিয়েছে সত্যের মশাল। রাজনীতির চড়াই-উতরাই পার হতে তাই বাংলার মানুষ কবিতা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়, সঞ্চয় করে শক্তি ও সাহস।
আসাদ চৌধুরী বলেন, বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মহাজোট সরকার ৰমতায় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর বিচারের রায় কার্যকর করে গোটা জাতিকে শাপমুক্ত করেছে। কিন্তু বিগত আমলের ধিক্কৃত প্রেতাত্মারা তো এখনও সর্বত্র ছড়ানো ছিটানো। এদের মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ বিগত সরকারের প্রশ্রয়ে আস্কারা পেয়েছিল তাঁদের নিজস্ব স্বার্থেই। আমরা যদি সামনে এগিয়ে যেতে চাই, তবে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতেই হবে এবং সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী এদের বিরম্নদ্ধে সরকারের সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই হবে।
তারিক সুজাত বলেন, বিগত একটি সময়ে (বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার) রাষ্ট্রীয় মৌল আর্দশের বহুকিছুই বিসত্মৃতির অনত্মরালে চলে গিয়েছিল । এমনকি রাষ্ট্রীয় পদক থেকে শুরম্ন করে সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রচলিত পদগুলোও রৰা পায়নি। প্রায় সব ৰেত্রেই লঙ্ঘিত হয়েছে মেধা, জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতা। সেই অসহনীয় অবস্থা থেকে পরিত্রাণের আশায় দিন বদলের অঙ্গীকারকে মানুষ স্বাগত জানিয়েছে। সময় এসেছে বাংলাদেশকে তার আপন সত্তায় ফিরিয়ে আনতে। এ নতুনের জয়ধ্বনির মধ্য দিয়ে জয় হয়েছে বাংলা কবিতার। যে অশুভ শক্তি এদেশে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতির বিসত্মার ঘটিয়েছিল, আজ তারা পরাভূত হচ্ছে শুভ শক্তির কাছে। এটাই আমাদের সেরা অর্জন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায় কার্যকরের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে সত্যের জয় অবধারিত।
ভারতীয় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হওয়ায় খুশি হয়েছি। এখন যে অপরাধীরা বাইরে আছে, তাদের যোগ্য শাসত্মি হলে খুশি হবো। তিনি আরও বলেন, কবি শামসুর রাহমানের নিশ্বাস ও বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের নিশ্বাস ও বিশ্বাসের মিল ছিল, সে কারণে এখানে এলেই তাঁর কথা বেশ মনে পড়ে। তাঁর সঙ্গে আমাদের খুব আনত্মরিকতা ছিল। শামসুর রাহমান প্রসঙ্গে একই কথা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উচ্চারণ করে আরও বলেন, একদিন আমিও থাকব না, কিন্তু কবিদের স্রোত থাকবে।
সকালে এই উৎসব শুরম্নর আগে জাতীয় কবিতা পরিষদের সদস্যরা উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে একটি শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি দোয়েল চত্বর, শহীদ মিনার হয়ে টিএসসিতে এসে শেষ হয়। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, জাতীয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী পটুয়া কামরম্নল হাসানের সমাধিতে পুষ্পসত্মবক অর্পণ করেন কবিগণ। তারপর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয় জাতীয় পতাকা। পরিবেশিত হয় একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত। পরে বিকেলে শুরম্ন হয় তিন পর্বে কবিতা পাঠের আসর। প্রথম পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেন কবি রবিউল হুসাইন ও জিলস্নুর রহমান সিদ্দিকী। রাতে কবিতা আবৃত্তি পর্বে সভাপতিত্ব করেন আসাদুজ্জামান নূর। আজ মঙ্গলবার উৎসবের সমাপনী দিনে আছে দু'টি সেমিনার ও কবিতা পাঠের আয়োজন।
এবারের উৎসবে এসেছেন ভারতের ২৫ কবি। এদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও রয়েছেন সমরেন্দ্র সেন গুপ্ত, রাতুল দেব বর্মন, বীথি চট্টোপাধ্যায়, অমৃত মাইতি, শ্যামল কানত্মি ধর, তাপস রায়, স্বাতী চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ চৌধুরী, মোহর চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ ম-ল, সনত্মষ রায় প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রয়াত কবি শামসুর রাহমানের স্ত্রী জোহরা রাহমান, নাতনি দীপিকা রাহমান ও পুত্রবধূ টিয়া রাহমান উপস্থিত ছিলেন।
No comments