‘মাঠের বাইরে আমি সাধারণ একজন’
কয়েক বছর ধরে ফিফা ব্যালন ডি’অরের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আপনার নিয়মিত উপস্থিতি। আরেকবার এই অভিজাত তালিকায় থাকার অনুভূতিটা কেমন?
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো: খুবই ভালো। মনোনীত হওয়াটা দারুণ সম্মানের, সব সময়ই এটা ভীষণ তৃপ্তি দেয় আমাকে। এটা প্রমাণ করে, ক্যারিয়ারজুড়ে আমি খুব উঁচু একটা মান ধরে রাখতে পেরেছি, আর এটা তো খুশি হওয়ার মতোই ব্যাপার! প্রথমবারের তুলনায় কি পরিবর্তন হয়েছে? আমি মূলত সেই একই আছি। আরও বেশি অভিজ্ঞ, তবে আকাঙ্ক্ষা একই রকম তীব্র। এমনিতে আমি সেই একই মানুষ, একই খেলোয়াড়। সেই সময় (প্রথমবার) আপনি খেলতেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে, এখন রিয়াল মাদ্রিদে। দুই ক্লাবের মধ্যে পার্থক্য কী?
রোনালদো: বিশ্বের সেরা দুটি ক্লাব এবং এ জন্যই তাদের হয়ে সফল হওয়া সব সময়ই কঠিন। ইতিবাচক দিক যেমন অনেক আছে, তেমনি কম ইতিবাচক দিকও আছে। আমার মনে হয়, ইউনাইটেডের চেয়ে মাদ্রিদে চাপ বেশি। সাড়ে তিন বছর হলো আমি এখানে আছি এবং এটাই অনুভব করছি। কারণ, ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার সব মনোযোগ দশম ইউরোপিয়ান ট্রফি জয়ে। এটা বাড়তি একটা উদ্বেগ তৈরি করে, যা সব সময়ই অনুভূত হয়।
আপনার কি মনে হয়, প্রত্যাশার মাত্রাটা মাঠের পারফরম্যান্সে বাজে প্রভাব ফেলতে পারে?
রোনালদো: আমার মনে হয় হ্যাঁ, চাপটা অনেক এবং কখনো কখনো সেটা আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। তবে আমাদের চেষ্টা করতে হয় এসব পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। লোকের কথায় কান না দিতে, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের, রিয়াল মাদ্রিদকে নিয়ে প্রতিদিনই যেমন বলা হয়। দিন শেষে সিদ্ধান্তটা যার যার ব্যক্তিগত, কেউ সংবাদপত্র পড়তে চায় কি না। আমার মনে হয় না, পত্রিকাগুলো যা বলে, তাতে খুব বেশি কিছু আসে-যায়।
লা লিগায় রিয়ালের বাজে শুরু কি ক্লাবের ওপর চাপ বাড়িয়েছে?
রোনালদো: চ্যাম্পিয়নশিপের শুরুটা আমরা নিশ্চিতভাবেই ভালো করতে পারিনি। আমরা জানি, লা লিগা আমাদের জন্য এখন দুরূহ এক লড়াই। কিন্তু ফুটবলে অসম্ভব বলে কিছু নেই। আর চ্যাম্পিয়নস লিগ ও কোপা ডেল রেও তো আছে। জেতার মতো অনেক কিছুই আছে আমাদের।
এই পরিস্থিতিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়টাকেই কি অগ্রাধিকার দিচ্ছে মাদ্রিদ?
রোনালদো: অবশ্যই। প্রত্যেক মাদ্রিদিস্তা চায় ওই দশম ইউরোপিয়ান শিরোপা—আমরা সে ব্যাপারে সচেতনের চেয়েও বেশি কিছু। গত মৌসুমে খুব কাছে গিয়েও ছিটকে যাওয়াটা ছিল খুবই হতাশাজনক। এ বছর সুযোগ আছে সেই হতাশা ভুলিয়ে দেওয়ার, যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মুখোমুখি হওয়াটা আমাদের কাজ কঠিন করে দিয়েছে। লড়াইটা মোটেও সহজ হবে না, আমি তো বলব সম্ভাবনা ৫০-৫০। তার পরও অবশ্য আমি অনেক আত্মবিশ্বাসী।
রিয়াল মাদ্রিদ যদি সেরা ফর্মে ফিরতে পারে, শিরোপা জয়ে তারাই কি ফেবারিট?
রোনালদো: কোনো দলই অপরাজেয় নয়। তবে সেরা ফর্মে থাকলে আমরা দারুণ দল। ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের লড়াইয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডও দারুণ শুরু করেছে, বাকিদের চেয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তার পরও সামর্থ্য অনুযায়ী খেলতে পারলে আমরা ওদের হারাতে পারব। ওদের হারাতে হলে আমাদের একটা দল হিসেবে খেলতে হবে, আগে অনেক ম্যাচে আমরা যেমন খেলেছি।
লিগে বাজে পারফরম্যান্সের কারণে মাদ্রিদ সমর্থকদেরই একটা অংশ হোসে মরিনহোর বিরুদ্ধে অনেক কিছু বলছে। আপনার মত কী?
রোনালদো: লোকের ভিন্নমত থাকবেই এবং সেটাকে শ্রদ্ধাও করতে হবে। যদিও আমার মনে হয়, লোকজনের আরও ধৈর্য ধরা উচিত। আমার কাছে এটা পরিষ্কার যে, মরিনহো সব সময় ক্লাবের সবচেয়ে ভালোটা চান এবং এ জন্য আমৃত্যু লড়াই করতেও প্রস্তুত। আমরা যারা তাঁর পাশে কাজ করি, সবাই এটা জানে। তার পরও সমর্থকদের মতকে শ্রদ্ধা করতেই হয়। আমার মতে, তিনি বিশ্বের সেরা কোচ, যাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ, জিতেছেন সম্ভব সবকিছুই।
দর্শকের সঙ্গে আপনার সম্পর্কটাও ঠিক সুবিধের নয়। মাঝেমধ্যেই আপনাকে নিয়ে বিতর্ক হয়, কেন?
রোনালদো: নিশ্চিত কোনো উত্তর আমি দিতে পারব না, কারণ এই প্রশ্ন আমি নিজেকেও করেছি। যারা আমাকে চেনে এবং আমার সঙ্গে খেলেছে, তারা জানে মানুষ হিসেবে আমি কেমন। যারা আমাকে চেনে না, তারা যা ইচ্ছা ভাবতে বা বলতে পারে। যারা আমার সমালোচনা করে, তাদেরও আমি শ্রদ্ধা করি। কারণ, আমি জানি, আমার সম্পর্কে তারা ভুল ধারণা নিয়ে আছে। এসব নিয়েই বাঁচতে শিখতে হবে আমাদের। সত্যি বলতে, সমালোচনা প্রতিটি ফুটবলারের জীবনেরই অংশ, সবারই তো তা-ই।
আপনি ক্লাব ছাড়বেন বলে সম্প্রতি অনেক কথা শোনা যাচ্ছে। সত্যিই কি এমন কিছু হতে যাচ্ছে?
রোনালদো: চুক্তির শেষ পর্যন্ত (২০১৫) রিয়াল মাদ্রিদে থাকতে চাই, এটা নিয়ে আমি একদম পরিষ্কার। এরপর জানি না কী হবে।
কী মনে হয়, এখনো পর্যন্ত ক্যারিয়ারে এতটা সফল হয়েছেন কীভাবে?
রোনালদো: আমার মনে হয়, প্রতিভা একটা ব্যাপার। আর লক্ষ্য অর্জনে আমি অবিশ্বাস্য রকম কঠোর পরিশ্রম করেছি। নিজের খেলার ঘাটতিগুলো মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে এবং সেটা নিয়ে কাজ করতে হবে। ক্যারিয়ারজুড়ে আমি চেষ্টা করেছি সব সময় শিখতে, বিকশিত হতে ও শিরোপা জিততে। আমি খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী, সব সময়ই জিততে চাই এবং বুটজোড়া তুলে রাখা পর্যন্ত আমি এমনই থাকতে চাই।
মাঠের বাইরেও আপনার অনেক আনন্দময় মুহূর্ত আছে, যেমন ছেলের জন্ম!
রোনালদো: আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ছিল সেটা, অনেক গর্বের ব্যাপার। ওর সঙ্গ আমার খুবই ভালো লাগে, পরিপূর্ণতার অনুভূতি এনে দেয়।
ওকে কি ফুটবলার হিসেবে দেখতে চান?
রোনালদো: ও যা চায়, তা-ই করবে। হলে অবশ্যই আমার ভালো লাগবে। ওকে ফুটবলের দিকে একটু ঠেলেও হয়তো দিতে চাইব। তবে শেষ পর্যন্ত ও কী করবে, সেটা ওরই সিদ্ধান্ত। তবে যা-ই করুক, আমার সমর্থন থাকবে।
ফুটবলের বাইরে কী করতে আপনার ভালো লাগে?
রোনালদো: কাজের ব্যস্ততার সময় যা যা করতে পারি না, তা করতে ভালো লাগে। যেমন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো, ঘুরে বেড়ানো, হাঁটতে যাওয়া, বাস্কেটবল দেখা, টেনিস এবং ছেলেকে সময় দেওয়া। মাঠের বাইরে এলে ফুটবলকে আমি এক পাশে রেখে দিই। মাঠের বাইরে আমি সাধারণ একজন।
খ্যাতির বিড়ম্বনা অনেক সময় কি বেশি মনে হয়? সাধারণ জীবনটাকে মিস করেন?
রোনালদো: ফুটবলার হওয়ার অনেক ভালো দিক আছে, আবার এমন অনেক কিছু আছে, যা ভালো নয়। সাধারণ জীবনযাপন এবং আরও অনেক কিছুই মিস করতে হয়, এতটা পরিচিত না হলে যেসব করতে হতো না। কিন্তু এই পেশা আমি নিজেই বেছে নিয়েছি এবং সবকিছুই এই পেশার অংশ। নিজের পছন্দের জন্য বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই।
সবশেষে, ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে কি আপনি সুখী?
রোনালদো: সত্যি বলতে হ্যাঁ, এমন কিছু করছি, যা আমি ভালোবাসি, উপভোগ করি। জানি, আমি কতটা সৌভাগ্যবান। নিজেকে খুব পরিতৃপ্তও মনে হয়।
No comments