একুশের বইমেলা এবং প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণ সম্পর্কে দু'টি কথা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
প্রতিবছর যেমনটা হয় এ বছরও তেমনি পয়লা ফেব্রম্নয়ারি একুশের বইমেলার উদ্বোধন হলো। যথা নিয়মে দেশের প্রধানমন্ত্রী বইমেলার উদ্বোধন করেছেন। বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি দর্শক পরিপূর্ণ সমাবেশে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিয়েছেন এবং ফিতা কেটে মেলার উদ্বোধন করেছেন। এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। নানা কারণে যেতে পারিনি। তবে ঘরে বসে টেলিভিশনে পুরো অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেছি। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসসুজ্জামান খানের স্বাগত ভাষণটি তথ্যপূর্ণ। সভাপতি কবীর চৌধুরীর খুবই সংৰিপ্ত ভাষণ ছিল কৌতুক এবং পা-িত্যের মিশ্রণ। দু'একজন মন্ত্রীর কেবল পদাধিকার বলে এই জ্ঞান ও শিৰার আলোকিত মঞ্চে উঠে মেঠো রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ না থাকলে ভাল হতো। তাতে সময় বাঁচত। শ্রোতারা অব্যাহতি পেতেন। সমাবেশের ভাবগাম্ভীর্য রৰা পেত।রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রী হলেই কি ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান সবকিছু সম্পর্কে ভাষণ দেয়ার অধিকার জন্মে? এ প্রশ্নটি একবার ওঠেছিল রবীন্দ্রনাথের শানত্মি নিকেতনে, বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি কবির সঙ্গে সাৰাতের জন্য শানত্মি নিকেতনে গেছেন। কবির ইচ্ছা প্রধানমন্ত্রী যেন তার শিৰা প্রতিষ্ঠানের একটি সমাবেশে বক্তৃতা দেন। কবি ভক্তদের কেউ কেউ তাতে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, একজন রাজনৈতিক নেতা তাদের শিৰা প্রতিষ্ঠানে এসে রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে শিৰার পরিবেশটি নষ্ট করবেন। তার চাইতে কবি বরং তাকে সাৰাতদানেই সন্তুষ্ট করম্নন।
রবীন্দ্রনাথ তাতে রাজি হননি বলেছিলেন, শুনেছি ফজলুল হক কেবল রাজনৈতিক নেতা নন, বিদ্বান এবং বুদ্ধিমান মানুষও। শানত্মি নিকেতনে এসে তিনি নিশ্চয়ই রাজনৈতিক বক্তৃতা দেবেন না। তা যে দিতে নেই এটুকু উপলব্ধি নিশ্চয়ই তার আছে। আমাদের শিৰা প্রতিষ্ঠানের জন্য কিছু সরকারী সাহায্য সহযোগিতা দরকার। সেই প্রত্যাশাই আমি তাকে জানাব। তিনি তার ভাষণে হয়ত সেই সাহায্য সহযোগিতার কিছু প্রতিশ্রম্নতি দেবেন।
শানত্মি নিকেতনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন সমাবেশে ফজলুল হক বক্তৃতা দেননি। দিয়েছিলেন ঘরোয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেখানে শানত্মি নিকেতনের জন্য সরকারী সাহায্যের প্রতিশ্রম্নতি দিতে গিয়ে তিনি 'যতো সাধছিল সাধ্য ছিল না, তবু বহিয়াছি কঠিন কামনা'_ রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি পুরো মুখস্থ বলেন এবং তার বক্তৃতায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন ও সমসাময়িক কবিদের নাম এবং তাদের কবিতার উলেস্নখ করে রবীন্দ্রকাব্যের যে তুলনামূলক আলোচনা করেন, তাতে না কি রবীন্দ্রনাথও বিস্মিত হয়েছিলেন।
আমাদের বর্তমান কালের মন্ত্রিদের এসব গল্প শুনিয়ে লাভ নেই। ফজলুল হক শানত্মি নিকেতন গিয়ে অনুরম্নদ্ধ হয়ে এমন বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে সম্পর্কে তার পেটে বিদ্যেবুদ্ধি ছিল। নেহেরম্ন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দিলস্নীতে বিজ্ঞান ভবনের ভিত্তি স্থাপনে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ে বক্তৃতা দিতে রাজি হননি। বলেছেন, এ বিষয়ে বক্তৃতা দেয়ার যোগ্য অনেক ব্যক্তি আছেন, তাদের কাউকে ডাকুন। বিশ্বখ্যাত নেতা হওয়া সত্ত্বেও নেহেরম্নর এই কা-জ্ঞানটি ছিল, যা আমাদের এখনকার অল্পবিদ্যায় মন্ত্রী বা নেতাদের অনেকের নেই। নইলে বইমেলার মতো জ্ঞান ও মননসম্পৃক্ত উৎসবের উদ্বোধনের সভায় দেশের জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের অনেকেই শ্রোতার সারিতে বসিয়ে রেখে মন্ত্রীরাই মঞ্চ দখল করতেন না এবং গুণী শ্রোতাদের নির্গুণ অর্বাচীন (বেশিরভাগ রাজনৈতিক) বক্তব্য শোনাতেন না।
এটা ছিল বিদেশী কলোনিয়ান কালচার। ঔপনিবেশের শিৰা-সংস্কৃতি শাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদটি দখল করতেন বিদেশী ভাইসরয় ও গবর্নরেরা। স্কুল কলেজের দ্বারোদ্ঘাটনের কাজেও ডেকে আনা হতো মন্ত্রী কিংবা আমলাদের। এই মন্ত্রী কিংবা নেতারা অল্পশিৰার লোক হলেও তারাই ফিতা কাটার জন্য অগ্রাধিকার পেতেন, কারণ ওই স্কুল বা কলেজে সরকারী অনুদান অনুমোদনের ব্যাপারে তারাই ছিলেন হর্তাকর্তা। উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এই বিদেশী ঔপনিবেশিক কালচারটিকে সযত্নে অনুসরণ করা হয়েছে। ফলে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিসত্মান গঠিত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হয়েছিলেন পদাধিকার বলে গবর্নর স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন। ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্র মতো খ্যাতনামা প-িত ভাইস চ্যান্সেলরও হতে পারেননি। হয়েছিলেন বিদেশী ড. জেনকিন্্স্।
এই ঔপনিবেশিক কুপ্রথাটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাতিল করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপতি হওয়ার ফলে তিনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও চ্যান্সেলর হয়েছিলেন পদাধিকার বলে। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই ঔপনিবেশিক প্রথাটি তিনি বিলোপ করতে চান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আইন সংশোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর পদে দেশের যোগ্য জ্ঞানী-গুণীজনের নিয়োগ লাভের ব্যবস্থা করবেন। রাষ্ট্রপ্রধান আর পদাধিকার বলে ওই পদে বসবেন না। বঙ্গবন্ধু তার এই সিদ্ধানত্ম কার্যকর করার সময় ও সুযোগ পাননি। তার আগেই তাকে দেশদ্রোহী ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিতে হয়।
উপমহাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই যদি আমাদের শিৰা ও সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের এই ঔপনিবেশিক কালচারটি বর্জিত হতো, তাহলে পাকিসত্মান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদটি মোনায়েম খানের মতো ময়মনসিংহের এক বটতলার উকিল এসে দখল করতে পারত না এবং তার 'ভাষণ' শোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা অস্বীকৃতি জানানোর ফলে হৈচৈ উচ্ছৃঙ্খলার মধ্যে সমাবর্তন উৎসবটি প- হতো না। এবং সমাবর্তনের গাউন ও টোপর মাথায় কাউনের বেশে চ্যান্সেলর সাহেবকেও পুলিশ পাহারায় পালাতে হতো না।
আমাদের শিৰা-সংস্কৃতির ৰেত্রে ঔপনিবেশ যুগের অনৈতিক কালচারটি এখনও অনুসৃত হওয়ায় দিন দিন নৈরাজ্য বাড়ছে। 'গণতান্ত্রিক কর্তৃত্বের' নামে শিৰা-সংস্কৃতির ৰেত্রেও অল্পশিৰিত (ৰেত্র বিশেষে নিম্নরম্নচি ও নিম্নশিৰায় অধিকারী) রাজনীতিক এবং অনুরূপ সরকারী আমলাদের নিয়ন্ত্রণে শিৰা-সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক মান উর্ধমুখী না হয়ে, ক্রমশই নিম্নমুখী হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বিরাট অঙ্গনেও এখন যেন গোপাল ভাঁড়ের বৈঠকখানা। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছি, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার স্বঘোষিত জন্মদিনে কমিক দেলোয়ার নামে পরিচিত বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন তার নেত্রীকে একখ- 'সুকানত্ম কাব্য সমগ্র' উপহার দিয়েছেন। খবরটি পড়ে একটি প্রাচীন কবির দু'লাইন কবিতায় কথা মনে পড়েছে :
"তুমি কার গলে দিলে দামি মুক্তার হার?
সে যে মুক্তা ফেলিয়া গলায় পরায়
কাঁচের রঙ বাহার।"
আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের শিৰা-সংস্কৃতির বিকাশের বর্তমান অধোগতি রোধ করা যাবে যদি কলোনিয়াল যুগের কন্ট্রোল কালচার থেকে তাকে অবিলম্বে মুক্ত করা হয়। স্বাধীন বিচার বিভাগের মতো আমাদের স্বাধীন শিৰা-সংস্কৃতির অঙ্গনেও থাকা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর পদ রাষ্ট্রপ্রধান পদাধিকার বলে পাবেন এই প্রথাটি বিলোপ করতে চেয়েছিলেন। তার ইচ্ছাটি কন্যা শেখ হাসিনা পুনর্বিবেচনা করে দেখতে পারেন। বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীর মতো শিৰা-সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের সাহায্য পাবে, কিন্তু সরকার বা তাদের আমলাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে না। দেশের যোগ্য জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের পরিচালনায় এগুলো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হওয়া উচিত।
সরকার বদল হলেই বাংলা একাডেমী বা শিল্পকলা একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর মহাপরিচালক বদলে যাবেন এবং যোগ্যতা ও জ্ঞানের মান বিচার না করেই অনেক সময় একজন দলীয় চামচাকে ওই পদে যে বসিয়ে দেওয়া হয় এই প্রথাটি বদল হওয়া প্রয়োজন। একমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের পৰেই এই প্রথা পরিবর্তন সম্ভব। কারণ, দলটি গণতান্ত্রিক এবং দিনবদল ও প্রথা পরিবর্তনের কর্মসূচী তাদেরই। যে বিএনপি-জামায়াত কলোনিয়াল যুগের এই কুপ্রথাগুলোকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দান করে গেছে, তাদের পৰে এই সংস্কার ও পরিবর্তন আনয়ন সম্ভব নয়।
সোমবার বাংলা একাডেমীতে একুশের বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানটি দেখে আমার মনে হয়েছে, অনুষ্ঠানটি দলীয় রাজনৈতিক বক্তব্যের আবহ থেকে মুক্ত থাকলে আরও ভাল হতো। আওয়ামী লীগের অভিযোগ (যে অভিযোগটি সত্য), গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রশাসন, শিৰা, বিচার ব্যবস্থা সব কিছুর দলীয়করণ শেষ করে গেছে। এর উচ্ছেদ ঘটাতে হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে বিপরীত পন্থা অনুসরণ করতে হবে। শেখ সাদী বলছেন, তিনি আদব শিখেছেন বেআদবের কাছ থেকে। অর্থাৎ বেআদব যে কাজটি করে তার উল্টো কাজটি করে তিনি দেখেছেন সেটাই আদব। আওয়ামী লীগ যদি বিএনপি'র কাজের অনুকরণ না করে উল্টো কাজ করে সেটাই হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরম্নদ্ধারের কাজ।
একুশে বইমেলার উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে মন্ত্রীরা যেসব কথা বলেছেন, যাতে দলীয় রাজনীতির আপ্তবাক্যগুলো বেশি শোনা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণ তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকলে তাকে আনত্মরিক অভিনন্দন জানাতাম। তার শিৰা-সংস্কৃতিমূলক ভাষণকে তার রাজনৈতিক ভাষণের সম্পৃক্ততা থেকে মুক্ত রাখতে পারলে তিনি দেশের 'ভাষণ-রাজনীতির'র ৰেত্রে দিনবদলের একটা চমৎকার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন।
তার ভাষণে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করবে এমন অনেক সুসংবাদ আছে। তিনি প্রকাশকদের নবীন লেখকদের বই প্রকাশে উৎসাহী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। রমনার সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানকে ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। তার ঘোষণার সবচাইতে বড় কথা ৰুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরৰণে তার সরকারের সদিচ্ছা এবং সে সদিচ্ছা পূরণে আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা। তিনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা সত্মম্ভকে ঘিরে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণের কথাও বলেছেন। এই ঘোষণা সর্বসত্মরের মানুষকে বিপুলভাবে উদ্দীপিত করবে।
এই ভাষণটিকে তিনি যদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, দেশের শিৰা-সংস্কৃতির একজন অদলীয় অভিভাবক হিসেবে দিতেন এবং ভাষা আন্দোলনের বহু কথিত ইতিহাসটিকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষণের প্রথম দিকে দীর্ঘ সময় ধরে না বলতেন, তাহলে একজন পলিটিসিয়ানের উর্ধে উঠে স্টেটসম্যানের পরিচয় দিতে পারতেন। দেশের মানুষও তাকে এখন একজন দলীয় রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে নয়, জাতীয় রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে দেখতে চায়।
স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যে একচ্ছত্র সম্মান, তাতে দেশের অন্যান্য আন্দোলনেও তার ভূমিকাকে বার বার একক ভূমিকা হিসেবে দেখানোর দরকার নেই। তাতে তাকে ছোট করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনী ভাষণের সময় টেলিভিশনের পর্দায় একমাত্র বঙ্গবন্ধুর ছবি কি বারবার ফাশ করার দরকার ছিল? এটা তো স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান নয়। ভাষা দিবসের গ্রন্থমেলার অনুষ্ঠান। এই ভাষা আন্দোলনের সূচনায় (মার্চ ১৯৪৮) আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভই করেনি। ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতারা তাতে অংশ নিয়েছেন_বিশেষ করে তরম্নণ শেখ মুজিব।
কিন্তু ভাষা আন্দোলনে তৎকালীন প্রবীণ নেতাদের মধ্যে সবচাইতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন_আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক আবুল কাশেম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ। তৎকালীন তরম্নণ নেতাদের মধ্যে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন গাজিউল হক, আবদুল মতিন, অলি আহাদ, কাজি মাহবুব, শামসুল হক চৌধুরী টেনু মিয়া, কেজি মুসত্মাফা, এমআর আখতার মুকুল এবং আরও অনেকে। ১৯৪৮ সালে কার্জন হলে উর্দু ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়ার সময় গবর্নর জেনারেল জিন্নার মুখের ওপর নো নো বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন ছাত্রলীগের তদানীনত্মন সাধারণ সম্পাদক নইমুদ্দীন আহমদ (পরে এ্যাডভোকেট)। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে প্রাদেশিক সরকারী ভাষা করার দাবিতে তদানীনত্মন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে স্মারকলিপি পেশের প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং গ্রেফতার হয়েছিলেন ছাত্র নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে বিচারপতি)।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় এই ভাষা সংগ্রামীদের ছবিও যদি ছোট করে হলেও টিভির পর্দায় ফাশ করা হতো এবং সভামঞ্চেও বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তাদের ছবি ও পরিচয় স্থান পেত তাহলে ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাসের প্রতি সম্মান দেখানো হতো। বইমেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানটিরও মর্যাদা বাড়ত। তাতে অনুষ্ঠানটিও বিশেষ দল ও বিশেষ রাজনীতির গন্ধমুক্ত জাতীয় শিল্প-সাহিত্যের প্রকৃত মিলন মেলার রূপ আরও বেশি করে ধারণ করত।
বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে কিছু তথ্যবিভ্রাটও লৰ্য করা যায়। এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিবের এবং সচিবের অধীনে যে টিমটি আছে, তাদের সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। আমি কয়েকটি বিভ্রাটের মধ্যে একটি কথা উলেস্নখ করছি। এই বক্তব্যটি বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেছেন, "আওয়ামী লীগ দেশের (পাকিসত্মানের) কেন্দ্রীয় ৰমতায় এসে শাসনতন্ত্র প্রণয় করে।"
আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছে; পাকিসত্মানের নয়। ১৯৫৬ সাল পাকিসত্মানে কেন্দ্রীয় ৰমতায় অধিষ্ঠিত ছিল হক সাহেবের নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের অংশ এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের অংশ। চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছিলেন এই কোয়ালিশন সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ ফজলুল হক দ্বিতীয় গণপরিষদে সংবিধানটি উত্থাপন করেন এবং তা পাস হয়। পূর্ব পাকিসত্মানের স্বার্থ ও অধিকার এই সংবিধানে রৰিত হয়নি এই অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগ এই সংবিধান পাসের সংসদীয় বৈঠকে যোগ দেয়নি। কিন্তু পরে দলনেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলের সিদ্ধানত্ম অমান্য করে পরিষদের বৈঠকে যোগ দেন এবং সংবিধান পাসের সনদে সই দেন।
বইমেলার উদ্বোধনী ভাষণে এই ধরনের রাজনৈতিক প্রসঙ্গ রাখা ছিল অপ্রয়োজনীয়। এসব ছোটখাট ত্রম্নটি ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি ছিল অভিনন্দন লাভের যোগ্য। আমার এই দীর্ঘ আলোচনার একটাই লৰ্য দেশের শিৰা, সংস্কৃতির অঙ্গনে দলীয় রাজনীতির স্পর্শদোষমুক্ত হোক। অনত্মত এই একটি ৰেত্রে গণতান্ত্রিক জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গ এবং জাতীয় মনোভাব প্রাধান্য লাভ করম্নক।
ঢাকা, ২ ফেব্রম্নয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১০
No comments