পুঁজিবাজার খাদের কিনারায় শেয়ার সঙ্কট তীব্র-= রাজু আহমেদ
যৌক্তিক সংশোধন ছাড়াই ধারাবাহিক ঊধর্্বগতির কারণে খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। টানা তিন মাস ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে সব সূচক। মাত্র দু' মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়েছে আর্থিক লেনদেন।
নানা উৎস থেকে স্রোতের মতো টাকা ঢুকলেও এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়েনি নতুন শেয়ারের যোগান। ফলে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারের দর ইতোমধ্যেই কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁৗছেছে। এরপরও নানা ধরনের গুজব ও প্রলোভনের কারণে শেয়ার ধরে রাখছেন অধিকাংশ বিনিয়োগকারী। একের পর এক পদৰেপ নিয়েও বাজারের রাশ টানতে ব্যর্থ হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারে জমে ওঠা পুঁজি উৎপাদনমুখী খাতে স্থানানত্মর করে শেয়ারের যোগান বাড়াতে না পারলে যে কোন সময় বড় ধরনের ধস নামতে পারে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন।সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার জনকণ্ঠকে বলেন, শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে বিভিন্ন পদৰেপ নেয়া হচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা যাতে বুঝে-শুনে বিনিয়োগ করেন সেজন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে কমিশনের পৰ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক করা হয়েছে। মার্জিন ঋণ নিয়ন্ত্রণসহ শেয়ারবাজার, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউসগুলোকেও বিভিন্নভাবে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
তবে শেয়ার সংখ্যা না বাড়িয়ে মার্জিন ঋণ কমানোসহ কোন পদৰেপই বাজারের ঊধর্্বমুখী প্রবণতা থামাতে পারবে না বলে মনে করেন বিশেস্নষকরা। এ বিষয়ে মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, শুধু মার্জিন ঋণ সঙ্কোচনের নির্দেশনা দিয়ে শেয়ারবাজারে ঝুঁকির হার কমানো যাবে না। বর্তমানে অধিকাংশ শেয়ারের দর যে পর্যায়ে পেঁৗছেছে তাতে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নিজেরাই সতর্কভাবে ঋণ দিচ্ছে। ফলে এ বিষয়ে এসইসির নির্দেশনা নতুন করে কোন প্রভাব ফেলতে পারবে না। বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ও পুঁজির প্রবাহ যেভাবে বাড়ছে তাতে এই মুহূর্তে শেয়ারের সংখ্যা দ্রম্নত বাড়ানো ছাড়া শেয়ারবাজারকে ঝুঁকিমুক্ত করার অন্য কোন পথ নেই।
সংশিস্নষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নানা মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংক আমানত ও সঞ্চয়ের সুদের হার কমে যাওয়ার কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষ পুঁজিবাজারের দিকে ঝুঁকছেন। এ কারণেই প্রতিদিনই নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসছেন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ (সিডিবিএল)'র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এক বছরের ব্যবধানে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৭ থেকে বেড়ে ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০টিতে দাঁড়িয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি শেয়ারবাজারে নগদ টাকার প্রবাহও ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কালো টাকা সাদা করার শর্তহীন সুযোগ গ্রহণ করে অনেকেই বিপুল পরিমাণ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছেন। কারণ অন্যান্য খাতের চেয়ে শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগে ঝামেলা কম, মুনাফার সুযোগ বেশি। এ কারণে গত ৬ মাসে বিপুল পরিমাণ কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হয়েছে বলে সংশিস্নষ্টরা ধারণা করছেন। পাশাপাশি শিল্পখাতে বিনিয়োগ প্রত্যাশা অনুযায়ী না বাড়ায় ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত তারল্য শেয়ারবাজারে ঢোকানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এসব কারণেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। ইতোমধ্যেই দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ১৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
অর্থের প্রবাহ বাড়লেও সেই তুলনায় নতুন কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ছে না। সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) সিদ্ধানত্মহীনতা, কোম্পানির ৪০ শতাংশ শেয়ার ছাড়ার বাধ্যবাধকতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক নতুন ইসু্য বাজারে আসতে পারছে না। এর বিপরীতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় তীব্র হয়ে উঠেছে ভাল শেয়ারের সঙ্কট। চাহিদা ও যোগানের এই অসামঞ্জস্যতা কমাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে না পারলে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়তে পারে বলে বিশেস্নষকরা মনে করেন।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারে যে হারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। এর ফলে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। অনাকাঙ্ৰিত পরিস্থিতি এড়াতে এখনই উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নতুন নতুন কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসতে হবে।
সংশিস্নষ্টরা মনে করেন, শেয়ারবাজারকে অস্থিতিশীলতা থেকে রৰা করতে হলে এখনই ভাল শেয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে। যেসব কোম্পানির আইপিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যথাযথভাবে যাচাইয়ের মাধ্যমে সেগুলোকে দ্রম্নত অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন মিউচু্যয়াল ফান্ডগুলোর অনুমোদনে এসইসি'র নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তন করা প্রয়োজন। একইভাবে সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার প্রক্রিয়া স্বল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা হলে শেয়ারবাজারে বিপুলসংখ্যক শেয়ার যুক্ত হবে_ যা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সভাপতি রকিবুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারে চাহিদা অনুযায়ী ভাল শেয়ারের সরবরাহ নেই। ফলে অনেক শেয়ারই অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় বাজারে শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শেয়ারবাজার নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তাতে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সম ভাল কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার এটাই উপযুক্ত সময়। একই সঙ্গে লাভজনক বিদেশী কোম্পানিগুলোর শেয়ার ছাড়ার বিষয়ে পদৰেপ নেয়া প্রয়োজন। এতে একদিকে যেমন পুঁজিবাজারে ভাল শেয়ারের সঙ্কট কাটবে, তেমনি সবধরনের বিনিয়োগকারীর জন্য পুঁজি বিনিয়োগের দরজাও প্রসারিত হবে।
সংশিস্নষ্টরা মনে করেন, পুঁজিবাজারে ভাল শেয়ারের সঙ্কট কাটাতে হলে সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (এসইসি) উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেসব কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রসত্মাব (আইপিও) প্রক্রিয়াধীন রয়েছে যথাযথভাবে যাচাইয়ের মধ্যে এগুলোকে দ্রম্নত অনুমোদন দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া এসইসির কাছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ৫২ মিউচু্যয়াল ফান্ড গঠনের প্রসত্মাব জমা আছে। দীর্ঘ কয়েক মাস আগে জমা দেয়া হলেও এসইসির দিক থেকে 'ধীরে চলো' নীতির কারণে এসব প্রসত্মাব আটকে আছে। একইভাবে নীতিগত সিদ্ধানত্ম থাকলেও সরকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ছাড়ার প্রক্রিয়া অগ্রসর হচ্ছে না। স্বল্প সময়ের মধ্যে এসব প্রক্রিয়া শেষ করা হলে শেয়ারবাজারে বিপুলসংখ্যক শেয়ার যুক্ত হবে_যা বাজারের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, শক্তিশালী পুঁজিবাজারকে দেশের উৎপাদনমুখী খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতির বিকাশে কিভাবে কাজে লাগানো যায়_ সরকারের দিক থেকে সে ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। এজন্য বিদু্যত, গ্যাসসহ অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং শিল্প খাতকে শক্তিশালী করতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সরবরাহের প্রক্রিয়া গতিশীল করতে হবে। এৰেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারলে একদিকে যেমন জাতীয় অর্থনীতি গতিশীল হবে_ তেমনি পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থের নিরাপত্তা বাড়বে।
বাজারে শেয়ারের যোগান বাড়ানোর প্রয়োজনীতা স্বীকার করে এসইসি চেয়ারম্যান জিয়াউল হক খন্দকার জানিয়েছেন, কমিশনের কাছে যেসব নতুন ইসু্যর প্রসত্মাব জমা আছে_ প্রয়োজনীয় পরীৰা-নিরীৰার পর এগুলো বাজারে আনা হচ্ছে। এছাড়া অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া দ্রম্নততর হলে শেয়ার সঙ্কট দূর হবে বলে তিনি মনে করেন।
No comments