শ্বতপাথরের ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ, নান্দনিক যুগল মন্দির by বাবুল হোসেন
রাজবাড়ির ঠিক মাঝখানে শ্বেতপাথরের সয়ংক্রিয় ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ। পাশে নান্দনিক কারম্নকার্য খচিত রাজরাজেশ্বরী মন্দির। পেছনে রাজ কোষাগার, টিন ও কাঠের সুরম্য দ্বিতল রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদ লাগোয়া রাজমাতার অন্দরমহল।
রাজরক্ষী ও প্রহরীদের আসত্মানা। রাজবাড়ির সম্মুখভাগের বিশাল লোহার ফটক পেরম্নতেই সু-উচ্চ করিডর। এর একপাশে রাজদরবার ও দ্বিতল কাছারিঘর। আরেক পাশে লাইব্রেরী। করিডরের দু'পাশে ছিল হাতির ছয়টি মাথার উপর শিকার করা বাঘের নমুনা। রঙ্গমঞ্চ আর এই করিডরের মাঝখানে ছিল লক্ষ্মীপুজো, দুর্গাপুজোর ঘর। এসবের অনেক কিছুই এখন কিংবদনত্মি, কালের সাক্ষী, হারিয়ে যেতে বসেছে। তারপরও মুক্তাগাছার ষোল হিস্যার জমিদার মহারাজ সূর্যকানত্ম আচার্য চৌধুরীর রাজবাড়িটিতে এখনও দেখার আছে অনেক কিছু। রাজবাড়ি লাগোয়া বিশাল সব পুকুর, মন্দির ও যুগল মন্দিরসহ সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এই বাড়িটি ঘুরেফিরে দেখলে মন জুড়িয়ে যায়।ময়মনসিংহ শহর থেকে মুক্তাগাছা জমিদার বাড়ির দূরত্ব মাত্র ১৬ কিমি। এই মুক্তাগাছায় ছিলেন ষোল হিস্যার জমিদার। ষোলজন জমিদার মুক্তাগাছা অঞ্চল শাসন করতেন। মহারাজ সূর্যকানত্ম আচার্য চৌধুরী ছিলেন অন্যতম জমিদার। তারই দত্তক পুত্র মহারাজ শশীকানত্ম আচার্য চৌধুরী। মুক্তাগাছার দর্শনীয় স্থানসমূহের এই রাজপরিবারের বাড়িটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রায় এক শ' একর জমির উপর রাজপরিবারের তিনটি বাড়ির অবস্থান। এক নম্বর বাড়িটি ছিল মহারাজ সূর্যকানত্মের। সম্মুখভাগের একতলা ভবনটি বেশ উঁচু ও উপরিভাগে নানা কারম্নকার্য খচিত রয়েছে। লোহার পাত ও কাঠের পাটাতনের ওপর এর ছাদ নির্মিত। এর চারপাশে ব্যবহৃত লোহার পাতেও রয়েছে নানা নকশা খচিত। পবশ চওড়া করিডর। হাতি অনায়াশে এই ভবনের নিচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারত। এই ভবনের একপাশে ছিল রাজদরবার আরেক পাশে লাইব্রেরী। রাজদরবারের পেছনে দ্বিতল ভবনে ছিল কাছারি। লাইব্রেরীর পেছনের একতলা ভবনে ছিল মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামে শ্বেতপাথর ও কষ্টিপাথরের নানা মূর্তিসহ জমিদারদের ব্যবহৃত ঢাল তলোয়ার ও নানা সামগ্রী ছিল। মিউজিয়াম ও কাছারি লাগোয়া ছিল চমৎকার ভেন্টিলেশনের লক্ষ্মীপুজো ও দুর্গাপুজোর দৃষ্টিনন্দন ঘর। লক্ষ্মীপুজো ঘরের মূর্তি রাখার আসনটি মোড়ানো ছিল শামুক আর ঝিনুকসহ মূল্যবান পাথর দিয়ে। তেমনি দুগাপুজোর ঘরটিও ছিল চমৎকার। এসবের পেছনে রাজবাড়ির ঠিক যেন মাঝখানে ছিল সয়ংক্রিয় ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ। এটি শ্বেতপাথরে নির্মিত ছিল। পরে এটি ময়মনসিংহ শহরের টাউনহলে স্থাপন করা হয়েছিল। মুক্তাগাছা রাজবাড়ির এই রঙ্গমঞ্চের পাশেই ছিল রাজেশ্বরী মন্দির। এর মেঝে শ্বেতপাথরে মোড়ানো। দরজায় জোড়া সিংহ ও জোড়া ময়ূরসহ সিমেন্টের ওপর নানা কারম্নকার্যখচিত রয়েছে। রঙ্গমঞ্চের পেছনে আছে গোপন রাজকোষের সুরক্ষিত লোহার পাঁচ কুঠুরি। রাজ পরিবারের সোনাদানা, হীরা মানিক মুক্তাসহ নগদ অর্থকড়ি রাখা হতো এই সুরক্ষিত কুঠুরিতে। এর পেছনে রয়েছে টিন কাঠের দ্বিতল সুরম্য রাজপ্রাসাদ, মহারাজ শশীকানত্মের শোবার ঘর। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর এই ঘরের নিচতলায় চারপাশে করিডর দিয়ে ঘেরা চারটি পৃথক কক্ষ। এসব কক্ষের চারপাশ কাঁচ দিয়ে ঘেরা ছিল। তবে বাথরম্নম লাগোয়া উপরের চারটি কক্ষ ছিল লোহার পাত দিয়ে ঘেরাও করা। শশীকানত্মের শোবার ঘরের এক কোনায় ছিল রাজমাতার ঘর। এটিও টিন ও কাঠের দ্বিতল। পুরো বাড়ির পেছনে রাজরক্ষী ও প্রহরীদের থাকার ব্যবস্থা। এর পেছনে গোপন সুরঙ্গ। জনশ্রম্নতি রয়েছে, এই সুরঙ্গপথে মুক্তাগাছা রাজবাড়ির সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরের শশীলজের যোগাযোগ ছিল। চারপাশে দেয়াল দেয়া ঘেরা বাড়ির পেছনে বিশাল পুকুর। মূলত এটিই ছিল মুক্তাগাছায় শশীকানত্মের বসতবাড়ি। বর্তমানে এই রাজবাড়িটি জাতীয় জাদুঘরের অধীনে রয়েছে। জাদুঘরের অধীনে থাকা বাড়িটি দেখভাল করতে দু'জন কর্মচারীও রয়েছে। কিন্তু তাদের বেতন মিলছে না গত দু'বছর ধরে। বাড়ির মালিকানা নিয়ে চলছে আইনী লড়াই। এসব কারণে জাদুঘরও বাড়িটির কোন সংস্কার করতে পারছে না। ফলে সুন্দর স্থাপত্যশৈলীর এই বাড়িটি এখন বিপন্নের পথে। এই রাজবাড়ির পাশে আরও দুটি রাজবাড়ি রয়েছে। এক পাশের দু'নম্বর বাড়িটি ছিল শশীকানত্মের এক ভাইয়ের। এটি বর্তমানে মুক্তাগাছা শহীদ স্মৃতি ডিগ্রী কলেজ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আরেক পাশের তিন নম্বর বাড়িটিতে রাখা হতো রাজপরিবারের হাতি। প্রচার রয়েছে এই পরিবারের ৯৯ হাতি ছিল। সেই হাতিশালাটিতে এখন আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ হেডকোয়ার্টার করা হয়েছে। এই তিনটি বাড়ির সামনে আরও আছে গোপাল মন্দির, শিব মন্দির। একটু দূরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন যুগল মন্দির। এছাড়া মুক্তাগাছা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও অনেক বিশাল বিশাল পুকুর। প্রজাসাধারণের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে জমিদাররা এসব পুকুর খনন করেছিলেন। মুক্তাগাছা রাজপরিবারের অনেক নিদর্শন খোয়া গেছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও লুট হয়ে গেছে বাড়ির মূল্যবান অনেক সম্পদ।
No comments