‘এবার মেসির চাই বিশ্বকাপ’ by জাহিদুল আলম জয়
শচীন টেন্ডুলকরের সঙ্গে বেশ সাদৃশ্য লিওনেল মেসির! ভারতীয় ক্রিকেট ঈশ্বরকে বলা হয় রেকর্ড গড়ার কারিগর। গত ডিসেম্বরে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরে যাওয়া লিটল মাস্টার ক্যারিয়ারে অগণিত গৌরবময় রেকর্ড গড়েছেন।
বলা যায়, ক্রিকেটের প্রায় সব উজ্জ্বল রেকর্ডের মালিক শচীন রমেশ টেন্ডুলকর। সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিন্ন মতামত, এসব অর্জনই শচীনের বৃথা যেত যদি না তিনি ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ট্রফি না জিততেন। ক্যারিয়ারের ঊষালগ্নে এসে বিশ্বকাপ জিতে অবশেষে পরিতৃপ্তির হাসি হাসেন এ কালের ডন ব্র্যাডম্যান। ফুটবল তারকা লিওনেল মেসির পথচলাও হবহু শচীনের মতো! স্প্যানিশ ক্লাব বার্সিলোনার হয়ে বছরের পর বছর রেকর্ডের বরমাল্য পরছেন। নতুন বছরের শুরুতে বিশ্বরেকর্ড গড়ে জিতেছেন টানা চারবার ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার। মূলত এ পর্যন্ত মেসির যা অর্জন তা এসেছে ক্লাবের হয়ে সাফল্যের কারণেই। বার্সার হয়ে স্বর্ণসাফল্য পেলেও জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে মেসি ম্লান। অবাক করা ব্যাপার, ২০০৫ সাল থেকে জাতীয় দলে খেলে এখন পর্যন্ত জিততে পারেননি কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা।বর্তমানে বয়স ২৫। ক্যারিয়ারের মধ্যগগন হলেও আগামী বছর ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপই মেসির শেষ সুযোগ মনে করছেন অনেকে! ফুটবল বিশেষজ্ঞদের মতে, সর্বকালের সেরা হতে ও আক্ষেপ ঘোচাতে ২০১৪ বিশ্বকাপই হবে মেসির আদর্শ উপলক্ষ। সেবার না পারলে ২০১৮ বিশ্বকাপের সময়ে মেসির বয়স হবে ৩০ বছর। তখন চলতি ফর্ম থাকবে কিনা তা নিয়ে ঢের সংশয় আছে। এসব বিবেচনায় এখন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত, ব্রাজিল বিশ্বকাপই মেসির শেষ সুযোগ। শচীনের মতো তাই মেসিও বিশতম বিশ্বকাপ জয়ের জন্য মরিয়া থাকবেন তা বলাইবাহুল্য। টানা চারবার ফিফা বর্ষসেরা হওয়ার পর আর্জেন্টাইন অধিনায়কও এমন ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন। এক সাক্ষাতকারে সময়ের সেরা ফুটবলার অকপটে বলেছেন, ‘আমি বিশ্বকাপ চাই’।
দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা পায়নি আর্জেন্টিনা। সেই ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্বের আসর কোপা আমেরিকা কাপে শিরোপা জিতেছিল আকাশী-সাদা জার্সিধারীরা। বিশ্বকাপ জয় তো আরও সুদূরে। ১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার জাদুতে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। এর পরের আসরগুলোতে সঙ্গী শুধুই হতাশা আর আপসোস। লিওনেল মেসির আবির্ভাবের পর অনেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেন, বিশ্বকাপ খরা কাটবে আর্জেন্টিনার। কিন্তু ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয় ম্যারাডোনার শিষ্যরা। ২০১১ সালে ঘরের মাটিতে কোপা আমেরিকা কাপেও দেশকে শিরোপা উপহার দিতে ব্যর্থ হয় মেসি বাহিনী। দেশের হয়ে ধারাবাহিক এই ব্যর্থতার মাঝে ক্লাব দল বার্সিলোনার হয়ে ঠিকই একের পর এক সাফল্য পেয়ে চলেছেন ২৫ বছর বয়সী মেসি। দেশের হয়ে কিছু জিততে না পারলেও তাই টানা চারবার ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন বর্তমান সময়ের এই সেরা ফুটবলার। অবশেষে দেশের হয়ে এই না পারার হতাশা দূর করার ঘোষণা দিয়েছেন লিওনেল মেসি। মেসির এ ঘোষণা অবশ্য নতুন কিছু নয়, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। এরপর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয়বার ফিফা সেরা হওয়ার পর একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। এবার ফিফা সেরার মুকুট অক্ষুণœ রাখার পর ফের বিশ্বকাপ জয়ের সুপ্ত বাসনার কথা বলেছেন মেসি।
প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নের কথা জানিয়ে মেসি বলেছিলেন, ‘দেশের হয়ে বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকা জেতা আমার স্বপ্ন, যা আমি এখনও পূরণ করতে পারিনি। তবে আমি নিশ্চিত সেটা একসময় অবশ্যই পারব।’ নিজের আকাক্সক্ষার কথা বলতে গিয়ে মেসি আরও বলেছিলেন, ‘ধীরে ধীরে আমাদের দল উন্নতি করছে। আশা করি আমরা একসময় বিশ্বকাপ জিততে পারব।’ এরপর গত বছর ফিফা সেরা হওয়ার পর মেসি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ব্যালন ডি’অরের চেয়ে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ জয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি যদি আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারি তাহলে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই নেই। এই অর্জনের জন্য যদি আমি পরের দুই বছর ব্যালন ডি’অর এ্যাওয়ার্ড জিততে নাও পারি তাহলেও কোন আপসোস নেই।’ কিন্তু মেসির ইচ্ছা পূরণ হয়নি! তিনি এবারও জিতে নিয়েছেন ফিফা বল্যান ডি’অর পুরস্কার। বিরল কীর্তিগাথা রচনার পর ব্রাজিল বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছেন। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে মেসি বলেন, ‘বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে না। এটাই সত্য। আমি বিশ্বকাপের সঙ্গে ব্যালন ডি’অরের তুলনা করছি না। আমি সবসময় চেয়েছি এটা জিততে। আমি কখনই দুটোকে এক করে দেখি না।’ স্বপ্নকাতর মেসি আরও বলেন, ‘আমি বার্সিলোনা ও আমার দেশের হয়ে সব অর্জন করতে চাই। আমি সবসময় বলেছি, এটা আমার স্বপ্ন।’
গত বছর মেসির ৯১ গোলের ১২টি ছিল আর্জেন্টিনার হয়ে। আকাশী-সাদা জার্সিতে এক বছরে এক ডজন গোল এর আগে করেছিলেন শুধু ‘বাতিগোল’ সার্জিও বাতিস্তুতা। মেসি গত বছর দুটি হ্যাটট্রিকও করেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক হিসেবে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ওই অঞ্চলের সর্বোচ্চ গোলদাতাও মেসি। যোগ্য অধিনায়কের মতোই নেতৃত্ব দিচ্ছেন সামনে থেকে। এই পরিবর্তনে তুষ্ট মেসি। তিনি বলেন, ‘গত বছর দেশে আমাকে দারুণভাবে বরণ করে নেয়া হয়েছে। দেশের মানুষও এখন জাতীয় দলকে অসাধারণভাবে সমর্থন দিচ্ছে। অনেকদিন হয়ে গেল এই রসায়নটা হারিয়ে গিয়েছিল। বছরটা ভালভাবে শেষ করতে পারায় আমি খুশি। চারদিক থেকে সমালোচনা ধেয়ে আসা আর জাতীয় দল নিয়ে সবার ভাল ভাল কথা বলা আলাদা ব্যাপার। সমালোচনা হলে খারাপ তো লাগেই।’ দেশের মানুষের দুঃখ অনুধাবন করে মেসি বলেন, ‘আর্জেন্টিনার মানুষকে সেরাটা দিতে, আনন্দের উপলক্ষ এনে দিতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এখন আপনারা দলের সেই একতা দেখতেই পারছেন। এটাই আর্জেন্টিনাকে আরও শক্তিশালী বানিয়েছে। আমরা জানি, আমরা ঠিক পথেই আছি। কিন্তু আমাদের একতাবদ্ধ হয়ে আরও পরিশ্রম করে যেতে হবে।’ বার্সিলোনার ডায়মন্ড বলেন, এত প্রাপ্তির মধ্যে অপ্রাপ্তি শুধু একটা বিশ্বকাপ। সত্যি কথা বলতে, যদি ব্যালন ডি’অরের সঙ্গে বিশ্বকাপ ট্রফি অদল-বদলের কোন সুযোগ থাকত তাহলে আমি অবশ্যই বিশ্বকাপকে বেছে নিতাম। সবসময় আমি এভাবেই ভাবি। কোন কিছুর সঙ্গেই বিশ্বকাপ জয়ের তুলনা হয় না। আমি সবসময় বলে আসছি আমি বার্সিলোনা ও জাতীয় দল আর্জেন্টিনার হয়ে আরও সাফল্য চাই। আর এটাই আমার সব সময়ের স্বপ্ন।’ আর্জেন্টিনার ফুটবল নিয়ে আলোচনা এলে সবসময়ই সামনে চলে জীবন্ত কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনার সঙ্গে লিওনেল মেসির তুলনা। আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বরের সঙ্গে এই বিশ্বকাপেই পিছিয়ে আছেন মেসি। ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনাই শেষবারের মতো আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে ভাসান। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার কীর্তিকে মেসি ছুঁতে পারবেন কিনা তা নিয়ে ইতোমধ্যে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে ফুটবলবিশ্বে। সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মেসি বলেন, ‘গত বছর পুরস্কার জিতে দেশে ফেরার পর সমর্থকরা আমার প্রতি যে ভালবাসা দেখিয়েছিল তাতে আমি কৃতজ্ঞ। আশা করি এবারও এমনটাই ঘটবে। জাতীয় দলের প্রতিও মানুষের সমান আবেগ। তাই জাতীয় দলের হয়ে আরও ভাল খেলার ব্যাপারে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। মাঝে অনেকদিন আমাদের দলের রসায়নটা কাজ করছিল না। তবে এখন দল যেভাবে নিজেদের সেরাটা দিতে পারছে তাতে আমি খুশি।’ আর্জেন্টিনার হয়ে শিরোপা জিততে যে মেসি ব্যাকুল তা পরিস্কার এ মন্তব্যে, ‘আসলে ব্যক্তিগত পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমি অন্তত সেভাবে আনন্দে ফেটে পড়তে পারি না। দলের সবার সঙ্গে একটা ট্রফি জেতায় যে বাঁধভাঙ্গা আনন্দ করা যায়; এখানে তা হয় না। আর দলীয় পুরস্কারের সঙ্গে এসব ব্যক্তিগত পুরস্কারের তুলনাও হয় না।’ তবে বাস্তবিক কোন লক্ষ্য নয়, মেসি বর্তমানে ডুবে থাকতেই বেশি পছন্দ করেন, ‘আমি আসলে এ রকম বাস্তবিক কোন লক্ষ্য নিয়ে খেলি না। আমি বর্তমানে ডুবে থাকতে বেশি পছন্দ করি।’ ব্যালন ডি’অর জয়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে বর্তমান বিশ্বসেরা ফুটবলার বলেন, ‘আমার পরিবারের সবার কাছে প্রথমবারের মতো ব্যালন ডি’অর জেতাটা ছিল অসাধারণ এক অনুভূতি। আর দ্বিতীয়টা ছিল একটা চমক। আমি দ্বিতীয় ট্রফিটা একদমই আশা করিনি। পরেরটা ছিল প্লাতিনি আর ক্রুইফের মতো কিংবদন্তির নামের পাশে নাম লেখানো। ব্যক্তিগতভাবে বিরাট সম্মানের ব্যাপার। এরপর আমি তাঁদের ছাড়িয়ে গেলাম। যদিও তাঁরা আমার কাছে আগের মতোই গ্রেট। তারপরও প্রতিটি পুরস্কারে ভিন্ন ভিন্ন এক অনুভূতি, ভিন্ন ভিন্ন গুরুত্ব আছে।’ তবে সবকিছু ছাপিয়ে বর্তমানে যে বিশ্বকাপই একমাত্র লক্ষ্য সেটা মেসি জানালেন অবলীলায়, ‘এসব রেকর্ড ভাল, পেতে ভাললাগে। তবে কি জানেন, আমি সবসময় এসব প্রাপ্তির স্বপ্ন দেখতে থাকি না। আমি অবশ্যই আরও জিততে চাই। সেটা বিশ্বকাপ হলে ভাল হয়।’ অর্থাৎ মেসির কথাতে স্পষ্ট, তাঁর স্বপ্ন দুটি। বার্সিলোনা ও আর্জেন্টিনা। বার্সিলোনার হয়ে ইতোমধ্যে তাঁর চাওয়া পূরণ হয়েছে। এবার পালা জাতীয় দলের হয়ে। এক্ষেত্রে ব্রাজিল বিশ্বকাপই আদর্শ মঞ্চ ক্ষুদে জাদুকরের। পারবেন কি মেসি? উত্তর আপাতত বন্দী সময়ের হাতেই।
No comments