ফিরে দেখা ২০১২
সাযযাদ কাদির: বছর শেষে পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে প্রথমেই মনের পরদায় ভেসে ওঠে হারিয়ে যাওয়া কাছের মানুষ, প্রিয় মানুষগুলোর মুখ।
মনে পড়ে কত কথা। কত স্মৃতি। একটা হু-হু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ভেদ করে। ভাবি, এই তো ছিলাম এক সঙ্গে... কথা বলেছি, হাসি-ঠাট্টায় মেতেছি, দুঃখ-অভিমানও করেছি। কখনও মনে হয়নি বিচ্ছেদ ঘটবে তাঁদের সঙ্গে, কিন্তু সত্যিই তো চোখের আড়াল হয়েছেন রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান খান শাহজাহান (২রা জানুয়ারি), ছড়াকার-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ (২০শে ফেব্রুয়ারি), সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী (১৬ই মে), কবি কবিরুল ইসলাম ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ (১৯শে জুলাই), কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ (৪ঠা সেপ্টেম্বর), কবি বাসুদেব দেব (৯ই অক্টোবর), বহুমাত্রিক লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (২৩শে অক্টোবর), চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত (১৬ই নভেম্বর), কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী (২৫শে নভেম্বর)... আরও কত ভাললাগা মানুষ। এ পর্যন্ত লিখতেই খবর এলো আরও এক প্রিয় শিল্পীর চিরবিদায়ের খবর। নজরুলগীতির নন্দিত গায়ক সোহরাব হোসেন আর নেই (২৭শে ডিসেম্বর)। খবরটা শুনতেই কানে ভেসে আসে তাঁর মধুকণ্ঠের গান। মনে পড়ে সংগীত জগতের আরও দুই নক্ষত্রকে হারিয়েছি এই বিদায়ী বছরে। সুরকার-সংগীত পরিচালক রবি (৭ই মার্চ) ও মেহেদি হাসান (১৩ই জুন)-এর কথা বলছি। তারা হারালেও তাদের গান কি হারাবে কখনও? না। আমাদের হারিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের গান থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এখানে যাদের কথা বললাম এরা সকলেই কৃতিত্বে কীর্তিতে অমর হয়ে থাকবেন সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে। তাদের মনে রাখবে দেশ, সম্মান শ্রদ্ধা জানাবে আন্তর্জাতিক বিদগ্ধ মহল। তবে আমি আরও দু’জনকে আজ স্মরণ করতে চাই বিশেষ করে। তারা খ্যাতিমান কেউ নন, বরণীয় স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব নন, হতেও চাননি... সাধারণ মানুষের মতোই বেঁচে থেকে নীরবে চলে গেছেন এই বিদায়ী বছরে। তবে চরিত্রে অসাধারণত্ব ছিল তাদের। যথাসময়ে যথাভূমিকা রাখার মতো মহিমাও ছিল। সে প্রমাণ রেখেছেন তারা। তখন বড় দুঃসময়। উনিশ শ’ একাত্তর। হানাদার পাকিবাহিনীর হত্যাবিভীষিকা দেশজুড়ে। তাদের দোসর ঘাতক দালালদের রক্তচক্ষু আরও ভয়ঙ্কর। অবরুদ্ধ শহরে উদ্যত সঙ্গীনের নিচে জীবন। যখন তখন হুমকিধমকি, ধরপাকড়, খুনজখম। হঠাৎ করে হামলা, পাকড়াও। তারপর বন্দিশিবিরে বধ্যশিবিরে নৃশংস মৃত্যু। কেউ কোনও মতে ধুঁকে-ধুঁকে প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসে নানা তদবির, কাকুতি-মিনতি, অনুনয়-বিনয়, ক্ষমাভিক্ষা করে... কিন্তু ফেরে না অনেকেই। আটক হয়ে, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে, ক্ষতবিক্ষত দেহে, চরম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও অপমান-অসম্মানের মধ্যে তখন অবরুদ্ধ শহর টাঙ্গাইলে চরম পরিণতির প্রতীক্ষা করছি আমরা- গোলাম আম্বিয়া নূরী, আখতার বোখারী, আনোয়ার বখশ, মোয়াজ্জেম হোসেন, এস এম রেজা, আবদুর রহমান রক্কু, নূরুন্নবী মাস্টার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী, আমি ও আরও ক’জন। এদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আনোয়ার বখশ (এখন আওয়ামীলীগের নেতা) ও মোয়াজ্জেম হোসেন (প্রয়াত), ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন এস এম রেজা (প্রয়াত) ও আবদুর রহমান রক্কু (পরে খ্যাতিমান নাট্যজন, প্রয়াত), শিবনাথ হাইস্কুলের শিক্ষক নূরুন্নবী মাস্টার ছিলেন ন্যাপ-নেতা। গোলাম আম্বিয়া নূরী এখন খ্যাতিমান নাট্যকার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী বিএনপি’র নেতা। শহরে তখন প্রায়ই চোরাগোপ্তা অপারেশন চলে কাদেরিয়া বাহিনীর। এক-একটি অপারেশনের পর পাকিরা পাকড়াও করে কয়েকজন করে কিশোর-তরুণকে, চলে অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যাও। কিন্তু বন্ধ হয় না অপারেশন। তখন পাকিরা বলে, পাড়ায়-পাড়ায় পাহারা দাও। কোনও বোমা যেন না ফাটে, গুলি যেন না চলে। চললেই তোমাদের কল্লা ঘ্যাচাং। ওই সময় আমাদের আকুরটাকুর পাড়ায় অসীম সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে যারা রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের একজন আমার প্রতিবেশী খাজা মিঞা। আমি ডাকতাম খাজা কাকা বা খাজাক্কা বলে। পাড়ার কিশোর তরুণ যুবকদের তিনি একত্রিত করেছিলেন এ কাজে। সে তরুণদের একজন আলমগীর। আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই, স্বাধীনতার পর আমার ছাত্র। রেজাউল হাসান বাবুল (সাংবাদিক, বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী), ইকবাল হাসান (স্বাধীনতার পর গুম) এবং আরও অনেকের সঙ্গে তারা দু’জন সময়োপযোগী ভূমিকা রাখায় সেই মৃত্যুভয়াল দুঃসময়ে আর কোনও মৃত্যু হানা দেয়নি আমাদের পাড়ায়। এ কৌশল পরে অন্যান্য পাড়াও গ্রহণ করে সমর্থ হয় আত্মরক্ষায়। ফলে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া, আশ্রয় নেয়া, খবর সংগ্রহ, অপারেশন চালানো সহজ হয় অনেকখানি। বিদায়ী বছরে হারিয়েছি প্রিয় খাজাক্কাকে, স্নেহের আলমগীরকে। বিপদে পাশে থাকার ভূমিকা নিয়ে তারা যে অবদান রেখেছেন তা যেন পাড়ার আমরা কেউ ভুলে না যাই কখনও। একাত্তরের আক্রান্ত জনপদে আরও অনেকে নিশ্চয়ই এমন মমতাময় ভূমিকা রেখেছেন তাদের মতো। তাদেরও স্মরণ করি আজ।
মনে পড়ে কত কথা। কত স্মৃতি। একটা হু-হু দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক ভেদ করে। ভাবি, এই তো ছিলাম এক সঙ্গে... কথা বলেছি, হাসি-ঠাট্টায় মেতেছি, দুঃখ-অভিমানও করেছি। কখনও মনে হয়নি বিচ্ছেদ ঘটবে তাঁদের সঙ্গে, কিন্তু সত্যিই তো চোখের আড়াল হয়েছেন রাজনীতিবিদ শামসুর রহমান খান শাহজাহান (২রা জানুয়ারি), ছড়াকার-সাংবাদিক ফয়েজ আহমেদ (২০শে ফেব্রুয়ারি), সাংবাদিক বাহাউদ্দিন চৌধুরী (১৬ই মে), কবি কবিরুল ইসলাম ও জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ (১৯শে জুলাই), কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ (৪ঠা সেপ্টেম্বর), কবি বাসুদেব দেব (৯ই অক্টোবর), বহুমাত্রিক লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (২৩শে অক্টোবর), চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত (১৬ই নভেম্বর), কবি অর্ধেন্দু চক্রবর্তী (২৫শে নভেম্বর)... আরও কত ভাললাগা মানুষ। এ পর্যন্ত লিখতেই খবর এলো আরও এক প্রিয় শিল্পীর চিরবিদায়ের খবর। নজরুলগীতির নন্দিত গায়ক সোহরাব হোসেন আর নেই (২৭শে ডিসেম্বর)। খবরটা শুনতেই কানে ভেসে আসে তাঁর মধুকণ্ঠের গান। মনে পড়ে সংগীত জগতের আরও দুই নক্ষত্রকে হারিয়েছি এই বিদায়ী বছরে। সুরকার-সংগীত পরিচালক রবি (৭ই মার্চ) ও মেহেদি হাসান (১৩ই জুন)-এর কথা বলছি। তারা হারালেও তাদের গান কি হারাবে কখনও? না। আমাদের হারিয়ে যাওয়ার পরেও তাদের গান থেকে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এখানে যাদের কথা বললাম এরা সকলেই কৃতিত্বে কীর্তিতে অমর হয়ে থাকবেন সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে। তাদের মনে রাখবে দেশ, সম্মান শ্রদ্ধা জানাবে আন্তর্জাতিক বিদগ্ধ মহল। তবে আমি আরও দু’জনকে আজ স্মরণ করতে চাই বিশেষ করে। তারা খ্যাতিমান কেউ নন, বরণীয় স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব নন, হতেও চাননি... সাধারণ মানুষের মতোই বেঁচে থেকে নীরবে চলে গেছেন এই বিদায়ী বছরে। তবে চরিত্রে অসাধারণত্ব ছিল তাদের। যথাসময়ে যথাভূমিকা রাখার মতো মহিমাও ছিল। সে প্রমাণ রেখেছেন তারা। তখন বড় দুঃসময়। উনিশ শ’ একাত্তর। হানাদার পাকিবাহিনীর হত্যাবিভীষিকা দেশজুড়ে। তাদের দোসর ঘাতক দালালদের রক্তচক্ষু আরও ভয়ঙ্কর। অবরুদ্ধ শহরে উদ্যত সঙ্গীনের নিচে জীবন। যখন তখন হুমকিধমকি, ধরপাকড়, খুনজখম। হঠাৎ করে হামলা, পাকড়াও। তারপর বন্দিশিবিরে বধ্যশিবিরে নৃশংস মৃত্যু। কেউ কোনও মতে ধুঁকে-ধুঁকে প্রাণটা নিয়ে ফিরে আসে নানা তদবির, কাকুতি-মিনতি, অনুনয়-বিনয়, ক্ষমাভিক্ষা করে... কিন্তু ফেরে না অনেকেই। আটক হয়ে, নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়ে, ক্ষতবিক্ষত দেহে, চরম লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ও অপমান-অসম্মানের মধ্যে তখন অবরুদ্ধ শহর টাঙ্গাইলে চরম পরিণতির প্রতীক্ষা করছি আমরা- গোলাম আম্বিয়া নূরী, আখতার বোখারী, আনোয়ার বখশ, মোয়াজ্জেম হোসেন, এস এম রেজা, আবদুর রহমান রক্কু, নূরুন্নবী মাস্টার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী, আমি ও আরও ক’জন। এদের মধ্যে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন আনোয়ার বখশ (এখন আওয়ামীলীগের নেতা) ও মোয়াজ্জেম হোসেন (প্রয়াত), ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন এস এম রেজা (প্রয়াত) ও আবদুর রহমান রক্কু (পরে খ্যাতিমান নাট্যজন, প্রয়াত), শিবনাথ হাইস্কুলের শিক্ষক নূরুন্নবী মাস্টার ছিলেন ন্যাপ-নেতা। গোলাম আম্বিয়া নূরী এখন খ্যাতিমান নাট্যকার, খন্দকার বাবুল চৌধুরী বিএনপি’র নেতা। শহরে তখন প্রায়ই চোরাগোপ্তা অপারেশন চলে কাদেরিয়া বাহিনীর। এক-একটি অপারেশনের পর পাকিরা পাকড়াও করে কয়েকজন করে কিশোর-তরুণকে, চলে অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যাও। কিন্তু বন্ধ হয় না অপারেশন। তখন পাকিরা বলে, পাড়ায়-পাড়ায় পাহারা দাও। কোনও বোমা যেন না ফাটে, গুলি যেন না চলে। চললেই তোমাদের কল্লা ঘ্যাচাং। ওই সময় আমাদের আকুরটাকুর পাড়ায় অসীম সাহস ও ঝুঁকি নিয়ে যারা রাত জেগে পাহারার ব্যবস্থা করেছিলেন তাদের একজন আমার প্রতিবেশী খাজা মিঞা। আমি ডাকতাম খাজা কাকা বা খাজাক্কা বলে। পাড়ার কিশোর তরুণ যুবকদের তিনি একত্রিত করেছিলেন এ কাজে। সে তরুণদের একজন আলমগীর। আমার কলেজ-জীবনের বন্ধু জাহাঙ্গীরের ছোট ভাই, স্বাধীনতার পর আমার ছাত্র। রেজাউল হাসান বাবুল (সাংবাদিক, বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী), ইকবাল হাসান (স্বাধীনতার পর গুম) এবং আরও অনেকের সঙ্গে তারা দু’জন সময়োপযোগী ভূমিকা রাখায় সেই মৃত্যুভয়াল দুঃসময়ে আর কোনও মৃত্যু হানা দেয়নি আমাদের পাড়ায়। এ কৌশল পরে অন্যান্য পাড়াও গ্রহণ করে সমর্থ হয় আত্মরক্ষায়। ফলে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আসা-যাওয়া, আশ্রয় নেয়া, খবর সংগ্রহ, অপারেশন চালানো সহজ হয় অনেকখানি। বিদায়ী বছরে হারিয়েছি প্রিয় খাজাক্কাকে, স্নেহের আলমগীরকে। বিপদে পাশে থাকার ভূমিকা নিয়ে তারা যে অবদান রেখেছেন তা যেন পাড়ার আমরা কেউ ভুলে না যাই কখনও। একাত্তরের আক্রান্ত জনপদে আরও অনেকে নিশ্চয়ই এমন মমতাময় ভূমিকা রেখেছেন তাদের মতো। তাদেরও স্মরণ করি আজ।
No comments