দেশের ফুটবলে বিদেশী কোচ উপাখ্যান
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের তৃতীয় কোচ ও প্রথম বিদেশী কোচ ছিলেন তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির বেকেল হফট। তাঁর মাধ্যমেই ইউরোপিয়ান (জার্মান) ফুটবল স্টাইলের সঙ্গে পরিচিত হয় বাংলাদেশের ফুটবলাররা।
১৯৭৮-৮১ পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে ছিলেন জাতীয় দলের। ক্ষ গেরহার্ড স্মিথ (জার্মানি) ॥ কোচ হিসেবে তিন বছর ছিলেন বেকেল হফট। তিনি চলে যান, তাঁরই স্বদেশী গেরহার্ড স্মিথকে বাংলাদেশ দলের দ্বিতীয় বিদেশী কোচ হিসেবে দায়িত্ব দেয় বাফুফে। সেটা ১৯৮২ সাল। মাত্র কয়েকমাস পরই তাঁকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ক্ষ নাসের হেজাজী (ইরান) ॥ দু’জন জার্মান কোচের অধীনে খেলে বাংলাদেশ দলের নৈপুণ্য আশাপ্রদ ছিল না। কাজেই বাফুফে ১৯৮৯ সালে মনস্থ করে, তারা এবার এশিয়ান কোচ আনবে। খুঁজে পাওয়া গেল ইরানের নাসের হেজাজীকে, যিনি ১৯৭৮ বিশ্বকাপে খেলোয়াড় হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তেমন সাফল্য না থাকলেও হেজাজী স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ দলকে একটি লড়াকু দলে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশের কোচ হওয়ার আগে ঢাকা মোহামেডানের কোচ কাম গোলরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বছর দুয়েক। নিজ দেশে ২০১১ সালে তিনি মারা যান ৬১ বছর বয়সে।ক্ষ ওল্ডরিখ সোয়াব (সুইজারল্যান্ড) ॥ হেজাজীর বিদায়ের পর আবারও ইউরোপিয়ান কোচ আনে বাফুফে। সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াব ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ দলের চতুর্থ বিদেশী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সাফল্যও তথৈবৈচ। ছিলেন মাত্র কয়েকমাস।
ক্ষ ম্যান ইয়াং ক্যাং (দক্ষিণ কোরিয়া) ॥ ১৯৮৬ থেকে বিশ্বকাপের মূলপর্বে টানা অংশ নিচ্ছে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। বাফুফের কর্তাদের মনে হলো, সেদেশ থেকেই কোচ আনলে হয়ত রাতারাতি উন্নতি সম্ভব। কাজেই ম্যান ইয়াং ক্যাং পরিণত হন জাতীয় ফুটবল দলের পঞ্চম বিদেশী কোচে। বিশ্বকাপ খেলা দেশ থেকে কোচ আনলেই যে উন্নতি সম্ভব নয়, সেটা প্রমাণ করে দিয়ে ওই বছরই (১৯৯৪) বিদায় নেন ক্যাং।
ক্ষ অটো ফিস্টার (জার্মানি) ॥ ক্যাংয়ের পর আবারও ‘জার্মান কোচ’ তত্ত্বে ফিরে যায় বাফুফে। ১৯৯৪ সালে অটো ফিস্টার আসেন তৃতীয় জার্মান এবং ষষ্ঠ বিদেশী কোচ হিসেবে (ছিলেন ১৯৯৭ পর্যন্ত)। তাঁর অধীনেই প্রভূত উন্নতি করে বাংলাদেশ। জেতে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের (১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। অধিনায়ক ছিলেন প্রয়াত মোনেম মুন্না)।
ক্ষ সামির শাকির (ইরাক) ॥ ইরাকের সামির শাকির জাতীয় দলের সপ্তম বিদেশী কোচ (১৯৯৮-১৯৯৯)। তাঁর কোচিংয়েই ১৯৯৯ সালের কাঠম-ু সাফ গেমসে প্রথমবারের মতো ফুটবলে স্বর্ণপদক করায়ত্ত করে বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ও ১৯৮৮ অলিম্পিকে ইরাকের হয়ে খেলা শাকিরের (ঢাকার ফুটবলেও খেলেছেন আবাহনীর হয়ে) বিদায়টা ছিল তিক্ত। বাংলাদেশকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করানোর পরই নিজ দেশে ফিরে যান তিনি। নেপথ্যে ছিল বাফুফের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ।
ক্ষ মার্ক হ্যারিসন (ইংল্যান্ড) ॥ ফুটবলের জন্ম দিয়েছে যে দেশ, সেই ইংল্যান্ড থেকে কাউকে কোচ করাটাই বাকি ছিল বাফুফের। ২০০০ সালে সেটাও করে ফেলে তারা। বাংলাদেশের অষ্টম বিদেশী কোচ হিসেবে মার্ক হ্যারিসন দায়িত্ব পালন করেন এবং চিহ্নিত হন অসফল কোচ হিসেবে। ভুটান সফরে গিয়ে সেখান থেকেই ইংল্যান্ডে ফিরে যান তিনি। দায়িত্বে ছিলেন ছয় মাস।
ক্ষ জর্জ কোটান (অস্ট্রিয়া) ॥ ২০০০ সাল। এবারও ইউরোপিয়ান কোচ। অস্ট্রিয়ার জর্জ কোটানের অধীনেই ২০০৩ সালের সাফ ফুটবল আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ২০০৩ সালে বাফুফের খেয়ালী কিছু কর্মকর্তার কারণে বিদায় নেন কোটান। অনেকেই এখনও আক্ষেপ করেন তিনি থাকলে আরও উন্নতি করত এদেশের ফুটবল।
ক্ষ আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি (আর্জেন্টিনা) ॥ এবার আর ইউরোপ বা এশিয়া নয়, ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনা থেকে ২০০৫ সালের আগস্টে কোচ নিয়ে আসে বাফুফে। আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি জাতীয় দলের দশম বিদেশী কোচ হিসেবে ছিলেন ২০০৭ সাল পর্যন্ত। আবেগপ্রবণ কোচ ক্রুসিয়ানির আমলেই বাংলাদেশ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে প্রভূত উন্নতি করে (১৪৩)। তাঁর অধীনে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ।
ক্ষ সৈয়দ নাঈমউদ্দিন (ভারত) ॥ ২০০৭ সালে একাদশ বিদেশী কোচ হিসেবে যোগ দেন সৈয়দ নাঈমউদ্দিন। ভারতের অন্যতম সেরা কোচ হলেও তিনি বাংলাদেশকে কোন সাফল্য এনে দিতে পারেননি, বরং চার মাসের মেয়াদকালে সমালোচিত হন ভালভাবেই!
ক্ষ এডসন সিলভা ডিডো (ব্রাজিল) ॥ ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা থেকে কোচ এসেছে, তাহলে পেলের ব্রাজিল বাদ থাকবে কেন? পরের বিদেশী (দ্বাদশ) কোচ ব্রাজিলের এডসন সিলভা ডিডো। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর পর্যন্ত কোচ ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে এর আগে যা হয়নি, সেটাই করেন ডিডো। একসঙ্গে জাতীয় দলের আট ফুটবলারকে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে দল থেকে বাদ দেন। ফলাফল উল্টো বাফুফেই তাঁকে বরখাস্ত করে!
ক্ষ জোরান জর্জেভিচ (সার্বিয়া) ॥ এমন পাগলাটে কোচ এর আগে দেখেনি বাংলাদেশ। সার্বিয়ার জোরান জর্জেভিচ ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র এক মাস দায়িত্ব পালন করেন। তারপরও এ সময়ে তাঁর অধীনে খেলেই এসএ গেমসে দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। রাতারাতি হিরো বনে যান তিনি। কিন্তু চুক্তি না মেনে আরও আকাশছোঁয়া উচ্চ পারিশ্রমিক দাবি করে তুলকালাম কা- বাঁধিয়ে বসেন। উপায় না দেখে তাঁকেও বাতিলের খাতায় পাঠিয়ে দেয় বাফুফে।
ক্ষ রবার্ট রুবচিচ (ক্রোয়েশিয়া) ॥ বিদেশী কোচ নম্বর ১৪- ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচ। তিনি দায়িত্ব নেন ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে। কিন্তু ২০১১ সালের ২ জুন কাউকে কিছু না জানিয়েই ফিরে যান স্বদেশে। যদিও তাঁর চুক্তির মেয়াদ ছিল ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। পরে জানা যায়, পাকিস্তানে গিয়ে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলতে যেতে হবে বলে তিনি দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। কারণ সহিংসতাপূর্ণ পাকিস্তানে গেলে নিজের প্রাণ সংশয়ে পড়ার জন্য যথেষ্ট ভীত ছিলেন শান্ত স্বভাবের এবং নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত রুবচিচ।
ক্ষ জর্জি ইয়োভানোভস্কি (মেসিডোনিয়া) ॥ রুবচিচের পর মেসিডোনিয়ার জর্জি ইয়োভানোভস্কিকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় বাফুফে। ২০১১ সালের ২০ জুন তাঁর জাতীয় দলের দায়িত্ব নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু রুবচিচ যে কারণে বাংলাদেশ ছেড়েছিলেন, একই কারণে বাংলাদেশেই আসেননি জর্জি! কোচ হয়েও সে দেশে না গিয়ে পদত্যাগ করা এমন ঘটনা বিশ্ব ফুটবলে বোধকরি বিরল। এজন্যই জর্জিকে বাংলাদেশের পঞ্চদশ বিদেশী কোচ হিসেবে গণ্য করতে চান না অনেকেই।
ক্ষ নিকোলা ইলিয়েভস্কি (মেসিডোনিয়া) ॥ মেসিডোনিয়ান জর্জি আসেননি তো কি হয়েছে, করিৎকর্মা বাফুফে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে মাত্র দুদিনের মাথাতেই তাঁরই স্বদেশী নিকোলা ইলিয়েভস্কিকে নিয়োগ দিয়ে দেয়! কিন্তু হলে হবে কি, তিনিও পুরো মেয়াদে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হন। এক বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেও ২০১১ সালের ডিসেম্বরেই ফিরে যান তিনি। জানা যায়, অতীতের কোচদের তিক্তকর বিদায়ের কথা মাথায় রেখে বাফুফে ইলিয়েভস্কিকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার প্রস্তাব দেয়। আর মান বাঁচাতে ইলিয়েভস্কিও সেটা মেনে নিয়ে ‘হাসিমুখে’ সংবাদ সম্মেলন করে বিদায় নেন, যেটা বাংলাদেশের আর কোন কোচের বেলায় ঘটেনি।
ক্ষ লোডভিক ডি ক্রুইফ (হল্যান্ড) ॥ বাংলাদেশ দলের প্রথম ডাচ্ এবং ষষ্ঠদশ বিদেশী কোচ হিসেবে জুন থেকে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছেন ৪৩ বছর বয়সী লোডভিক ডি ক্রুইফ। বাফুফের সঙ্গে তাঁর চুক্তি দুই বছরের। তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ার তেমন উল্লেখযোগ্য না হলেও ১৮ বছরের কোচিংয়ের শেষদিকে এসে ভাল করেছেন। নাইজিরিয়ান ক্লাব হার্টল্যান্ডকে পর পর দুইবার এফএ কাপ ও সুপার কাপ চ্যাম্পিয়ন করেছেন। হয়েছেন দেশটির বর্ষসেরা কোচ। লন্ডনে বাফুফে সভাপতি কাজী মোঃ সালাউদ্দিনের সঙ্গে আলোচনায় ক্রুইফ মৌখিকভাবে সম্মতি জানানোর পর ঢাকায় আসেন। স্বদেশী রেনে কোস্টার হবেন তাঁর সহকারী। এখন দেখার বিষয়, ফিস্টার, শাকির ও কোটানের মতো বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক কোন শিরোপা এনে দিতে পারেন কি না ‘টোটাল ফুটবলের দেশ’ হল্যান্ডের ক্রুইফ।
No comments