আদালত চত্বরে পুলিশি নিষ্ঠুরতা- তরুণীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ, পুলিশের তদন্তে নির্দোষ পুলিশ!
‘বাদিনী তাঁর অপরাধী স্বামী ফারুককে পুলিশের গ্রেপ্তার থেকে রক্ষার জন্য এবং পুলিশ সদস্যদের জনগণের কাছে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ভুল তথ্য দিয়ে এই মামলার ঘটনা সৃষ্টি করেন। যাহা তথ্যগত ভুল বলে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।’
পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা শ্লীলতাহানির অভিযোগ তদন্ত করে আদালতে এভাবে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।গত বছরের ২৯ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে বিচারপ্রার্থী এক তরুণী পুলিশের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তোলেন। পুলিশ দুই দফায় তরুণী ও তাঁর বাবা-মাকে কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আটকে রাখে। পরে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামালের হস্তক্ষেপে মেয়েটিসহ তাঁর বাবা-মা থানা থেকে মুক্তি পান এবং মেয়েটির মা পুলিশের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন।
মামলার আসামিরা হলেন: পরিদর্শক ওমর ফারুক, উপপরিদর্শক (এসআই) জিয়ারত হোসেন, এসআই নাজমুল হুদা, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) নুরুজ্জামান, এএসআই আমির আফজাল, কনস্টেবল মিজানুর রহমান ও পুলিশের সোর্স বাবু। আসামি পুলিশ সদস্যরা তখন বংশাল ও কোতোয়ালি থানায় কর্মরত ছিলেন। মামলার পর চার পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
যে ঘটনায় মামলা: ২৯ মে ওই ঘটনার দিন মেয়েটি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করতে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর উত্তরখান এলাকা থেকে আদালতে এসেছিলেন তিনি। মামলা করতে না পেরে দুপুর ১২টার দিকে ফিরে যাওয়ার সময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা পুলিশ ক্লাবের সামনে তাঁদের আটকান। পুলিশ তাঁর বাবাকে ‘ডাকাত’ বলে শার্টের কলার ধরে টানতে থাকলে মোটরসাইকেল কাত হয়ে তাঁরা তিনজনই পড়ে যান। এরপর পুলিশ তাঁর বাবাকে মারতে মারতে তাঁর মা ও তাঁকেসহ পুলিশ ক্লাবের ভেতরে নিয়ে যায়। সেখানে দুই পুলিশ সদস্য তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাঁর সঙ্গে চরম অশালীন আচরণ করেন। এক পুলিশ সদস্য তাঁর গলা থেকে চেইন খুলে নেন। প্রতিবাদ করলে গালে চড় মারেন। চড়ের আঘাতে মেয়েটির কানের দুল চামড়ার ভেতরে ঢুকে যায়।
মেয়েটি সাংবাদিক ও আইনজীবীদের সামনে ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার সময় পুলিশের লালবাগ বিভাগের তৎকালীন সহকারী কমিশনার রাজীব আল মাসুদ ও কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দীন খানের উপস্থিতিতে পুলিশ সাংবাদিক ও আইনজীবীদের মারধর করেন। এ নিয়ে পরদিন ৩০ মে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ‘আদালত চত্বরে পুলিশি নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
হামলার পর ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে এক সপ্তাহ আগে রাজীব আল মাসুদ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান। সালাহউদ্দীন মিরপুর থানার ওসি পদে বদলি হয়েছেন।
তরুণীকে নির্যাতনের মামলা দায়েরের কয়েক দিন পরেই মামলাটির তদন্তভার পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মামলার বিবরণকে ‘তথ্যগত ভুল’ হিসেবে উল্লেখ করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক মিয়া জাহিদ হোসেন। আদালত মামলাটি বিচারের জন্য ৩ জানুয়ারি ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩-এ পাঠান।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ‘তদন্তকালে মামলার রুজুকৃত ধারা (অভিযোগ) প্রমাণ করার মতো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে সংযোজিত ধারার কোনো উপাদান বাদীর অভিযোগ এবং আমার নিরপেক্ষ তদন্তে পাওয়া যায়নি। সার্বিক তদন্তে প্রদত্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে আনীত অভিযোগ প্রাথমিকভাবে তথ্যগত ভুল প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্ত সাতজনকে অব্যাহতিদানের প্রার্থনা করছি।’
ট্রাইব্যুনাল সূত্র জানায়, মামলার নথি গ্রহণ করা হবে কি না, আদালত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। মামলায় কিছু ধারাগত সমস্যা রয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা মিয়া জাহিদ হোসেন দাবি করেন, তদন্তে তিনি যা পেয়েছেন, সে মোতাবেকই প্রতিবেদন দিয়েছেন।
ঘটনার শিকার তরুণী পুলিশের এই প্রতিবেদন নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘ঘটনা ভুল হবে কেন? তাহলে তো আর আমরা এত দূর যেতাম না।’
No comments