অরণ্যে রোদন-আমার মতন সুখী কে আছে by আনিসুল হক
সেদিন সকালবেলা বিবিসি বাংলা শুনছিলাম রেডিওতে। সেদিনের পত্রিকা নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচকেরা কথা বলছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিল পরিচালিত বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম শীর্ষক জরিপ নিয়ে। ওই জরিপে বলা হয়েছে, ৮৮ ভাগ তরুণ নিজেদের মনে করে সুখী বা খুব সুখী। আবার ৪১ শতাংশ তরুণ বিদেশে যেতে চায়।
বিদেশে যেতে চাওয়ার কারণ, বিদেশে বেশি আয় বা শিক্ষার সুযোগ আছে আর তার বিপরীতে দেশে রয়েছে চাকরি-স্বল্পতা। আলোচকদের চিন্তা ছিল, সুখীই যদি হবে, তবে তারা বিদেশে যেতে চায় কেন?
সুখী মানুষেরা বিদেশে যেতে চাইতে পারবে না, সে কথা অবশ্য কোনো পুস্তকে লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। বরং বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নটা হূদয়ে ধারণ করার সুযোগ থাকাটাও হয়তো ওই ৪১ ভাগের অনেকের সুখের কারণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিদেশে যেতে চায় না, এ রকম একটা বিরাট অংশও সুখী। অন্যদিকে ৫৯ ভাগ তরুণ তো বিদেশেও যেতে চায় না।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপের ফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। বাংলাদেশের তারুণ্যের ওপর পরিচালিত এই জরিপের ফল অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হলেও আমার কাছে মোটেও অভাবনীয় কিছু বলে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, অনেক ইতিবাচক, দারুণ আশাপ্রদ।
প্রথম কথা, এই তরুণেরা অসুখী নয়। নিশ্চয়ই এই সুখের পেছনে কাজ করে বিরাট আশাবাদ যে, বাংলাদেশটার হবে। কিছুই হবে না, এটা বৃদ্ধদের মুখে শোনা যেতে পারে, তরুণেরা কেন এই রকম বলবে বা ভাববে? কিছুই হবে না, এই রকম পরিস্থিতিতে তারা বলবে, আপনাআপনিই কিছুই হবে না, না হোক, আমরা না-টাকে হ্যাঁ বানিয়ে ফেলব। এই কারণেই তো আমরা তরুণ।
আর এই আশাবাদ, এই ইতিবাচকতা যাদের মধ্যে আছে, তারা তো সুখীই হবে। ইতিবাচক মানুষ কেন অসুখী হবে? তারা অসন্তুষ্ট হতে পারে, বিক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু তারা অসুখী হয় না। পথে-প্রান্তরে মুক্তির সংগ্রামে স্টেনগানে হাতরাখা তরুণও অসুখী নয়, দাবি আদায়ের মিছিলে সোচ্চার মানুষটিও নিজেকে অসুখী ভাবে না।
এই জরিপ থেকেই দেখা যাচ্ছে, ৭০ ভাগ তরুণ মনে করে, দেশ ঠিক পথেই এগোচ্ছে। সার্বিক দিক থেকে দেখলে, দেশ অবশ্যই ঠিক পথে এগোচ্ছে। প্রথম কথা, বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ। নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথ থেকে এই দেশ সরে যায়নি। গণতন্ত্রের প্রতি এই দেশের মানুষের যে অঙ্গীকার, তা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। ৬৪ শতাংশ তরুণ মনে করে, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মৌলবাদী রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমরাও মনে করি, অদূর ভবিষ্যতেও এই দেশের মৌলবাদী হয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ এই দেশের মানুষ মোটের ওপর মধ্যপন্থী, নরম প্রকৃতির, পরমতসহিষ্ণু। তারা সহজেই নতুনকে গ্রহণ করতে পারে। সহজে খাপ খাইয়েও নিতে পারে। জরিপ থেকে দেখছি, ৭৩ ভাগ তরুণ-তরুণীর হাতে মুঠোফোন আছে, আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ১৫ ভাগ। সাড়ে পাঁচ কোটির ১৫ ভাগ কিন্তু সংখ্যায় কম নয়। আমরা যদি আমাদের প্রতিদিনের ছোটখাটো রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা ভুলত্রুটির হিসাব না কষে বড় একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই সঠিক পথেই আছে। থাকার মতো কতগুলো প্রাকৃতিক সুবিধাও আছে। আগেই বলেছি, এই দেশের মানুষ নরম, উদার, আধুনিক, সমন্বয়বাদী ও মুক্তমনা। সংকীর্ণতার মধ্যে তারা নেই, ডান বা বাম কোনো চরম পন্থার সঙ্গেই তারা নেই। গোষ্ঠীগত জাতিগত প্রদেশগত দাঙ্গাহাঙ্গামার অবকাশ এই দেশে নেই। আজকে মাওবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্যায় আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম হারাম, পাকিস্তানে রোজ বোমা ফুটছে। নেপাল বা শ্রীলঙ্কা যেকোনো দেশের তুলনায়ই আমরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ভালো আছি। সত্য বটে, তরুণদের ৬০ ভাগ মনে করে, আগামী পাঁচ বছরে দুর্নীতি আরও বাড়তে পারে। সেটা না মনে করার মতো কোনো কারণ তো ঘটেনি। এই জায়গায় সরকারের করণীয় আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি তাই সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
তরুণদের মধ্যে ইতিবাচক যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করে, তা হলো, ৯৮ ভাগ মনে করে তাদের সমাজসেবা করা উচিত। ৯৫ ভাগ তরুণ নিজের এলাকা আর স্থানীয় অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কাজ করতে চায়। ৭৯ ভাগ তরুণ উন্নয়নের বিষয়ে আগ্রহী। ৭৬.৫ ভাগ তরুণ মনে করে, স্থানীয় এলাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা আরও বড় হওয়া উচিত। তার মানে এই তরুণেরা একদম ঠিক লাইনে চিন্তা করছে। তারা ইতিবাচকভাবে ভাবছে, কাজে অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু তাদের সামনে করণীয় কিছু নেই। ৯৪ ভাগ তরুণ-তরুণী বলছে, তরুণদের দ্বারা পরিচালিত বা তরুণদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের নাম তারা জানে না।
এই শূন্যতাটা যে আছে, সেটা আমরা বারবার বলছি। আমাদের তারুণ্যে যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা এক অমিত বৈভবসম্পন্ন শক্তি। এই বাঁধভাঙা তারুণ্য সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে, আবার বহু অসাধ্য সাধন করতে পারে। বহু কিছু গড়ে তুলতে পারে। সেই স্বপ্নটা সেই কাজটা সেই সংগঠনটা তাদের দিতে হবে।
সরকারি ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা যে টেন্ডারবাজি অস্ত্রবাজি চাঁদাবাজি করে, তার মূলেও আছে, তাদের সামনে বড় স্বপ্ন সৃষ্টি না করা। তাদের দেশ গঠনে সমাজ গঠনে বড় কোনো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে না পারা। তাদের কোনো কাজ নেই। কী করবে তারা? কাজেই অপকর্ম করে।
এই জায়গাতেই আমরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালদের মতো মানুষের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। একজন তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছেন বই পড়তে, আরেকজন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পক্ষ থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলে উদ্বুদ্ধ করছেন গণিত চর্চা করতে আর বড় স্বপ্ন দেখতে।
প্রথম আলো বন্ধুসভার মাধ্যমেও আমরা তরুণদের সামাজিক মানবিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি করতে।
আমাদের তরুণদের স্বরূপ নির্ধারণ করছে কোন দুটো জিনিস? ছেলেরা বলেছে, জাতীয় ও পেশাগত ব্যাপার নিয়ে তারা ভাবিত। আর মেয়েরা বলেছে, তাদের স্বরূপ নির্ধারিত হয় পরিবার দিয়ে আর জাতীয়তা দিয়ে। তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে তাদের ভাবনার মধ্যে একটা সাধারণ বিষয় রেখেছে, সেটা তার দেশ, তার জাতীয়তা।
রাজনীতি নিয়ে হ্যাঁ আর না-র পাল্লা দেখা যাচ্ছে সমানে সমান। ৩০.৫ শতাংশ মনে করে, তাদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া কিছুতেই উচিত নয়, ৩০.৫ শতাংশ মনে করে, তাদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত। এর ব্যাখ্যা কোনো কোনো কাগজে দেখলাম, বলা হচ্ছে তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ। আমার মনে হয় না, ৩০ ভাগের বেশি মানুষের সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অবকাশ আছে। বরং ওই সংখ্যাটাও অনেক বড়। সবাই রাজনীতি করবে নাকি একটা দেশে? তবে ৭৪ ভাগ তরুণ রাজনীতিবিমুখ, এই তথ্যটাও উঠে আসছে জরিপে। খুব হতাশার কথা কি এটা? আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে এই প্রজন্মের এই পার্থক্যটা তো থাকবেই। ভাষা আন্দোলনের কাল, স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কাল আমরা অতিক্রম করে এসেছি। এখন একটু থিতু তো হতে হবে, নাকি? কিন্তু দরকার হলে আজকের তারুণ্যও যে রাজপথে নেমে আসতে পারে, সে বিষয়ে যেন কারও মনে কোনো সন্দেহ না থাকে।
তবে হ্যাঁ, রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে, মেধাবীদের, শিক্ষিতদের, সৎ ও সাহসীদের আসতে হবে রাজনীতিতে।
সবটা মিলিয়ে এই জরিপের ফল আমাদের তরুণদের সম্পর্কে আমাদের আশাবাদকে জোরদার করেছে। তারা লেখাপড়া করতে চায়, তারা বিদেশে যেতে চায়, তাদের প্রায় সবাই সমাজের কাজে লাগতে চায়। তাদের প্রায় সবাই মনে করে, তাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাদের জাতীয়তা। এ রকম একটা দেশপ্রেমিক কর্মোদ্যোগী তরুণ প্রজন্ম আগামী ১০ বছর পরে এই দেশটাকে চালাবে। তখন দেশটা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে, উন্নত হবে।
আমাদের তারুণ্যের সৃজনশীলতা এই জরিপের আওতায় ছিল না। কিন্তু কত কী করছে তারা। কত বিচিত্রমুখী উদ্যোগই না তারা গ্রহণ করছে। কিন্তু উদ্যোক্তা বলতে যা বোঝায়, সেটা কিন্তু এই জরিপই বলছে, আমাদের তরুণদের মধ্যে এখনো কম। শ্রমবাজারে মাত্র এক ভাগ তরুণ ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা। আমাদের উদ্যোক্তা দরকার। কেবল চাকরি খোঁজা তরুণ দিয়ে আর চলবে না। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় শক্তি আমাদের প্রবাসী জনশক্তি। আমাদের তরুণেরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে এ থেকে জাতীয়ভাবে আমরা কীভাবে সর্বাধিক লাভবান হতে পারি, সে বিষয়ে সরকারের অতি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমাদের বহির্মুখী জনশক্তির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অদক্ষ জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার বাস্তব উদ্যোগ চাই। সেই উদ্যোগের অভাবের কথাও এই জরিপে ফুটে উঠেছে।
আমাদের অপরাজেয় তারুণ্যকে আরেকবার সালাম দিই। এরাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে, এরাই অর্থনৈতিক বাধা প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে এভারেস্টে উঠেছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে যে বৃদ্ধরা বা অকালবৃদ্ধরা ‘কিছুই হবে না’ বলে চোখের পানি ফেলছেন, তাঁদের এই তরুণেরা এই বলে কাছে ডাকতে পারে:
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী আয় আমার কাছে—
সুখী হূদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা\
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
সুখী মানুষেরা বিদেশে যেতে চাইতে পারবে না, সে কথা অবশ্য কোনো পুস্তকে লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। বরং বিদেশে যাওয়ার স্বপ্নটা হূদয়ে ধারণ করার সুযোগ থাকাটাও হয়তো ওই ৪১ ভাগের অনেকের সুখের কারণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিদেশে যেতে চায় না, এ রকম একটা বিরাট অংশও সুখী। অন্যদিকে ৫৯ ভাগ তরুণ তো বিদেশেও যেতে চায় না।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের জরিপের ফল সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। বাংলাদেশের তারুণ্যের ওপর পরিচালিত এই জরিপের ফল অনেকের কাছেই বিস্ময়কর মনে হলেও আমার কাছে মোটেও অভাবনীয় কিছু বলে মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, অনেক ইতিবাচক, দারুণ আশাপ্রদ।
প্রথম কথা, এই তরুণেরা অসুখী নয়। নিশ্চয়ই এই সুখের পেছনে কাজ করে বিরাট আশাবাদ যে, বাংলাদেশটার হবে। কিছুই হবে না, এটা বৃদ্ধদের মুখে শোনা যেতে পারে, তরুণেরা কেন এই রকম বলবে বা ভাববে? কিছুই হবে না, এই রকম পরিস্থিতিতে তারা বলবে, আপনাআপনিই কিছুই হবে না, না হোক, আমরা না-টাকে হ্যাঁ বানিয়ে ফেলব। এই কারণেই তো আমরা তরুণ।
আর এই আশাবাদ, এই ইতিবাচকতা যাদের মধ্যে আছে, তারা তো সুখীই হবে। ইতিবাচক মানুষ কেন অসুখী হবে? তারা অসন্তুষ্ট হতে পারে, বিক্ষুব্ধ হতে পারে, কিন্তু তারা অসুখী হয় না। পথে-প্রান্তরে মুক্তির সংগ্রামে স্টেনগানে হাতরাখা তরুণও অসুখী নয়, দাবি আদায়ের মিছিলে সোচ্চার মানুষটিও নিজেকে অসুখী ভাবে না।
এই জরিপ থেকেই দেখা যাচ্ছে, ৭০ ভাগ তরুণ মনে করে, দেশ ঠিক পথেই এগোচ্ছে। সার্বিক দিক থেকে দেখলে, দেশ অবশ্যই ঠিক পথে এগোচ্ছে। প্রথম কথা, বাংলাদেশ একটা গণতান্ত্রিক দেশ। নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের পথ থেকে এই দেশ সরে যায়নি। গণতন্ত্রের প্রতি এই দেশের মানুষের যে অঙ্গীকার, তা নানা পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। ৬৪ শতাংশ তরুণ মনে করে, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের মৌলবাদী রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমরাও মনে করি, অদূর ভবিষ্যতেও এই দেশের মৌলবাদী হয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ এই দেশের মানুষ মোটের ওপর মধ্যপন্থী, নরম প্রকৃতির, পরমতসহিষ্ণু। তারা সহজেই নতুনকে গ্রহণ করতে পারে। সহজে খাপ খাইয়েও নিতে পারে। জরিপ থেকে দেখছি, ৭৩ ভাগ তরুণ-তরুণীর হাতে মুঠোফোন আছে, আর ইন্টারনেট ব্যবহার করে ১৫ ভাগ। সাড়ে পাঁচ কোটির ১৫ ভাগ কিন্তু সংখ্যায় কম নয়। আমরা যদি আমাদের প্রতিদিনের ছোটখাটো রাজনৈতিক বাগিবতণ্ডা ভুলত্রুটির হিসাব না কষে বড় একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই সঠিক পথেই আছে। থাকার মতো কতগুলো প্রাকৃতিক সুবিধাও আছে। আগেই বলেছি, এই দেশের মানুষ নরম, উদার, আধুনিক, সমন্বয়বাদী ও মুক্তমনা। সংকীর্ণতার মধ্যে তারা নেই, ডান বা বাম কোনো চরম পন্থার সঙ্গেই তারা নেই। গোষ্ঠীগত জাতিগত প্রদেশগত দাঙ্গাহাঙ্গামার অবকাশ এই দেশে নেই। আজকে মাওবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমস্যায় আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘুম হারাম, পাকিস্তানে রোজ বোমা ফুটছে। নেপাল বা শ্রীলঙ্কা যেকোনো দেশের তুলনায়ই আমরা রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে ভালো আছি। সত্য বটে, তরুণদের ৬০ ভাগ মনে করে, আগামী পাঁচ বছরে দুর্নীতি আরও বাড়তে পারে। সেটা না মনে করার মতো কোনো কারণ তো ঘটেনি। এই জায়গায় সরকারের করণীয় আছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি তাই সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
তরুণদের মধ্যে ইতিবাচক যে জিনিসটা আমাদের সবচেয়ে অনুপ্রাণিত করে, তা হলো, ৯৮ ভাগ মনে করে তাদের সমাজসেবা করা উচিত। ৯৫ ভাগ তরুণ নিজের এলাকা আর স্থানীয় অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে কাজ করতে চায়। ৭৯ ভাগ তরুণ উন্নয়নের বিষয়ে আগ্রহী। ৭৬.৫ ভাগ তরুণ মনে করে, স্থানীয় এলাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর ভূমিকা আরও বড় হওয়া উচিত। তার মানে এই তরুণেরা একদম ঠিক লাইনে চিন্তা করছে। তারা ইতিবাচকভাবে ভাবছে, কাজে অংশ নিতে চাইছে। কিন্তু তাদের সামনে করণীয় কিছু নেই। ৯৪ ভাগ তরুণ-তরুণী বলছে, তরুণদের দ্বারা পরিচালিত বা তরুণদের নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের নাম তারা জানে না।
এই শূন্যতাটা যে আছে, সেটা আমরা বারবার বলছি। আমাদের তারুণ্যে যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা এক অমিত বৈভবসম্পন্ন শক্তি। এই বাঁধভাঙা তারুণ্য সবকিছু তছনছ করে দিতে পারে, আবার বহু অসাধ্য সাধন করতে পারে। বহু কিছু গড়ে তুলতে পারে। সেই স্বপ্নটা সেই কাজটা সেই সংগঠনটা তাদের দিতে হবে।
সরকারি ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা যে টেন্ডারবাজি অস্ত্রবাজি চাঁদাবাজি করে, তার মূলেও আছে, তাদের সামনে বড় স্বপ্ন সৃষ্টি না করা। তাদের দেশ গঠনে সমাজ গঠনে বড় কোনো কাজে উদ্বুদ্ধ করতে না পারা। তাদের কোনো কাজ নেই। কী করবে তারা? কাজেই অপকর্ম করে।
এই জায়গাতেই আমরা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালদের মতো মানুষের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। একজন তরুণদের উদ্বুদ্ধ করছেন বই পড়তে, আরেকজন গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির পক্ষ থেকে অন্যদের সঙ্গে মিলে উদ্বুদ্ধ করছেন গণিত চর্চা করতে আর বড় স্বপ্ন দেখতে।
প্রথম আলো বন্ধুসভার মাধ্যমেও আমরা তরুণদের সামাজিক মানবিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। চেষ্টা করে যাচ্ছি নানা সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে একটা জাগরণ তৈরি করতে।
আমাদের তরুণদের স্বরূপ নির্ধারণ করছে কোন দুটো জিনিস? ছেলেরা বলেছে, জাতীয় ও পেশাগত ব্যাপার নিয়ে তারা ভাবিত। আর মেয়েরা বলেছে, তাদের স্বরূপ নির্ধারিত হয় পরিবার দিয়ে আর জাতীয়তা দিয়ে। তরুণ-তরুণী নির্বিশেষে তাদের ভাবনার মধ্যে একটা সাধারণ বিষয় রেখেছে, সেটা তার দেশ, তার জাতীয়তা।
রাজনীতি নিয়ে হ্যাঁ আর না-র পাল্লা দেখা যাচ্ছে সমানে সমান। ৩০.৫ শতাংশ মনে করে, তাদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া কিছুতেই উচিত নয়, ৩০.৫ শতাংশ মনে করে, তাদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়া উচিত। এর ব্যাখ্যা কোনো কোনো কাগজে দেখলাম, বলা হচ্ছে তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ। আমার মনে হয় না, ৩০ ভাগের বেশি মানুষের সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার অবকাশ আছে। বরং ওই সংখ্যাটাও অনেক বড়। সবাই রাজনীতি করবে নাকি একটা দেশে? তবে ৭৪ ভাগ তরুণ রাজনীতিবিমুখ, এই তথ্যটাও উঠে আসছে জরিপে। খুব হতাশার কথা কি এটা? আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে এই প্রজন্মের এই পার্থক্যটা তো থাকবেই। ভাষা আন্দোলনের কাল, স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কাল আমরা অতিক্রম করে এসেছি। এখন একটু থিতু তো হতে হবে, নাকি? কিন্তু দরকার হলে আজকের তারুণ্যও যে রাজপথে নেমে আসতে পারে, সে বিষয়ে যেন কারও মনে কোনো সন্দেহ না থাকে।
তবে হ্যাঁ, রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে হবে, মেধাবীদের, শিক্ষিতদের, সৎ ও সাহসীদের আসতে হবে রাজনীতিতে।
সবটা মিলিয়ে এই জরিপের ফল আমাদের তরুণদের সম্পর্কে আমাদের আশাবাদকে জোরদার করেছে। তারা লেখাপড়া করতে চায়, তারা বিদেশে যেতে চায়, তাদের প্রায় সবাই সমাজের কাজে লাগতে চায়। তাদের প্রায় সবাই মনে করে, তাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে তাদের জাতীয়তা। এ রকম একটা দেশপ্রেমিক কর্মোদ্যোগী তরুণ প্রজন্ম আগামী ১০ বছর পরে এই দেশটাকে চালাবে। তখন দেশটা নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর হবে, উন্নত হবে।
আমাদের তারুণ্যের সৃজনশীলতা এই জরিপের আওতায় ছিল না। কিন্তু কত কী করছে তারা। কত বিচিত্রমুখী উদ্যোগই না তারা গ্রহণ করছে। কিন্তু উদ্যোক্তা বলতে যা বোঝায়, সেটা কিন্তু এই জরিপই বলছে, আমাদের তরুণদের মধ্যে এখনো কম। শ্রমবাজারে মাত্র এক ভাগ তরুণ ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা। আমাদের উদ্যোক্তা দরকার। কেবল চাকরি খোঁজা তরুণ দিয়ে আর চলবে না। আমাদের অর্থনীতির একটা বড় শক্তি আমাদের প্রবাসী জনশক্তি। আমাদের তরুণেরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে, এটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখে এ থেকে জাতীয়ভাবে আমরা কীভাবে সর্বাধিক লাভবান হতে পারি, সে বিষয়ে সরকারের অতি অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া দরকার। আমাদের বহির্মুখী জনশক্তির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, অদক্ষ জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করার বাস্তব উদ্যোগ চাই। সেই উদ্যোগের অভাবের কথাও এই জরিপে ফুটে উঠেছে।
আমাদের অপরাজেয় তারুণ্যকে আরেকবার সালাম দিই। এরাই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছে, এরাই অর্থনৈতিক বাধা প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে এভারেস্টে উঠেছে। বাংলাদেশের ব্যাপারে যে বৃদ্ধরা বা অকালবৃদ্ধরা ‘কিছুই হবে না’ বলে চোখের পানি ফেলছেন, তাঁদের এই তরুণেরা এই বলে কাছে ডাকতে পারে:
আমার মতন সুখী কে আছে। আয় সখী আয় আমার কাছে—
সুখী হূদয়ের সুখের গান শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রাণ।
প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা—
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা\
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments