আফগান নারী জারিফার অনন্য জয়
দেশের গড়পড়তা অন্য সব নারী প্রতিনিয়ত যেখানে পর্দার ঘেরাটোপে বন্দী, আফগান নারী জারিফা কাজিজাদা (৫০) সেখানে একেবারেই অন্য রকম। গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়মিত সবার খোঁজখবর নেন তিনি। প্রয়োজনে গোঁফ লাগিয়ে পুরুষের বেশে মোটরসাইকেলে চালিয়ে যান বিভিন্ন স্থানে। তাঁর এসব কাজের মূল লক্ষ্য একটাই—আশপাশের মানুষ, এলাকাবাসীর কল্যাণ সাধন।
মানবকল্যাণের এই অদম্য ইচ্ছা ও চেষ্টার গুণেই নারী হয়েও জারিফা আফগানিস্তানের পুরুষ-শাসিত সমাজে হতে পেরেছেন একজন গ্রামপ্রধান। নিজ এলাকার সব পুরুষ এখন নিশ্চিন্তে ভরসা করেন তাঁর ওপর।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় বালখ প্রদেশের নাও আবাদ গ্রামের প্রধান জারিফা। ব্যক্তিত্ব আর প্রত্যয়ের জোরে অতি রক্ষণশীল অজপাড়া গাঁয়ের মানুষ হয়েও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন তিনি।
আফগানিস্তানের অধিকাংশ মেয়ের মতো জারিফারও বিয়ে হয় অল্প বয়সে। মাত্র ১০ বছর বয়সে কনে সাজতে হয়েছিল তাঁকে। ১৫ বছর বয়সে হলেন মা। জারিফার ভাষ্য, স্বামীর বাড়িতে তাঁর জীবন ছিল অনেকটা গৃহকর্মীর মতো। তবে এই জীবন থেকে উত্তরণে একটি ইচ্ছাশক্তি নিরন্তর কাজ করেছে মনের গভীরে।
তালেবান শাসনামলে তিনি স্বামীর সঙ্গে বালখ প্রদেশের রাজধানী মাজার-ই-শরিফে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। মেয়েদের পড়াশোনায় খুব উত্সাহ ছিল তাঁর। এতে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। আরও অনেক কল্যাণকর কাজে চলে গেছে তাঁর অনেকটা সময়। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন। করেছেন ঘরকন্নাও। এখন ৩৬ জন নাতি-নাতনি তাঁর।
২০০১ সালে তালেবান শাসনামলের অবসান হলে বালখ প্রদেশের নাও আবাদ গ্রামে ফিরে যান জারিফা। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। ২০০৪ সালে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গিয়ে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি গ্রামে বিদ্যুত্ আনতে চাই। তোমরা কোনো ঝামেলায় পড়লে, সমস্যায় ভুগলে, তোমাদের পক্ষে সে কথা সরকারকে জানাব। রাতে যদি দুর্বৃত্তরা হানা দেয়, বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তোমাদের পাশে দাঁড়াব।’
জারিফার এসব কথা শুনে সবাই হেসেছে, কটুকাটব্য করেছে—নারী হয়ে তিনি আর কী করছেন? তবে এসব গায়ে মাখেননি তিনি। তিনি এসব কেন চান, কার জন্য চান—মানুষকে এসব বোঝাতে চেষ্টা থেমে থাকেনি তাঁর। এতে গ্রামবাসীর মন গলেনি। সেবার নির্বাচনে হেরে যান তিনি।
তবে হাল ছাড়েননি জারিফা কাজিজাদা। গ্রামে বিদ্যুত্ আনার জেদ চেপে বসে তাঁর মনে। চার বছরের শিশু মেয়েকে কোলে করে রাজধানী কাবুলে বিদ্যুত্মন্ত্রীর বাড়িতে যান জারিফা। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার দাবি জানালে মন্ত্রী পরদিন তাঁকে সাক্ষাতের সময় দেন। মন্ত্রী তাঁর গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন, তবে একটি শর্তও জুড়ে দেন। সেই অর্থ অনুযায়ী, গ্রামবাসীকেই বিদ্যুতের খুঁটি ও তারের অর্থ দিতে হবে।
তবে এই শর্তে দমে যাননি জারিফা। কাবুলে যাওয়া-আসার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে নিজের বেশ কিছু গয়না আগেই বিক্রি করেছিলেন। এ জন্য অর্থ জোগাড় নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে অর্থ জোগাতে তিনি নিজের বাড়িটা বন্ধক রাখেন। এর পাঁচ মাস পর গ্রামের বাসিন্দারা বিদ্যুত্ পান। এখন ধীরে ধীরে শোধ করেছে গ্রামবাসী।
দুই বছর পর পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যায়। একসময় যারা গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা শুনে উপহাস করেছিল, গ্রামের সেই পুরুষেরা এবার তাঁকে গ্রামপ্রধান হতে আবেদন করার অনুরোধ জানান। গ্রামপ্রধান হয়ে তিনি বিদ্যুতের চুরি রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাই আমি বিদ্যুতের তার চুরি হতে দিতে পারি না।’
দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে জারিফা বলেন, ‘রাতে যখন গ্রামে কিছু ঘটে, তখন আমাকে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিতে হয়। আমি পুরুষের পোশাক পরে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই।’
আফগানিস্তানে নারীদের একা মোটরসাইকেল চালাতে দেখার দৃশ্য খানিকটা বিরল। আর সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই জারিফা মোটরসাইকেল চালানোর আগে পুরুষের পোশাকে ছদ্মবেশ নেন, নকল গোঁফ লাগান।
জারিফার কাজে গ্রামবাসী যে সন্তুষ্ট, মৌলভি সায়েদ মোহাম্মদের কথায় এর প্রমাণ মেলে। তিনি বলেন, ‘তিনি (জারিফা) এমন কাজ করেন, যা অনেক পুরুষও করতে পারে না।’
জারিফা গ্রামের পাশের একটি খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ করেছেন। এতে মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাও আবাদ গ্রামটি। গ্রামে মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করেছেন তিনি। এই মসজিদে নারী-পুরুষের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা জায়গা আছে। জারিফা বললেন, ‘যখন সবাই দেখল আমি এভাবে কাজ করছি, তারাও আমার সঙ্গে যোগ দিল। এখন গ্রামের মানুষ নিজেদের গ্রামের মসজিদেই নামাজ পড়তে পরে। গ্রামের ছোট ছেলেদের এখন আর কষ্ট করে দূরে গিয়ে কোরআন পাঠ শিখতে হয় না।’
গ্রামপ্রধানের পাশাপাশি স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলেরও প্রধান জারিফা। গ্রামের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একসময় আপনাদের মতোই একজন গৃহিণী ছিলাম। কিন্তু এখন এক হাজার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করতে পারি। স্থানীয় নানা বিষয় নিয়ে আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’ আফগানিস্তানের নারীদের নিয়ে আশাবাদী জারিফা। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা দেশে নারীরা প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আমাদের নারীরাও সাহসী এবং তাঁরাও অনেক কিছু অর্জন করতে পারে।’ বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে তপতী বর্মন
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় বালখ প্রদেশের নাও আবাদ গ্রামের প্রধান জারিফা। ব্যক্তিত্ব আর প্রত্যয়ের জোরে অতি রক্ষণশীল অজপাড়া গাঁয়ের মানুষ হয়েও বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে পেরেছেন তিনি।
আফগানিস্তানের অধিকাংশ মেয়ের মতো জারিফারও বিয়ে হয় অল্প বয়সে। মাত্র ১০ বছর বয়সে কনে সাজতে হয়েছিল তাঁকে। ১৫ বছর বয়সে হলেন মা। জারিফার ভাষ্য, স্বামীর বাড়িতে তাঁর জীবন ছিল অনেকটা গৃহকর্মীর মতো। তবে এই জীবন থেকে উত্তরণে একটি ইচ্ছাশক্তি নিরন্তর কাজ করেছে মনের গভীরে।
তালেবান শাসনামলে তিনি স্বামীর সঙ্গে বালখ প্রদেশের রাজধানী মাজার-ই-শরিফে চলে যান। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হন। মেয়েদের পড়াশোনায় খুব উত্সাহ ছিল তাঁর। এতে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছেন। আরও অনেক কল্যাণকর কাজে চলে গেছে তাঁর অনেকটা সময়। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন। করেছেন ঘরকন্নাও। এখন ৩৬ জন নাতি-নাতনি তাঁর।
২০০১ সালে তালেবান শাসনামলের অবসান হলে বালখ প্রদেশের নাও আবাদ গ্রামে ফিরে যান জারিফা। গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন তিনি। ২০০৪ সালে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে গিয়ে তিনি উপস্থিত ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি গ্রামে বিদ্যুত্ আনতে চাই। তোমরা কোনো ঝামেলায় পড়লে, সমস্যায় ভুগলে, তোমাদের পক্ষে সে কথা সরকারকে জানাব। রাতে যদি দুর্বৃত্তরা হানা দেয়, বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তোমাদের পাশে দাঁড়াব।’
জারিফার এসব কথা শুনে সবাই হেসেছে, কটুকাটব্য করেছে—নারী হয়ে তিনি আর কী করছেন? তবে এসব গায়ে মাখেননি তিনি। তিনি এসব কেন চান, কার জন্য চান—মানুষকে এসব বোঝাতে চেষ্টা থেমে থাকেনি তাঁর। এতে গ্রামবাসীর মন গলেনি। সেবার নির্বাচনে হেরে যান তিনি।
তবে হাল ছাড়েননি জারিফা কাজিজাদা। গ্রামে বিদ্যুত্ আনার জেদ চেপে বসে তাঁর মনে। চার বছরের শিশু মেয়েকে কোলে করে রাজধানী কাবুলে বিদ্যুত্মন্ত্রীর বাড়িতে যান জারিফা। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার দাবি জানালে মন্ত্রী পরদিন তাঁকে সাক্ষাতের সময় দেন। মন্ত্রী তাঁর গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেন, তবে একটি শর্তও জুড়ে দেন। সেই অর্থ অনুযায়ী, গ্রামবাসীকেই বিদ্যুতের খুঁটি ও তারের অর্থ দিতে হবে।
তবে এই শর্তে দমে যাননি জারিফা। কাবুলে যাওয়া-আসার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে নিজের বেশ কিছু গয়না আগেই বিক্রি করেছিলেন। এ জন্য অর্থ জোগাড় নিয়ে তিনি চিন্তায় পড়ে যান। একপর্যায়ে অর্থ জোগাতে তিনি নিজের বাড়িটা বন্ধক রাখেন। এর পাঁচ মাস পর গ্রামের বাসিন্দারা বিদ্যুত্ পান। এখন ধীরে ধীরে শোধ করেছে গ্রামবাসী।
দুই বছর পর পরিস্থিতি অনেকটা বদলে যায়। একসময় যারা গ্রামের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর পরিকল্পনার কথা শুনে উপহাস করেছিল, গ্রামের সেই পুরুষেরা এবার তাঁকে গ্রামপ্রধান হতে আবেদন করার অনুরোধ জানান। গ্রামপ্রধান হয়ে তিনি বিদ্যুতের চুরি রোধ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমাদেরকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাই আমি বিদ্যুতের তার চুরি হতে দিতে পারি না।’
দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সম্পর্কে বলতে গিয়ে জারিফা বলেন, ‘রাতে যখন গ্রামে কিছু ঘটে, তখন আমাকে তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নিতে হয়। আমি পুরুষের পোশাক পরে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যাই।’
আফগানিস্তানে নারীদের একা মোটরসাইকেল চালাতে দেখার দৃশ্য খানিকটা বিরল। আর সেই বিষয়টি মাথায় রেখেই জারিফা মোটরসাইকেল চালানোর আগে পুরুষের পোশাকে ছদ্মবেশ নেন, নকল গোঁফ লাগান।
জারিফার কাজে গ্রামবাসী যে সন্তুষ্ট, মৌলভি সায়েদ মোহাম্মদের কথায় এর প্রমাণ মেলে। তিনি বলেন, ‘তিনি (জারিফা) এমন কাজ করেন, যা অনেক পুরুষও করতে পারে না।’
জারিফা গ্রামের পাশের একটি খরস্রোতা নদীতে সেতু নির্মাণ করেছেন। এতে মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নাও আবাদ গ্রামটি। গ্রামে মসজিদ নির্মাণে অর্থায়ন করেছেন তিনি। এই মসজিদে নারী-পুরুষের নামাজ পড়ার জন্য আলাদা জায়গা আছে। জারিফা বললেন, ‘যখন সবাই দেখল আমি এভাবে কাজ করছি, তারাও আমার সঙ্গে যোগ দিল। এখন গ্রামের মানুষ নিজেদের গ্রামের মসজিদেই নামাজ পড়তে পরে। গ্রামের ছোট ছেলেদের এখন আর কষ্ট করে দূরে গিয়ে কোরআন পাঠ শিখতে হয় না।’
গ্রামপ্রধানের পাশাপাশি স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলেরও প্রধান জারিফা। গ্রামের মেয়েদের উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একসময় আপনাদের মতোই একজন গৃহিণী ছিলাম। কিন্তু এখন এক হাজার মানুষের সঙ্গে বৈঠক করতে পারি। স্থানীয় নানা বিষয় নিয়ে আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পারি।’ আফগানিস্তানের নারীদের নিয়ে আশাবাদী জারিফা। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা দেশে নারীরা প্রেসিডেন্ট হতে পারে। আমাদের নারীরাও সাহসী এবং তাঁরাও অনেক কিছু অর্জন করতে পারে।’ বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে তপতী বর্মন
No comments