শেকড়ের ডাক-জাপানে বিস্ফোরণ, আমাদের আতঙ্ক! by ফরহাদ মাহমুদ
জাপানে ভয়াবহতম ভূমিকম্প এবং তৎপরবর্তী সুনামির কারণে জাপানের ফুকুশিমায় অবস্থিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি চুলি্লতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণ ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। বাতাস ও বৃষ্টির মাধ্যমে সেগুলো ছড়িয়ে যায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে।
সেটি কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা মানে না। তাই জাপানের আশপাশের দেশগুলোতেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু আমরা এতটা আতঙ্কিত হচ্ছি কেন? পরমাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, জাপানের দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার কোনো আশঙ্কাই নেই। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে। তার পরও এরা কারা এবং কেন এ নিয়ে আতঙ্ক বিস্তার করছে? দেখা যায়, মোবাইল ফোন বা অন্যান্য মাধ্যম, এমনকি কোনো কোনো গণমাধ্যমেও আতঙ্ক বিস্তার করা হচ্ছে। তাদের এ আতঙ্ক বিস্তারের উদ্দেশ্য কী_সে কথায় একটু পরে আসছি।
এর আগে ১৯৮৬ সালেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক চুলি্লতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেটিও বাংলাদেশে খুবই আতঙ্ক বিস্তার করেছিল। আর তাতে একটি মহল প্রকাশ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কার্যালয়ে রীতিমতো একটি সেল খোলা হয়েছিল। সেখানে প্রতিদিন সাংবাদিকদের নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হতো। তার আগেও যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক পারমাণবিক চুলি্লতে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছিল; কিন্তু সেগুলো নিয়ে সেভাবে আতঙ্ক ছড়ায়নি। কেউ আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্যোগও নেয়নি। অনেকটা অগোচরে বা নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে গেছে সেসব দুর্ঘটনার খবর। কারণ এ ধরনের দুর্ঘটনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশ প্রভাব ফেলে। এতে কেউ লাভবান হয়, কেউ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এ ধরনের প্রচারণা একেবারে অপরিকল্পিত নয়। ইতিমধ্যেই থাইরয়েড ক্যান্সারবিরোধী ওষুধের বিক্রি অভাবনীয় পর্যায়ে বেড়ে গেছে। আতঙ্ক যত বাড়বে, বিক্রিও তত বাড়বে।
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে একটি পুরনো অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। আমি তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করি। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু লেখালেখি করি। গুঁড়াদুধ সম্পর্কে তখন মানুষের মনে প্রবল আতঙ্ক। সেই সুবাদে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি বিদেশি গুঁড়াদুধ কম্পানির একজন দেশীয় প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বন্ধুটি রীতিমতো জোর করে মতিঝিলের একটি ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে আমাকে মধ্যাহ্নভোজ করালেন। তারপর বললেন আসল কথাটি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমরা যে দেশ থেকে দুধ আনি সেটি ইউক্রেন থেকে অনেক দূরে। সেখানে তেজস্ক্রিয়া ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই, যেটা আছে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আনা দুধে। আমার কোনো লেখায় এ কথা লিখে দিতে হবে। বন্ধুটি আমাকে জানালেন, বিনিময়ে আমাকে খুশি করা হবে। সেই কাজটি আমি না করলেও অনেকেই সে সময় করেছিলেন।
তেজস্ক্রিয়া কিন্তু সর্বত্রই এবং সব সময়ই আছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নির্ধারিত মান অনুযায়ী, তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা তিন বা তার ওপরে গেলেই কেবল তেজস্ক্রিয়াকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে ধরে নেওয়া হয়। চেরনোবিলের দুর্ঘটনায় আশপাশে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ছিল ৭। জাপানের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে এ মাত্রা ৬ বলে ধারণা করা হচ্ছে, কমও হতে পারে। পাশাপাশি তেজস্ক্রিয়া ছড়ানো বন্ধ করতে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিকিরণরোধী পোশাক পরে ৫০ জন জাপানি কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত কারখানায়ও প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাপানের পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেবারেই নেই। যদি না জাপান থেকে শাকসবজি, ফলমূল বা দুগ্ধজাতীয় খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয়। সে ক্ষেত্রে ফুড চেইনের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কিছু পরিমাণে থেকে যায়। তবে জাপান থেকে বাংলাদেশে এসব পণ্য আনা হয় না বললেই চলে। আর মেঘ বা বাতাসবাহিত হয়ে তেজস্ক্রিয়া বাংলাদেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ জাপান বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কয়েক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। বাংলাদেশে এখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। জাপান থেকেও বাতাস পূর্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তেজস্ক্রিয়ায় দূষিত বাতাস বা মেঘ কোনোটিরই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসার কোনোরূপ সম্ভাবনা নেই। তার পরও মোবাইল ফোনে এসএমএস করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এর ফলে এসিড-বৃষ্টি হতে পারে। সেই বৃষ্টি গায়ে লাগলে ত্বকে ফোস্কা পড়া, মাথার চুল উঠে যাওয়াসহ নানা রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ক্যান্সারও হতে পারে। এগুলো ডাহা মিথ্যা প্রচারণা। সাধারণত এ-জাতীয় দুর্ঘটনায় চুলি্লর খুব নিকটবর্তী অঞ্চলের মানুষ সরাসরি বিকিরণের শিকার হতে পারে, এমনকি জাপানেরও দূরবর্তী শহরগুলোতে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। জাপানে চুলি্লর চারপাশে ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যাদের বাড়িঘর রয়েছে, তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনা-পরবর্তীকালে বরং কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বাতাস ও বৃষ্টিবাহিত হয়ে তেজস্ক্রিয় উপাদান মাটিতে মিশে যায়। সেই মাটিতে জন্মানো ঘাস, শাকসবজি, ফলমূলে তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। সেই তেজস্ক্রিয়ার কারণে মানুষ ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, তা হলো থাইরয়েডের ক্যান্সার। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর আজ পর্যন্ত সেখানে ছয় হাজারের বেশি মানুষ থাইরয়েডের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে, যাকে অনেকটা মহামারি বলা চলে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, থাইরয়েড ক্যান্সার ছাড়া চেরনোবিল এলাকায় বিকিরণজনিত আর কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়নি। থাইরয়েডের ক্যান্সার সহজেই প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য। যাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় রাখতে হয়। সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেকটর গলায় লাগিয়ে খুব সহজেই জানা যায়, থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোনো তেজস্ক্রিয় আয়োডিন প্রবেশ করেছে কি না। আবার কারো শরীর, পরিধেয় কাপড়চোপড়, ত্বক বা চুল তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে এসেছে কি না_তাও গাইগার কাউন্টার নামক যন্ত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। কেউ বিকিরণের সংস্পর্শে এলে কাপড়চোপড় খুলে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভালোভাবে গোসল করতে হবে। কাপড়গুলো গভীর মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এ ব্যাপারে রোচেস্টারের বিখ্যাত মায়ো ক্লিনিকের জৈব পদার্থবিদ্যার প্রফেসর ইমেরিটাস ড. রিচার্ড জে ভেট্টারের মতে, বিকিরণের সংস্পর্শে আসার এক থেকে দুই মাসের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যত আগে আসা যায়, ততই ভালো। দেরি হলেই বরং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
জাপানের দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা অহেতুক যতটা আতঙ্কিত হচ্ছি, তার ১ শতাংশ পরিমাণে যদি স্থানীয় বিভিন্ন উৎসের বিকিরণ নিয়ে চিন্তা করতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। এমনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের একটি উৎস হলো এঙ্-রে মেশিন। আশির দশকে বাংলাদেশ আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের স্বাস্থ্য-পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ব্যবহৃত এঙ্-রে মেশিনগুলোর বেশির ভাগই মানসম্মত নয়, কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোর বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। মানব শরীরে যে মাত্রায় বিকিরণ দেওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বিকিরণ দেয়। ফলে রোগীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তা ছাড়া যে ঘরে এঙ্-রে মেশিন থাকে সে ঘরের যে ধরনের প্রতিরোধী দেয়াল (প্রায় ১৮ ইঞ্চি কংক্রিটের দেয়াল) থাকার কথা, সে রকম দেয়াল নেই। ফলে নিক্ষিপ্ত বিকিরণ দেয়াল ভেদ করে আশপাশের লোকজনের ওপর নিয়মিত বিকিরণ ছড়াচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে শিল্পে ব্যবহৃত এঙ্-রে যন্ত্রও পাওয়া গেছে, যা মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ ছাড়া বেশ কিছু চিকিৎসাযন্ত্রে এবং শিল্পে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করা হয় এবং যেগুলো উপযুক্ত পরিবেশে চালানো হয় না। ফলে আশপাশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলো প্রতিরোধে আমরা মোটেও সচেতন নই এবং এ পর্যন্ত এসব বিকিরণ বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জাপানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনার কারণে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন নেই। তাঁদের জানা প্রয়োজন, ভূমিকম্প ও সুনামির দিক থেকে বাংলাদেশ, বিশেষ করে পাবনার রূপপুর এলাকা অনেক বেশি ঝুঁকিমুক্ত। দ্বিতীয়ত, এখন যেসব পারমাণবিক চুলি্ল স্থাপিত হচ্ছে সেগুলোকে বলা হয় পঞ্চম প্রজন্মের পারমাণবিক চুলি্ল। এগুলোতে দুর্ঘটনাজনিত স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেক বেশি জোরদার ও কার্যকর। চুলি্লতে যে পরমাণু জ্বালানি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর 'হাফ লাইফ' অনেক কম। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অনেক উন্নত এবং নিরাপদ। চেরনোবিলের পারমাণবিক চুলি্লটি ছিল প্রথম প্রজন্মের। জাপানের চুলি্লটিও ছিল আগের প্রজন্মের এবং তারা কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছিল। তার পরও এর বিকিরণ-প্রতিরোধী যে ব্যবস্থা ছিল তা বিকিরণ কতটুকু ছড়িয়েছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিতর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটির পরমাণু প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেরি লাউ ডানজিক-গগারের মতে, সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল। আগুনে সম্পূর্ণরূপে গলে গেলেই কেবল সেখানকার প্রেশার ভেসেল থেকে বিকিরণ ছড়াতে পারে, যার সম্ভাবনা খুবই কম। তদুপরি ফুকুশিমা থেকে তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের যে বিকিরণ বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে নেমে আসতে পারে, তার 'হাফ লাইফ' মাত্র আট দিন। কাজেই মাস দুয়েক পরে সেখানে যে শাকসবজি হবে তাতে তেজস্ক্রিয়া থাকার আশঙ্কা খুবই কম। কাজেই এসব যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করা হবে আত্মঘাতী। দেশে জনজীবন এবং শিল্পের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ লাগবেই। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র যে পরিমাণ দূষণ করবে তার ক্ষতি বরং অনেক বেশি।
লেখক : সাংবাদিক
এর আগে ১৯৮৬ সালেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত ইউক্রেনের চেরনোবিলে পারমাণবিক চুলি্লতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেটিও বাংলাদেশে খুবই আতঙ্ক বিস্তার করেছিল। আর তাতে একটি মহল প্রকাশ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের কার্যালয়ে রীতিমতো একটি সেল খোলা হয়েছিল। সেখানে প্রতিদিন সাংবাদিকদের নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হতো। তার আগেও যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক পারমাণবিক চুলি্লতে দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছিল; কিন্তু সেগুলো নিয়ে সেভাবে আতঙ্ক ছড়ায়নি। কেউ আতঙ্ক ছড়ানোর উদ্যোগও নেয়নি। অনেকটা অগোচরে বা নীরবে-নিভৃতে হারিয়ে গেছে সেসব দুর্ঘটনার খবর। কারণ এ ধরনের দুর্ঘটনা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেশ প্রভাব ফেলে। এতে কেউ লাভবান হয়, কেউ হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এ ধরনের প্রচারণা একেবারে অপরিকল্পিত নয়। ইতিমধ্যেই থাইরয়েড ক্যান্সারবিরোধী ওষুধের বিক্রি অভাবনীয় পর্যায়ে বেড়ে গেছে। আতঙ্ক যত বাড়বে, বিক্রিও তত বাড়বে।
বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে একটি পুরনো অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল। আমি তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করি। বিজ্ঞান বিষয়ে কিছু লেখালেখি করি। গুঁড়াদুধ সম্পর্কে তখন মানুষের মনে প্রবল আতঙ্ক। সেই সুবাদে এক বন্ধুর মাধ্যমে একটি বিদেশি গুঁড়াদুধ কম্পানির একজন দেশীয় প্রতিনিধি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। বন্ধুটি রীতিমতো জোর করে মতিঝিলের একটি ভালো রেস্তোরাঁয় নিয়ে আমাকে মধ্যাহ্নভোজ করালেন। তারপর বললেন আসল কথাটি। তাঁদের বক্তব্য ছিল, আমরা যে দেশ থেকে দুধ আনি সেটি ইউক্রেন থেকে অনেক দূরে। সেখানে তেজস্ক্রিয়া ছড়ানোর কোনো আশঙ্কা নেই, যেটা আছে ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে আনা দুধে। আমার কোনো লেখায় এ কথা লিখে দিতে হবে। বন্ধুটি আমাকে জানালেন, বিনিময়ে আমাকে খুশি করা হবে। সেই কাজটি আমি না করলেও অনেকেই সে সময় করেছিলেন।
তেজস্ক্রিয়া কিন্তু সর্বত্রই এবং সব সময়ই আছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) নির্ধারিত মান অনুযায়ী, তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা তিন বা তার ওপরে গেলেই কেবল তেজস্ক্রিয়াকে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বলে ধরে নেওয়া হয়। চেরনোবিলের দুর্ঘটনায় আশপাশে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ছিল ৭। জাপানের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে এ মাত্রা ৬ বলে ধারণা করা হচ্ছে, কমও হতে পারে। পাশাপাশি তেজস্ক্রিয়া ছড়ানো বন্ধ করতে বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। বিকিরণরোধী পোশাক পরে ৫০ জন জাপানি কর্মী ক্ষতিগ্রস্ত কারখানায়ও প্রতিরোধ তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
জাপানের পারমাণবিক চুলি্লতে বিস্ফোরণের কারণে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেবারেই নেই। যদি না জাপান থেকে শাকসবজি, ফলমূল বা দুগ্ধজাতীয় খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা হয়। সে ক্ষেত্রে ফুড চেইনের মাধ্যমে তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কিছু পরিমাণে থেকে যায়। তবে জাপান থেকে বাংলাদেশে এসব পণ্য আনা হয় না বললেই চলে। আর মেঘ বা বাতাসবাহিত হয়ে তেজস্ক্রিয়া বাংলাদেশে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ জাপান বাংলাদেশ থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কয়েক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। বাংলাদেশে এখন দক্ষিণ থেকে উত্তরে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। জাপান থেকেও বাতাস পূর্ব দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে তেজস্ক্রিয়ায় দূষিত বাতাস বা মেঘ কোনোটিরই বাংলাদেশ পর্যন্ত আসার কোনোরূপ সম্ভাবনা নেই। তার পরও মোবাইল ফোনে এসএমএস করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে এর ফলে এসিড-বৃষ্টি হতে পারে। সেই বৃষ্টি গায়ে লাগলে ত্বকে ফোস্কা পড়া, মাথার চুল উঠে যাওয়াসহ নানা রকম উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ক্যান্সারও হতে পারে। এগুলো ডাহা মিথ্যা প্রচারণা। সাধারণত এ-জাতীয় দুর্ঘটনায় চুলি্লর খুব নিকটবর্তী অঞ্চলের মানুষ সরাসরি বিকিরণের শিকার হতে পারে, এমনকি জাপানেরও দূরবর্তী শহরগুলোতে এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। জাপানে চুলি্লর চারপাশে ২০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত যাদের বাড়িঘর রয়েছে, তাদের অন্যত্র চলে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে এবং যথাসম্ভব ঘরে থাকতে বলা হয়েছে। দুর্ঘটনা-পরবর্তীকালে বরং কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। বাতাস ও বৃষ্টিবাহিত হয়ে তেজস্ক্রিয় উপাদান মাটিতে মিশে যায়। সেই মাটিতে জন্মানো ঘাস, শাকসবজি, ফলমূলে তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা বেড়ে যায়। সেই তেজস্ক্রিয়ার কারণে মানুষ ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, তা হলো থাইরয়েডের ক্যান্সার। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পর আজ পর্যন্ত সেখানে ছয় হাজারের বেশি মানুষ থাইরয়েডের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে, যাকে অনেকটা মহামারি বলা চলে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, থাইরয়েড ক্যান্সার ছাড়া চেরনোবিল এলাকায় বিকিরণজনিত আর কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা যায়নি। থাইরয়েডের ক্যান্সার সহজেই প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য। যাদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাদের নিয়মিত পরীক্ষার আওতায় রাখতে হয়। সোডিয়াম আয়োডাইড ডিটেকটর গলায় লাগিয়ে খুব সহজেই জানা যায়, থাইরয়েড গ্রন্থিতে কোনো তেজস্ক্রিয় আয়োডিন প্রবেশ করেছে কি না। আবার কারো শরীর, পরিধেয় কাপড়চোপড়, ত্বক বা চুল তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে এসেছে কি না_তাও গাইগার কাউন্টার নামক যন্ত্রের সাহায্যে নির্ণয় করা যায়। কেউ বিকিরণের সংস্পর্শে এলে কাপড়চোপড় খুলে দীর্ঘক্ষণ ধরে ভালোভাবে গোসল করতে হবে। কাপড়গুলো গভীর মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে। এ ব্যাপারে রোচেস্টারের বিখ্যাত মায়ো ক্লিনিকের জৈব পদার্থবিদ্যার প্রফেসর ইমেরিটাস ড. রিচার্ড জে ভেট্টারের মতে, বিকিরণের সংস্পর্শে আসার এক থেকে দুই মাসের মধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যত আগে আসা যায়, ততই ভালো। দেরি হলেই বরং বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
জাপানের দুর্ঘটনা নিয়ে আমরা অহেতুক যতটা আতঙ্কিত হচ্ছি, তার ১ শতাংশ পরিমাণে যদি স্থানীয় বিভিন্ন উৎসের বিকিরণ নিয়ে চিন্তা করতাম, তাহলে অনেক ভালো হতো। এমনি তেজস্ক্রিয় বিকিরণের একটি উৎস হলো এঙ্-রে মেশিন। আশির দশকে বাংলাদেশ আণবিক গবেষণা কেন্দ্রের স্বাস্থ্য-পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় ব্যবহৃত এঙ্-রে মেশিনগুলোর বেশির ভাগই মানসম্মত নয়, কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোর বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও কার্যকর নয়। মানব শরীরে যে মাত্রায় বিকিরণ দেওয়ার কথা, তার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বিকিরণ দেয়। ফলে রোগীর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তা ছাড়া যে ঘরে এঙ্-রে মেশিন থাকে সে ঘরের যে ধরনের প্রতিরোধী দেয়াল (প্রায় ১৮ ইঞ্চি কংক্রিটের দেয়াল) থাকার কথা, সে রকম দেয়াল নেই। ফলে নিক্ষিপ্ত বিকিরণ দেয়াল ভেদ করে আশপাশের লোকজনের ওপর নিয়মিত বিকিরণ ছড়াচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে শিল্পে ব্যবহৃত এঙ্-রে যন্ত্রও পাওয়া গেছে, যা মানুষের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ ছাড়া বেশ কিছু চিকিৎসাযন্ত্রে এবং শিল্পে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ব্যবহার করা হয় এবং যেগুলো উপযুক্ত পরিবেশে চালানো হয় না। ফলে আশপাশে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ে। সেগুলো প্রতিরোধে আমরা মোটেও সচেতন নই এবং এ পর্যন্ত এসব বিকিরণ বন্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জাপানে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শক্তিশালী ভূমিকম্প ও সুনামির ফলে সৃষ্ট দুর্ঘটনার কারণে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজন নেই। তাঁদের জানা প্রয়োজন, ভূমিকম্প ও সুনামির দিক থেকে বাংলাদেশ, বিশেষ করে পাবনার রূপপুর এলাকা অনেক বেশি ঝুঁকিমুক্ত। দ্বিতীয়ত, এখন যেসব পারমাণবিক চুলি্ল স্থাপিত হচ্ছে সেগুলোকে বলা হয় পঞ্চম প্রজন্মের পারমাণবিক চুলি্ল। এগুলোতে দুর্ঘটনাজনিত স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অনেক বেশি জোরদার ও কার্যকর। চুলি্লতে যে পরমাণু জ্বালানি ব্যবহার করা হয় সেগুলোর 'হাফ লাইফ' অনেক কম। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অনেক উন্নত এবং নিরাপদ। চেরনোবিলের পারমাণবিক চুলি্লটি ছিল প্রথম প্রজন্মের। জাপানের চুলি্লটিও ছিল আগের প্রজন্মের এবং তারা কেন্দ্রটি বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছিল। তার পরও এর বিকিরণ-প্রতিরোধী যে ব্যবস্থা ছিল তা বিকিরণ কতটুকু ছড়িয়েছে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিতর্ক আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটির পরমাণু প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেরি লাউ ডানজিক-গগারের মতে, সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল। আগুনে সম্পূর্ণরূপে গলে গেলেই কেবল সেখানকার প্রেশার ভেসেল থেকে বিকিরণ ছড়াতে পারে, যার সম্ভাবনা খুবই কম। তদুপরি ফুকুশিমা থেকে তেজস্ক্রিয় আয়োডিনের যে বিকিরণ বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে নেমে আসতে পারে, তার 'হাফ লাইফ' মাত্র আট দিন। কাজেই মাস দুয়েক পরে সেখানে যে শাকসবজি হবে তাতে তেজস্ক্রিয়া থাকার আশঙ্কা খুবই কম। কাজেই এসব যুক্তি দেখিয়ে বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতা করা হবে আত্মঘাতী। দেশে জনজীবন এবং শিল্পের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ লাগবেই। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র যে পরিমাণ দূষণ করবে তার ক্ষতি বরং অনেক বেশি।
লেখক : সাংবাদিক
No comments