কথা সামান্যই-আমার আধুনিকতা by ফজলুল আলম
অনেকের কাছে আধুনিকতার প্রশ্নটি পুরনো তো বটেই, দীর্ণজীর্ণও হয়ে গেছে। আমরা এখন প্রাগৈতিহাসিক, বর্বর ইত্যাদি নানা যুগ, এমনকি আধুনিক যুগও পার করে উত্তর-আধুনিক যুগে পৌঁছে গেছি বলে অনেকে দাবি করতে পারেন।
এই সময়ে আধুনিকতা কী? প্রশ্নটি অবান্তর মনে হতে পারে। আবার এমনো মনে হয়, যে সময়টাকে আমরা এখন আধুনিক বলে অভিহিত করি, সে সময়ও প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া গিয়েছিল বলে মনে হয় না অথবা প্রশ্নটি উত্থাপিতই হয়নি। আঠারো শতকের শেষ পর্যায়ে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন দ্রুতবেগে পরিবর্তিত হতে শুরু করল যে পণ্ডিত থেকে সাধারণ মানুষও সেসবের কারণ একবারে নির্ণয় করতে পারছিল না। দেশে দেশে রাজতন্ত্রের জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন স্থায়ী রূপ পেয়েছে, কয়েকটি ইউরোপীয় শক্তি কাঁচামাল, মণিরত্ন ও অন্যান্যভাবে সমৃদ্ধ বিদেশে শক্তির জোরে উপনিবেশ স্থাপন করেছে। সে সময় সে রকম ব্যবস্থাই দেশে ও বহির্বিশ্বে অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বাভাবিক মনে হতো। আঠারো শতকের শেষে ইউরোপে জ্যোতির্ময়কাল (ইংরেজিতে এনলাইটমেন্ট) যুগ শুরু হয়- অতীতের প্রায় সব কিছু, এমনকি শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন, রাজার শাসন করার ক্ষমতা বা অধিকার- সবই প্রশ্নের মুখে চলে এলো, ভেঙে পড়তে শুরু করল শক্তিধরদের দাপট, ধর্মের নামে অত্যাচার, যাজকদের ক্ষমতার সমর্থন। শুরু হলো জ্ঞান-বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো সৃষ্টি- শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ তো বটেই; সাধারণ মানুষও মানবতা কী তা উপলব্ধি করতে শুরু করল, প্রত্যেক মানুষের জন্মগত অধিকার অক্ষত রাখার আইন তৈরি হতে লাগল। সোজা কথায়, সে সময় মধ্যযুগের আবহাওয়া, সমাজ, অর্থনীতি, রাজ-রীতি ও রাজনীতি অনেকটা জ্যোতির্ময়কালের নতুন জ্ঞানে পরিবর্তিত হতে লাগল। অর্থাৎ যুগই যেন পাল্টাতে শুরু করল।
সবাই বলতে শুরু করল, এটাই তো আধুনিক যুগ। কী এই আধুনিকতা? উনিশ-বিশ শতকেও ইউরোপের অনেক সুপণ্ডিত, বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি আধুনিকতার প্রশ্নে সদুত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তখনো প্রশ্নটির একবাক্যে মীমাংসা হয়নি। সে সময়ে যদি না হয়ে থাকে, তবে সে প্রশ্ন এখন তোলা মোটেই অনাবশ্যক হবে না। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত কি আমরা সবাই আধুনিক?
আমি নিজে কতটা আধুনিক, সেটার বিচার করার প্রচেষ্টা থেকে আমার রচনার শিরোনাম দিয়েছি 'আমার আধুনিকতা'। এই প্রসঙ্গে একজন তরুণের কথা মনে পড়ল। মহাযুদ্ধ দুইয়ের মাঝামাঝি। গ্রামের ছেলেটি চাষাবাদ করে, মাঝেমধ্যে জাল ফেলে মাছ ধরে, নৌকাও আছে। পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছার বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। শীতকালে হাতে বোনা চাদর। গ্রামের পাঠশালা শেষ করে কিছুদিন শহরতলির স্কুলেও গিয়েছিল সে, কিন্তু ১২-১৩ বছরের পরে আর এগোয়নি। সেই ছেলেটির একদিন শখ হলো, সে আধুনিক হবে। তাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। সে টাকা-পয়সা কিছু সংগ্রহ করে দর্জির কাছে গিয়ে ফুলপ্যান্ট-শার্ট বানালো, কাবুলি জুতা কিনল। ভালো নাপিতের কাছে গিয়ে স্টাইল করে চুল ছাঁটল। তারপর হাতে কিছু কাগজপত্র, নতুন-পুরনো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সে গ্রামে ও কাছের শহরতলিতে চৌকস স্টাইলে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
যারা তাকে চেনে তারা অবাক, তারা ছেলেটির এই বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন তাকিয়ে দেখে আর বলে, ছেলেটা আধুনিক হয়ে উঠেছে। ছেলেটাও নিজেকে আধুনিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে খুবই আনন্দিত।
আমি অবশ্য এর বেশি জানি না- তার চাষবাসের কী হলো, মাছ ধরা, নৌকা চালানোর কী হলো- কিছুর খবরই আমার নেই। হয়তোবা সে আমেরিকান ড্যান্ডি হয়ে গিয়েছিল।
আমি এখন ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরি, মাঝে মধ্যে সুটেড-বুটেড হয়ে সমাজের ভালো ভালো জায়গায় বিচরণ করি- টেলিভিশনে দর্শকের গ্যালারিতে, মাঝেমধ্যে বক্তা হিসেবেও আমাকে দেখা যায়। আমি নিশ্চিত যে আমাকে কেউ 'অনাধুনিক' বলবে না। আমি অবশ্যই শিক্ষাদীক্ষা-কর্মে, আচার-আচরণে একজন আধুনিক ব্যক্তি।
আধুনিক হওয়ার পেছনে কী কী উপাদান আছে, তার সবই আমার আছে হয়তো, কিন্তু সেই উপাদানগুলো কী? আমি কি সেসব জানি? সেই গ্রামের চাষবাস করা ছেলেটির পোশাক-পরিচ্ছদে শৌখিন হয়ে গিয়ে আধুনিক হওয়া এবং আমার আধুনিক হওয়া- এই দুইয়ে কিছু পার্থক্য আছে বৈকি! সেই ছেলেটির মতো আমি নিজের ইচ্ছায় এই আধুনিকতার খোলস ধারণ করিনি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে- আমি সেই পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে আধুনিক হয়ে উঠেছি। সেটাই আমার কাছে ও আমার পারিপাশ্বর্িকতার কাছে সত্য ও আমাকে আধুনিক বলার কারণ।
আমি নিশ্চিত যে এমন একসময় আসবে, যখন আমি নিজে উত্তর-আধুনিক বা আধুনিকতা-উত্তর, উত্তর-উত্তর আধুনিক হয়ে উঠব। সবাই না হলেও অনেকে সমর্থন দেবেন। অথচ এই বিশেষণগুলো জুড়ে দেওয়ার কারণ, কী আধুনিক, কী উত্তর-আধুনিক কোনোটারই সত্যিকার কারণ না জেনেই, আমি তো বটেই, আমরা অনেকে উল্লসিত হয়েছি।
ঐতিহাসিকভাবে ঠিক কোন সময়ে আধুনিক সময়ের শুরু হয়েছিল সেটা নির্ণয় করা আরো একটা কঠিন কাজ। এই সময়টা কোন এলাকার, কোন অঞ্চলের, কোন ঘটনাপ্রেক্ষিত উদ্ভূত- সেসব জানতে হবে। অথবা বিপরীতে ধারণা করে নিতে হবে যে সারা বিশ্বেই একটা সুনির্দিষ্ট ক্ষণে 'আধুনিক সময়' শুরু হয়েছিল। সেটা যে সম্ভবপর ঘটনা হতে পারে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, অঞ্চল বিভেদে একেক পরিস্থিতি বিরাজ করে। অর্থনৈতিক, যান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাগত, মনমানসিকতাগত অবস্থা সর্বত্র এক রকম হয় না। প্রাচীনকাল থেকে এক গোত্র অন্য গোত্রকে বা এক দেশ অন্য দেশকে দাবিয়ে রাখার একটা ইতিহাস চলছিল বহুদিন ধরে। সেসবের আরো অন্যান্য কারণের জের ধরে পৃথিবীর দেশগুলো ও মানব-মানবী অসম পরিণতিতে পৌঁছে গিয়েছিল- সেখান থেকে নিস্তার পাওয়ার পন্থা-কৌশল আবিষ্কৃত হলেও খুব কমই অসম বিশ্বব্যবস্থা দূর করা গেছে।
মধ্যযুগের ইউরোপে এবং বিশ্বের অন্যত্র অধিকাংশ দেশে রাজরাজড়া, বনেদি, অভিজাত সম্প্রদায় সমাজের উচ্চ স্তরে থেকে দেশ পরিচালনা করত। সাধারণ মানুষকে অবদমিত, অবনত ও দমিত রাখার জন্য ধর্মের ব্যবহার ছিল- যাজক সম্প্রদায় রাজরাজড়ার বন্দনা করে প্রজাদের মঙ্গল কামনা করত; কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্য (সম্পদ, ঐশ্বর্য, বিলাস- এসব সাধারণ মানুষের জন্য অনেক দূরের বস্তু) কোনোটাই আনতে প্রয়াস পেত না।
একসময় সেই ধারাটি বদলে যেতে শুরু করল। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, তর্কবিদ্যা ও শিক্ষার প্রসার, রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন ধারা, রাজতন্ত্রের অবক্ষয়, সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও দাবি পূরণের সংগ্রাম নিয়ে আন্দোলন- লুণ্ঠনকারী ও শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে হতে লাগল। এগুলোই আধুনিক সময়ের কিছু বৈশিষ্ট্য। এসবের আগমনেই মধ্যযুগ ধীরে ধীরে অতিক্রান্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে। এর আগে সাধারণ মানুষকে জানতে দেওয়া হতো না যে সব নরনারীরই অধিকার একই। এই অধিকারের ধারণা সৃষ্টি হওয়াটা বিশ্বে নতুন ধারার প্রবর্তন করল একসময়। আমার ধারণায় আধুনিক যুগের অন্যতম লক্ষণ ছিল এটাই।
নতুন যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নতুন রাজ্য ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি হতে শুরু করল। অবশ্য মধ্যযুগ বিশ্বে যে শোষণ ব্যবস্থা তা সঙ্গে সঙ্গে শেষ হলো না। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক জগতে অতিক্রান্ত হয়ে শোষণের চরিত্র ও আকার একটু বদলাল বটে, শোষণ কিন্তু ঠিকই রয়ে গেল। আইন বানিয়ে রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচারগুলোতে ন্যায্যতার ছাপ দিয়ে সেসব সাধারণের কাছে সহনীয় করে তোলাও একটা কাজ হলো।
কিন্তু মানুষের সাধারণ জ্ঞানে বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থব্যবস্থা, রাজনীতির চর্চার ফসল এসে গেল, হলো তাদের দাবি-দাওয়া ও চাওয়ার পরিবর্তন। তার ওপর উনিশ শতকে সমাজতন্ত্রের বাণী এসে রাজতন্ত্রবিরোধী গণবিদ্রোহ, বিপ্লব, পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাও যোগ হলো- এর সবই আধুনিক সময়ের চিত্র।
আমার মনমানসিকতা কি এসব উপাদানসমৃদ্ধ? আমি কি যুক্তিনির্ভর, মানবিক ও ন্যায় কাজে বিশ্বাসী? আমি কি শোষণ আর বৈষম্যের বিরোধিতা করি? আমার ধ্যান-ধারণা, চিন্তাপ্রবাহ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- এসব কি মধ্যযুগীয় সময় পার করতে পেরেছে? নাকি আমার মধ্যে এখনো বর্বর যুগ থেকে মধ্যযুগের গুণাবলি ভালোভাবেই রয়ে গেছে!
সেই গ্রামের ছেলেটি আধুনিক হয়েছিল পোশাক ছাড়া অন্য পরিবর্তন না এনেই, আমিও কি এই সময়ের পোশাক পরিধান করে আমার মতে নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করছি? তা যদি হয় তাহলে আমি কোনোমতেই আধুনিক নই।
অনেকে আবার আধুনিক বনে যাওয়ার ভাবনা ফেলে দিয়ে এখনই উত্তর-আধুনিক হয়ে উঠেছেন! তাঁরা কোন গ্রামের ছেলেমেয়ে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
সবাই বলতে শুরু করল, এটাই তো আধুনিক যুগ। কী এই আধুনিকতা? উনিশ-বিশ শতকেও ইউরোপের অনেক সুপণ্ডিত, বিদ্বান ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি আধুনিকতার প্রশ্নে সদুত্তর দেওয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তখনো প্রশ্নটির একবাক্যে মীমাংসা হয়নি। সে সময়ে যদি না হয়ে থাকে, তবে সে প্রশ্ন এখন তোলা মোটেই অনাবশ্যক হবে না। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত কি আমরা সবাই আধুনিক?
আমি নিজে কতটা আধুনিক, সেটার বিচার করার প্রচেষ্টা থেকে আমার রচনার শিরোনাম দিয়েছি 'আমার আধুনিকতা'। এই প্রসঙ্গে একজন তরুণের কথা মনে পড়ল। মহাযুদ্ধ দুইয়ের মাঝামাঝি। গ্রামের ছেলেটি চাষাবাদ করে, মাঝেমধ্যে জাল ফেলে মাছ ধরে, নৌকাও আছে। পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি-গামছার বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না। শীতকালে হাতে বোনা চাদর। গ্রামের পাঠশালা শেষ করে কিছুদিন শহরতলির স্কুলেও গিয়েছিল সে, কিন্তু ১২-১৩ বছরের পরে আর এগোয়নি। সেই ছেলেটির একদিন শখ হলো, সে আধুনিক হবে। তাতেও কোনো সমস্যা হয়নি। সে টাকা-পয়সা কিছু সংগ্রহ করে দর্জির কাছে গিয়ে ফুলপ্যান্ট-শার্ট বানালো, কাবুলি জুতা কিনল। ভালো নাপিতের কাছে গিয়ে স্টাইল করে চুল ছাঁটল। তারপর হাতে কিছু কাগজপত্র, নতুন-পুরনো খবরের কাগজ হাতে নিয়ে সে গ্রামে ও কাছের শহরতলিতে চৌকস স্টাইলে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
যারা তাকে চেনে তারা অবাক, তারা ছেলেটির এই বাহ্যিক রূপ পরিবর্তন তাকিয়ে দেখে আর বলে, ছেলেটা আধুনিক হয়ে উঠেছে। ছেলেটাও নিজেকে আধুনিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরে খুবই আনন্দিত।
আমি অবশ্য এর বেশি জানি না- তার চাষবাসের কী হলো, মাছ ধরা, নৌকা চালানোর কী হলো- কিছুর খবরই আমার নেই। হয়তোবা সে আমেরিকান ড্যান্ডি হয়ে গিয়েছিল।
আমি এখন ফুলপ্যান্ট-শার্ট পরি, মাঝে মধ্যে সুটেড-বুটেড হয়ে সমাজের ভালো ভালো জায়গায় বিচরণ করি- টেলিভিশনে দর্শকের গ্যালারিতে, মাঝেমধ্যে বক্তা হিসেবেও আমাকে দেখা যায়। আমি নিশ্চিত যে আমাকে কেউ 'অনাধুনিক' বলবে না। আমি অবশ্যই শিক্ষাদীক্ষা-কর্মে, আচার-আচরণে একজন আধুনিক ব্যক্তি।
আধুনিক হওয়ার পেছনে কী কী উপাদান আছে, তার সবই আমার আছে হয়তো, কিন্তু সেই উপাদানগুলো কী? আমি কি সেসব জানি? সেই গ্রামের চাষবাস করা ছেলেটির পোশাক-পরিচ্ছদে শৌখিন হয়ে গিয়ে আধুনিক হওয়া এবং আমার আধুনিক হওয়া- এই দুইয়ে কিছু পার্থক্য আছে বৈকি! সেই ছেলেটির মতো আমি নিজের ইচ্ছায় এই আধুনিকতার খোলস ধারণ করিনি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দেশে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে- আমি সেই পরিবর্তনের স্রোতে ভেসে আধুনিক হয়ে উঠেছি। সেটাই আমার কাছে ও আমার পারিপাশ্বর্িকতার কাছে সত্য ও আমাকে আধুনিক বলার কারণ।
আমি নিশ্চিত যে এমন একসময় আসবে, যখন আমি নিজে উত্তর-আধুনিক বা আধুনিকতা-উত্তর, উত্তর-উত্তর আধুনিক হয়ে উঠব। সবাই না হলেও অনেকে সমর্থন দেবেন। অথচ এই বিশেষণগুলো জুড়ে দেওয়ার কারণ, কী আধুনিক, কী উত্তর-আধুনিক কোনোটারই সত্যিকার কারণ না জেনেই, আমি তো বটেই, আমরা অনেকে উল্লসিত হয়েছি।
ঐতিহাসিকভাবে ঠিক কোন সময়ে আধুনিক সময়ের শুরু হয়েছিল সেটা নির্ণয় করা আরো একটা কঠিন কাজ। এই সময়টা কোন এলাকার, কোন অঞ্চলের, কোন ঘটনাপ্রেক্ষিত উদ্ভূত- সেসব জানতে হবে। অথবা বিপরীতে ধারণা করে নিতে হবে যে সারা বিশ্বেই একটা সুনির্দিষ্ট ক্ষণে 'আধুনিক সময়' শুরু হয়েছিল। সেটা যে সম্ভবপর ঘটনা হতে পারে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, অঞ্চল বিভেদে একেক পরিস্থিতি বিরাজ করে। অর্থনৈতিক, যান্ত্রিক, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাগত, মনমানসিকতাগত অবস্থা সর্বত্র এক রকম হয় না। প্রাচীনকাল থেকে এক গোত্র অন্য গোত্রকে বা এক দেশ অন্য দেশকে দাবিয়ে রাখার একটা ইতিহাস চলছিল বহুদিন ধরে। সেসবের আরো অন্যান্য কারণের জের ধরে পৃথিবীর দেশগুলো ও মানব-মানবী অসম পরিণতিতে পৌঁছে গিয়েছিল- সেখান থেকে নিস্তার পাওয়ার পন্থা-কৌশল আবিষ্কৃত হলেও খুব কমই অসম বিশ্বব্যবস্থা দূর করা গেছে।
মধ্যযুগের ইউরোপে এবং বিশ্বের অন্যত্র অধিকাংশ দেশে রাজরাজড়া, বনেদি, অভিজাত সম্প্রদায় সমাজের উচ্চ স্তরে থেকে দেশ পরিচালনা করত। সাধারণ মানুষকে অবদমিত, অবনত ও দমিত রাখার জন্য ধর্মের ব্যবহার ছিল- যাজক সম্প্রদায় রাজরাজড়ার বন্দনা করে প্রজাদের মঙ্গল কামনা করত; কিন্তু তারা সাধারণ মানুষের জীবনে সুখ বা স্বাচ্ছন্দ্য (সম্পদ, ঐশ্বর্য, বিলাস- এসব সাধারণ মানুষের জন্য অনেক দূরের বস্তু) কোনোটাই আনতে প্রয়াস পেত না।
একসময় সেই ধারাটি বদলে যেতে শুরু করল। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, রাজনীতি, তর্কবিদ্যা ও শিক্ষার প্রসার, রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন ধারা, রাজতন্ত্রের অবক্ষয়, সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ও দাবি পূরণের সংগ্রাম নিয়ে আন্দোলন- লুণ্ঠনকারী ও শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া স্বাভাবিক বলে মনে হতে লাগল। এগুলোই আধুনিক সময়ের কিছু বৈশিষ্ট্য। এসবের আগমনেই মধ্যযুগ ধীরে ধীরে অতিক্রান্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে। এর আগে সাধারণ মানুষকে জানতে দেওয়া হতো না যে সব নরনারীরই অধিকার একই। এই অধিকারের ধারণা সৃষ্টি হওয়াটা বিশ্বে নতুন ধারার প্রবর্তন করল একসময়। আমার ধারণায় আধুনিক যুগের অন্যতম লক্ষণ ছিল এটাই।
নতুন যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে নতুন রাজ্য ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো সৃষ্টি হতে শুরু করল। অবশ্য মধ্যযুগ বিশ্বে যে শোষণ ব্যবস্থা তা সঙ্গে সঙ্গে শেষ হলো না। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক জগতে অতিক্রান্ত হয়ে শোষণের চরিত্র ও আকার একটু বদলাল বটে, শোষণ কিন্তু ঠিকই রয়ে গেল। আইন বানিয়ে রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচারগুলোতে ন্যায্যতার ছাপ দিয়ে সেসব সাধারণের কাছে সহনীয় করে তোলাও একটা কাজ হলো।
কিন্তু মানুষের সাধারণ জ্ঞানে বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থব্যবস্থা, রাজনীতির চর্চার ফসল এসে গেল, হলো তাদের দাবি-দাওয়া ও চাওয়ার পরিবর্তন। তার ওপর উনিশ শতকে সমাজতন্ত্রের বাণী এসে রাজতন্ত্রবিরোধী গণবিদ্রোহ, বিপ্লব, পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাও যোগ হলো- এর সবই আধুনিক সময়ের চিত্র।
আমার মনমানসিকতা কি এসব উপাদানসমৃদ্ধ? আমি কি যুক্তিনির্ভর, মানবিক ও ন্যায় কাজে বিশ্বাসী? আমি কি শোষণ আর বৈষম্যের বিরোধিতা করি? আমার ধ্যান-ধারণা, চিন্তাপ্রবাহ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য- এসব কি মধ্যযুগীয় সময় পার করতে পেরেছে? নাকি আমার মধ্যে এখনো বর্বর যুগ থেকে মধ্যযুগের গুণাবলি ভালোভাবেই রয়ে গেছে!
সেই গ্রামের ছেলেটি আধুনিক হয়েছিল পোশাক ছাড়া অন্য পরিবর্তন না এনেই, আমিও কি এই সময়ের পোশাক পরিধান করে আমার মতে নিজেকে আধুনিক বলে দাবি করছি? তা যদি হয় তাহলে আমি কোনোমতেই আধুনিক নই।
অনেকে আবার আধুনিক বনে যাওয়ার ভাবনা ফেলে দিয়ে এখনই উত্তর-আধুনিক হয়ে উঠেছেন! তাঁরা কোন গ্রামের ছেলেমেয়ে?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও গবেষক
No comments