সংস্কৃতি-ভারতীয় সিনেমা আমদানি ও প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ by মোহাম্মদ এ আরাফাত

সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে উন্মুক্তভাবে প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সরকারিভাবে। যদিও বিদেশি সিনেমা হিসেবে শুধু ভারতীয় সিনেমা নয়, অন্য দেশের সিনেমাও উন্মুক্ত হতো, তবুও আমাদের ভয়টা বেশি ছিল ভারতীয় হিন্দি সিনেমা নিয়ে।


প্রধানমন্ত্রীকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্তকে বাতিল করেছেন সে জন্য। আমরা ভারতীয় তথা হিন্দি/বলিউড-সংস্কৃতির আগ্রাসনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে। এ প্রসঙ্গে আমি একটি কাল্পনিক গল্প বলতে চাই।
ভারতে আমার কিছু বন্ধুবান্ধব আছে। মাঝেমধ্যে তারা আমাকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানায়। আমিও তাদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছি। ধরলাম, তাদের একজন বাংলাদেশে আসার জন্য সড়কপথে রওনা দিল। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে হেঁটে বর্ডার ক্রস করল। বাসের টিকিট কেটে বাসের জন্য অপেক্ষা। চা হাতে নিয়ে আমার ভারতীয় বন্ধুটি হঠাৎ লক্ষ করল, দোকানের ছাদ থেকে একটি সরু সুতায় এক টুকরো কাগজ ঝুলছে। কাগজটিতে একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন। মডেলটি তার চেনা এক ভারতীয় মডেল। হঠাৎ হোঁচট খেল। তবে কি সে বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি? একটু ধীরস্থিরভাবে চিন্তা করে দেখল, সে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অপেক্ষা করছে বাসের জন্য, ঢাকায় আসবে। সে আহ্লাদিত হলো, এখানেও ভারতীয় মডেল!
একটু পড়ে সে যখন বাসে উঠল, আরও বড় চমক অপেক্ষা করছে তার জন্য। এ কী? বাসে হিন্দি সিনেমা ছাড়া হলো। আমার বন্ধুটি বড়ই আনন্দ পেল। অন্য দেশে এসেও নিজের সংস্কৃতির মধ্যেই আছে সে। পরিশেষে আমার বন্ধুটির বাসটি যখন ঢাকায় ঢুকল, তার মনে হলো সে বোধ হয় ভারতেরই কোনো একটি শহরে ঢুকেছে। রাস্তার দুই ধারে ভারতীয় মডেল আর নায়িকাখচিত বিশাল বিলবোর্ডগুলো যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। এসব কিছুর পর সে যখন আমার বাসায় পৌঁছাল, টেলিভিশনের চ্যানেল ঘুরিয়ে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর আধিপত্য দেখে মোটেও আর বিস্মিত হলো না। সে মনে মনে ভাবতে থাকল, সংস্কৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ বোধহয় ভারতেরই একটি অঙ্গরাজ্য।
এবার আমি তাকে নিয়ে গেলাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে আমি অধ্যাপনা করি, সেখানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সংগীত ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করছে। এক-দুটি বাংলা গান গাওয়ার পরই শুরু হলো হিন্দি গানের মহাযজ্ঞ। আমার বন্ধুটি ভাবতেই পারছিল না, এ দেশের ছাত্রছাত্রীরা এতটাই বলিউড-সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত।
পরদিন আমি বন্ধুটিকে নিয়ে গেলাম আমার এক আত্মীয়র গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে। আমার বন্ধুটিও আমাকে দিল্লিতে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিল, ওর দেশের সংস্কৃতি এবং আচার-অনুষ্ঠান দেখানোর জন্য। আমিও তাকে নিয়ে গেলাম আমার দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে। আমি ছোট মুখ করে দেখলাম সেই গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানেও হিন্দি/বলিউড-সংস্কৃতির প্রতিফলন। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, আমার বাংলাদেশ কোথায় এখানে? লজ্জায়, অপমানে, আত্মপরিচয়হীনতার বিষাদে এক অদ্ভুত ব্যথা অনুভব করলাম। এই বাংলাদেশ, যা এত আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালিত্বকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করেছে, তা আজ আত্মহননের প্রক্রিয়ায়।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা বলি, টিভি সাউথ এশিয়া নামের একটি আঞ্চলিক চ্যানেল আছে। একদিন টিভিতে চ্যানেল পরিবর্তন করতে করতে ঠেকলাম সেই চ্যানেলে। একটি গানের অনুরোধের আসর হচ্ছিল, সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে দর্শকেরা ফোন করে গানের জন্য অনুরোধ করছিল। কাকতালীয়ভাবে পরপর চারটা ফোন এল বাংলাদেশ থেকে। চারজন দর্শকই চমৎকার হিন্দিতে হিন্দি গানের জন্য অনুরোধ জানাল। অনুষ্ঠানের হোস্ট বলছে, ফোন কল ফ্রম বাংলাদেশ—সঙ্গে সঙ্গে উচ্চকিত স্বরে হিন্দি ভাষায় গানের জন্য অনুরোধ এল। এ কী? বাংলাদেশের মানুষ কবে থেকে হিন্দিতে কথা বলে? সহসাই ব্যথা অনুভব করলাম, লজ্জায়-অপমানে খেয়াল করলাম, এ ব্যথা শুধু মানসিক নয়, শারীরিকও।
আমি নিজেকে কখনো একজন রক্ষণশীল, প্রতিক্রিয়াশীল মনে করি না। বিশ্ব সংস্কৃতি, সংগীত-সাহিত্য এগুলোকে আমি উদারনৈতিকভাবেই দেখতে চাই। ব্যক্তিগতভাবে যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো ভাষা বা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারে, তা সংগীতের মাধ্যমে হোক বা সিনেমা, নাটক কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমেই হোক। ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিন্দি, স্প্যানিশ বা অন্যান্য ভাষার সংগীত, এমনকি উর্দু সংগীত শোনার বিষয়টিও খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু বাঙালির বিশাল ঐশ্বর্য সম্ভার থাকার পরও যখন একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সংগঠন করতে হিন্দি সংস্কৃতি থেকে ধার করতে হয়, তখন তা আমাদের সংস্কৃতির দৈন্যকেই প্রকাশ করে। বিশেষ করে এই ধার করার বিষয়টি যখন সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যাপকভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে, তখন তা আমাদের আত্মমর্যাদা বোধের প্রশ্নে গভীর সংকট তৈরি করে।
বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি বড়ই প্রয়োজন। আমি ভারতের এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময়ের পক্ষে। একই সঙ্গে একপাক্ষিক, অসম-নৈতিক ব্যবস্থা যা আমাদের নিজস্ব স্বকিয়তা ও আত্মপরিচয় রক্ষার্থে ক্ষতিকারক, আমি তার বিপক্ষে।
১৯৯১-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ একপাক্ষিকভাবে তার সব দরজা খুলে দিয়েছিল। ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার্থে দরজা-বন্ধ নীতি মেনে চলেছে। আমাদের উন্মুক্ত, অসম এবং একপাক্ষিক উদারনৈতিক অবস্থা আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতি সাধন করেছে, অনেক শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্যদিকে সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা এক মহা আগ্রাসনের শিকার হয়েছি।
আমি মনে করি ভারতীয় সিনেমা তো বটেই বরং ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোও ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ করার নীতি গ্রহণ করা উচিত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেল যাতে ভারতে প্রবেশ করতে পারে, তার প্রচেষ্টা চালানো উচিত। আমাদের আরও অন্যান্য পথ খুঁজে বের করা দরকার, যাতে আমরা আমাদের বাঙালির কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে সগৌরবে দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিতে পারি। আমি আমার দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে প্রচণ্ড গর্ব অনুভব করি। একই সঙ্গে বিশ্বমানব হওয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। পরিশেষে বলতে চাই, প্রগতিশীলতা এবং আত্মমর্যাদা বোধ পরস্পরবিরোধী নয়, দুটোই হাত ধরাধরি করে চলতে পারে।
মোহাম্মদ এ আরাফাত: শিক্ষক, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.